#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ৬|
-গাড়ি থামাও।’
নীড় বজ্রকন্ঠ গলায় ড্রাইভারের উদেশ্যে কথাটা বলে গাড়ির দরজায় হাত রাখল। তার কথা শুনেও ড্রাইভার গাড়ি থামাচ্ছে না দেখে চিৎকার করে উঠল সে,
-ইডিয়ট তোমাকে গাড়ি থামাতে বলেছি।’
ড্রাইভার যান্ত্রিক গলায় বলল,
-বড় স্যারের অর্ডার আছে স্যার। স্যার বলেছেন নতুন ভাবীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় কোথাও যেন গাড়ি না থামাই। আপনাদের নিয়ে সোজা বাসায় গিয়ে তবেই যেন গাড়ি থামে।’
-তোমার স্যারের আমাকে নিয়ে যখন এতই চিন্তা! তখন স্যারকেও এই গাড়িতে নিয়ে আসলে না কেন?”
-কী বলেন স্যার! ছেলের নতুন বউয়ের সাথে শ্বশুর কি কখনও এক গাড়িতে আসতে পারে? স্যার সামনে অন্য গাড়িতে চলে গেছেন। আমরা পেছনে আছি।’
গাধাটার ভাষণ কে শুনতে চাইছে এখন? বকবক করে মাথা ব্যথা তুলে দিল।
-তুমি কি গাড়িটা থামাবে?’
-আমি পারব না স্যার। বড় স্যারের কড়া নিষেধ।’
নীড়ের গা জ্বলে গেল। মাথায় আগুন জ্বলছে তার। একে তো বিয়েটা তার মতের বিরুদ্ধে হয়েছে। এখন আবার ড্রাইভারও কথা শুনছে না!
সামান্য একটা ড্রাইভারের এত বড় সাহস! তার মুখে মুখে কথা বলছে! অবশ্য সাহস ওকে নাহিদ চৌধুরীই দিয়েছেন। নইলে ওর মুখে মুখে কথা বলা এই ব্যাটার পক্ষে সম্ভব হত না। নীড় হাসল। ওর বাপের চামচাটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই চলন্ত গাড়ির দরজা খুলে ফেলল। ড্রাইভারের চোখ কপালে উঠে গেছে। ভয়ও পেয়েছে সে। ভয়মিশ্রিত গলায় সে বলল,
-স্যার! কী করছেন স্যার?’
-স্যার! কী করছেন স্যার?’ ব্যঙ্গ করে বলল নীড়, ‘গাধা! তুমি গাড়ি না থামালে আমাকে তো আত্মহত্যা করতেই হবে। হাসপাতালে নেওয়ার আগ পর্যন্ত যদি বেঁচে থাকি, তাহলে আমার লাস্ট স্টেটমেন্টে তোমার আর তোমার বড় স্যারের নাম বলে যাব। আমার আত্মহত্যার পেছনে এই দুইজন লোক দায়ী।’
-অ্যাঁ! এমন করবেন না স্যার।’
-জেলে যদি যেতে না চাও তাহলে এক্ষুনি গাড়ি থামাও।’
-আপনি নেমে গেলে বড় স্যারকে আমি কী জবাব দেব,স্যার? বড় স্যার আমাকে চাকরি থেকে বের করে দিবেন।’
-সেটা তোমার আর তোমার বড় স্যারের মামলা। গাড়ি থামাবে কি-না বলো? আমি কিন্তু ঝাপ দিলাম।’
-না,না স্যার ঝাপ দিবেন না। আমি গাড়ি থামাচ্ছি।’
ভীষণ মজা পেয়েছে নীড়। মনে মনে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে সে। নাহিদ চৌধুরী বা তার ড্রাইভার একজনকে তো অন্তত শায়েস্তা করতে পেরেছে। ব্যাটা চামচা, এবার কাঁদতে কাঁদতে তোর বাপের সামনে গিয়ে দাঁড়া। বাপের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গাধাটা। যা আমাকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে দেখা। আজ আর আমি ওই দোজখে ফিরছি না।
ড্রাইভার লোকটা ভাবছে, স্যারের আদেশ অমান্য করা তার কাছে পাপ। কিন্তু স্যারের আদেশ পালন করতে গিয়ে স্যারের ছেলেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া কি ঠিক হবে? গাড়ি থেকে ঝাপ দিয়ে ছোট স্যারের কিছু হলে তখন তো বড় স্যার তাকেই দোষবে। চাকরি থেকে তো বের করবেই, ছেলের কিছু হলে জেলেও দিতে পারে। না বাবা, রিস্ক নেওয়া চলবে না। তার থেকে ভাল ছোট স্যারকে সে এখানেই নামিয়ে দিক বরং।
সশব্দে গাড়ির দরজা লাগিয়ে সামনের জানালার কাছে এসে ঝুঁকে দাঁড়াল নীল। আঙুল দিয়ে জানলার কাঁচে ঠুকঠুক শব্দ করল।
-ড্রাইভার সাহেব, সাবধানে যাবেন। নতুন ভাবীকে সহিসালামত ওর শ্বশুর মশাইয়ের হাতে তুলে দেবেন। বুঝতে পেরেছেন?’
লোকটা থমথমে গলায় মিনমিনিয়ে বলল,
-জি স্যার।’
নীড় লক্ষ্য করল লোকটার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে। ব্যাটা ভীতু। বাড়ি ফেরার আগেই প্যান্ট না ভিজিয়ে ফেলে। নাহিদ চৌধুরী লোকটাকে সবাই বাঘের মত ভয় পায় কেন? এর পেছনে কারণটা কী?
সদ্য বিবাহিতা বউকে গাড়িতে রেখে নীড় মাঝ রাস্তায় নেমে গেল। যাবার আগে পাশের সিটে ঘোমটা দিয়ে বধূ বেশে বসে থাকা মেয়েটার দিকে একবার তাকালো না পর্যন্ত। আজ তার বিয়ের দিন ছিল। শাশুড়ি, শ্বশুরবাড়ির লোকদের থেকে বিদায় নিয়ে বউ নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা একটা মেয়েকে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়েছে সে। মেয়েটা আজ থেকে তার বউ বলে পরিচয় পেয়েছে। অথচ সে এখনও মেয়েটার মুখও দেখেনি! মুখ কেন দেখবে সে? বিয়েটা কি সে নিজের ইচ্ছেতে করেছে? এই বিয়েতে তো সে রাজি ছিল না। নাহিদ চৌধুরীর চক্রান্তে এবার তাকে রাজি হতে হয়েছে। মত না থাকলেও বাধ্য হয়ে কুবল বলে ঘাড়ে একটা আপদ জুটাতে হয়েছে। না জানি আজকের পর থেকে এই আপদ আরও কত বিপদ ডেকে আনবে তার জন্য।
বিয়েটা কি শুধু দু’টা পরিবারের সমঝোতায় এসে অচেনা অজানা দু’টা ছেলে মেয়েকে জোরজবরদস্তি করে এক সুতোয় বেঁধে দেওয়া! যাদের জীবন নিয়ে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, তাদের মতামতের কি কোন দাম নেই? বিয়ের পর পরিবার দুইটা তো একসাথে থাকবে না। থাকবে ওই মানুষ দু’জন। বিবাহিত জীবনে সুখে থাকার জন্য তাদের মনের মিল হওয়া একান্তই প্রয়োজন। নাহিদ চৌধুরী এসব কিছুই ভাবলেন না। এই বিয়েতে মেয়েটা রাজি ছিল কি-না নীড় জানে না। কিন্তু সে তো একদমই রাজি ছিল না। লোকটা অতীব ধুরন্ধর। কোথায় কলকাঠি নাড়লে কাজ হবে তা খুব ভালো ভাবেই জানে। দীর্ঘ সময় একটা নীরব যুদ্ধ চলার পর শেষমেশ নাহিদ চৌধুরীর জেদই জিতে গেল।
———_——
ছেলের বউকে বরণ করে ঘরে তোলার জন্য নাহিদ চৌধুরী নিজে দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। হাতঘড়ি দেখলেন তিনি। গেটের দিকে তাকালেন একবার। উনার মুখে কিঞ্চিৎ চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে। ওদের গাড়ি এখনও আসছে না কেন? এত দেরী হবার তো কথা না। উনার গাড়ির পেছনেই ওদের গাড়ি ছিল। বেশি হলে বড়জোর বিশ মিনিট দেরী হবার কথা। উনি বাড়ি ফিরে উপরে গিয়ে চেঞ্জ করে এসেছেন। পঁচিশ মিনিট ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন। তবুও ওদের গাড়ির কোন খবর নেই৷ অপদার্থটা রাস্তায় কোন গণ্ডগোল পাকায়নি তো! বলা যায় না, হয়তো মাঝপথে এসে গাড়ি থেকে নেমে গেছে। কিন্তু উনি তো ড্রাইভারকে আগে থেকেই বলে রেখেছেন। উনার অর্ডার, বাড়ি ফেরার আগে রাস্তায় যেন কোথাও গাড়ি না থামে।
দেখতে দেখতে মেইন গেট দিয়ে ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িটা এসে ঢুকল। স্বস্তির শ্বাস নিলেন তিনি। যাক, দেরি করে হলেও এসেছে ওরা।
উনি মুখটা হাসি হাসি রাখতে চেষ্টা করলেন। ছেলের বউ যেন প্রথম দেখাতেই এটা ধারণা করে না নেয় যে, আমার শ্বশুরটা একটা বুইড়া খাটাশ। হাসে টাসে না।
ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে পেছনের দরজা খুলে না দিয়ে কাচুমাচু মুখ করে উনার দিকে লম্বা পা ফেলে হেঁটে আসছে দেখেই যা বোঝার উনি বুঝে নিলেন। মুখের হাসি হাসি ভাবটা মিলিয়ে গেল সাথে সাথে। অপদার্থটা তাহলে সত্যিই কোন গণ্ডগোল পাকিয়েছে!
-নীড় কি মাঝ রাস্তায় গাড়ি থেকে নেমে গেছে?’
লোকটা এবার কেঁদে ফেলবে যেন। বড় স্যারের আদেশ অমান্য করে গাড়ি থামিয়েছে সে। অপরাধবোধে সে মরে যাচ্ছে।
-স্যার, আমি গাড়ি থামাতে চাইনি স্যার। নীড় স্যার আমাকে হুমকি দিলেন যে, উনি চলন্ত গাড়ি থেকে ঝাপ দেবেন। উনার কিছু হলে মারা যাবার আগে নাকি আমার আর আপনার নাম পুলিশের কাছে বলে যাবেন। উনার মৃত্যুর পেছনে নাকি আমরাই দায়ী। আমি অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম স্যার। উনি গাড়ির দরজা খুলে সত্যিই ঝাপ দিতে নিচ্ছিলেন।’
নাহিদ চৌধুরী রাগলেন না। কারণ তিনি মনে মনে নিশ্চিত ছিলেন উনার গুনধর ছেলে, উনার নাক কাটাতে আজ তো কিছু একটা নিশ্চয় করবে। বিয়ে বাড়িতে এতগুলো লোকের সামনে যে কিছু করেনি সেটা কপাল। শান্ত গলায় তিনি বললেন,
-বৌমা কি গাড়িতে? ‘
–জি স্যার।’
আর কিছু না বলে উনি গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। গাড়ির দরজা খুলে নাহিদ চৌধুরী ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেলেন। উনার গলার স্বর এক স্তর চড়ে গেল।
-বৌমার কী হয়েছে! সিটে হেলে পড়েছে কেন? নীড় ওকে কিছু করেছে?”
-না স্যার। নীড় স্যার ভাবীকে কিছুই করেননি।’
উনার হতভম্ব ভাব কাটছে না। নতুন বউয়ের কিছু হলো না তো!
-তাহলে ও এভাবে সিটে শুয়ে আছে কেন?’
-ভাবী মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে স্যার।’
চোখ পাকিয়ে নাহিদ চৌধুরী তাকানোর সাথে সাথে ড্রাইভার আগের কথার সাথে যোগ করল,
-নয়তো জ্ঞান হারিয়েছে। আজ ভীষণ গরম ছিল। ভারী লেহেঙ্গা পরনে…
-গরম! গরম লাগবে কেন? গাড়িতে এসি ছিল না?’
-ছিল স্যার। কিন্তু নীড় স্যার এসি চালাতে দেননি। উনার নাকি শীত লাগে।’
নাহিদ চৌধুরী দাঁত কিড়িমিড়ি করে কতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন। নীড়ের মাথায় এতটা শয়তানি বুদ্ধি কাজ করে! মেয়েটাকে জব্দ করার জন্যই এই প্রচণ্ড গরমের মাঝেও এসি চালাতে দেয়নি!
উনি সাধারণত বাড়ির কাজের লোকের উপর রাগারাগি করেন না। কিন্তু আজ রাগ সামলাতে না পেরে হুংকার ছাড়লেন।
-কেউ এক গ্লাস পানি নিয়ে আসবে?’
নাহিদ চৌধুরী ছেলের বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেছে। এই মেয়েই তার সংসারে খুশি ফিরিয়ে আনবে।
বরযাত্রী যাওয়ার এক ঘন্টা আগেও নীড়কে পাওয়া যাচ্ছিল না। নাহিদ চৌধুরীর চারপাশ অন্ধকার ছিল। কপাল গুণে ম্যানেজার বুদ্ধি করে মিডিয়াকে ওই খবরটা জানালো। নাহিদ চৌধুরীর বাড়ির দীর্ঘদিন পুরানো কাজের লোক মতিন মিয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। উনার অবস্থা ভালো না। টিভিতে এটা প্রচার হওয়ার বিশ মিনিটের মধ্যে নীড় ফিরে আসে। মতিনও ভালোই অ্যাক্টিং করেছে। এখনও নিচের ঘরে শুয়ে আছে। নাহিদ চৌধুরী এতেই সন্তুষ্ট, যেভাবেই হোক বিয়েটা হয়ে গেছে। তার বৌমার মান বেঁচেছে।
চলবে_
গ্রুপ —- মায়ামহল (নিপা’র গল্প)