চুপকথারা বিষন্ন পর্ব-৭

0
3663

#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ৭|

রুমে এনে চোখেমুখে কয়েক ফোঁটা পানির ছিটা দিলে কথার জ্ঞান ফিরল। চোখ পিটপিট করে সে সামনে দাঁড়ানো লোকগুলোকে দেখল। এতগুলো মানুষ চোখ বড় বড় করে তার দিকে চেয়ে আছে। মানুষগুলো তার অচেনা। এদের কাউকেই আগে কখনও দেখেনি সে। কথা এই মুহূর্তে কোথায় আছে বুঝতে না পেরে আশেপাশে দেখল। নাহিদ চৌধুরী হয়তো কথার এই মুহূর্তের অবস্থা বুঝতে পারছে। তিনি বললেন,

-তুমি ঠিক আছো তো মা? এখন তোমার কেমন লাগছে?’

সাথে সাথে কথার মনে পড়ল আজ তার বিয়ে হয়েছে। বরের সাথে সে গাড়িতে করে শ্বশুরবাড়ি আসছিল। বাবার বাড়ি ছেড়ে চলে আসছে বলে কথার একটুও কান্না পায়নি। দজ্জাল সৎ মায়ের কবল থেকে বের হতে পারছে এটাই তার খুশির কারণ ছিল। বাড়ি থেকে হাসিখুশিই সবার থেকে বিদায় নিয়েছে সে৷ কিন্তু মাঝপথে এসে ভাই দুইটার কথা মনে পড়ে গেল। সৎভাই হলেও শিমুল, পলাশ যে কথাকে আপন বোনের থেকেও বেশি ভালোবাসত। শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে ওকে কে আপু বলে ডাকবে ভেবেই কান্না পেল। ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল সে। তার কান্নার শব্দ শুনে পাশে বসা তার স্বামী লোকটা ধমকে উঠেছিল।

-কী নাটক! এতক্ষণ কান্না পায়নি। এখন সবাইকে ছেড়ে চলে এসে কান্না পাচ্ছে! আজব। এই মেয়ে এই, একদম কানের কাছে ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদবে না। আজাইরা ন্যাকামি সহ্য হয়না।’

ধমক খেয়ে কথা মুখ টিপে কাঁদছিল। ফোঁপাতে ফোপাঁতে তার দম আটকে আসছিল। বরটা তাকে সান্ত্বনা দিবে তো দূরের কথা, ঠিক তখনই এসি অফ করে দিতে বলল। এসি অফ করার পর গরমে তার জান বেরিয়ে যাচ্ছিল। এর একটু পর থেকেই কথার আর কিছু মনে নেই। চোখ খুলে সে নিজেকে এখানে, এতগুলো লোকের সামনে আবিষ্কার করল।
নাহিদ চৌধুরীর গলা আবার কানে যেতে কথা হুড়মুড় করে উঠে বসে মাথার ওড়না টেনে ঠিক করতে লাগল। বিয়ে পড়ানোর সময় সে দেখেছে, এই মানুষটা তার সব দিকের খেয়াল রাখছে। কিছু একটা বলতে হয়। কথা তাড়াহুড়ো করে বলে উঠল,

-আসসালামু আলাইকুম শ্বশুর আব্বা।’

-ওয়ালাইকুমুস সালাম।’ মাথা দুলিয়ে সালাম নিতে নিতে উনি থতমত ভাবটা সামলে নিলেন।

-আমি কি গাড়িতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম? আমাকে এখানে কে এনেছে? আমি না একটুও বুঝতে পারিনি। কীভাবে যে অজ্ঞান হয়ে গেলাম!’

কথার গলায় হতাশা স্পষ্ট। নতুন বউকে কেউ কোলে করে ঘরে নিয়ে এসেছে! বিষয়টা কেমন দৃষ্টিকটু লাগে না? শ্বশুরবাড়িতে পা দিতে না দিতে, প্রথম দিনেই একটা ভুল করে ফেলল সে। বিয়ের দু’দিন আগেও মা বলেছে,

-‘তুই শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে দুই দিনও টিকতে পারবি না। ওরা তোকে এক গলি দিয়ে নিয়ে যাবে,আরেক গলি দিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে। শ্বশুরবাড়ির ভাত তোর কপালে নসিব হবে না। যা অলক্ষ্মী মেয়ে তুই! আমার কথা মিলিয়ে নিস। তখন আমার বাড়িতে ফিরে এলে ঠ্যাং ভেঙে দেব তোর।’

মায়ের কথাগুলো এখানো কানে বাজছে কথার। মা ঠিকই বলেছিল। কথার মুখে চিন্তার রেখা নাহিদ চৌধুরীর চোখ এড়ালো না।

-মা তোমাকে টেনশন করতে হবে না। জ্ঞান হারানো কোন অপরাধের মধ্যে পড়ে না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। আর আমাকে বাবা বলে ডাকো,কেমন? ‘

-হুম।’

হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল কথা। চুপিচুপি একবার মানুষটার মুখের দিকে তাকাল। উঁহু, একটুও রাগী মনে হচ্ছে না। বরং নিতান্তই একজন সহজসরল ভালো মানুষ মনে হচ্ছে। ওকে মা বলে ডাকছে। তার ভাগ্যে তাহলে রাগী শ্বশুর জুটেনি! অনুর শ্বশুরটা নাকি ভীষণ রাগী। অনুর উনাকে পানি দিতে দেরী হওয়ায় নাকি পানির গ্লাসটাই ওর পায়ের উপর ছুঁড়ে মেরেছিল। পাঁচদিন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়েছিল বেচারিকে। সে পাতানো মা’কে জিজ্ঞেস করেছিল,

‘আচ্ছা পাতানো মা, আমার শ্বশুরবাড়ির লোকগুলো কেমন গো? রাগী নাকি ভালো মানুষ? ‘

পাতানো মা তার কথা শুনে হেসেছিল। হাসতে হাসতেই বলেছিল,

‘তোর শ্বশুরবাড়ির লোকগুলো অনেক ভালো মানুষ রে পাগলী। তুই খুঁজেও ওদের মত মানুষ পাবি না। বাইরে থেকে একটু শক্ত সেজে থাকার চেষ্টা করলেও ভেতরটা তুলোর মত নরম। তুই শুধু একবার ওদের মন জয় করতে পারলে, ওরা তোকে চোখের তারায় রাখবে। বুঝলি?’

-কিন্তু মন কীভাবে জয় করতে হয়? একেকজনের মন জয় করার পদ্ধতি কি একেকরকম? নাকি সবার মন জয় করার পদ্ধতি একইরকম? পাতানো মা’কে এই প্রশ্নও করেছিল সে। উত্তরে তিনি বলেছে, সেটা তো ওবাড়িতে গিয়ে তোকেই জেনে নিতে হবে। তবেই তো ওই বাড়ির যোগ্য বউ হয়ে উঠতে পারবি।’

যোগ্য বউ হতে গেলে ওকে কী কী করতে হবে এটা কেউ বলে দিলে ভালো হত না কি? কিন্তু কে বলবে? কেউই তো বলেনি কীভাবে যোগ্য বউ হওয়া যায়।
———–
কথা বউয়ের সাজে বিষন্ন মুখে ঘরে বসেছিল। মানুষের কথা তার কানেও আসছিল। এখনও বর আসছে না। কে জানে কী ঘাপলা আছে।
তাহলে কি সত্যিই বর আসবে না? এক সময় কথার চোখ জ্বালা করতে লাগল। তার মন এমনটাই বলছিল। কিন্তু না তখনই বাইরে হৈচৈ চেঁচামেচি শোনা গেল। বর এসেছে, বর এসেছে। কথা নিজেও লাজলজ্জা ত্যাগ করে জানালার কাছে উঠে গেল। উঁকি দিয়ে সে বরকে দেখার চেষ্টা করেও পারল না। খানিক পরে ওর বান্ধবীরা এসে জানালো,

-কথারে কী একটা জামাই যে পাইছোস না তুই! পুরাই রাজপুত্র। হলিউড, বলিউডের হিরোকেও হার মানাবে।’

-হায়! তোর মত কপাল নিয়ে কেন দুনিয়ায় এলাম না। এই জামাই নিয়ে তুই তো বাড়ি থেকে বেরুতে পারবি না।’

-আমি তো দুলাভাইয়ের স্টাইলের উপর ফিদা! কী হ্যান্ডসাম! কী লুক মাইরি।’

বিয়ে পড়ানো শেষে বর আয়নায় বউয়ের মুখ দেখবে। এই নিয়ম তাদের দিকে পালন করা হয়। চাচী, জেঠি, বান্ধবীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ল। কথা সেই প্রথম আয়নার মানুষটার মুখ দেখছে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েই ছিল সে। পাশ থেকে কেউ ধাক্কা দিলে হুঁশ ফিরেছে তার। বিয়ের দিন সবাই ক্লিন সেভ করে ছিলা মুরগী হয়ে আসে। কিন্তু ইনি তা করেননি। কথা সর্বপ্রথম তার মুখে না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ির প্রেমে পড়েছে। আচ্ছা সে লাজলজ্জা ভুলে মানুষটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে যাচ্ছে অথচ উনি একটা বার কথার দিকে তাকাচ্ছে না। লজ্জা পাচ্ছে নাকি? ছেলেদের আবার লজ্জা কিসের? নিজের বউকে একটু দেখলে কী এমন ক্ষতি হবে শুনি!

নাহিদ চৌধুরীর ডাকে কথার ধ্যান ভাঙে।

-মা তুমি রেস্ট নাও। আমরা এখন যাই। কিছু লাগলে রমিজাকে ডাকবে।’

-হুম।’
————
বাসর রাতটা মাতাল বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে বাড়ির বাইরে কাটিয়েছে নীড়। সকালবেলা চুরের মত চুপিচুপি বাড়ি ঢুকছে সে। মেইন দরজার কাছে এসে তার মনে পড়ল।

-‘নিজের বাড়িতে চুরের মত কেন ঢুকছি আমি! এটা আমার বাড়ি। না ভুল হয়েছে। এটা নাহিদ চৌধুরীর বাড়ি। আমার নিজের বাড়ি না হলেও চুরের মত ঢুকব না আমি। বীর পুরুষের মত বুক ফুলিয়ে ঢুকব। বাসর রাতে বাড়ি না ফিরে কোন অন্যায় করিনি। না, নিজের জীবনে যা খুশি করতে পারব আমি। আমাকে বাধা দেওয়ার অধিকার কারো নেই। স্বয়ং নাহিদ চৌধুরীরও না। এখন আমি এডাল্ট। বাচ্চাটি নেই যে, আমার মর্জি মতন চলাফেরা করার জন্য কারো কাছ থেকে পারমিশন নিতে হবে।’

মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা করছে। সচরাচর মদ খায়না সে। মদ তার পেটে হজম হয়না। সাথে সাথে বমি হয়ে যায়। শুধু বমি না, নাড়িভুড়ি ছিড়ে আসতে চাওয়া বমি। তাই নীড় সজ্ঞানে কখনও মদ খায়না। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে নাহিদ চৌধুরীকে শায়েস্তা করার জন্য মদ দিয়ে কুলি করে, গায়ে মদ ছিটিয়ে বাড়ি ফিরে মাতালের অভিনয় করে। নাহিদ চৌধুরী কোন সময়ই তার অভিনয় ধরতে পারে না। পারবে কী করে? এতদিনে পাক্কা অভিনেতা হয়ে গেছে সে। নাহিদ চৌধুরীর সাধ্য আছে তার অভিনয় ধরার! মতিন চাচাও তেমন। কেউই তাকে বুঝে না।

নিজের ঘরে এসে সবার আগে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল নীড়। ঠান্ডা পানির নিচে দাঁড়িয়ে লম্বা সময় নিয়ে শাওয়ার সারল। তোয়ালে হাতে মাথা মুছতে মুছতে গুনগুন করতে করতে রুমে এসে দাঁড়াল। মাথায় এতক্ষণ ঠান্ডা পানি ঢেলেও নেশাটা পুরোপুরি কাটেনি। হ্যাংওভার কাটানোর জন্য লেবুর রস খেতে হবে।

-‘ওরে বাবা! ও বাবা! এই কুত্তা আমাকে খেয়েই ফেলবে গো!’

চিৎকার করতে করতে দৌড়ে ঘরে ঢুকে সোজা বেডের উপর উঠে চোখ বন্ধ করে দুই হাত হাওয়ায় ছুড়তে ছুড়তে লাফাচ্ছে কথা।

-‘কেউ বাঁচাও। এই কুত্তার হাত থেকে কেউ আমাকে বাঁচাও।’

ঘটনার আকস্মিকতায় নীড় হতভম্ব। কে এই মেয়ে! তার রুমে ছুটে এসে পাগলের মত এসব কী বলছে। নীড় কিছু বলতে যাবে তার আগে দরজায় তার পোষা জার্মান শেফার্ড, তার একমাত্র আদরের কুকুর জ্যাকিকে দেখল সে। জ্যাকি জিহবা মুখের বাইরে বের করে তীক্ষ্ণ চোখে মেয়েটাকে দেখছে। সন্দেহ নেই এই মেয়েটা জ্যাকির দৌড়ান খেয়েছে। হাত বাড়িয়ে জ্যাকিকে ডাকল নীড়।

-‘হেই বাডি, কাম। এদিকে আয়।’

কথার চোখ ছানাবড়া। তার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। আজ এই পাগলা কুত্তা তাকে খেয়েই ফেলত। আর একটুর জন্য কুকুরের পেটে যেতে যেতে বেঁচেছে সে। শ্বশুরবাড়িতে যে পাগলা কুত্তা ছাড়া আছে এটা জানলে কক্ষণো বাড়ি ঘুরে দেখতে চাইত না সে। দরকার নেই দেখার।
কথা আতঙ্কগ্রস্ত চোখে কুকুরটাকে দেখছে। কুকুটার মুখ যেন কালো কুচকুচে। কান দু’টা উপরের দিকে খাঁড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাঢ় বাদামি চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। মুখের বাইরে জিহবা বেরিয়ে লকলক করছে। গলার নিচের লোম গুলো আর সামনের পা দু’টো বাদামি রঙের। পিঠটা তেলতেলে কালো। পেছনের পা দু’টো সামনের পায়ের থেকে একটু বেশিই লম্বা মনে হচ্ছে। লেজটা সুন্দর করে নেমে গিয়ে ফ্লোরে গড়াচ্ছে। কুকুরটাকে ভাল মত লক্ষ্য করে কথার গায়ে কাটা দিয়ে উঠল। এই কুকুর ওকে ছিড়েখুঁড়ে খেয়ে ফেলতে পারত। ভাগ্য ভালো, ভালোই দৌড় জানে সে।

চলবে_
গ্রুপ – মায়ামহল (নিপা’র গল্প)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here