চুপকথারা_বিষন্ন পর্ব-১৮

0
3212

#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ১৮|

রাতটা নীড়ের ঘুমহীন অবস্থাতেই কেটেছে। জ্যাকি তার হৃদয়ের কত কাছের কাউকে এটা বোঝাতে পারবে না সে। বিশতম জন্মদিনে বাবা তাকে জ্যাকিকে এনে দিয়েছিল। বাবার সাথে এখন তার দূরত্ব আকাশ মাটি সমান। বাবা ছেলের স্বাভাবিক সম্পর্কটা অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু বাবার দেওয়া এই উপহারটা তার কাছে অনেক মূল্যবান। এত সহজে একে হারাতে পারবে না নীড়। কথাও কিছুটা সময় নীড়ের সাথে জেগে ছিল। কিন্তু তার ঘুম তাকে ছাড়ল না। কখন যে চোখ লেগে গেল! গুটিসুটি মেরে নীড়ের পাশে শুয়ে রইল। এই মেয়েটাকে ঘুমন্ত অবস্থায় এর আগে কখনও খেয়াল করে দেখেনি নীড়। বাবা তাকে ফাঁদে ফেলে বিয়েটা করিয়েছে। এই মেয়ের প্রতি তার বিন্দুমাত্র আগ্রহও নেই। ভালোবাসা, মনের টান তো বহু পরের ব্যাপার। নীড় এর সাথে কখনও ভালো ব্যবহার করে না। সারাক্ষণই রাগারাগি করে। তারপরও তাকে নিয়ে মেয়েটার কোন অভিযোগ নেই। একটুও রাগ নেই। বরং তাকে দুঃশ্চিন্তায় দেখে মেয়েটা নিজেও অস্থির হয়। তার কষ্টে মেয়েটাও কষ্ট পায়। নীড় এক দৃষ্টিতে কথার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন বাচ্চাদের মত ঘুমোচ্ছে। বাম হাতটা গালের নিচে দেওয়া।

-তুমি কেন আমাকে ঘৃণা করো না? কেন আমাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবো না? আমার থেকে পাচ্ছটা কি হ্যাঁ? কিছুই তো না। তবুও আমাকে নিয়ে তোমার এত মাথাব্যথা কেন? আমাকে অস্থির দেখে নিজেও অস্থির হও। আমার কষ্টে নিজেও কষ্ট পাও। তুমি কি আমাকে তোমার মায়ায় জড়াতে চাও? পারবে না। কেন ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছ। আমাকে তুমি কোনোদিনও বদলাতে পারবে না। আমার সাথে থাকলে কোনোদিনও সুখী হতে পারবে না। তার থেকে ভালো তুমি চলে যাও।’

নীড় কথাগুলো বলা শেষ করেও কথাকেই দেখছে। কথাকে যেভাবেই হোক তার জীবন থেকে বের করতে হবে। নীড়ের মাথায় অতি নীচু মানের একটা আইডিয়া আসছে। এতে ৮০% কাজ হলেও হতে পারে। কথাকে এখন ঘুম থেকে তুলে বিনা কারণে ওর গালে ঠাস ঠাস কয়েকটা চড় লাগালে মেয়েটা এমনিতেই তাকে ভয় পাবে। অন্তত এই কাজের পর তাকে পাগল ভাবতে শুরু করবে। আর একটা পাগলের সাথে কোন মেয়েই সংসার করার কথা ভাববে না। বেডের একেবারে কোণায় শুয়েছিল কথা। ওপাশ ফিরতেই ধপাস করে নিচে পড়বে। নীড় এতদিনে এটা বুঝতে পেরেছে কুকুরে কথার ভীষণ ভয়। জ্যাকির ভয়ে বেচারি নীড়ের পায়ের কাছে শুয়েছিল। একটু একটু করে আসতে আসতে এখন সে নীড়ের জায়গা দখল করে শুয়ে আছে। ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরতে যাচ্ছিল কথা। ও পড়ে যাবে ভেবে নীড় ওকে পাশ ফিরতে না দিয়ে কথার মাথার নিচে হাত দিয়ে ওকে আরও নিজের কাছে টেনে আনলো। কথা বিড়ালছানার মত নীড়ের বুকে মুখ ঘষে দিয়ে ভীষণ ঘুমে চলে গেল।
—————-
কথা ঘুমের মধ্যে অনুভব করছে কেউ ভারী একটা কিছু ওর উপর চাপিয়ে দিয়েছে। জিনিসটা ক্রমশ ওর গলা চেপে ধরছে। শ্বাস টানতে কষ্ট হচ্ছে। বুক ভরে দম নেওয়ার জন্য ছটফট করছে কথা। এভাবেই তার ঘুমটা ভেঙে গেল। চোখ খুলে উঠতে বসতে যাবে তখন কথা খেয়াল করল সত্যি নীড়ের একটা হাত ওর গলার উপর। নীড়কে নিজের এত কাছে দেখে চোখ ছানাবড়া ওর। লাফিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়ল। নীড় এখনও ঘুমাচ্ছে। চোখ বড় বড় করে নীড়কে দেখছে ও। দোয়া দরুদ পড়ে বুকে ফুঁ দিল।

-আল্লাহ! একটা মানুষের হাত এতটা ভাড়ী! আর একটুর জন্য দম আটকে মারা যেতাম। নির্ঘাত আজরাইলকে ফাঁকি দিয়ে চলে এসেছি। আজরাইল ব্যাটা আমাকে ধরেই ফেলছিল।’

কথা তীক্ষ্ণ চোখে নীড়কে দেখছে। তার ঠিক ঠিক মনে আছে নীড়ের পায়ের কাছে শুয়েছিল সে। এখানে কীভাবে এলো? আর সে যে রাতে নীড়কে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে ছিল এটা কি নীড় জানে? তাকে এভাবে দেখেছে?

-না দেখেনি। দেখবে কীভাবে? আর দেখলেও উনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে ফেলেননি! এটা কীভাবে সম্ভব!’

নীড়ের মাথা বালিশ থেকে পড়ে আছে। ঘাড়টা কীভাবে কাত হয়ে আছে। কথা খুব সাবধানে নীড়কে না জাগিয়ে ওর মাথা বালিশে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারল না। নীড়ের এতটা কাছে যেতেই কথার বুকের ভেতর কেমন করতে লাগল। তাড়াহুড়ো করে নীড়ের থেকে দূরে সরে এলো। কথার মনে হচ্ছে ঘুমন্ত মানুষটা তাকে দেখতে পারছে। এক্ষুনি ধমক দিয়ে বলে উঠবে,

-তোমার সাহস তো কম না৷ তুমি আমাকে ছুঁয়েছ! তোমার এই অপরাধের শাস্তি হলো, তোমার দু’টো হাতই কনুই থেকে কেটে ফেলে দিব।’

কথা ভয় পেয়ে দু’হাত চোখের সামনে ধরে দেখল। না বাবা থাক, তার হাত তার ভীষণ প্রিয়। হাত না থাকলে খাবে কীভাবে? নীড় যেভাবে আছে সেভাবেই থাকল। কথা ওকে বালিশে তোলার চেষ্টা করল না। জ্যাকির দিকে চোখ গেল কথার।

-ইশ! বেচারা কী ভোগান্তিটাই না ভুগছে। তুই কি জানিস পাঁজি কুত্তা তোর জন্য আমার বরটা পুরোটা রাত ঘুমায়নি। আমার বর তোকে তার বউয়ের থেকেও বেশি ভালোবাসে। দোষ তোর না বুঝলি। দোষ আমার কপালের। আমার ভাগের ভালোবাসাটুকুও তোর কপালে জুটছে।’
———-
কথা কলেজে চলে এসেছে। ক্লাসে বসেও সে আজ সকালের কথাটাই ভাবছে। সে জ্যাকিকে ভয় পায় এটা ঠিক। জ্যাকিও যেন তাকে ইচ্ছে করেই ভয় দেখায়। কিন্তু আজ জ্যাকি তাকে দেখে ওরকম কেন করল? বাবাকে চা দিয়ে কথা দেখতে এসেছিল নীড়ের ঘুম ভেঙেছে কি-না। কিন্তু সে ঘরে ঢোকার সাথে সাথে জ্যাকি এমন চেঁচাতে লাগল! কথা ভয়ে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। দৌড়ে পালানোর জন্য তার পা চলছিল না। জ্যাকির যদি পা ভাঙা না থাকতো তাহলে মনে হয় জ্যাকি আজ ওকে ছিড়েখুঁড়ে খেয়ে ফেলত। জ্যাকির এমন চিৎকারে হুড়মুড় করে নীড় উঠে বসে। জেগে উঠেই জ্যাকির আচরণে নীড় নিজেও হতভম্ব। জ্যাকির দৃষ্টি অনুসরণ করে কথাকে দেখল সে।

-কী করেছ তুমি ওকে?’

কথার মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরুলে তো! কথা বোবা হয়ে চেয়ে আছে। তার পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে।

-কী হলো? কথা বলছো না কেন? কী করেছ তুমি ওকে?’

-বি-বিশ্বাস করুন। আ-আমি কিছু করিনি। আল্লাহর কসম আমি কিছু করিনি। আমি তো দেখতে এসেছিলাম আপনার ঘুম ভেঙেছে নাকি। ঘরে আসার সাথে সাথে জ্যাকি এমন করছে। আমি ওর কাছেও যাইনি।’

কথা মিথ্যে বলছে না এতটুকু বুঝতে পারল নীড়। কিন্তু জ্যাকির আচরণ তার কাছে স্বাভাবিক লাগছে না। কথাকে দেখেই কেন এমন করবে সে? কথা ওর কী করেছে? কথার সাথে জ্যাকির কিসের শত্রুতা!

-সত্যি কিছু করোনি?’

-আল্লাহর কসম বলেছি তো! তারপরও বিশ্বাস করছেন না!’

নীড় কথাকে বাদ দিয়ে জ্যাকির দিকে নজর দিল। জ্যাকিকে কোন ভাবেই শান্ত করা যাচ্ছে না। নীড় ওর গলার লোমে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। পিঠ চুলকে দিচ্ছে। গাঢ় স্নেহের গলায় বলছে,

-কী হয়েছে? কী হলো তোর? এরকম করছিস কেন? শান্ত হ। আমাকে বল কোথায় সমস্যা হচ্ছে তোর?’

জ্যাকি নীড়ের চোখে চোখ রেখে কিছু বলতে চাচ্ছে যেন। কিন্তু বেচারা কথার বলার ক্ষমতা নেই। যার কারণে নীড়কে তার মনের অনুভূতি জানাতে পারছে না। বারবার জ্যাকি কথাকে দেখিয়ে নীড়কে কিছু বলতে চাচ্ছে।

-ওকে পছন্দ না তোর? হ্যাঁ বল না। ওকে তোর ভালো লাগে না?’

-আমি সত্যিই কিছু করিনি। ও আমাকে ভয় দেখায়। কিন্তু তার জন্য ওর উপর আমার একটুও রাগ নেই। বিশ্বাস করুন, আমি সত্যি বলছি।’

জ্যাকির অস্থিরতা দেখে নীড় মেজাজ ঠিক রাখতে পারছে না। এর আগে তো কোনোদিনও জ্যাকি এরকমটা করেনি। সে শান্ত নিরীহ একটি প্রাণী। কথার মত অপছন্দ জ্যাকি কোন মানুষকেই করেনি। কথায় প্রথম জন যাকে জ্যাকি দেখতে পারে না। কিন্তু কেন? এর পেছনে কোন কারণ তো নিশ্চয় আছে। সবকিছুর পেছনেই কোন না কোন কারণ থাকে। কথার উপর চেঁচিয়ে উঠল নীড়।

-তুমি দয়া করে ওর সামনে থেকে যাও তো। জ্যাকি তোমাকে পছন্দ করে না।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল কথা। সবই তার কপাল। বর তো তাকে পছন্দ করে না-ই। বরের কুকুরটাও তাকে পছন্দ করে না। সে এতটাই বাজে মেয়ে। মা-ও তাকে পছন্দ করে না। তাকে সবার এত অপছন্দ কেন? সে তো সবার মনের মতন হতে চায়। সবার প্রিয় হয়ে থাকতে চায়৷

-কী! ক্লাসে মন না থাকলে ক্লাসে আসো কেন? বসে আছো এখানে কিন্তু মন পড়ে আছে অন্য কোথাও? তোমার সমস্যা কী? পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না!’

কখন যে স্যার এসে কথার সামনে দাঁড়িয়েছে কথা তা লক্ষ করেনি। মনে হয় অনেকক্ষণ ধরেই স্যার তাকে দেখছে। ক্লাসের সবার দৃষ্টি এখন কথার দিকে। তার হেটার্স হিংসুটে মেয়েগুলো হাসছে। স্যার ধমক দিলেন,

-সাইলেন্স! তুমি বলো, মনোযোগ কোথায় তোমার? মন কোথাও থাকে?’

একটা মেয়ে বলে উঠল,

-বরের কাছে।’

পুরো ক্লাসে আবার হাসির রোল পড়ল। রাগে কথার গা জ্বলছে৷ এই মেয়েটাকে কিছু বলে না বলে বাড় পেয়ে গেছে। স্যার আবার ধমকালেন,

-শাটআপ!’

-স্যার কয়দিন আগে কথার বিয়ে হয়েছে। বেচারি নতুন নতুন সংসারী হয়েছে। এখন কি আর পড়াশোনায় মন বসবে? ক্লাসে তো এমনি আসে। দেখছেন না মনোযোগ অন্য কোথাও।’

কথাকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করছে। অপমানে চোখে পানি এসে গেল কথার।
——-
ছুটির পরে আজও ওই লোকটার সাথে দেখা হয়ে গেল কথার। সৌভিক কথার জন্যই প্রায় দশ মিনিট ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছে। কথাকে দেখেই একগাল হেসে এগিয়ে এলো। কথা প্রথমে ওকে দেখেনি। চলে যাচ্ছিল সে, সৌভিক ছুটে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

-কথা! কোথায় যাচ্ছ? মন খারাপ নাকি?’

কপাল কুঁচকে চোখ ছোট ছোট করে সৌভিককে দেখছে কথা। এই লোকটা আজও তাকে জ্বালাতে চলে এসেছে? কেন? কথা সৌভিককে এড়িয়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু সৌভিক ওর পিছু ছাড়ছে না।

-কী হয়েছে? মন খারাপের কোন কারণ থাকলে আমাকে বলতে পারো।’

কথা হুট করে থেমে গেল। ঝাঁঝালো গলায় বলল,

-কেন? আপনি কে? আমি আপনাকে চিনি? আমার আপনজন আপনি? আমার কাছের কেউ? আমার বন্ধু, ভাই, বর? কে আপনি? কেন বিরক্ত করছেন আমাকে?’

সৌভিক ভরকে গেল। কারণ এরকম কিছু একটা হবে ভাবেনি সে। কথা মনে হয় আগে থেকেই কোনোকিছু নিয়ে রেগে আছে। আর সে-ই রাগটা ওর উপর ঢালছে।

-আমি তোমার কেউ হই না সত্য। কিন্তু তুমি চাইলে আমি তোমার ভাইয়ের জায়গা নিতে পারি। সেদিন বলেছিলাম না তোমার মত আমারও একটা বোন ছিল। কিছু কারণে সে এখন আমার চোখের সামনে নেই। আসলে কি জানো কথা, তোমার মাঝে আমি আমার ওই বোনকে খুঁজে পাই।’

কথার সব রাগ পানি হয়ে গেল। মানুষটার উপর শুধু শুধু চোটপাট করে ফেলেছে সে। এই লোকের মনে বদ কোন উদেশ্য নেই। মানুষটাকে তাকে বোন বানাতে চাচ্ছে। তার ভাই হতে চাচ্ছে।

-সরি। কথাগুলো ওভাবে বলা ঠিক হয়নি। আসলে আজ আমার মনটা খারাপ ছিল।’

-কেন? কী হয়েছে? কলেজে কোন ছেলে তোমাকে বিরক্ত করেছে? আমাকে শুধু একবার বলো। হাতপা ভেঙে দেব শালার।’

কথা হেসে ফেলল। বলল,

-হাতপা ভাঙতে হবে না। ওরকম কিছু না। আচ্ছা আপনার বোন এখন কোথাও? আপনার সাথে নেই কেন?’

-তুমি যদি আমাকে ভাই মনে করো তবেই বলব।’

-আমার ছোট দুইটা ভাই আছে। কিন্তু আমার অনেক শখ ছিল, আমার যদি বড় একটা ভাই থাকত।’

-আমাকে ভাই বানাবে তো তুমি?’

-হুম।’

চলবে_
@মায়ামহল (নিপা’র গল্প)
বিঃদ্রঃ রিচেক দেওয়া হয়নি। পাঠক কষ্ট হলেও কমেন্ট করবেন। এটা অনুরোধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here