চুপকথারা_বিষন্ন পর্ব-১৭

0
3659

#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ১৭|

নীড়কে কথা দু’দণ্ডের জন্যেও বাড়িতে পায় না। মানুষটা সারাটা দিন থাকে কোথায়? বেকার সময় কীভাবে কাটায়! না কোন কাজ, না বাড়িতে থাকে।
একটা মানুষ যে এতটা অকাজের হতে পারে তা কথা তার নিজের স্বামীকে না দেখলে জানতে পারত না। বিয়ের আগে সে বাড়ির সব কাজ করেছে। তারপরও মা তাকে সারাদিন বকাবকি করত। সে নাকি কোন কাজ পারে না। বিয়ের পর দু’দিনও স্বামীর ঘর করতে পারবে না। কিন্তু এ বাড়িতে কথার দশটা দিন কেটে গেল। এই দশ দিনে শুধু চা বানানো ছাড়া তেমন কোন কাজই তাকে করতে হয়নি। শুধু নীড় ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে তার অগোছালো জিনিস গুলো গুছিয়ে রেখেছে। শ্বশুর আব্বা একয়দিনে তার সাথে দু-এক বার রাগারাগিও করেনি। মতিন চাচার মত ভালো মানুষ হয় না। রমিজা খালার ব্যবহারে কথা নিজের মা’কে খুঁজে পায়। এই বাড়ির সবাই এত ভালো কেন? নাকি কথার চোখে সবাইকে ভালো মনে হয়। মানুষ কি সত্যিই এত ভালো হয়!

-আমি সবসময় ভাবতাম আমার কপালে হয়তো সুখ লিখা নেই। সুখ জিনিসটা আমার জন্য না। আমি যে কতটা ভুল ছিলাম তা এখন বুঝতে পারি। সুখ তো আমার কপালেই লিখা ছিল। এইযে এত এত সুখ! এই সবই আমার ভাগের। নিজের বাবার থেকেও ভালো শ্বশুর পেয়েছি। মতিন চাচা, রমিজা খালার মত মমতাময়ী একজন মানুষ। সবাই কত্ত ভালো। শুধু সেই মানুষটা, যে আমার খুব আপন, যাকে আমি প্রতিনিয়ত সৃষ্টিকর্তার কাছে চেয়ে গেছি। যাকে না দেখেই ভালোবেসেছি। যাকে নিয়ে কতশত সুখের স্বপ্ন বুনেছি। আমার কল্পনা জল্পনা, আমার অস্তিত্ব সবকিছু দিয়ে তাকে অনুভব করেছি। সেই মানুষটাই পুরোপুরি আমার হলো না। সে শুধু কাগজে কলমেই আমার হয়েছে। সে আমাকে পছন্দ করে না। আমি এটাও জানি সে আমাকে ভালোও বাসে না। কেন, কোন বাধ্যবাধকতায় সে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে? তিনি দেখতে সুন্দর। যেকোনো মেয়ে বিনা শর্তে তার বউ হওয়ার জন্য রাজি হয়ে যাবে। বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে। সব মেয়ের বাবাই তাকে জামাই করতে চাইবে। আমার তো কোন যোগ্যতাই নেই। উনাকে পাওয়া আর আকাশের চাঁদ চাওয়া দু’টোই আমার জন্য সমান। তারপরও ভাগ্য আমাকে এখানে টেনে এনেছে। উনার বউ হওয়া আমার তকদিরে লেখা ছিল। কিন্তু উনার ভালোবাসা হয়তো আমার নসিবে লেখা নেই।’

টুপটুপ করে কয়েক ফোঁটা নোনতা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল কথার গাল বেয়ে। কথা চোখ মুছল না।
তার অনেক সুখ। ভাগ্য করে এমন শ্বশুরবাড়ি পেয়েছে সে। এরকম ভাগ্য কয়জনের হয়?
ছোটবেলা থেকে কারো ভালোবাসাই তো পায়নি সে। এখানে এসে যা পাচ্ছে তা-ই তো অনেক। আর কী চায় তার? কিছুই না। তবুও মানুষটার জন্য তার মন কেমন করে। মানুষটা যখন তার সাথে সর্বক্ষণ রেগে কথা বলে তখন কথার বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা হয়। মানুষটার কাছে জ্যাকির গুরুত্ব তার থেকে অনেক বেশি।

কথা বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। রমিজা খালা ওকে দেখে ডাকল। কথার কানে মনে হয় রমিজা খালার ডাক পৌঁছালো না। সে থামল না। রমিজা খালা ডাকতে ডাকতে এগিয়ে আসছে।

-কথা। কথা হুনো৷ ও নতুন বউ।’

কথার চলার ভঙ্গিটা রমিজা খালার কাছে ভালো লাগছে না। মেয়েটা তার ডাক শুনেও সাড়া দিচ্ছে না। হ্যাঁ এইতো কথা তার দিকে তাকিয়েছে। তার চোখে অবজ্ঞার দৃষ্টি। ঠোঁটের কোণেও ক্ষীণ হাসি লেগে আছে কি-না কে জানে। রমিজা দাঁড়িয়ে গেল। কপাল কুঁচকে বিড়বিড় করে বলল,

-আজব মাইয়া তো! এর আগে কথা কখনও এমন করে নাই। কী হইলো মাইয়াটার? যাইতাছে কই! ওর চোখ,,, ধুরু কী ভাবতাছি আমি। এইডা তো নতুন বউই। আমারে দেখে নতুন বউ এমনে হাসল কেন? সত্যই হাসছে নাকি আমার দেখার ভুল।’
—————
নীড়ের অতি প্রিয় পোষা কুকুর জ্যাকি। জ্যাকির সাধারণ সর্দি লাগলেও নীড় ডাক্তার টাক্তার ডেকে একাকার করে ফেলে। জ্যাকিকে নিয়ে তার এই বাড়াবাড়ি এই বাড়ির মানুষ গুলোর সয়ে গেছে। কেউই এখন তাকে বাঁধা দেয় না। অন্যরা শুনলে হয়তো তাকে পাগল ভাববে। একটা কুকুরের জন্য তার এই পাগলামি অনেকেই স্বাভাবিক ভাবে দেখতে পারে না৷ আজ জ্যাকি খুঁড়িয়ে হাঁটছে। তার পেছনের পা-টা চামড়ার সাথে ঝুলছে যেন। ওই পায়ে ভর দেওয়ার তো দূর কোনোরকমে হেঁচড়ে আনতেও কষ্ট হচ্ছে বেচারার। ব্যথায় কুকাচ্ছে জ্যাকি। কোন রক্তারক্তি কারবার ঘটেনি। তারপরও কীভাবে পা-টা এভাবে ভেঙে গেল কীভাবে? জ্যাকিকে এই অবস্থায় সবার আগে মতিন চাচা আবিষ্কার করেছে। একটু আগেও জ্যাকিকে খাবার দিয়েছেন তিনি৷ তখন তো এরকম কিছুই চোখে পড়েনি। মতিন চাচা সঙ্গে সঙ্গে নীড়কে কল করে জানিয়ে দিয়েছে। তবে এটা বলেনি জ্যাকির পা ভেঙেছে। শুধু এতটুকু বলেছে, এক্ষুনি বাড়িতে আসো তুমি। উত্তরে নীড় জানতে চেয়েছে,
–কেন?’
–তোমারে বাড়ি আইতে কিইছি। প্রশ্ন করতে কই নাই।’
–আচ্ছা, আচ্ছা। রাগছো কেন তুমি? আসছি আমি। কী এমন কাজ পড়ল আমার কে জানে।’

জ্যাকি বেচারার এই কষ্টমাখা কাতরানি কেউই সহ্য করতে পারছে না। কথা সবসময় জ্যাকিকে ভয় পেত। কোনোদিনও কাছে যায়নি। আজ সে জ্যাকির কষ্ট দেখে কেঁদে ফেলল। খুব আপন মানুষের কিছু হলে মানুষ যেভাবে কাঁদে ঠিক সেভাবে কাঁদছে। জ্যাকি কথার দিকে তাকিয়ে মুখ দিয়ে কাতর শব্দ বের করছে। কথা ওর দিকে এগোতে নিলেই জোরে জোরে ঘেউঘেউ করে উঠছে। বেচারার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। ওর কষ্টের পরিমাণ কথা আন্দাজ করতে পারছে। কাঁদতে কাঁদতে কথা বলল,

-কষ্ট পাচ্ছিস। ব্যথায় নিজেও কাঁদছিস। তবু্ও আমাকে ভয় দেখানো থামাবি না। কী হয়েছে তোর? কীভাবে হয়েছে? অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে?’

নীড়ের ফিরতে বিশ মিনিট লাগল। সে বেশিদূরে ছিল না। মতিন চাচার জরুরি তলব পেয়ে পড়িমরি করে ছুটে এসেছে। বাসায় এসে জ্যাকিকে ঘিরে সবার ভীড় দেখে নীড়ের মন কেমন করে উঠল। জ্যাকি এভাবে ডাকছে কেন? তার গলা তো এরকম না! জ্যাকি ব্যথা পেলেই এমন করে ডাকে। এক দৌড়ে জ্যাকির কাছে চলে এলো নীড়। কথাকে সরিয়ে দিয়ে জ্যাকিকে কোলে তুলে নিল। মতিন চাচার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল,

-কী হয়েছে জ্যাকির? কীভাবে ব্যথা পেয়েছে ও? তোমরা সবাই কোথায় ছিলে?’

-ওরে আমি খাবার দিয়া একটা কাজে গেছিলাম। আমার সামনেই খাইয়া খেলতে গেল। একটু পরে আইসা দেখি হাঁটতে পারে না। পেছনের এক পা ঝুলে আছে।’

নীড় জ্যাকির পায়ে হাত দেওয়ার সাথে সাথে জ্যাকি কাতর গলায় ককিয়ে উঠল। ওকে কষ্ট পেতে দেখে নীড়ের মাথা এলোমেলো হয়ে গেল।
কথাও তার সামনেই বসে কাঁদছে। কথাকে এক ধমক লাগালো সে।

-চুপ। তুমি কাঁদছো কেন?’

-ও কষ্ট পাচ্ছে।’

– তুমি কাঁদলে ওর কষ্ট কমবে! আমার সামনে প্যানপ্যান না করে এখান থেকে যাও। জ্যাকি ব্যথা পাওয়ার সময় তুমি কোথায় ছিলে? তখন ওর খেয়াল রাখতে পারোনি। এখন কাঁদছ কেন তাহলে?’

নীড় জ্যাকিকে কোলে তুলে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। গাড়ি রেডিই আছে তার। জ্যাকিকে এক্ষুনি ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। মানুষ বলে বোঝাতে পারে কোথায় কষ্ট হচ্ছে তার, কতটুকু কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু বোবা প্রাণীরা সেটা পারে না।
নীড়ের কড়া কথা শুনে কথার মন আরও খারাপ হয়ে গেছে। তাকে কাঁদতে দেখে রমিজা কাঁধে হাত রেখে বলল,

-নতুন বউ, কাইন্দো না। তুমি কানলে কিছু ঠিক হইব, কও? ভাইজান ওর কিচ্ছু হইতে দিব না। কাইন্দো না।’

কথার ইচ্ছে হচ্ছিল নীড়ের সাথে যেতে। কিন্তু নীড় তাকে নিবে না। বললেও রাগ দেখাবে। জ্যাকি উনার মনের খুব কাছের। ভীষণ প্রিয়। ওর কষ্ট কথাই দেখতে পারছে না। নীড় কীভাবে সহ্য করবে তাহলে? কথা মন থেকে জ্যাকির জন্য দোয়া করল।

-হে সৃষ্টিকর্তা, হে সর্বশক্তিমান তুমি ওর কষ্ট আসান করে দাও। ও তো বোবা প্রাণী, কথা বলতে পারে না। ওর কষ্ট তুমি কমিয়ে দাও। মানুষটা ওকে কষ্ট পেতে দেখতে পারবে না। ওর কষ্ট দেখে নিজেও কষ্ট পাচ্ছে।’

নীড় জ্যাকিকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে অনেকটা সময় হয়েছে। তার ফোন লাগছে না। জ্যাকির অবস্থাও জানা যাচ্ছে না। ওর পা কি ঠিক হয়েছে? এত সহজে কি ঠিক হবে? আজকের বিকেলের এই ছোটাছুটিতে কলেজে দেখা হওয়া ওই লোকটার কথা কথা নীড়কে জানাতেই ভুলে গেল। মনে থাকলেও বলত কি-না সন্দেহ। মানুষটার মন ভালো নেই। এসব কথা এখন না তুললেও হবে।
কথা ঘরময় পায়চারি করে বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। আটটা বেজে গেছে নীড় এখনও ফিরছে না কেন? জ্যাকি ঠিক আছে তো। কথার মন ছটফট করছে। সে আর ঘরে থাকতে পারল না। নীড় জ্যাকিকে কোলে নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকছে। কথা ওদের দেখে ছুটে গেল।

-জ্যাকি ঠিক আছে তো? ওর পা এখন কেমন?’

জ্যাকি নীড়ের কোলে মাথা রেখে একেবারে শান্ত হয়ে শুয়ে আছে। নীড়ের চেহারায়ও ক্লান্তির ছাপ।

-ও ওভাবে শুয়ে আছে কেন?’

-ঘুমচ্ছে। পা-টা মনে হয় ভেঙেই গেছে। কিছুতেই ব্যথা কমছিল না। ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে।’

-পা কি আর ঠিক হবে না?’

-জানি না। তোমরা সবাই কোথায় ছিলে কথা? এই বাড়িতে আমার মত আমার কুকুরটাও অবহেলিত জানতাম না।’

নীড়ের এই অভিযোগ মেশানো কণ্ঠে নিজের নাম শুনে কথার কান্না পেয়ে গেল। মা ঠিকই বলত, সে সত্যিই ভালো বউ হতে পারবে না। তার স্বামী কষ্ট এর জন্য কিছুটা সে-ও দায়ী। নীড়ের পছন্দের জিনিস গুলো তার আগলে রাখা উচিত ছিল।
জ্যাকি নীড়ের বিছানায় মরার মত পড়ে ঘুমচ্ছে। বেচারার পা ফোলে ঢোল হয়ে আছে। ওর স্বাস্থ্য যেন এই সামান্য সময়ে অনেকটা ভেঙে গেছে। নীড় রাতে কিছু খেল না। কথা কয়েকবার ডাকতে এসেছে।

-আপনি খাবেন না?’

-না।’

-খাবেন চলুন। আপনি না খেয়ে থাকলে যদি জ্যাকি সুস্থ হয়ে যায় তাহলে আমিও আপনার সাথে না খেয়ে থাকব।’

নীড় কথাকে দেখছে। আজ রাগ দেখাচ্ছে না সে। মেয়েটাকেও চিন্তিত দেখাচ্ছে।

-তুমি খেয়ে নাও কথা। আমি খাব না। খিদে নেই আমার।’

কথা চলে গেল। একটু পরেই খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলো। নীড় ওর দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হলো। এবার মেয়েটা বেশি বেশি করে ফেলছে।
কথা একটা টোল টেনে খাবারের প্লেটটা রাখল। নীড়ের হাত ধরে টেনে ওকে সোফায় নিয়ে বসালো। নীড় যেন কেনই আজ কথার সাথে কঠোর হতে পারছে না।

-জানি আপনার খিদে নেই। তবুও একটু খান।’

কথা নীড়ের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে। নীড় মেয়েটাকে যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। তার এত এত খারাপ ব্যবহারের পরও মেয়েটা তার প্রতি কোন অভিযোগ না রেখে উল্টো তার খেয়াল রাখছে।

-প্লিজ একটু খেয়ে নিন। আমি কথা দিচ্ছি আজকের পর থেকে জ্যাকির খুব খেয়াল রাখব। আপনার পছন্দের সব জিনিস আগলে রাখব।’

চলবে 🌼

বানান ভুল ক্ষমা করবেন।

মায়ামহল (নিপা’র গল্প)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here