চিঠি দিও ১.

চিঠি দিও
১.
কলেজ গেটে পা দেয়া মাত্র ভূমিকম্পের মতো গমগম শব্দ কানে এলো উপমার। পৃথিবী যেন তার ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। ঝড়ের বেগে ছুটতে ছুটতে চিকন মতো একটা ছেলে তার দিকে ধেয়ে আসছে। ওকে ধাওয়া করছে আরও দুজন। তাদের হাতে ঈষৎ রূপোলী ভীষণ ধারালো বড় বড় দু খানা রামদা।
ছুটে আসা ছেলেটা উপমার কাছাকাছি আসতে আসতেই চিল চিৎকার করে আচমকা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সাথেসাথে উপমা টের পেলো ঈষদুষ্ণ কিছু তরল মুখে এসে পড়েছে তার। কাঁপা কাঁপা হাতখানি মুখে ছুঁইয়ে তরলটা স্পর্শ করে চোখের সামনে মেলে ধরতেই ভয়ে সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল উপমার। এ তো রক্ত! চিৎকার করতে চাইলেও মুখ দিয়ে একটা টু শব্দ বেরোলো না। কেবল চিঁ চিঁ একটা শব্দ করে দু পা পিছিয়ে গেল সে।
— এই মাগী চুপ। একটা টু শব্দ করছিস তো কল্লা ছিঁড়ি ফেলাব।
রামদা হাতে দু’জনের একজন তারস্বরে ধমকে উঠল উপমাকে। ধমক খেয়ে ভয় পাওয়ার কথা থাকলেও আচমকা রাগে চোখ জ্বলে উঠল উপমার। জীবদ্দশায় এত নোংরা শব্দযোগে গালিগালাজ কেউ করেনি তাকে। কানে যেন গরম সীসা ঢেলে দিয়েছে অনুভূত হলো। আশেপাশে ইতোমধ্যে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করে যাচ্ছে তারা। সকলের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু নিজেকে কল্পনা করেই রাগের উদ্ভব উপমার মধ্যে। কিন্তু সে বুদ্ধিমতি মেয়ে। ষোলআনা প্রটেস্ট জানলেও দিন-দাহাড়ে ভরা লোকসমাগমে লাশ ফেলে দেয়া অমন দানবীয় ছেলেদের সাথে পাঙ্গা নেয়ার দুঃসাহস এই মুহুর্তে দেখাতে পারে না। দুঃসাহসিকতার পরিচয় দেয়ার সঠিক সময় এটা নয়। যেখানে দানব দুটো এখনও রক্তমাখা অস্ত্র হাতে স্ব-দর্পে তার সামনে দাঁড়ানো। তবে উপমা জানে, ওর পরিচয় যদি এক্ষুনি বাইরে আসে, দানব দুটো পেছনে হাত দিয়ে বাপ বাপ করে পালিয়েও কূল পাবে না। তার আপন মামা এই কলেজের ক্যামিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর। এরচেয়ে বড় আরেকটা পরিচয়, বর্তমান সময়ের ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের বোন হয় সে। অতনু হাওলাদারকে চেনে না এরকম মানুষ এই শহরে খুঁজে পাওয়া দুস্কর। এক ডাকে সবাই ওকে চেনে। সদাসর্বদা উপমা জেনে এসেছে সকলের কাছে অতনু হাওলাদার এক ত্রাসের নাম। সেজো ভাই অতনুর এই ক্ষমতার বড়াই একসময় ভীষণ অপছন্দের হলেও সুক্ষ্মজ্ঞানে উপমা উপলব্ধি করেছে কিছু জায়গায় ক্ষমতার বড়াই বড্ড প্রয়োজন।
“জোর যার মুল্লুক তার” কথাটা যেহেতু নিরেট সত্যি তাই ক্ষমতার জোর একটুখানি দেখালেই বড় বড় বিপদের হাত থেকে চোখের পলকে বেরুনো যায় বলেই মনে করে উপমা। কিন্তু এই মুহুর্তে ক্ষমতার ব্যবহার শোভনীয় মনে হচ্ছে না তার। রাজনীতি-রাজনীতি করে তার স্কুল জীবন পুরোটা মাটি হয়ে গিয়েছিল। সে চায় না স্কুলের মতো কলেজ জীবনটাও মাটি হোক। আই.এ দিয়ে আবার অনার্স-মাস্টার্সও এই কলেজ থেকেই করতে হবে। রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না।
স্কুল জীবনের কথা মনে পড়লে এখনও কান্না পায় উপমার। বাব্বাহ অতনু হাওলাদারের বোন আমাদের সাথে পড়ে! শুনতেই সহপাঠীরা কেমন হুজুর হুজুর করতো। উপমা খেয়াল করেছে হুজুর হুজুর করলেও ভাইয়ের বাজে ইমেজটার কারণে কিছু সহপাঠী ওকে ভীষণ ঘৃণার নজরে দেখে এসেছে সবসময়। নিত্যদিন উঠতে বসতে কোনো কারণ ছাড়াই এমন জোড়া-জোড়া ঘৃণার দৃষ্টি হজম করতে ঠিক কতখানি কষ্ট হয়েছে কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না উপমা।
সাত বছরের স্কুল জীবনে একটা বিশ্বস্ত বন্ধু ও বানাতে পারেনি সে। এটা কোনো কথা! কতবার কত উপায়ে চেষ্টা করেছে। কিন্তু কেন যেন কেউ মন খুলে কখনো মেশেইনি ওর সাথে। তাই কলেজে পা দেয়ার আগে ও নিজেও প্রতিজ্ঞা করেছে এবং বাড়ির সবাইকে জানিয়ে রেখেছে অতনু হাওলাদারের মতো ক্ষমতাসীন ব্যক্তি ওর আপন মামাত ভাই এ খবর যেন কলেজে কেউ না জানে। কেউ না মানে কেউ না। কাকপক্ষীতেও না।
— কিরে কথা বলিস না ক্যান? বল এই মুহুর্তে চোখে দেখা ঘটনা ভুলে যাবি। কাকপক্ষীও যদি টের পায় রফিক্কারে আমরা কোবাইছি তাইলে সেই মুহুর্ত থেকে নিজের শেষ সময় গননা শুরু করে দিবি। বুঝছিস?
আচমকা ধমকে ভাবনা সকল টুপ করে সাঙ্গ হলো উপমার। স্তম্ভিত হয়ে সে দেখলো সামনে দাঁড়ানো কালোমতো ছেলেটা ওর গলার কাছে মুষ্টিবদ্ধ রামদাটা চেপে ধরেছে। আঁড়চোখে আশেপাশে তাকানোর চেষ্টা করল উপমা। এতক্ষণ যারা জড়ো হয়েছিল তাদের অধিকাংশ ভয়ে ল্যাজ গুটিয়ে পালাতে আরম্ভ করেছে। তাকে সাহায্য করার মতো বুকের পাটা কারোর নেই শুরুতেই বুঝতে পেরেছিল উপমা। এই দেশটা এমনই। চোখের সামনে জলজ্যান্ত মানুষকে লাশ হতে দেখবে, টু শব্দটাও করবে না। ঠিকাছে। সময় বড় খেলোয়াড়। এখন তবে উপমাকেও ভীতুদের পথ অনুসরণ করেই হাঁটতে হবে;নিজের নিরাপত্তার খাতিরে। তাই এই মুহুর্তে কোনোরূপ বিরোধ না করে এদের কথায় তাল মেলানোই সমীচীন মনে করল উপমা। যেমনটা এরা বলছে সুবোধের মতো মেনে নিতে হবে। কাঁধে ঝোলানো পাটের ব্যাগটা শক্ত করে চেপে ধরল উপমা। এরপর চট করে কাঁদো-কাঁদো মুখ বানিয়ে ফেলল নিজের। সেকেন্ডের মধ্যে বড়-বড় দু ফোঁটা অশ্রুও ঝরল দু-চোখ বেয়ে। হাত জোর করে ভয় ভয় গলায় বলে উঠল,
— আপনারা যেমন বলেন অমনই হবে ভাই। আমি কাউকে কিচ্ছু বলব না। বিশ্বাস করেন। এইসবের সাথে আমার কোনো লেনাদেনা নেই। একদমই নেই। আমাকে ছেড়ে দেন ভাই। পারলে এই পথ দিয়ে আর কলেজেই আসব না আমি। এখনও যে যাব ভুল করেও পিছু ঘুরে তাকাব না। তবুও আমাকে ছেড়ে দেন।

বলতে বলতে এমনভাবে ওর গলা বুঁজে এলো এবং অনর্গল চোখ থেকে পানি পড়তে লাগল নাটককে আর নাটক বলে মনে হলো না। অনায়াসে ছেলে দু’টোকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হলো সে ভয় পেয়েছে এবং ওদের কথামতো মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে নেবে। দিন-দাহাড়ের এই খুনের সাথে তার কোনো সংযোগ নেই।
মেয়েটাকে শতভাগ ভয় দেখাতে সক্ষম হয়েছে উপলব্ধি করামাত্রই গৌরবের হাসি ফুটে উঠতে দেখা গেল ছেলেদুটির মুখে। হাসির আভাস ধরে রেখে দু’জন দু’জনার দিকে তাকাল একবার। এরপর উপমার কাঁধ থেকে অস্ত্র নামাতে যাবে ঠিক সেই সময় পাঁচ ছয়জনের একটা দল আচমকা এসে ঘিরে দাঁড়ালো ওদের কেন্দ্র করে। পেছন থেকে হোন্ডার শব্দ কানে এলেও কোনো নড়চড় করল না উপমা। এবার তার বুক কেঁপে উঠতে শুরু করল। শেষ মুহুর্তে বেঁচেও বাঁচতে পারবে না নাকি! কে এলো আবার? ভালই তো ছেড়ে দিচ্ছিল ওকে ছেলেগুলো।
ভাবনার অবকাশ তেমন পেলো না উপমা। তার আগেই অনুভূত হলো এতক্ষণ বীর দর্পে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে দু’টোর বীরত্ব আচমকা ঘুচে গেছে। চোরাই দৃষ্টিতে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে থরথর কাঁপছে তারা। এবং ওদের অকস্মাৎ কম্পনের ফলে উপমার গলায় ধরা রামদাটাও সবেগে নড়াচড়া করছে। স্বভাবসুলভ ভ্রুতে কুঞ্চন লাগলেও উপমার ভয় লাগছে কখন না ওটা লেগে যায় গলায়! তীব্র আশংকা থেকেই ভীতু চোখে একবার ঘাড় ফেরাল সে। তখনই বাঁধল বিপত্তি। রামদার ধারালো অংশ চট করে ছুঁয়ে গেল তার গলার একাংশ। সাথেসাথে ব্যথায় মৃদু স্বরে “উফফ” করে উঠল উপমা। বন্ধ হয়ে গেল তার দুচোখ। ক্ষতের যন্ত্রণা নাকি ভয়ের আভাসে, এবার সত্যি সত্যি কান্না পেয়ে গেল। কি এক ঝামেলা কাঁধে এসে পড়ল তার! ঠোঁট চেপে তৎক্ষনাৎ নিঃশব্দে কেঁদে উঠল উপমা। কান্নার কারণে খেয়াল হলো না অস্ত্রের সামনে থেকে বহু আগেই নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিয়েছে কেউ তাকে। এবং মিনিটখানেক আগে অবধি যারা লোকসমাগমে তরতাজা এক প্রাণকে লাশ বানিয়ে দিলো তারাই এখন নিজ প্রাণ হাতে নিয়ে কোথায় ছুট লাগিয়েছে।

দ্বিতীয়বার সম্বিত ফিরল গলায় খসখসে একটা আঙুলের স্পর্শে। ঝট করে চোখ মেলে নতুন মুখ দেখতেই বিস্মিত হলো উপমা।
ওপাশের মানুষটাও ভ্রু কুঁচকে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। উপমাকে চোখ মেলতে দেখে গমগমে গলায় সে বলে উঠল,
— ক্ষত বেশি গভীর না। অল্প করে ছুঁয়ে গেছে। রক্তও বেরোয়নি তেমন। তবুও স্যাভলন দিয়ে ওয়াশ করে নিলে ভালো হয়। হসপিটালে যেতে হবে।
— কোনো প্রয়োজন নেই।
চোখ মুছে দু পা পিছিয়ে গেল উপমা। ওপাশের ব্যক্তি শীতল দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। পকেটে হাত পুরে কণ্ঠের গাম্ভীর্য বাড়িয়ে দিলো শতগুণ।
— কোন ডিপার্টমেন্ট?
উপমার মনে হলো জবাব না দিয়ে পিছু মুড়ে চলে যায়। আঁড়চোখে চারিদিক তাকালও একবার। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত কোনো মানুষের দেখা নেই। এত নিস্তব্ধ চারিদিক! অথচ একটু আগেও মানুষে মানুষে গমগম করছিল আশপাশটা।
— কোন ডিপার্টমেন্ট?
পুনরায় প্রশ্ন ভেসে এলো আগন্তুকের থেকে। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে উপমা জবাব দিলো,
— ডিপার্টমেন্ট না আমি ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ার।
— কিহ্! বাচ্চা মেয়ে।
তড়িৎ ভ্রু জোড়ায় কুঞ্চন লাগল তার। সেসবের ধার দিয়েও গেল না উপমা। তরল গলায় বলল,
— দেখুন এসবের সাথে কোনোভাবেই আমার সম্পৃক্ততা নেই। প্রথম দিন আজ কলেজের। সাইড গেট দিয়ে আসার কথাও ছিল না আমার। কিন্তু মেইন গেটে মিছিল হচ্ছে দেখে বাধ্য হয়ে সাইড গেট দিয়ে ঢুকছিলাম। কল্পনাও করিনি অপ্রত্যাশিতভাবে এমন কিছুর সম্মুখীন হয়ে যাব।
— এসব আমাকে বলে কি লাভ?
বিরক্তি ঝরে পড়ল আগন্তুকের গলায়। সামনের মানুষটার হাবভাবে মেজাজটা আবারও খারাপের দিকে যেতে চাইল উপমার।তথাপি নিজেকে সামলে নিয়ে সে দৃঢ় স্বরে বলল,
— প্লিজ আমি খুব সাধারণ ঘরের মেয়ে। অনেক সংগ্রাম করে পড়াশোনা করছি। পুলিশি ব্যাপারে নাম জড়ালে অনর্থ হয়ে যাবে।
— আশ্চর্য তুমি আমাকে এসব বলছো কেন? আমি কি করতে পারি এখানে!
— আপনাকে বলছি মানে। ওই রফিক বলে লোকটা তো..

পিছু ফিরে আঙুলের ইশারা করতে চাইল উপমা। কিন্তু কি আশ্চর্য! ওখানে তো কোনো লাশই নেই। এমনকি কালচে রক্তে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে থাকা মাটিও কি অদ্ভুতভাবে শুকানো। সব একদম স্বাভাবিক।
বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে পুনরায় আগন্তুকের দিকে চাইল উপমা। জলপাই রঙা হোন্ডায় হেলান দিয়ে বসে ছিল সে এতক্ষণ। এবার সোজা হয়ে দাঁড়াল। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে উপমার চোখে চোখ রেখে বলল,
— এখানে কিচ্ছু হয়নি। কেউ কিচ্ছু দেখেনি;কোনোকিছুর সাক্ষী নয়। ভুলে যাও সব। এই মুহুর্ত থেকে ভুলে যাও। জাস্ট ফরগেট ইট।
— কিন্তু..
— বললাম না ভুলে যাও। কলেজে তো এসেছ। আস্তে আস্তে সব দেখতে পারবে, জানতে পারবে। তবে হ্যাঁ দূর থেকে দেখো কিন্তু। নিজেকে জড়াতে যেও না এসবের সাথে। আজ ভাগ্য করে ছাড়া পেলে, দ্বিতীয়বার নাও পেতে পারো। এসব এখানে ডালভাত।

উপমাকে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই বলে উঠল সে। উপমার বিস্ময় এখনও কাটেনি। কিছু বুঝতেও পারছে না সে। কেবল বিভ্রান্ত হয়ে বোঝার চেষ্টা করছে ভ্রমের মধ্যে সে আছে নাকি সব বাস্তব!
— রক্তটা মুছে নাও। দ্রুত শুশ্রুষা দরকার নইলে দাগ বসে যেতে পারে। আর হ্যাঁ সবার থেকে লুকতে চাইলে গলায় কয়েকদিন ওড়না জড়িয়ে রাখবে।
পকেট থেকে নীল সাদা চেক চেক রুমাল বের করে উপমার হাতে ধরিয়ে দিলো আগন্তুক। রুমাল নেয়ার সময় উপমা দেখলো আগন্তুকের বাঁ হাতে সুন্দর ভাঁজ করা আরও একটা রুমাল বাঁধা।কবজির কাছটায় রুমালের ওপর লাল সুতোয় নকশা করে লেখা “রওনক” আরও কিছু বোধহয় লেখা কিন্তু ভাঁজ পড়ায় দেখা যাচ্ছে না পুরো লেখাটা৷
— তোমাকে পৌঁছে দিতে পারতাম কিন্তু ইমেজ খারাপ হওয়ার ভয় আছে। তোমারও-আমারও।
— আমি একাই যেতে পারব।
কড়া গলায় বলে রুমাল নিলো উপমা। দু ভাঁজ করে সে রুমাল ক্ষতে চেপে ধরে আরেকবার আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে প্রস্থানের নিমিত্তে পা বাড়াল। আজকের এই ঘটনা তার জন্য নতুন। সম্পূর্ণ নতুন। কতটুকু ভুলতে পারবে জানা নেই তবে সতর্ক থাকতে হবে এখন থেকে। কখন কি হয়ে যায়!
কিছুটা পথ হাঁটার পর উপমা টের পেলো খুব কাছে থেকে ধিমিধিমি আওয়াজে হোন্ডার শব্দ ভেসে আসছে। পিছু ঘুরল না সে। তখনও এই হোন্ডাটারই আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল। আগন্তুক তার পেছন পেছন আসছে। আসুক, পাহারা দিক। উপমা জানে না কেন লোকটাকে প্রথম দেখায় খারাপ লাগল না তার। লাগার কথা কি ছিল?
সাইন্স বিল্ডিংয়ে পা দেয়ার পর হোন্ডার শব্দ প্রায় নেই হয়ে গেল। তাকাবে না তাকাবে না করেও পিছু ফিরে উপমা দেখল সে চলে যাচ্ছে। গমন পথে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে চপল পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল সে নতুন ক্লাস রুমের দিকে।
____________________________

জয় বাংলা হোটেলের পাশ ঘেঁষে সরু গলি অনুসরণ করে ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে রওনকের জলপাই রঙা হোন্ডা। এই গলিটার শেষ মাথায় মাঝারি আকৃতির টিনের চালা দেয়া একটা ঘর আছে। যার বহির্মুখী দেয়ালে ফ্যাকাশে নীল সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয়া। যেখানে লেখা “প্রশিকা” মানবিক সহযোগিতা সংস্থা, লালবাগ শাখা, রংপুর। প্রথম ঝলকে এটাকে সমিতি আকারের কিছু মনে হলেও আদতে এটা সমিতি নয়। বরং ছাত্রনেতাদের আড্ডাখানা; ক্লাবঘর। দিনের বেলা প্রশিকার সাইনবোর্ড টানানো থাকলেও সূর্য ডোবার সাথে সাথে সাইনবোর্ড খুলে ক্লাবঘর হিসেবেই ব্যবহার করা হয় একে। বলার অপেক্ষা রাখে না ছাত্র নেতাদের একজনের মধ্যে রওনকও আছে। রওনকের পুরো নাম রইসুল ইসলাম রওনক। সে এই কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। একসময় রাজনীতির প্রতি প্রবল আগ্রহ থেকে এ পথে আসা। বোঝার বয়স থেকে গনতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্রে উত্তাল দেশটাকে পেয়েছে সে। উদ্যমী রাজনৈতিক কর্মীদের হরদম যাতায়াত দেখেছে আঙিনায়। ছাত্রসংগঠনের অনেক মিটিং তাদের বসার ঘরে হয়েছে। বড় ভাই তার কট্টর বামপন্থী ছিল। মিটিং, মিছিল, পার্টির গল্প সকাল বিকেল শুনেছে সে। একটু একটু করে দেখতে দেখতে ভাইয়ের বিপ্লবী চিন্তাচেতনা কবে তার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে জানে না রওনক। এ পথে আসার হাতেখড়ি ভাই হলেও সে এখন সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। গোটাতে পারেনি কেবল রওনক নিজেকে। কখনো পারবেও না হয়তো। রোজ সকালে বেরুবার মুহুর্তে বড় ভাই রওনকের চোখে অবাক নয়নে তাকিয়ে বলে, “তোকে দেখে আমার এত ভয় লাগে কেন রুনু? বাঁধনছাড়া হবি না তো?”
রওনকের হাসি পায়। বাঁধনছাড়া হবার বয়স তার পেরিয়ে গেছে। এই পথে এলে সবাই যে বাঁধনছাড়া হয়ে যায় এমন কোনো কথা নেই। জীবনের প্রত্যেকটা পদক্ষেপে ব্যালেন্স করতে জানতে হয়। বাঁধনছাড়া হওয়ার হলে ম্যাট্রিকের পরপরই হয়ে যেত।

ক্লাবঘরের সামনে এসে গাড়ি সাইড করে রাখে রওনক। শব্দ শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে মিজান। রওনকের সবচেয়ে কাছের এবং বিশ্বস্ত বন্ধু। রওনককে দেখেই সে হৈ হৈ করে ওঠে।
— দোস্ত এইটা কোনো কাম করলা? এত দেরি করলা আসতে। আজকাও আমাকেই দূষিত করতে হইলো হাত দুইটা। ধুর্।
— আমি তো প্রতিদিনই করি। একদিন না-হয় তোমরা করলা।
মুচকি হেসে শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে এগোয় রওনক। আঙুলের ফাঁকে ধরে রাখা সিগারেটটা রওনকের দিকে বাড়িয়ে নীচু গলায় মিজান বলে,
— একদম ভ্যানিশ করি দিছি দুইটাকে। কিন্তু সমস্যা হইলো খবর তো দুই দলেই চলি গেছে। আনিস ভাইয়ের বিশ্বস্ত লোক ছিল রফিক। ভাই দেশের বাড়ি আসিয়া যে কি তাণ্ডব শুরু করবে ভয় লাগতেছে আমার।
— ভয়ের কিছু নাই। যখন যা পরিস্থিতি হয় মোকাবিলা করা লাগবে। এইতো।

— তুমি বলো তো এত দেরি করলা কেন? বোঝো না আমার একার পক্ষে চাপ হয়া যায়।

মিজানের প্রশ্নের বিপরীতে নিশ্চুপ হয়ে গেল রওনক। সিগারেটে একবার টান দিয়ে ঠোঁট প্রসারিত করে সিগারেটটা মিজানের হাতে ধরিয়ে ভেতরে চলে গেল। এ হাসির অর্থ বোধগম্য হলো না মিজানের। তখন স্পটে একটা মেয়েকেও দেখতে পেয়েছিল সে। মেয়েটাকে কি সহি সালামতে পৌঁছে দিতে পেরেছে রওনক? ওকে পৌঁছে দিতেই কি দেরি হলো!
___
প্রথম দিন বিধায় দুটো ক্লাস করে কলেজ ছুটি দিয়ে দেয়া হলো। তেমন মিশুক না হলেও ক্লাসে দু’টো বান্ধবী বানিয়ে ফেলেছে উপমা। ডালিয়া আর মিতালী। ডালিয়ার বাড়ি কলেজের পাশে হলেও গল্প করতে গিয়ে দেখা গেল মিতালী আর উপমা পাশাপাশি পাড়ায় থাকে। এ তো সোনায় সোহাগা৷ ডালিয়ার থেকে বিদায় নিয়ে দুই বান্ধবী খুশিমনে রিকশা চেপে বাড়ির পথ ধরল। পরিচয় পর্বে পারিবারিক অনেক বিষয় এলেও বুদ্ধিমত্তার সাথে অনেক কথা আড়াল করে গেল উপমা। বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হোক তখন সে নিজের আসল পরিচয় জানাবে বলে ঠিক করল।
ভাগ্যিস মিতালীর বাড়ি তার আগে পড়ে। একটু ঘুরতে হবে জেনেও মিতালীকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে তারপরেই সে নিজের বাড়ির পথ ধরল। সময় যদিও একটু বেশি লাগল। কিন্তু এতে কোনো সমস্যা নেই।

বাড়ি ফিরতেই উপমা দেখল বাড়ির সামনে বিরাট এক জটলা। এ তো নিত্যদিনের পরিচিত চিত্র। রিকশা থেকে নেমে প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে ওড়নায় নাকমুখ ঢেকে সে বাড়ির পেছন দিকে পা বাড়াল। ওখানে একটা পকেট গেট করা হয়েছে। অপরিচিত মানুষের অবাধ যাতায়াত এ বাড়িতে। তাদের নজর এড়াতে মামার এই সিদ্ধান্ত। সরু গলিতে ঢুকে বা হাতে বাঁধা ছোট্ট ডায়ালের কালো চামড়ার ঘড়িটাতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো উপমা। ১ টা বেজে সতেরো। ভরদুপুর একেবারে। আজ গরমও পড়েছে বেশ৷ সেজো ভাই ছাড়া বাড়িতে কেউ নেই নিশ্চয়ই! বাড়ি গিয়েই মেজো মামির তিরিক্ষি মেজাজের মুখোমুখি হতে হবে ভাবতেই মুখ তেঁতো হয়ে উঠল উপমার। উপমার কলেজ যাওয়া নিয়ে তীব্র অসন্তোষ মামির। তার কথা হচ্ছে মেয়ে ম্যাট্রিক পাশ করেছে মানে বিয়ের বয়স হয়েছে। কোথায় পাত্র দেখবে তা না! ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ করে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে । তাও আবার যেখানে ছেলে-মেয়ে একসাথে পড়ে সেখানে। ছিঃহ্! সকালে এ নিয়ে কতগুলি কটু কথা শুনিয়ে দিলো মামি উপমাকে। এখন আবারও নিশ্চয়ই কটু কথাগুলো শুনতে হবে। আজ তো কেউ বাঁচানোরও নেই। ভাবতেই রাজ্যের হতাশা আঁকড়ে ধরল উপমাকে। সেই হতাশাকে আপন করে নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল সে।
গেট বন্ধ করে ওড়না খুলতে না খুলতেই চটপটে মেয়েলি গলার স্বর ভেসে আসতে শোনা গেল খানিক দূর থেকে।
“ঘটনা তো আজকে ঘটি গেছে আনন্দি আপা। ভ”য়ানক ঘটনা, সর্বনাশা ঘটনা।”
বলে রাখা ভালো উপমার ডাকনাম হচ্ছে আনন্দি। এ বাড়িতে তাকে সবাই আনন্দি বলেই ডাকে। পারলে আনন্দি নামটাকে অনেকে শর্টে আন্নি করেও ডাকে। ডাকাডাকির প্রসঙ্গ এখন বাদ থাকুক। এখন বরং জানা যাক নতুন করে আবার কি ভয়ানক ঘটনা ঘটল।
ভ্রু কুঁচকেই কন্ঠের মালিক জান্নাতিকে উপমা জিজ্ঞেস করল,
— কি সর্বনাশ হয়েছে দয়া করে বলবেন জান্নাতি আপা?
— আরে সেজো ভাইজান, সে তো আজকে মেয়ে তুলি আনছে।
— মানেহ্!
আঁতকে উঠল উপমা।
— আরে হ আপা। সকাল থেকি দেখি ভাইজান ক্লাবঘরে না গিয়া আইজ বাড়িত। আমার তখনে সন্দেহ হইছিল কিরে, ভাইজানের কাজকাম নাই নাকি? যায় না কেনবা বাইরত!
উনি তারপর হুকুম দিয়া দিয়া ভাত খাইলেন, রং চা খাইলেন। পত্রিকা পড়লেন।
বারোটার দিক চাইরজন ব্যাটা মানুষ আসলো জোয়ান তাগড়া। ফিসফিস করি কি কইলো থিত পাইলাম না। তারপর দেখি ভাইজান নাই।
এই ফিরছে কয় মিনিট হইলো। এক্কেরে কইতিছি বেনারসি পিন্দা মেয়ে নিয়া। ঘরে ঢুকি কয় কি জানেন? জান্নাতি বেগম ভাবি নিয়া আসছি সবাইকে খবর দেও৷
আমি আপা আমার বাপের তিন নাম্বার বিয়াতেও এত তাজ্জুব হইনাই যতরটা মনে করেন ভাইয়ের এক নাম্বার বিয়াত হইছি।
— বাড়ির অবস্থা এখন কি জান্নাতি?
ফ্যাসফ্যাসে গলায় জানতে চাইল উপমা। ভয়ে তার পুরো শরীর জমে যাচ্ছে। সেজো ভাই করেছে কি এটা! না জানে বাড়ির ওপর দিয়ে কি টর্নেডো যাবে আজ।
— মেজো মামি তো দাঁতকপাটি লাগি পড়ি আছে। ভাইজান লোক সামলাইতেছে। আর নয়া বউ পুতুলের মতো ঘরে বসি।
এরপর আর কিছু শোনার ইচ্ছে হলো না উপমার। শুকনো ঢোক গিলে পা টিপে টিপে সে ভেতরের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। ওপর তলায় সিঁড়ির পাশেই ঘরটা সেজো ভাইয়ের। তেঁতো মুখে সিঁড়ি দিয়ে উঠে বড় করে দম নিলো সে। এরপর সময়ক্ষেপণ না করে দরজায় মৃদু টোকা দিয়ে ঢুকে গেল ঘরের ভেতর। নতুন বউ একা মাথা নীচু করে বিছানায় বসা। উপমাকে দেখে সে আঁচল কাঁধে টেনে উঠে দাঁড়াল।
এদিকে ঘরে ঢুকে নতুন বউকে দেখে চট করে মনটা ভালো হয়ে গেল উপমার। সেজো ভাই তো আস্ত একটা পুতুল ধরে এনেছে। মামি একে দেখেছে ভালো মতো? উপমার মনে হচ্ছে দেখেনি। এমন ফর্সা, টুক টুকে পুতুল পুতুল মুখখানা দেখে কারোর দাঁতকপাটি কীভাবে লেগে যেতে পারে? আশ্চর্য!
— তুমি আনন্দি?
মিষ্টি রিনরিনে গলায় প্রশ্ন করে উঠল নতুন বউ। মৃদু হেসে মাথা নাড়ল উপমা। আরেহ্ এই মেয়ের তো কন্ঠও সুন্দর। তৎক্ষণাৎ আনন্দে দুবার পাক খেতে মন চাইল উপমার। উফফ! এতদিনে কাজের কাজ করেছে সেজো ভাই। পুতুল বউ নিয়ে এসেছে বাড়িতে। শুধুমাত্র এর জন্য সেজো ভাইয়ের সব অপরাধ মাফ। একদম মাফ।

চলবে,
Sinin Tasnim Sara

[এটি নিছকই একটি গল্প। কল্পনাপ্রসূত সৃষ্টি করা। এর সাথে কোনো দল, সংগঠনের কোনো মিল নেই। ধন্যবাদ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here