#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ১৯|
-সিঁথি। আমার বোনের নাম সিঁথি।’
সিঁথি! নামটা তো, তার মানে ইনি মুসলিম না! তাহলে তাকে বোন বানাতে চাইছে কেন? এটা কেমন কথা হলো! কথাকে কিছু ভাবতে দেখে সৌভিক হাসল।
-তুমি ঠিকই ভাবছো। আমি তোমাদের ধর্মের না। কিন্তু তাই বলে কি আমাকে ভাই বানানো যাবে না?’
-তেমন না।’
-তাহলে কী ভাবছ?’
-কিছু না।’
-আমার বোনটাকে আমি অনেক ভালোবাসতাম। প্রতি বছর ও আমাকে রাখি বাঁধত। আমি বোনকে রক্ষা করার কথা দিতাম। কিন্তু আফসোস! আমার কথা আমি রাখতে পারিনি। রক্ষা করতে পারিনি ওকে।’
-আপনার বোন, সিঁথি ও কি মারা গেছে?’
-হুম।’
কথা স্তব্ধ হয়ে গেল। মানুষটার বোন এখন আর এই পৃথিবীতে নেই। কথাকে সেই বোনের মত লাগে বলে তাকে বোন বানাতে চাচ্ছে! আর কথা কত কিছুই না ভেবে বসে ছিল। ছি! নিজের চিন্তাভাবনা এতটা ছোট। মানুষটা খারাপ না।
-কীভাবে মারা গেছে?’
সৌভিক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পুরোনো কথাগুলো মনে করলে রক্ত গরম হয় ওর। ওই কুলাঙ্গারটাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলতে ইচ্ছে করে।
-ওসব কথা আমি আর মনে করতে চাই না কথা।’
-আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আর জিজ্ঞেস করব না।’
সৌভিক হাঁটতে হাঁটতে ভাবছে, কথা মেয়েটা তার ভাবনার থেকেও বেশি সরল। এই মেয়েকে ব্যবহার করতে বিবেকে বাধবে ওর। কিন্তু কিছু করার নেই। সে নিরুপায়। কথাকে ব্যবহার না করলে নীড়কে শায়েস্তা করা যাবে না। নীড়কে শাস্তি দিতে হলে কথাকে কষ্ট দিতেই হবে।
-কিছু খাবে কথা? তোমার নিশ্চয় খিদে পেয়েছে।’
-না। আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে। চলুন না আমার সাথে।’
-কোথায়?’
-আমাদের বাসায়।’
-না। মানে আজ না অন্য একদিন।’
-আপনি আমাদের বাসায় যান না কেন? বিয়ের সময়ও আপনাকে দেখিনি। আপনি তো উনার বন্ধু। তাহলে যান না কেন?’
-নীড়ের কোন বন্ধুরাই ওর বাড়িতে যায় না। তোমার শ্বশুর পছন্দ করেন না।’
-ওহ।’
-নীড়কে আমার কথা বলেছ তুমি?’
-না। জানেন, কাল না উনার কুকুর জ্যাকির পা ভেঙে গেছে।’
জ্যাকি বেচারার জন্য সৌভিকেরও খারাপ লাগছে। কিন্তু নীড় কষ্ট পাচ্ছে শুনে মনে শান্তি পাচ্ছে। জ্যাকির মধ্যে নীড়ের আত্মা।
-সে কী! কীভাবে হলো?’
-জানি না। বেচারাকে নিয়ে উনি ভীষণ চিন্তিত। সময় পেলে কাল পরশু যাবেন। আমি উনাকে জানিয়ে রাখব।’
-না। কথা তুমি না আমার কথা এখন নীড়কে বলো না। হঠাৎ করে একদিন তোমাকে আমার বোন হিসেবে ওর সামনে দাঁড় করিয়ে নীড়কে চমকে দেব। তুমি ওকে বলবে আমি তোমার ভাই।’
-আচ্ছা। আজ তাহলে আমি যাই।’
-সাবধানে যেও কেমন।’
—————–
রমিজা খালা কথাকে কীভাবে যেন দেখে। এই বিষয়টা কাল সন্ধ্যার পর থেকেই কথার নজরে পড়েছে। রমিজা খালা তাকে কিছু বলতে চাচ্ছে। কিন্তু কী ভেবে যেন বলছে না।
-রমিজা খালা, তুমি আমাকে কিছু বলবে?’
রমিজা ইতস্তত করছে। একটা কথা তার মনে আসছে। কিন্তু বলার সাহস হয়ে উঠছে না। সে এই বাড়ির কাজের লোক। তার উপর বড় সাহেব ছেলের বউকে যা ভালোবাসে! বৌমার জন্য রমিজার চাকরি খেতে তিনি একবার ভাববেন না।
-কী হলো? কিছু বলবে।’
-কথাটা আমার মনে এমনেই আইছে। কোন কারণ নাই। তুমি কিছু মনে করবা না তো।’
-না। কিচ্ছু মনে করব না। তুমি বলো।’
-কাল সন্ধ্যার আগে আগে তুমি কই গেছিলা?’
-আমি! সন্ধ্যার আগে! কই, কোথাও যাইনি তো।’
রমিজা অবাক হয়ে কথাকে দেখছে। মেয়েটা চোখে মুখে মিথ্যা বলছে! তার চোখের সামনে দিয়ে গেছে। সে ডেকেছে তবুও দাঁড়ায়নি। এখন মুখ মুছে অস্বীকার যাচ্ছে।
-কোথাও যাও নাই?’
-না।’ কথা মনে করার চেষ্টা করছে। না, সে কোথাও যায়নি। হেসে কথা বলল,
-না গো, কোথাও যাইনি৷ গেলে মনে থাকত।’
রমিজা মনে মনে আশ্চর্য হচ্ছে। এই মেয়েকে সে কী ভেবেছিল। আর এই মেয়ে কী বের হলো! কে বলেছে এই মেয়ে বোকা! আস্ত চালাক। কী সুন্দর হেসে হেসে মিথ্যা বলছে। মুখ দেখে কেউ বলতেই পারবে না যে, এই মেয়ে মিথ্যা বলছে।
-তুমি কাল বাগানে যাও নাই? আমি তোমারে ডাকছিলাম। তুমি মনে হয় শুনো নাই।’
-আমি কাল বাগানেই যাইনি। তুমি ডাকবে কীভাবে শুনি?’
-অহ তাইলে মনে হয় আমার ভুল হইছে।’
-বুড়ি হয়ে যাচ্ছ বুঝলে। স্মৃতি শক্তি দুর্বল হচ্ছে। রোজ বাদাম খাবে। তাহলে সব মনে থাকবে।’
কথা চলে গেলে রমিজা তিক্ত স্বরে বলল,
-স্মৃতি আমার ঠিকই আছে। তোমার চালচলনই ঠিক নাই। কাল আমার সামনে দিয়া বাগানে গেছ। তার একটু পরেই মতিন চাচা জ্যাকিরে ওই অবস্থায় বাগানে পাইছে। জ্যাকি তোমারে দেখলেই চিল্লায়। বয়স তো এমনি এমনি হয় নাই নতুন বউ। মাথার চুল এমনিই পাকে নাই। দুনিয়ায় দানাপানি পেটে পইরাই বুড়ী হইছি। তোমার চালাকি আমি ধরতে পারমু না ভাবছ। তোমাকে যেমন দেখা যায় তুমি আদতেও তেমন না।’
কথা ঘরের দিকে যেতে যেতে ভাবল। রমিজা খালা ওসব কী বলছিল। সে কাল সন্ধ্যায় কখন বাগানে
গেছিল? আর গেলেও এখন মনে পড়ছে না কেন? কালকের কথা আজকে পুরোপুরি ভুলে যাবে এমনটা কীভাবে সম্ভব! দূর! রমিজা খালার মাথা ঠিক নেই। পাগলের মত কত কথাই তো বলে।
———–
-আপনার বন্ধু বান্ধবরা কি কখনও বাড়িতে আসে না?’
নীড় বাঁকা চোখে কথার দিকে তাকাল। হঠাৎ তার বন্ধুদের নিয়ে পড়লো কেন?
-আমার কোন বন্ধু নেই।’
-মিথ্যা বলছেন কেন?’
-আমি মিথ্যা বলছি এটা তুমি এত শিওর দিয়ে বলতে পারছ কীভাবে?’
-না সবারই তো বন্ধু থাকে৷ আপনার নেই এটা কেমন কথা!’
-আমি সবার মত না বুঝলে। সবার থেকে অনেক আলাদা আমি।’
-হু দেখতেই পারছি।’
– আমার সামনে বিড়বিড় করে কথা বলবে না। যা বলার ঠাসঠাস বলবে।’
-আপনি এমন কেন? জন্ম থেকেই এমন ছিলেন? নাকি বড় হয়ে হয়েছেন।’
নীড় রাগী চোখে কথার দিকে তাকাল। সে কিছু বলার আগেই মতিন চাচা দরজার সামনে থেকে বলল,
-নতুন বউ তোমার বাপের বাড়ি থেকে একজন আসছে।’
বাপের বাড়ি থেকে কে আসতে পারে? শিমুল এসেছে হয়তো। তার বিয়ের পর শিমুলটা একবারও বোনের শ্বশুরবাড়ি আসেনি। পলাশ এসে দুই দিন থেকে গিয়েছিল সেবার। বাপের বাড়ি থেকে মানুষ এসেছে শুনলেই যেন কেমন খুশি খুশি লাগে।
-কে এসেছে গো মতিন চাচা?’
-সোহান। হ সোহান নামের এক পোলা।’
কথা খুশিতে চিৎকার করে উঠল। সোহান ভাই! সোহান ভাই তার শ্বশুরবাড়িতে এসেছে! সত্যিই কি এসেছে! কথা হুড়মুড় করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
-সত্যিই সোহান ভাই এসেছে? তুমি ঠিক জানো তো!’
নীড় হতবুদ্ধি হয়ে কথাকে দেখছে। কে এই সোহান ভাই? যার নাম শুনে কথা খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেছে। এভাবে ছুটে গেল যদি উস্টা খেয়ে পড়ে যায়, নির্ঘাত নাক ভাঙবে। সোহান নামের ছেলেটাকে দেখার নীড়ের কৌতূহল হচ্ছে। তার বউ সোহান ছেলেটার জন্য রীতিমতো পাগল বোঝা যাচ্ছে। কথা এটুকু জায়গা কীভাবে এসেছে সে নিজেও জানে না। উড়ে এসেছে নাকি ছুটে এসেছে। সোহান ওকে দেখে হাসছে।
-আস্তে আয়। পড়ে যাবি। ছুটছিস কেন? আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি?’
কথা হাঁপাচ্ছে। সে এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না এটা সোহান ভাই।
-তুমি সত্যি এসেছ? আমি ঠিক দেখছি তো?’
সোহান কথার মাথায় হাত রাখল। মেয়েটা চলে আসার পর কথাদের বাড়ির সামনে দিয়ে গেলেও মনটা কেমন করে। আরও আগেই ওকে দেখতে আসতো। কিন্তু আসবে আসবে করে আর আসা হয়নি। নুড়ির কাছে তার সম্পর্কে কথার অভিযোগ শুনে আজ না এসে পারল না।
-সত্যি এসেছি রে পাগলী।’
কথা এতক্ষণ যতটা খুশি ছিল হুট করে তার সব খুশি নিভে গেল। মুখ কালো হয়ে গেল ওর। সোহান বুঝলো পাগলীটা অভিমান করেছে।
-দেখ কথা, তুই যদি এখন কাঁদিস তাহলে কিন্তু আমি চলে যাব। এতটা পথ কষ্ট করে এসে তোর চোখ পানি দেখতে পারব না।’
-আমি কাঁদব না। কিন্তু তোমার সাথে কথাও বলব না। বিয়ে দিয়ে তোমরা সবাই আমাকে পর করে দিয়েছ। না তুমি আমার খবর নিয়েছ। না আমার নিজের ভাইটা। আমি তো জানি তোমরা কেউ আমাকে ভালোবাসো না।’
-কে বলেছে তোকে? আমরা সবাই তোকে অনেক বেশি ভালোবাসি।’
নীড় দূরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছে। কপালে দু’চারটা ভাঁজ পড়েছে তার। তিরতির করে যেন রাগ উঠে যাচ্ছে। অথচ তার রাগার কোন কারণ নেই। এই ছেলেকে সে আগে কখনও দেখেনি। চিনেও না। তারপরেও এই ছেলেকে অসহ্য রকম বিরক্তি লাগছে কেন?
-তোর বর বাড়িতে নেই?’
-আছে। ও ঘরেই আছে। জানে না তুমি এসেছ। চলো আমার শ্বশুরবাড়ি ঘুরে দেখবে।’
-তুই ভালো আছিস তো কথা?’
-আমাকে দেখে কি তোমার মনে হয় আমি খারাপ আছি!’
-তারপরও তোর মুখ থেকে শুনতে চাই। কেমন আছিস তুই?’
-আমি অনেক বেশিই ভালো আছি সোহান ভাই। তুমি আমাকে নিয়ে ভেবো না।’
নীড় দাঁত কিড়মিড় করে ঘরে চলে এলো। এই বাড়িতে কথার ভালো না থাকার কোন কারণ আছে কি? কেন ভালো থাকবে না ও।
-আমরা কি ওকে টর্চার করি? খেতে পরতে দিই না! তাহলে ভালো থাকবে না কেন? কে হয় ও কথার? কথাকে নিয়ে এত মাথা ব্যথা কেন ওর?’
কথা সোহান ভাইকে কোথায় বসাবে, কী খাওয়াবে মাথায় তুলে রাখবে কি-না ভেবে পাচ্ছে না। আজ প্রথম সোহান ভাই তার সংসার দেখতে এসেছে। রমিজা খালাকে রান্নাবান্না থেকে ছুটি দিয়ে নিজেই সব রেঁধেছে কথা। রান্নাবান্না সে ক্লাস এইট থেকেই পারে। বাড়িতে তো সে-ই রাঁধত। কথা একবার রান্নাঘরে ছুটছে একবার সোহান ভাইয়ের কাছে যাচ্ছে।
-তুমি আমার ঘরে গিয়ে বসো না।’
-আমাকে নিয়ে তুই অত ব্যস্ত হচ্ছিল কেন? আমি এখানেই ঠিক আছি।’
-না ঠিক নেই। এই গরমের মধ্যে ফ্যানের নিচে বসবে চলো।’
-তোর পাগলামি আর গেল না!’
কথা হাসলো। আজ তার ঈদের দিনের মতন খুশি লাগছে। সোহান ভাই না জানিয়ে চলে এসেছে বলে আয়োজনে যেন কমতি না থাকে৷ বাবাকে কল করে বলে দিয়েছে দুপুরে যেন বাড়ি এসে খায়।
সোহান ভাই এতটা সময় ধরে এসেছে নীড় একবারও ঘর থেকে বেরোয় নি। কথার সামান্য মন খারাপ হলেও বুঝতে দিচ্ছে না সে। কথা মনে মনে প্রার্থনা করছে নীড় যেন সোহান ভাইয়ের সাথে খারাপ আচরণ না করে। মানুষটা এই বাড়ি থেকে কষ্ট পেয়ে গেলে কথারও আর এখানে থাকতে ভালো লাগবে না। তার বুঝ হওয়ার পর থেকে সোহান ভাইকে নিজের ভাই ভেবে আসছে। তার চাওয়া পাওয়া সোহান ভাই-ই তো পূরণ করেছে। বাবা মারা যাবার পর কথার সব আবদার এই মানুষটার কাছেই ছিল। ফুচকা খাব টাকা দাও। আইসক্রিম খাব এনে দাও। সোহান ভাই তুমি বাজারে গেলে আমার জন্য মিষ্টি নিয়ে আসবে। কালো গুলো আনবে। সাদা মিষ্টি আমি খাই না।
শেষে সোহান ভাই পাড়ার সব ক’টা দোকানে বলে রেখেছে, কথা এসে যা চাইবে দিয়ে দিবে। ওর কাছে টাকা চেয়ো না। লিখে রেখো, আমি পরে দিয়ে দিব।
-সোহান ভাই, তুমি আমাকে শুধু দিয়েই গেছো। বিনিময়ে কিছুই চাও নি। তুমি চাইলেও আমি তোমাকে কী দিতাম বলো? আমার কি সেই সামর্থ্য আছে? তুমি আমার ভাই৷ বোন হিসেবে তোমার থেকে যেটুকু ভালোবাসা পেয়েছি এই জীবনে তার প্রতিদান হয়তো দিতে পারব না। সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার একটাই চাওয়া, তিনি যেন তোমাকে পৃথিবীর সব খুশি দেয়। তোমার প্রিয় জিনিস গুলোকে কখনও তোমার থেকে কেড়ে না দেয়। তুমি ভালো থাকলেই আমিও ভালো থাকব।’
বলতে বলতে কথার চোখে পানি এসে গেল।
চলবে🌸