চুপকথারা বিষন্ন পর্ব-৮

0
3846

#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ৮|

কুকুরটাকে নীড়ের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে কথা ভয়মিশ্রিত গলায় তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে উঠল,

‘এই না,না। ও আপনাকে খেয়ে ফেলবে। কামড়ে দিবে। একবার কামড়ে দিলে চৌদ্দটা লাগবে। দূরে থাকুন। দূরে, দূরে। কাছে আসছে ও। হুস, হুস…যা সর। সর শয়তান কুত্তা।’

নীড় ভুরু কুঁচকে মেয়েটার আবোলতাবোল পেঁচাল শুনছে। নীড় এক হাঁটু গেড়ে বসলে জ্যাকি এসে জিভ দিয়ে ওর মুখ চেটে দিল। নীড় মৃদু হেসে জ্যাকির গলার নিচের দিকটায় চুলকে দিয়ে বলল,

‘কিরে খুব দুষ্টুমি হচ্ছে না?’ পরের কথাটা জ্যাকির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘মেয়েটাকে একা পেয়ে বদমায়েশি করছিস! ভয় দেখাচ্ছিস কেন ওকে? তুই তো কাউকে কামড়াস না। মানুষের মাংস খাওয়ার শখ কবে থেকে জাগল তোর?’

কথা হতভম্ব। সে পারলে কুকুরের থেকে এক মাইল দুরত্ব বজায় রাখে। আর এই লোক কিনা কুকুরকে চুমো দিচ্ছে! ইয়াক! গলায় বিস্ময় নিয়ে কথা জিজ্ঞেস করল,

‘আপনার কি ভয়ডর কিচ্ছু নেই?’

নীড় আড়চোখে ওকে দেখল। কোন উত্তর না দিয়ে ওকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে জ্যাকির গায়ের লোমের ভেতর আঙুল চালিয়ে দিল।

‘যা ব্যাটা। ব্রেকফাস্ট কর গিয়ে। আমিও আসছি।’

নীড়ের কথা শেষ হওয়ার আগে জ্যাকি লেজ নাড়িয়ে পেছন ফিরে দরজা বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল। নীড় এবার উঠে দাঁড়াল৷ কথা আবার বলল,

‘আপনার ভয় লাগে না?’

‘ভয় কিসের?’

‘কামড়ে দিত তো।’

‘ও আমাকে কামড়াবে!’ হাসল নীড়, অসম্ভব।’

‘কিন্তু পাগল কুত্তাটা তো আমাকে কামড়াতে যাচ্ছিল।’

নীড় যেন কানে ভুল শুনলো। আপনাতেই কপাল কুঁচকে উঠল ওর।

‘এই মেয়ে কুত্তা কাকে বললে তুমি!’

‘কাকে বললাম মানে? কুত্তাকে কুত্তা বললাম।’

রাগে গলার রগ দাঁড়িয়ে গেছে ওর। জ্যাকিকে মেয়েটা কুত্তা বলছে!

‘কুত্তা! আবার কুত্তা বললে তুমি! তোমার তো সাহস কম না।’

কথা লাফিয়ে বেড থেকে নামল। নীড়ের সামনে এসে দাঁড়াল। নীড় ওর থেকে এতটা লম্বা যে নীড়ের কাঁধ সমান হতে ওকে পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াতে হচ্ছে।

‘কুত্তাকে কুত্তা বলতে সাহস লাগে নাকি? আমি তো সাহস ছাড়াই সারাদিন বলতে পারব। পাগলা কুত্তা। আমাকে কী দৌড়টাই না দৌড়াল! ছোটলোক কুত্তা।’

নীড় গলা ফাটিয়ে ধমক দিয়ে উঠল,

‘শাট আপ! চুপ। আর একটা কথা না। আমার জ্যাকিকে আর একবার কুত্তা বললে তোমাকে মেরে কুত্তা বানিয়ে দেব আমি। তুমি জানো ওর দাম কত?’

কোমরে দুই হাত রেখে কপালে ভাঁজ ফেলে কথা জানতে চাইল,

‘কত?’

‘তোমার থেকেও বেশি। বুঝলে? তোমাকে বেচে দিলেও আমার জ্যাকির একবেলার খাবারের দাম আসবে না।’

‘অহ, এত বড় কথা!’

অপমান বোধ করল কথা। লোকটা কত অহংকারী! এটা নাকি তার স্বামী! বউকে বলছে, তোমাকে বেচে দিলেও আমার কুকুরের একবেলার খাবারের দাম আসবে না। কথা মুখে রাগী ভাব ফুটিয়ে তুলল।

‘কী বললেন আপনি?’

নীড় ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে জবাব দিল।

‘যা শুনেছ তাই। নাকি কানে কম শোনো?’

রাগে তোতলাচ্ছে কথা।

‘আপনি…আপনি একটা যা তা।’

‘শুকরিয়া। এখন বলো তুমি কে? আমার রুমে কী করো?’

কথার রাগ কমে গেল। আকাশ থেকে পড়ার মত করে কথা বলল,

‘আমি কে!’

‘হু।’

‘আপনি আমাকে চিনেন না!’

‘চিনলে নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করতাম না।’

কথার হতভম্ব ভাব কাটছে না। কালই বিয়ে করল আর আজ বউকে ভুলে গেল! একেবারে চিনতেই পারছে না! মুখ মুছে অস্বীকার করছে, তাকে চিনেই না! হায় আল্লাহ! এই স্বামী নিয়ে কী করবে সে। এর তো মাথায় সমস্যা আছে। স্মৃতিশক্তি দুর্বল।

‘নিজের বউকে চিনেন না আপনি? কালই না আমাদের বিয়ে হলো!’

বউ! তীক্ষ্ণ চোখে কপাল কুঁচকে কথাকে দেখছে নীড়। এই মেয়ের সাথে বিয়ে হয়েছে তার! এই মেয়ে তার বউ! সিরিয়াসলি? এই মেয়ের বয়স কত হবে? খুব বেশি হলে ষোলো, সতেরো। আঠারো তো হবেই না। এই বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে কে? মিস্টার নাহিদ চৌধুরী ছেলের গলায় শেষমেশ একটা বাচ্চা মেয়েকে ঝোলাল! বাল্যবিবাহ, আইন ভেঙেছেন নাহিদ চৌধুরী। নিজের দিকে নীড়কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কথা ইতস্তত করতে লাগল।

‘এভাবে কী দেখছেন হ্যাঁ? ‘

‘এই মেয়ে, তোমার বয়স কত হবে? ‘

‘কেন? ‘

‘বাচ্চা একটা মেয়ে। সে নাকি আবার আমার বউ! আমার বয়স কত সে সম্পর্কে কোন আইডিয়া আছে তোমার? ঠিক সময়ে বিয়ে করলে এতদিনে তোমার মত একটা মেয়ে থাকত আমার বুঝলে?’

কথার মাথায় হাত। বয়স কত হবে মানুষটার? পুরুষ মানুষের বয়স আন্দাজ করা যায় না,এই কথা তাহলে ঠিক?

‘আপনি এত বুইড়া! এ বাবা, আমার কপালে একটা বুইড়া জামাই জুটল!’

নীড় নিজের কথায় ফেঁসে গেল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

‘অতটাও বুড়ো না। আর আমাকে দেখে কি তোমার বুড়ো মনে হয়? রোজ জিম করে বডিটাকে ফিট রেখেছি। তুমি এত সহজে আমাকে বুড়ো বানিয়ে দিলে।’

‘আপনিই তো বলেছেন, বিয়ে করলে নাকি আমার বয়সী মেয়ের বাবা হয়ে যেতেন। তাহলে কি আপনি বুড়ো না? আমার তো এখনো আঠারো ছুঁতে পনেরো দিন বাকি।’

নীড় হতভম্ব। বলে কি মেয়ে! সত্যিই তাহলে বাল্যবিবাহ করেছে সে। ইশ! আগে জানলে পুলিশ টুলিশ ডেকে এই ব্যাপারটা নিয়ে নাহিদ চৌধুরীকে একটু জব্দ করা যেত। সমাজের প্রতিষ্ঠিত গুণ্য মান্য নাহিদ চৌধুরীর রাজনীতিতে ভালো নামডাক আছে। দূর কী সুযোগটাই না মিস হলো।

‘তোমার তো এখনো দুধের দাঁত পড়েনি মেয়ে। আক্কেল দাঁত উঠেছে তোমার? কী মনে করে তোমার বাবা তোমাকে বিয়ে দিল!’

হঠাৎ কথার মুখে একরাশ মেঘ এসে ভীড় করল। মন খারাপ হয়ে গেছে ওর। চোখ ছলছল করছে। কথা আস্তে করে বলল,

‘আমার বাবা বেঁচে নেই। দুই বছর আগে উনি মারা গেছেন।’

নীড় নিজের ভুল বুঝতে পারল। এভাবে বলা ঠিক হয়নি ওর। মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে। সে-ও চুপ মেরে গেল। হঠাৎ নিজেকে কেমন যেন অপরাধী লাগছে তার। মেয়েটার মন খারাপ হয়ে যেতে দেখে ভালো লাগছে না।
————-
নাহিদ চৌধুরী খবরের কাগজ থেকে মুখ না তুলে, খবরের কাগজের উপর দিয়ে চোখ তুলে সামনে তাকালেন। উনার ম্যানেজার এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। খবরের কাগজ পড়ছেন বলে উনাকে ডাকছে না।

‘ম্যানেজার, কিছু বলবে?’

ম্যানেজার লোকটা মাঝবয়েসী। লম্বা চওড়া সুদর্শন। বুদ্ধিমান ছেলে, কম কথা বলে। বলতে গেলে দরকার ছাড়া একটা কথাও বলে না। যতটা সম্ভব হ্যাঁ, হু, জি স্যার দিয়ে কথা চালিয়ে নিতে চায়। বড় সাহেবের সব আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। বড় স্যারকে যমের মতো ভয় পায়। স্যারের রাগের সামনা যেন কখনও হতে না হয় সব সময় সেই চেষ্টাই করে।
মাঝে মাঝে নাহিদ চৌধুরীর আফসোস হয়। তার নিজের ছেলেটা কেন এরকম হলো না! কেন নীড় এই ছোকরাটার মত গোছালো স্বভাবের হলো না!
ওর ইতস্তত ভাব দেখে নাহিদ চৌধুরী নিউজপেপার ভাঁজ করে সামনের ছোট টেবিলের উপর রাখলেন। ম্যানেজারের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বললেন,

‘কী বলবে? বলো।’

‘স্যার, নীড় স্যারের রিসিপশন করবেন না?’

হাসলেন তিনি। ছোকরাটা বড় সহজসরল। হাসি হাসি মুখেই তিনি বললেন,

‘রিসিপশন! শহরের সব নামি-দামি লোকের সামনে আমাকে ছোট করার আরেকটা সুযোগ করে দেই অপদার্থটাকে! বিয়ের দিনই টেনশনে আমার বিপি হাই হয়েছিল বুঝলে। সারাক্ষণ মনে হয়েছিল, এই বুঝি গাধাটা গ্যাঁড়ামি শুরু করে দিবে। এই বুঝি বেঁকে বসে বলবে, আমি বিয়ে করব না। দুঃখিত ক্ষমা করো আমাকে। তুমি তো জানোই ম্যানেজার, গাধাটা একবার বেঁকে বসলে ওকে মানানোর সাধ্য কারো নেই। ভালোয় ভালোয় বিয়েটা যে চুকে গেছে এটাই অনেক। রিসিপশন করার রিস্ক আমি নিতে চাইনা। আর তাছাড়া বৌমাও এখনো আঠারোয় পড়েনি। এই খবর মিডিয়ার হাতে পড়লে অযথা উল্টাপাল্টা নিউজ করবে। মিডিয়াদের এক সপ্তাহের খাবার জুটিয়ে দিতে পারলাম না। এজন্য আমারও কষ্ট হচ্ছে বুঝলে। বউমাও হয়তো একটু মন খারাপ করবে। কিন্তু ও ঠিক হয়ে যাবে৷ আরও পাঁচটা মানুষের সামনে কষ্ট পাওয়ার থেকে একা কষ্ট পেলে তাড়াতাড়ি ভুলতে পারবে।’

‘জি স্যার।’

‘গাজীপুরের ওই জমিটার কী হলো?’

‘আমরা কিনে নিয়েছি স্যার। জমির মালিক প্রথমে আপত্তি করলেও দশ হাজার টাকা বেশি পাওয়ার লোভ সামলাতে পারল না। দুই তিন দিনের মধ্যে কাজও শুরু হয়ে যাবে স্যার।’

‘বাহ! ভালো, ভালো। আসলে কী জানো ম্যানেজার, লোভই মানুষের বড় শত্রু। দশ হাজার টাকার লোভ সামলিয়ে ওই জমিটা যদি আরও এক মাস ধরে রাখত, তাহলে আমরাই এক লাখ টাকা বেশি দিয়ে জমিটা নিতাম। জমিটা আমাদের প্রয়োজন।’

‘হুম।’

‘কী আর করার। লোকটার লোভ তাকে ডোবাল। আমাদেরও লাভ হলো।’

‘জি স্যার। আপনি কি ক’দিনের ভিতর ওখানে গিয়ে কাজ দেখে আসবেন স্যার?’

‘না। তোমার উপর সব দায়িত্ব ছেড়ে দিলাম। কাজ শেষ হলে আমি বৌমাকে নিয়ে যাব। দেখি তোমার আইডিয়া আমার বৌমার কতটা ভালো লাগে। আমি ওর চোখে বিস্ময়, খুশি, অবিশ্বাস সব দেখতে চাই। ঠিক এক বছর পর বাগান বাড়িটা আমি বৌমাকে ওর বিবাহবার্ষিকীর গিফট দিতে চাই। এই এক বছরে আমি একবারও ওখানে যাব না।’

‘জি স্যার।’

‘বাবা, বাবা আপনি এখানে? আমি পুরো বাড়ি আপনাকে খুঁজে এসেছি।’

চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে বলল কথা।

‘উহ বাবা! কত বড় বাড়ি, মাথা ঘুরে।’

নাহিদ চৌধুরী ছেলের বউয়ের কথা শুনে হাসলেন।

‘আমাকে কেন খুঁজছিলে মা?’

‘চা। আপনার সকালের চা। রমিজা খালা বলল আপনি নাকি এই সময়ে এক চাপ চা খান। তবেই আপনার সকল শুরু হয়।’

কথা চায়ের ট্রে টেবিলের উপর রেখে কাপটা শ্বশুরের হাতে দিল। নাহিদ চৌধুরী কাপে প্রথম চুমুক দিয়ে তৃপ্তির একটা শব্দ করলেন। উনার বলার অপেক্ষায় না থেকে ম্যানেজার চলে যেতে নিলে কথা উনাকে ডাকল,

‘এইযে ভাই, আপনি চা খাবেন না?’

ম্যানেজার দাঁড়াল। স্যারের দিকে একবার তাকিয়ে দ্বিধাজড়িত গলায় বলল,

‘না ম্যাম। আমি চা খাইনা।’

‘কফি খান? খেলে বসুন, আমি এনে দিচ্ছি।’

কথা এতটা সাবলীল ভঙ্গিতে কথা বলছে যে, দেখে মনেই হবে না এই লোককে সে প্রথম দেখছে। এমনকি এই বাড়িতে তার প্রথম দিন। দ্বিধা, লজ্জা, ভয় নতুন বউয়ের কোন লক্ষণই তার আচরণে নেই। নাহিদ চৌধুরী কাপ হাতে মুচকি মুচকি হাসছেন। তিনি বললেন,

‘বসো ছোকরা বসো। আমার বৌমা এত যত্ন করে তোমাকে কফি খাওয়াতে চাচ্ছে। এক কাপ নাহয় খেয়েই যাও।’

ম্যানেজার লোকটা বসল না। স্যার অফার করছেন, তার জন্য এটা স্যারের আদেশই বলা চলে। দাঁড়িয়ে থেকেই তিনি বললেন,

‘জি আচ্ছা।’

কথা খুশি হয়ে গেল। বলল,

‘দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন না। আমি কফি বানিয়ে আনছি।’

‘না ম্যাম। কফি আনতে হবে না। আপনি আমাকে চা-ই দিন।’

‘চা! কিন্তু আপনি যে একটু আগে বললেন, আপনি চা খান না! ‘

‘এখন খাব ম্যাম।’

‘আচ্ছা।’

চলবে_

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here