চুপকথারা_বিষন্ন পর্ব-১৪

0
3422

#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ১৪|

নীড় চলে গেলে কথা পলাশকে খুঁজতে এলো। পলাশ এখনও নীড়ের কুকুরের সাথে খেলছে। দূর থেকে কথাকে দেখতে পেয়েই জ্যাকি ঘেউঘেউ করতে লাগল। কথা কুকুর এমনিতেই ভয় পায়। তার সাথে আরও জ্যাকির কলিজা কাঁপানো চিৎকার। দূরেই দাঁড়িয়ে গেল কথা। আর আগানোর সাহস পাচ্ছে না। সে এখানে দাঁড়িয়ে জ্যাকিকে শাসন করছে।

-চুপ। চুপ পাঁজি কুত্তা। আমার সাথে তোর এত কিসের শত্রুতা হ্যাঁ? আমাকে দেখলে এমন করিস কেন? মালিকের বউ হিসেবে আমাকে ভালো লাগে না? আমার মত সুন্দরী মালকিন আরেকটা পেতি নাকি তুই।’

জ্যাকি আবারও ঘেউঘেউ করে উঠলে কথা ভয় পেয়ে দু’পা পিছিয়ে গেল। বুকে থুথু দিয়ে বলল,

-বাবা গো! ভয় পাইয়ে দিয়েছিস বজ্জাত কুত্তা।’

পলাশ এসব দেখে শব্দ করে হাসতে লাগল। জ্যাকি তো তাকে কিছুই করছে না। তাহলে আপুকে এরকম করে ভয় দেখাচ্ছে কেন? ও জ্যাকিকে শান্ত করতে চেয়ে বলল,

-দুষ্টুমি করে না জ্যাকি। ও আমার আপু। আমার কথা আপু। ওকে তুমি ভয় দেখাচ্ছ কেন? তুমি তো ভালো কুকুর তাই না!’

পলাশ কথার দিকে ফিরে ওকে অভয় দিয়ে বলল,

-কিছু করবে না আপু। ও অনেক ভালো কুকুর। কাউকে কামড়ায় না।’

-তোকে বলেছে ও ভালো কুকুর! ও একটা বজ্জাত কুকুর। ওর মালিকের মত হাড় বজ্জাত।’

জ্যাকি কথার কথা কী বুঝল সে-ই জানে। সে কথার দিকে চোখ পাকিয়ে জোরে জোরে ঘেউঘেউ করতে লাগল। এতে কথা ভয় পেয়ে চোখমুখ খিঁচে চিৎকার দিল।

-ওরে বাবা রে… ‘

পলাশ বোনের কাণ্ড দেখে হেসে শেষ। জ্যাকিও হয়তো বুঝে গেছে কথা ওকে ভয় পায়। এটা জেনেই যেন সে ইচ্ছে করে কথাকে আরও ভয় দেখায়। কথা এক দৌড়ে জ্যাকির চোখের আড়ালে চলে গেল। ছোট বেলায় পাড়ার এক কুকুর ওকে কামড়ে দিয়েছিল। তারপর থেকেই কুকুরে কথার এত ভয়। কে জানত শ্বশুরবাড়ি এসে দেখবে তার বরের একটা পালতু কুত্তা আছে। তাকে ভয় দেখানোর জন্য বর ওটাকে খাইয়ে পরিয়ে আদর যত্নে করে বড় করেছে।
—————–
কথাকে দৌড়াতে দেখে নাহিদ চৌধুরী দাঁড়িয়ে গেলেন। কী হয়েছে মেয়েটার! এভাবে ছুটছে কেন?

-বৌমা!’

কথা শ্বশুরের কাছে ছুটে এলো। দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল। বুক ভরে শ্বাস নিতে নিতে বলল,

-বাবা আপনার ছেলে যে একটা পাগলা কুত্তা পালে তা কি আপনি জানেন?’

নাহিদ চৌধুরী বিড়বিড় করে আওড়ালেন।

-পাগলা কুত্তা! জ্যাকি!’

মুখে বললেন,

-কেন মা? কী হয়েছে? ও তোমাকে কিছু করেছে?’

চোখ বড় বড় করে হাত নাড়িয়ে কথা শ্বশুরের কাছে নালিশ দিতে লাগল।

-কিছু করেছে মানে! কী করেনি সেটা জিজ্ঞেস করেন। আমাকে দেখলেই কামড়াতে আসে। কয়েকবার দৌড়ানি দিয়েছে। ওর ভয়ে আমি বাড়িতে নিশ্চিন্ত ভাবে কোথাও যেতে পারি না। না জানি কোথায় ঘাপটি মেরে বসে থাকে। আমাকে দেখলেই ঘেউঘেউ। আস্ত বজ্জাত কুত্তা একটা।’

কথার অভিযোগ শুনে নাহিদ চৌধুরী হাসতে লাগলেন। এই মেয়ে বাড়িতে আসার পর থেকে তিনি রোজ রোজ সকাল বিকেল মন খুলে হাসতে পারছেন। এতদিন তার হাসি যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। কথা তা নিজের সাথে খুঁজে নিয়ে এসেছে। বাবাকে হাসতে দেখে কথা কিছুটা ব্যথিত হলো। বাবা তার কথার গুরুত্ব না দিয়ে উল্টো হাসছে। ভ্রু কুঁচকে, ঠোঁট বাকিয়ে কথা বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। নাহিদ চৌধুরী কথার মুখ দেখে হাসি থামিয়ে বললেন,

-জ্যাকিটা বড্ড দুষ্টু হয়ে গেছে মনে হচ্ছে।’

-দুষ্টু না। বজ্জাত হয়েছে, বজ্জাত।’

-নীড়কে আমি বলে দেব জ্যাকিকে যেন শাসন করে।’

-শাসন! জ্যাকিকে? হাহ্! আপনার ছেলে পারলে জ্যাকিকে উসকিয়ে দেয় আমাকে কামড়ানোর জন্য।’

-সেকি! নীড় এমনটা করে নাকি?’

-আপনার ছেলেই তো নাটের গুরু। জ্যাকির গুরুদেব। আমি এটাই বুঝি না কুকুরের মত একটা প্রাণীকে লোকে কেন পালতে যায়! দুনিয়াতে আর কোন প্রাণী নেই। বিড়াল পালতো। কত্ত কিউট প্রাণী। না, তিনি কুকুর পছন্দ করেন। যেটাকে আমি ভয় পাই সেটাকেই তিনি নিজের বউয়ের থেকে বেশি ভালোবাসেন। আপনার ছেলেকে এই কুকুর কে কিনে দিয়েছে? তার সাথে আমার বুঝাপড়া আছে।’

শেষের কথাটা শুনে নাহিদ চৌধুরী খানিকটা বিব্রত হলেন। নীড়কে এই কুকুরটা তিনিই কিনে দিয়েছিলেন। নীড়ের বিশতম জন্মদিনের দিন। তখন অবশ্য তাদের সম্পর্ক অন্যরকমই ছিল। বাবা ছেলের মাঝে ভালোবাসার কোন কমতি ছিল না।
নীড়ের একা জীবনের সঙ্গী হয়েছিল জ্যাকি।

-ওই লোকটাকে পেলে আমি পঁচা পানির পুকুরে ওকে চুবাতাম।’

কথা ঘূনাক্ষরেও ভেবে বলছে না জ্যাকিকে তো তার শ্বশুরও আনতে পারে। ছেলেকে যে বাবাই তার সবথেকে পছন্দের জিনিসটা কিনে দিবে এটা কথার ছোট্ট মাথায় ঢুকছে না। সে না ভেবেচিন্তেই আবোলতাবোল বলে যাচ্ছে।
নাহিদ চৌধুরী মৃদু হেসে গলা পরিষ্কার করে বলল,

-নীড়ের জন্মদিনে আমিই ওকে জ্যাকিকে গিফট করেছিলাম। বাল্যকাল থেকেই নীড় কুকুর পছন্দ করতো।’

কথার ছোট জীবনে যতগুলো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে তাদের মধ্যে আজকের ঘটনা অন্যতম। নিজের শ্বশুরকে পঁচা পানির পুকুরে চুবাতে চেয়েছে কথা। তাও উনারই সামনে আবার এই কথা বলেছে! লজ্জায় কথার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কেন মুখে লাগাম লাগাতে পারে না সে? কেন সবার সামনে সব বলে দেয়! বলার আগে অন্তত একটিবার ভাবা উচিত ছিল না।
কথা ভয়ে ভয়ে সামনে দাঁড়ানো নাহিদ চৌধুরীর মুখের দিকে দেখলেন। বাবা রেগে যায়নি তো!
তোতলাতে তোতলাতে কথা বলার চেষ্টা করছে,

-বাবা, ইয়ে…আমি আপনাকে, আপনাকে কিছু বলিনি আমি। আপনি তো ভীষণ ভালো। আমি পাগল। মাথা খারাপ আমার। কখন কী বলি নিজেও জানি না।’

নাহিদ চৌধুরী চেহারা থেকে গাম্ভীর্যের মুখোশ সরিয়ে ফেলে ছেলের বউয়ের সামনেই হো হো করে হাসতে লাগলেন। কথা অপরাধী মুখে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে মাথা নিচু করে রেখেছে। নাহিদ চৌধুরী মেয়েটাকে দেখে শরীর দুলিয়ে হাসছে।
——————-
রাতে কথা পলাশকে খাইয়ে দিচ্ছিল। দুই ভাইবোন মিলে টুকটাক নানান গল্প করছে। পলাশের মুখ দিয়ে যেন খই ফুঠছে। তার সব কথাই নীড়কে নিয়ে শুরু হচ্ছে। আবার শেষও নীড়কে দিয়েই হচ্ছে। নীড়ের প্রশংসা করে কোনোভাবেই শেষ করতে পারছে না বাচ্চা ছেলেটা। কথা অবাক হয়ে শুনছে। মানুষটা তার সাথে কোনোদিনও ঠিকভাবে দু’টা কথা বলেনি। কিন্তু তাই ভাইয়ের সাথে এত কথা কখন বলল! পলাশ তো কখনও মিথ্যা বলে না৷ বাচ্চা একটা ছেলে মিথ্যে বলে লাভই কি!

-জানো আপু দুলাভাই বলেছে আমাকে চিরিয়াখানায় বাঘ দেখাতে নিয়ে যাবে। আচ্ছা আপু বাঘ কি অনেক বড়? মানুষ খেয়ে ফেলে? দুলাভাই আমাকে নিয়ে গেছে আমাকেও কি খেয়ে ফেলবে?’

-পলাশ, তোর দুলাভাই তোর সাথে এত কথা কখন বলল!’

-সকালে। তুমি যখন ঘরে ছিলে না। দুলাভাই আমাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এই বাবু, তোমার নাম কী?’
আমি বলেছি, ‘আমার নাম পলাশ।’

-পলাশ! বাহ! পলাশ তো একটা ফুলের নাম। তুমি কি পলাশ ফুল?’

-না। আমি ফুল না।’

-তাহলে তোমার নাম যে ফুলের নামে রাখা হলো। তোমার নাম কে রেখেছে?’

-আপু।’

নীড় বিড়বিড় করে বলেছে,
-এমন গাধা মার্কা কাজ তোমার বোনকে দিয়েই হবে।
আচ্ছা পলাশ, তুমি স্কুলে পড়ো?’

-না। আমি তো ছোট তাই স্কুলে ভর্তি করায় না।’

-ওহ। তুমি আমাকে চেনো?’

-হুম। আপনি আমার দুলাভাই।’

-দুলাভাই কাকে বলে জানো?’

-না। কাকে বলে?’

-বোনের বরকে…থাক তোমার জানতে হবে না। তুমি আমার জ্যাকিকে দেখেছ?’

-হ্যাঁ। কাল এসে ওর সাথে অনেকক্ষণ খেলেছি।’

-জ্যাকিকে তুমি ভয় পাও না।’

-না।’

-তোমার বোন তো পায়।’

এরকম আরও অনেক কথা বলেছে ওরা। কথা সব কথা শুনে মনে মনে অবাক না হয়ে পারলো না। তার সাথে তাহলে লোকটার কী সমস্যা? সে কী করেছে যার জন্য তার সাথে এমন করেন?
অন্যমনস্ক হয়ে কথা পলাশকে মুখে ভাত দিয়েই যাচ্ছিল। পলাশ জোরে বললে কথার ধ্যান ভাঙল।

-আপু আর খাব না।’

-হ্যাঁ! ওহ, খাবি না। ঠিক আছে।’

তখনই নাহিদ চৌধুরী হন্তদন্ত হয়ে কোথাও বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। কথা উনাকে দেখে ডাকল।

-বাবা কোথায় যাচ্ছেন?’

নাহিদ চৌধুরী না দাঁড়িয়েই একপলক কথাকে দেখল। কিছু বলার সময় নেই তার হাতে। নাহিদ চৌধুরীর পেছনে মতিন চাচাও ছুটছে। কথা মতিন চাচার কাছে জানতে চাইল।

-চাচা কী হয়েছে? আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?’

মতিন চাচা কী ভাবল কে জানে। সে কথাকে সত্যিটা বলেই দিল।

-হাসপাতালে। নীড় বাবা হাসপাতালে ভর্তি আছে।’

কথা পাথর হয়ে জমে রইল। কী হয়েছে মানুষটার।
কাঁপা কাঁপা গলায় কথা কোনরকমে বলতে পারল,

-আমিও যাব।’

-যাবে! চলো তাহলে।’

কথা পলাশকে রমিজা খালার কাছে রেখে ওভাবেই মতিন চাচার পেছনে ছুটলো। এই তো দুপুরেই মানুষটা সুস্থ শরীরে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। এটুকু সময়ের মধ্যে কী হয়েছে উনার!
কথাকে জানিয়ে দেওয়ার নাহিদ চৌধুরী মতিনের উপর রাগ দেখালেন। মেয়েটাকে কোন চিন্তায় ফেলতে চান না তিনি। নীড়ের স্বভাব তো তার জানাই আছে। কথা কেমন থ মেরে গেছে। ছোট থেকেই কোন দুঃসংবাদ সহ্য করতে পারে না সে। ওর নার্ভ ভীষণ দুর্বল। এই মুহূর্তে কাঁদতেও পারছে না কথা।
হাসপাতালে পা রাখার সাথে সাথে নার্স, ডাক্তার নাহিদ চৌধুরীর কাছে এসে নীড়ের অবস্থা সম্পর্কে আশ্বস্ত করতে লাগল। নাহিদ চৌধুরী উনাদের ব্যস্ত হতে নিষেধ করলেন। নীড় কোথায় আছে জানতে পেরে কথা ওর কাছে ছুটে গেল। গুরুতর কিছু যে হয়নি তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সামান্য চোট এসেছে। ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হয়েছে। বাম হাতটা কপালের উপর রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে চোখ মেলে তাকাল। কথা নীড়কে দেখে হাসার চেষ্টা করল। সেটা কান্নার মতই দেখাল। নীড় উঠে বসতে বসতে বলল,

-তোমাকে এখানে কে আসতে বলেছে?”

চলবে🌸

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here