#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ১৫|
-তুমি এখানে কেন? তোমাকে কে নিয়ে এসেছে?”
নীড়ের গলায় স্পষ্ট বিরক্তি। তার তেমন কিছুই হয়নি। গুরুতর এমন কোন আঘাতও পায়নি যার কারণে হাসপাতালে নিয়ে আসতে হয়েছিল তাকে। তবুও গাধা গুলো নিয়ে এলো। সামান্য জ্ঞান হারালেই কেউ মারা যায় না। হাসপাতালে নিয়ে এলো তো এলোই বদমাশ ডাক্তারটা মনে হয় তার বাপকে কল করে জানিয়েছে তার সাঙ্ঘাতিক একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। বাপও লোকের সামনে পুত্র স্নেহ দেখিয়ে ছুটে এসেছে। সাথে এই পাগল মেয়েটাকেও নিয়ে এসেছে। অসহ্য। এদের জ্বালায় এখন দেশে থাকা মুশকিল হয়ে পড়ছে। দেশ ছেড়ে কোথাও চলে যাবে নাকি? পাহাড়, হিমালয়, বনজঙ্গল এমনকি মরুভূমিতেও শান্তিতে থাকা যাবে। কিন্তু নাহিদ চৌধুরী আর তার বৌমার ধারের কাছে থাকা যাবে না। কথা নীড়ের কাছে এসে দাঁড়াল। ধরা গলায় জিজ্ঞেস করল,
-কী হয়েছে আপনার?’
-তেমন কিছু যে হয়নি তা নিজের চোখেই দেখতে পারছ। নাকি চোখে কম দেখ? কানা টানা নও তো আবার!’
-আপনার কি খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে!’
-আমার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আমি কষ্ট পাচ্ছি?’
-অ্যাক্সিডেন্ট কীভাবে হয়েছে?’
-কিসের অ্যাক্সিডেন্ট!’
-অ্যাক্সিডেন্ট হয়নি আপনার!’
কথা অবাক। যদি অ্যাক্সিডেন্ট না হয়ে থাকে তাহলে হাসপাতালে কেন ইনি? কোন রোগী মানুষের মুখের কথা এমন না!
-অ্যাক্সিডেন্ট না হলে হাসপাতালে কী করছেন? কোন সুস্থ মানুষ নিশ্চয় হাসপাতালে ঘুরতে আসে না।’
নীড় প্রথমে বলতে না চাইলেও এবার বলে ফেলল।
-অ্যাক্সিডেন্ট ফেক্সিডেন্ট কিচ্ছু না। মারামারি করে এসেছি। শুনেছ, এবার খুশি?’
কথা চোখ গোল গোল করে আঁতকে উঠে বলল,
-মারামারি! কে কাকে মেরেছে?’
নীড় কথাকে ধমক মারল।
-অত কিছু শুনতে হবে কেন তোমার? আর আমাকে এত প্রশ্ন করার সাহস তোমাকে কে দিয়েছে? তুমি যে এখানে এসেছ এটার জন্যই তো তোমার শাস্তি পাওয়া উচিত।’
-শাস্তি!’
-হু।’
লোকটা কী ভীষণ ত্যাঁদড়! মারামারি করে হাসপাতালে শুয়ে আছে। সে যে সহানুভূতি দেখিয়ে দেখতে এসেছে এটাই তো অনেক। তাকে ধন্যবাদ না দিয়ে শাস্তি দেওয়ার কথা বলছে! মার খেয়েছে উচিত হয়েছে। মাস্তান গুলো জন্মের শিক্ষা দিয়ে ছাড়তে পারল না। একটুআধটু মেরেছে কেন? অন্তত আধমরা করে ছাড়ার উচিত ছিল। কথা ফোঁস করে দম ফেলল।
-ছ্যাহ! সামান্য কয়েকজন গুণ্ডার সাথে মারামারি করে পারলেন না? মার খেয়ে হাসপাতালে এসে শুয়ে আছেন! আপনার থেকে তো আমাদের পাড়ার পাতি মাস্তান গুলোই ভালো মারামারি পারে। ওরা মার খেয়ে কাপড় নষ্ট করে ফেললেও হাসপাতালে যাবে না।’
নীড় মেয়েটার কথা শুনে হতভম্ব। এক সেকেন্ড আগেও এর অন্য রূপ ছিল। ঝট করে যেন কোন বোতাম চেপে আলাদা একজন হয়ে গেল। নীড় রাগে তোতলাতে তোতলাতে বলল,
-তোমার সাহস তো কম না! আমার সাথে তোমাদের পাড়ার পাতি মাস্তানের তুলনা দিচ্ছ!’
-অবশ্যই দেওয়া যায়। কারণ ওরা আপনার থেকে ভালো মারামারি করে। আপনার মত মুখেই বড় বড় কথা বলে না। কাজকর্মেও করে দেখায়।’
নীড়ের ইচ্ছে করছিল কথাকে তুলে মাথার উপর থেকে আছাড় মারতে। যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা! দিনদিন বাড় বেড়েই যাচ্ছে।
-তোমাকে, তোমাকে তো আমি…
নীড়ের হাতের যে জায়গায় ব্যান্ডেজ করা কথা ওখানে চাপড় মেরে বলল,
-শুধু শুধু টেনশন দিলেন। আপনার তো কিছুই হয়নি। এখন উঠুন। হাসপাতালে পড়ে না থেকে বাড়ি ফেরা যাক। আনতাজে হাসপাতালের খরচ মিটাতে হবে। এর পর থেকে খুব গুরুতর আঘাত না পেলে হাসপাতালে আসবেন না।’
কথাগুলো বলে কথা আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ায়নি। ওর চলে যাওয়ার দিকে দেখতে দেখতে নীড় হতভম্ব, হতবুদ্ধি, হতবিহ্বল, বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ল। এই মেয়েটা কি আদোও স্বাভাবিক! কোন সুস্থ মেয়ে নিজের বরের সাথে এভাবে কথা বলতে পারে! নীড়ের জানা ছিল না মেয়ে জাতির মধ্যে কথার মতও যে দুই তিন পিস মেয়ে থাকতে পারে। দুই তিন পিস না, হয়তো এই এক পিসই আছে। তাকে ডিটারজেন্ট ছাড়া ধুয়ে দিয়ে গেল! আজব, অদ্ভুত, বিরল ক্যারেক্টার।
নাহিদ চৌধুরী ডাক্তারের সাথে কথা বলছিলেন।
-তেমন কোন আঘাত আসেনি। শুধু শরীরের দু’য়েক জায়গায় কিছুটা ছড়ে গেছে আর কেটে গেছে।’
– কী করে হয়েছে জানতে পেরেছেন?’
-অ্যাক্সিডেন্ট হয়নি। হয়তো কারো সাথে মারপিট করেছে। অজ্ঞান অবস্থায় উনাকে নিয়ে আসা হয়।আপনার ছেলে ভেবে আপনাকে জানানো প্রয়োজন মনে করলাম।’
-হু।’ নাহিদ চৌধুরী দাঁত চেপে মনে মনে আওড়ালেন, মারপিট! মাস্তান হবে। সব ভাবেই আমাকে জ্বালানো শেষ। অবশেষে এই পথ খুঁজেছে। কথা গটগট করে হেঁটে এসে শ্বশুরের সামনে দাঁড়াল।
-বাবা চলুন।’
-হ্যাঁ!’
-বাড়ি চলুন। আপনার ছেলের কিচ্ছু হয়নি। গায়ের জোর পরীক্ষা করার জন্য মারামারি করতে গেছিল। শুধু শুধু আপনাকে চিন্তায় ফেলা। সাথে আমাদেরও। আসার পথেও মনে করেছিলাম কী না কী হয়েছে! চলুন তো বাবা।’
কথা হাঁটা ধরল। নাহিদ চৌধুরীও কথার পেছন পেছন আসতে লাগলেন। মারপিঠের কথা ওকে কে বলেছে? নীড় নিজেই বলেছে! কী এবং কতটুকু বলেছে ওকে? কথার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে। ওর বরটা এমন কেন? অনুর বর তো এমন না। অনুকে কত ভালোবাসে। আর তার বর! ভালোবাসা কী এটাই হয়তো জানে না।
গাড়িতে বসে মুখ গোমড়া করে কথা বলল,
-আপনার ছেলে এমন কেন বাবা? উনাকে ছোটবেলা থেকে শাসন করতে পারেননি। আমার মা তো আমাকে কত শাসন করত। দেখুন আমি কেমন শান্তশিষ্ট, ভদ্র মেয়ে হয়েছি। খবরটা শোনার পর থেকে আমার আত্মা হাতে চলে এসেছিল। এখানে এসে মনটাই…থাক, বাসায় চলুন বাবা।’
মতিন চাচা নীড়কে ধরে ধরে নিয়ে আসছে। কথা ওদের দেখে বলল,
-বাবা, মতিন চাচাকে গাড়িতে বসতে বলে আপনি গাড়ি ছেড়ে দিন। উনাকে হেঁটে আসতে বলুন। এটাই উনার শাস্তি।’
নাহিদ চৌধুরী মেয়েটার ছেলেমানুষি দেখে মনে মনে হাসলেন। আরও একবার প্রমাণ হলো এই মেয়ে নিতান্তই সহজসরল। নইলে নিজের স্বামীকে নিয়ে এরকম করে কেউ শ্বশুরের সাথে কথা বলবে! এই মেয়ের মনে কোন প্যাঁচ নেই। নাহিদ চৌধুরী কথার কথা মতই মতিনকে গাড়িতে বসতে বলে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে নীড়ের চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল। নীড়ের নিজেরও ইচ্ছে ছিল না এই গাড়িতে সবার সাথে যাবার। তারপরও এভাবে তার সামনে থেকে চলে গিয়ে লোকটা তাকে অপমান করল! দেখেছে সে ব্যথা পেয়েছে। তারপরও এভাবে ফেলে যেতে পারল। নিশ্চয় ওই মেয়ে শ্বশুরের কানে তার নামে লাগিয়েছে। বজ্জাত মেয়েছেলে। এর শাস্তি তো নীড় ওকে দিয়েই ছাড়বে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে শূন্যে ঘুসি ছুড়লো নীড়। এই মেয়েটা তার জীবনে আসার পর থেকে মনে হচ্ছে সর্বক্ষণ ফাঁসির দঁড়ি গলায় নিয়ে ঘুরছে। জলজ্যান্ত মাথা ব্যথা একটা।
————————-
মেয়ের জামাইয়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে এই খবরটা কীভাবে যেন আশার কানে পৌঁছে গেছে। সে পরের দিন সকালেই মেয়ের শ্বশুরবাড়ি এসে হাজির। মানুষের কথায় তার বিশ্বাস নেই৷ কতটুকু কী হয়েছে নিজের চোখে দেখে তবেই শান্ত হবে। মানুষ কতকিছু বাড়িয়ে বলে৷ হয় একটা ওই ঘটনাকে রঙচঙ মেখে বানিয়ে বলে আরেকটা।
মা’কে দেখে কথা অবাক। এত সকালে কেউ কারো বাড়ি আসে নাকি!
-তোমার সকাল কোথায় হয়েছে! রাতেই রওনা দিয়ে দিয়েছিলে নাকি।’
আশা কথার হাত ধরে আড়ালে টেনে নিল। গলার স্বর যথেষ্ট খাদে নামিয়ে বলল,
-আমার কাছে খবর গেছে জামাইয়ের নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে। সত্যিই হয়েছে নাকি রে! মানুষ তো কতকিছু বলে।’
-এক্সিডেন্ট না ছাই…
কথা বলতে বলতে চুপ হয়ে গেল। আশার চোখ সন্দেহের দৃষ্টি। মা’কে না জানানোই ভালো হবে। যা শুনে এসেছে সেটাই বলা যাক।
-হ্যাঁ এক্সিডেন্টই তো হয়েছে। অনেক বড় এক্সিডেন্ট হয়েছে। একটুর জন্য মরতে মরতে বেঁচে গেছে।’
-বলিস কী রে! হাত পা ভেঙে গেছে নাকি?’
-না। শরীরের বাইরে তেমন কিছু হয়নি। তবে মাথার ভেতরে চাপা আঘাত পেয়েছে। মনে হয় ব্রেইন ট্রেন নড়ে গেছে। সমানে আবোলতাবোল বলে৷ পাগল হওয়ার লক্ষণ।’
-চুপ কর অলক্ষী মেয়ে। নিজের স্বামীকে নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে এসব কথা বলতে বুক কাপছে না?’
-আমার বুক কাঁপবে কেন? আমার কি হার্টের সমস্যা আছে নাকি!’
এই মেয়ের সাথে কথা বলার থেকে ভালো পাথরে মাথা ঠুকে মরে যাওয়া। আশা হাল ছেড়ে দিল। এইভাবে কতদিন শ্বশুরবাড়ি থাকতে পারে সেটাই দেখার বিষয়। আশা খুব গোপন কথা বলার ভঙ্গিতে বলল,
-এত সকালে এসেছি। দোকানপাট কিছুই খোলা পাইনি। মিষ্টি টিষ্টি কিছু আনতে পারিনি।’
-আমার শ্বশুরবাড়িতে কেউ মিষ্টি খায় না। সবার ডায়াবেটিস। ওদের জন্য নিমপাতা নিয়ে এলে ভালো করতে। রস করে খেতে পারত।’
-এই প্রথম মেয়ের শ্বশুরবাড়ি এসেছি। তাও খালি হাতে। বিয়াই কী মনে করবেন?’
-তোমার বিয়াইয়ের এত সময় কই? তিনি কিচ্ছু মনে করবেন না।’
-জামাই কই?’
-ঘরে। ঘুমচ্ছে।’
-আর পলাশ?’
-সে-ও দুলাভাইয়ের সাথে নাক টানছে।’
আশার চোখ বড় হয়ে গেল। সে যেন ঠিক বুঝতে পারেনি।
-পলাশ তোদের সাথে ঘুমায়!’
-হ্যাঁ।’
-আসার পর থেকেই!’
-তুমি জানো পলাশ আমাকে ছাড়া শুতে পারে না। তবুও এমন প্রশ্ন করছ। ওকে কি আমি একা ঘরে থাকতে দিতাম।’
এই মেয়েকে বলে কোন লাভ নেই। এই মেয়ে তাকে আগেও জ্বালিয়েছে৷ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জ্বালাবে।
আশা বিয়াইয়ের সাথে দেখা করে, মেয়ের জামাইকে দেখে সকালের নাস্তা ওদের সাথেই করল। ডাইনিং টেবিলের এত আয়োজন দেখে আশা ঠিক মত কিছু খেতেই পারল না। কথাটার কপাল! নাহিদ চৌধুরী অফিসে যাবার আগে আশাকে আজকে থাকতে বলে গিয়েছিলেন। কিন্তু এটা কি আর হয়? মা কীভাবে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে থাকবে! দুপুরেও এখানে খাওয়া দাওয়া করে বিকেলের দিকে পলাশকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল আশা। ভাই চলে যাওয়ায় কথার মনটাও খারাপ হয়ে আছে। তার এই মন খারাপের কারণ নীড়ও বুঝেছে। কথা ঘরে এসে চুপচাপ বসে থাকলে নীড় বলল,
-পানি দাও তো।’
বাধ্য মেয়ের মত নীড়কে পানি দিল কথা। নীড় পানির গ্লাস হাতে নিয়ে সে আবার আগের জায়গায় গিয়ে বসে রইল।
-উহ পা-টা নাড়াতে পারছি না। রগ ছিড়ে যাচ্ছে। ধরো তো, আহ আহ..’
কথা ছুটে এসে নীড়কে ধরল। মন খারাপ থাকলেও নীড়ের কষ্ট সহ্য করতে পারছে না সে।
-কী হয়েছে? কোথায় লাগছে বলুন।’
-পায়ের রগ ত্যাড়া হয়ে যাচ্ছে। পা বেঁকে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। একটু মালিশ করে দিবে?’
কথা বসে বসে নীড়ের পা মালিশ করে দিচ্ছে। নীড় ওকে দেখছে। সে ভেবেছিল তার এই আবদারে কথা রাগ করবে। অন্য দিনের মত তর্ক করবে। পা টেনে নিল সে। কথা বিরক্ত হয়ে ওর দিকে তাকাল।
-কী হলো?’
-কিছু না।’
-কিছু না মানে! পা দিন, মালিশ করে দিচ্ছি।’
-লাগবে না। ঠিক হয়ে গেছে।’
কথা চোখ কেমন করে সন্দেহ নিয়ে নীড়কে দেখছে। নীড় ভুলেও ওর দিকে তাকাচ্ছে না।
-মারামারি করে মাথায় কোন আঘাত পেয়েছেন নাকি? বাড়ি টারি লেগেছে দু’একটা! আজব আচরণ করছেন। আপনার পায়ের রগ না, মাথার তার ছিঁড়েছে বুঝেছেন।’
চলবে_
মায়ামহল (নিপা’র গল্প)