চুপকথারা_বিষন্ন পর্ব-২৭

0
2787

#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ২৭|

কয়েকটা দিনের জন্য সবকিছু ফেলে অনেক দূরে চলে যেতে ইচ্ছে করছে কথার। এই বাড়িতে তার থাকা মূল্যহীন। একটা মেয়ে যে মানুষটার জন্য ঘর পরিবার আপনজন ছেড়ে আসে তার কাছেই যদি ভালোবাসা না পায়, তার কাছেই যদি তার মূল্য না থাকে তাহলে মিছেমিছি সংসারের মায়ায় জড়িয়ে পড়া অর্থহীন। আজ হোক বা কাল কথা জানে তাকে এই বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে। পুরোটা সকাল মন খারাপ করে বসে থাকল কথা। তার মনের ভেতর কী চলছে, নিজেকে কতটা শূন্য একাকী লাগছে তা বলার জন্যও কেউ নেই কথার।
শিমুলকে দেখে কথার সমস্ত মন খারাপ এক নিমিষেই উড়ে গেল। ভাইকে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ল সে। বিয়ের পর এই প্রথম শিমুল এই বাড়িতে এসেছে। বলাই বাহুল্য বোনের কথা ভীষণ ভাবে মনে পড়ছিল তার। তাই না জানিয়েই সকাল সকাল এসে হাজির। শিমুলের উপর কথার কিছুটা অভিমান জমলো। এতগুলো দিনে বোনকে দেখতে এলো! শিমুল কথাকে দেখে লজ্জা পেয়ে হাসলো। আজ স্কুল বন্ধ। বন্ধুদের সাথে এদিক দিয়েই যাচ্ছিল। বোনের বাড়ির এত কাছ থেকে বোনকে না দেখে চলে যাবে এটা হয় না। তার পরনের জামাকাপড় বোনের বড়লোক শ্বশুরবাড়িতে আসার জন্য পরন যোগ্য না।

-কেমন আছো আপু?”

কথার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। ছুটে গিয়ে শিমুলকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। শিমুলটা কি বড় হয়ে যাচ্ছে? দিনদিন তাল গাছের মত লম্বা হচ্ছে কেন? এখন তো কথাকেই তার ছোট বলে মনে হয়। ওর সাথে দাঁড়ালে কাঁধ সমানও হবে না।

-আমি ভালো থাকলেই কি আর খারাপ থাকলেই কি? আমার ভালো খারাপ দিয়ে তোর কী?”

-তার মানে তুমি ভালো আছো।”

-কেন এসেছিস?”

-বোনের শ্বশুরবাড়িতে ভাই কেন আসে? খেতেই তো আসে। ভালো-টালো কিছু রান্না করো।”

-দাঁত ভেঙে দিব তোর। তুই আমার ভাই না। ভাই হলে বোনের কথা নিশ্চয় মনে পড়ত। আমার কথা তোদের কারোর মনে পড়ে না। আমি তোদের কে? কেউ না।”

-তুমিই আমাদের সব।”

কথা প্রতিবাদ করতেই যাচ্ছিল পেছন থেকে নীড় এসে পড়ায় চুপ করে গেল। নীড় শিমুলকে বিয়ের দিন একবার দেখেছিল গাড়ি থেকে নামার সময়। তারপর আর দেখেনি। তবুও ওকে চিনতে অসুবিধা হলো না। কারণ শিমুলের চেহারা অনেকটাই কথার সাথে মিলে। শিমুল নীড়কে সামনে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। দুলাভাইয়ের সাথে এখন পর্যন্ত তার কোন কথাই হয়নি। বিয়ের দিন শুধু দেখেছিল এটা তার বোনের স্বামী। ব্যস! তারপর আর দেখাও হয়নি। আজ হঠাৎ করে এসে পড়লো। আসার আগে ভাবলোও না বোনের বাড়িতে খালি হাতে যাওয়া যায় না। নীড়ের সাথে কী কথা বলবে, কীভাবে কথা শুরু করবে এটা ভাবতে ভাবতেই নীড় বলে ফেলল,

-বড় শালাবাবু নাকি! কেমন আছো তুমি?”

শিমুল লজ্জিত মুখে হেসে জবাব দিল।

-ভালো। আপনি?”

নীড় কথাকে দেখল। মনে মনে বলল,

“আমার ভালো না থেকে উপায় আছে। তোমার বোনই তো আমার ভালো থাকার মেডিসিন। তোমার বোন চোখের সামনে থাকলে আমি শত খারাপ থাকার মাঝেও ভালো থাকার উপায় খুঁজে নেব। ওর জন্য ভালো থাকতে শিখে গেছি আমি।”

নীড় হেসে বলল,

-আমিও ভালো আছি। এসো বসো।”

-না, আমি বসব না। এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, ভাবলাম…

শিমুলকে কথা শেষ করতে দিল না নীড়।

-ভাবলে এসেছি যখন তখন বোনকে সাথে করে নিয়ে যাই, তাই না? মূল কথা বোনকে নিয়ে যাওয়ার জন্যই আসা হয়েছে।”

নীড় কথার বাবার বাড়ি যেতে চাইছিল। কথার রোগটা সম্পর্কে তাকে জানতে হবে। কিন্তু কোনোভাবেই কথাকে বলতে পারছিল না। হঠাৎ করে শ্বশুরবাড়ি যাব বললে কথাই সবার আগে তাকে সন্দেহ করত। শিমুল কী বলবে ভেবে পেল না। মা’কে না বলে এখানে এসেছে সে। সে যে আজ আপুকে বাড়ি নিয়ে যাবে এটা মা জানে না। ঘরে বাজার-সদাই কী আছে কে জানে? মা’র হাতে টাকাপয়সা আছে তো? বোন, বোনের জামাইকে নিয়ে গেলে ওদের আপ্যায়নও তো করতে হবে।
নীড় শিমুলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। শিমুল ইতস্তত করছে।

-না মানে, হ্যাঁ। আপুকে দেখার জন্য, নেওয়ার জন্যই এসেছিলাম।”

নীড় সোফায় বসতে বসতে বলল,

-বসো শালাবাবু। তা শুধু কি আপুকেই নিয়ে যাবে? দুলাভাইকে নিবে না?”

-আপনি যাবেন?”

শিমুল যতটা অবাক হয়েছে তার থেকে তিনগুণ বেশি অবাক তো কথা হয়েছে। চোখ বড় বড় করে নীড়কে দেখছে সে। নীড় বুঝতে পারছে কথা তার দিকে ভূত দেখার মতো চেয়ে আছে। তবুও কথার দিকে খেয়াল দিল না সে। যেভাবেই হোক শ্বশুরবাড়ি তাকে যেতেই হবে। কথা মনে মনে না বলে পারছেই না।

-মানুষটার হঠাৎ কী হলো হ্যাঁ? ভূতপ্রেত ভর করলো নাকি? আজব ব্যবহার করছে? রাতে ঘুম কম হয়েছে বলে এখন সকাল বেলা চলতে ফিরতে ঘুমোচ্ছে নাকি? দেখা গেল ঘুমের মধ্যেই এসব বলছে। ঘুম ভেঙে গেলে পল্টি খাবে। এই লোক নির্ঘাত পল্টি খাবে। শুধু শুধু শিমুলটাকে আশা দিচ্ছে। পরে উনি না গেলে বেচারা কষ্ট পাবে।”

-শালাবাবু নিতে এলে না যেয়ে উপায় আছে? বড় শালাবাবুর একটা মান আছে না?”

কথা হুট করে নীড়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তার চোখে মুখে সন্দেহ। নীড় কিছু বুঝে ওঠার আগেই কথা নীড়ের কপাল হাত রেখে কিছু বুঝতে চেষ্টা করল।

-কী করছ কথা?”

-দেখছিলাম আপনার মাথায় জ্বর উঠেছে কি-না। আপনি তো আবার জ্বরের ঘোরে আবোলতাবোল বলেন। হঠাৎ করে শ্বশুরবাড়ির প্রতি এত দরদ উথলে উঠেছে কেন? বিয়ের দিন যে আমাদের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলেন ওটাই তো আমার আর আমার বাপের বাড়ির মানুষের ভাগ্য। বিয়ের পরের দিনও তো আমি একাই গেলাম। আপনি সেদিন বাড়িতেই ছিলেন না। আমাকে আনতেও গেলেন না। আমি একাই এসেছি। আজ হঠাৎ কারো না বলাতেও জোর জবরদস্তি করে যেতে চাইছেন। মতলবটা কী হ্যাঁ?”

আপু দুলাভাইয়ের সাথে এভাবে কথা বলছে কেন? আপু কি কোনোদিনও বুঝতে না মানুষের সাথে এভাবে কথা বলতে হয় না। শিমুল ভয় পাচ্ছিল দুলাভাই যদি এখন রেগে যায়। রেগে গিয়ে ওদের বাড়িতে আর জীবনেও যেতে না চায়। আপুটা যে কী! কিন্তু না, নীড় তেমন কিছুই করল না। রাগের কোন লক্ষণই তার মাঝে দেখা গেল না। সে কথার হাত কপাল থেকে সরিয়ে নিজের হাতে নিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলল,

-যাও ঘরে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নাও। ওখানে গিয়ে কতদিন থাকতে চাও তুমি সে অনুযায়ী আমার কপাড় নিও।”

দুলাভাই সম্পর্কে শিমুল মনে মনে একটা ভুল ধারণা পুষছিল। দুলাভাই বড়লোক বলেই ওদের বাড়িতে যেতে চায় না। আপুকে বিয়ে করে সে ওদের উপর দয়া করেছে। কিন্তু এমনটা একদমই সত্যি না। এই মানুষটার মাঝে অহংকারের ছিটেফোঁটাও নেই।আজই শিমুল এই বাড়িতে প্রথম এসেছে। কিন্তু দুলাভাই তার সাথে এমন ভাবে কথা বলছে যেন এই বাড়িতে ওর আসা যাওয়া রোজই লেগে থাকে। আর সবথেকে বড় কথা, আপুর আজব উদ্ভট ধরণের কথাবার্তা গুলোও দুলাভাই সহজ ভাবে নেয়। আপুর কোন আচরণেই সে রাগ হয় না। আপুকে মানুষটা ভালো রেখেছে। এর থেকে বেশি আর কী লাগে?
কথা গভীর ভাবনায় নখ কামড়াতে কামড়াতে ঘরে এসে দাঁড়াল। একটা কথা তার মাথাতে কিছুতেই ঢুকছে না। নীড় হঠাৎ এত ভালো ব্যবহার করছে কেন তার সাথে?

-শিমুলকে দেখেই কি উনি এরকম করছেন? যাক একদিক দিয়ে ভালোই হলো। আমার ভাইটা তার আপুকে সুখী দেখতে চায়। আমি কষ্টে আছি জানলে বেচারা না পারবে কিছু করতে না পারবে সইতে।”

একটু পরে নীড়ও ঘরে আসে। কথাকে এখনও বসে থাকতে দেখে নিজেই আলমারি থেকে কাপড়চোপড় বের করতে থাকল।

-এখনও বসে আছ কেন তুমি? ব্যাগ গুছাও নি কেন?”

কথা উদাস গলায় বলল,

-আপনি যাবেন না।”

ভ্রু কুঁচকে নীড় ওর দিকে তাকিয়ে বলল,

-আমাকে তোমার বাবার বাড়িতে যেতে মানা করছো তুমি!”

কথা এটা বলেনি। তার কথার উল্টো মানে করছে লোকটা। সে সাথে সাথে বলে উঠল,

-আরে আমি এটা বলেছি নাকি? আপনি যে আমার বাপের বাড়ি যাবেন না এটা আমি জানি।”

-কীভাবে জানলে? আমি বলেছি তোমাকে?”

-না।”

-তাহলে?”

-আপনি সত্যিই যাবেন!”

-কথা, এক কথা বারবার বলার তোমার এই বদ অভ্যাসটা কিন্তু পাল্টাতে হবে। আমি এক কথা দুই বার বলা পছন্দ করি না। আর আমি যা পছন্দ করি না তা আমার বউ করতে পারবে না। বুঝেছ?”

কথা কিছুই বুঝেনি। এসব কি সত্যিই ঘটছে? কতক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল সে। নীড় খানিকটা বিরক্ত গলায় বলল,

-এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার!”

-আমি কিন্তু ওখানে গিয়ে এক সপ্তাহ থাকব।”

-ঠিক আছে।”

কথা তার ছোট্ট জীবনে আজকের থেকে বেশি অবাক কোনোদিনও হয়নি। অবিশ্বাস্য গলায় সে বলল,

-আপনিও থাকবেন ততদিন?”

-যাবার সময় বউয়ের সাথে যাচ্ছি। আসার সময় একা আসব নাকি?”

-বাবাকে না বলেই চলে যাব আমরা?”

নীড় কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,

-বরের সাথে যাচ্ছ তারপরও শ্বশুরের থেকে অনুমতি নিতে হবে?”

-অনুমতি না। কিন্তু জানিয়ে যাব তো নাকি?”

-তোমার ইচ্ছে হলে জানিয়ে আসতে পারো। যা করার তাড়াতাড়ি করো। শিমুল দাঁড়িয়ে আছে।”

কথা খুশি হয়ে গেল। তার মানে আজ সত্যিই বাবার বাড়িতে যাচ্ছে সে! নীড় তার সাথে মজা করছে না। বা তার অনুভূতি নিয়েও খেলছে না। সে সত্যিই কথাদের বাড়িতে যাবে। আলম ভাই, অনু, রেখা কাকী আরও পাড়ার সবাই নীড়কে দেখতে চাচ্ছিল। কথার বর হিসেবে নীড় সবার কাছে স্পেশাল। সেবার যায়নি বলে অনেকে অনেক কথা বলেছে। এইবার নীড়কে সাথে নিয়ে গিয়ে ওদের মুখে বিছুটি পাতা ঘষে দিবে।
নীড় আড়চোখে ওকেই দেখছিল। কথাকে খুশি হতে দেখে নিজেও মনে মনে হাসল।

-আচ্ছা আপনি তাহলে কী কী নিবেন গুছিয়ে নিন। বাবাকে বলে আসি আমি। আমার কাপড় আলমারির দ্বিতীয় কাবার্ডে আছে। শাড়ি বাদে সবকিছুই ব্যাগে রেখে দিন।”

কথাগুলো বলেই কথা দৌড়ে চলে গেল। নীড় চোখ ছোট ছোট করে ওর যাওয়ার দিকে চেয়ে আছে। পাগল মেয়ে তাকে ব্যাগ গোছাতে বলে গেল!

-খুশির চোটে মাথা খারাপ মেয়েটা সত্যিই পাগল হয়ে গেছে। আমাকে কাজের হুকুম দিয়ে গেছে? বাবা নীড়, বউয়ের আদেশ পালন করার অভ্যাস করে নে। দেখ এখন থেকেই কীভাবে হুকুম ঝাড়ছে।”

চলবে_

@মায়ামহল (নিপা’র গল্প)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here