#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ৩১|
কথা ওড়নার এক কোণা হাতে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে উদ্বিগ্ন মুখে উঠানে পায়চারি করে যাচ্ছে। বারবার গেটের দিকে দেখছে সে। এগারোটা বেজে গেল নীড় এখনও ফেরেনি। সোহান ভাই উনাকে নিয়ে কোথায় গেল! তাদের যে পাড়া! সন্ধ্যার পরেই চোর ছ্যাঁচোড় রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। নীড় রাস্তায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়ল না তো!
-না। উনি একা থাকলেও একটা কথা ছিল। কিন্তু সোহান ভাই তো উনার সাথেই আছে। সোহান ভাইকে পাড়ার ছোট বড় সবাই চিনে। তাহলে এখনও ফিরছে না কেন ওরা?”
কথা চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছে। তার উপর আশা তো আছেই। সে বকবক করে কথার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলছে।
-সব দোষ তোর। ছেলেটাকে ওই হতচ্ছাড়া সোহানের সাথে কেন যেতে দিলি। এবার বোঝ ঠেলা। সোহান ওকে ভুলিয়ে বালিয়ে কোথায় নিয়ে গেছে।”
-আহ! বাজে বকো না তো। উনি ফিডার খাওয়া কোন বাচ্চা না। উনাকে ভুলানো এত্ত সোজা!”
আশা থামছে না। সে ঘরে গিয়ে মনে যা আসছে বলেই যাচ্ছে। কথা অনেকক্ষণ আগে শিমুলকে নীড়ের খুঁজে পাঠিয়েছে। এখন শিমুলেরও কোন খবর নেই।
-আমার ভাইটাও হারিয়ে গেল নাকি! একজনকে খুঁজতে পাঠিয়েছি এখন তাকেই আমার খুঁজতে বের হতে হবে নাকি!”
কথা গেটের বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে চলে এলো। কেউ আসছে না। কারো গলাই তো শোনা যাচ্ছে না।
-দূর ছাতা! উনি বাচ্চা না। আমার উনার জন্য চিন্তা করে মাথা খারাপ করতে হবে না। শরীরে যথেষ্ট শক্তি আছে। সেই শক্তি যদি চোর ডাকাতের উপর কাজে লাগাতে না পারে তাহলে দরকার কী ওরকম বডি বানানোর!”
কথা ঘরে চলে গেল। তার একটু পরেই শিমুল নীড় একসাথে ফিরেছে। দু’জন কিছু একটা কথায় হাসতে হাসতে বাড়িতে ঢুকেছে। নীড় ঘরে যেতেই কথা ওর চোখের আগুনে নীড়কে পুড়িয়ে দিতে চাইল। ঝাঁঝালো গলায় কথা বলে উঠল,
-এটা কি আপনার বাবার বাড়ি পেয়েছেন যে, যখন খুশি তখন আসবেন? এটা আমার বাপের বাড়ি। এখানে এগারোটা যথেষ্ট রাত। একটু বেরিয়ে আসি বলে কোন জাহান্নামে গিয়েছিলেন শুনি? আপনার জন্য চিন্তা করে আমি কেন আমার মাথার চুল পাকাবো।”
কথার গলা এতটা চড়তে পারে তা আজকের আগে জানা ছিল না নীড়ের। বাড়িতে কথা কখনও এরকম চেঁচিয়ে কথা বলেনি। বাবার বাড়ি এসে মেয়েদের গলার জোর বেড়ে যায় নাকি! নীড় কথার রাগ আরও বাড়িয়ে দিতে চায় না। কৈফিয়ত দেবার সুরে সে বলতে চাইল,
-এগারোটা বেজে গেছে খেয়াল করিনি।”
-আপনি জীবনে কোন জিনিসটা খেয়াল করেন? কোনো কিছুই তো আপনার খেয়াল থাকে না।”
-কথাগুলো তো একটু আস্তেও বলা যায় তাই না!”
-আস্তে কেন বলব! এটা কি আপনার বাড়ি? আমি কি এই বাড়ির বউ? আমি এই বাড়ির মেয়ে, চেঁচিয়ে কথা বলব আমি।”
নীড় হাসল। কথার পাশে বসতে বসতে বলল,
-তার মানে আমাদের বাড়িতে তুমি যা যা করো তার অর্ধেকটাই অভিনয়!”
-আপনার মতো তো না আমি। অভিনয় করতে যাব কেন?”
-কারণ বাড়িতে তুমি কখনও আমার সাথে এভাবে চেঁচিয়ে কথা বলোনি। এখানে কিন্তু বলছো।”
-বলছি কারণ আপনার জন্য চিন্তা হচ্ছিল আমার। আমাদের পাড়া আপনাদের ভদ্র সোসাইটির মত ভালো না। এখানে অনেক অসভ্য অভদ্র মানুষ বসবাস করে। যদি তেমন কোন মানুষের খপ্পরে পড়তেন! আপনার সাথে কী করত ওরা জানেন? প্যান্টটা পর্যন্ত খুলে রেখে দিত।”
নীড় বিষম খেয়ে কাশতে লাগল। হাসিও পেল ওর। কথার টেনশনও ওর মতই ছেলেমানুষ। কোনোরকমে কাশি থামিয়ে নীড় বলল,
-আমাকে এতটা আন্ডারএস্টিমেট করো কেন তুমি! আমার প্যান্ট খুলে নেওয়ার মত সাহস তোমাদের পাড়ার ছেলেছোকরাদের বুকে আছে! ওদের এত বড় কলিজা আছে তোমার মনে হয়!”
কথা মুখ ফুলিয়ে বলল,
-অত কিছু জানি না আমি। আপনি ভীষণ বাজে মানুষ। আমাকে জ্বালিয়ে মনে হয় আপনি সুখ পান। তাই তো এমন করেন।”
নীড় কথাকে দেখল। নিজের অজান্তেই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ওর। কথাকে সে ভালোবেসেছে ফেলেছে। এটা কি কথা কোনোদিনও বুঝতে পারবে! কথার হাত ধরলো নীড়। অপরাধী মুখে বলল,
-তোমাকে জ্বালানোর জন্য আমাকে ক্ষমা করতে পারবে না কথা? আজকের পর থেকে তোমার টেনশন হবে এমন কোন কাজই করব না আমি। বেশি রাত করে বাড়ি ফেরা বন্ধ করে দেব। আর তুমি যা যা বলবে সব শুনব।”
সবচেয়ে বড় বিপত্তি ঘটল যখন ওরা রাতের খাওয়া শেষে নিজেদের ঘরে ঘুমোতে এলো। এসেছে পর থেকে কথা খেয়ালই করেনি এই ঘরে আগে দুইটা খাট ছিল। জানালার পাশে একটা ছিল, এটায় সে আর পলাশ ঘুমাতো। আর এখন যেখানে পড়ার টেবিল আছে সেখানে আরেকটা ছিল। ওটায় শিমুল একা থাকত। কিন্তু এখন একটাই আছে। আরেকটা গেল কই? কথা ভাবনায় পড়ে গেল। বিছানাটা এত ছোট এখানে একজনই ভালো করে থাকা যাবে। দু’জন শুতে গেলে সমস্যা হবে। নিজের ঘরের এত বড় পরিবর্তন কীভাবে কথার চোখে পড়ল না! মনটাই খারাপ হয়ে গেল ওর। নীড় কথাকে দেখছে। কিন্তু সে কী ভাবছে তা আন্দাজ করতে পারছে না।
-কী ভাবছো?”
-হু? কিছু না।”
কথা ভেবে নিয়েছে নিচে শুবে সে। নীড় উপরে থাকুক। মনে মনে হাসলো কথা। লোকটার এত বড় বাড়ি, এত বড় বেডরুম, এত বড় বিছানা রেখে এ কোথায় এসে পড়লো ভাবছে হয়তো। ভাবুক, কিছুই করার নেই। ওরা যে তাদের মত ধনী না তা দেখেই তো বিয়েটা করিয়েছে।
-আপনি বিছানায় শুয়ে পড়ুন।”
-তুমি ঘুমাবে না!”
-ঘুমাব। রাত তো ঘুমানোর জন্যই। আমার জেগে থাকার তো কোন কারণ নেই।”
-তাহলে আমাকে একা শুতে বলছ কেন? তুমি শুবে না।”
-আপনি বড্ড প্যাঁচাল পারেন! আমি কি একবারও বলেছি, আমি শুবো না।”
-কোথায় শুবে?”
-নিচে। বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখতেই পারছেন নিশ্চয়। এটা একজনের বিছানা। দু’জন আঁটবে না। আপনি এই বাড়ির জামাই রাজা। আপনাকে তো আর আমি মেঝেতে শোয়াতে পারি না। আমি মেঝেতে বিছানা করে নিচ্ছি।”
নীড় চোখ মুখ শক্ত করে এক ভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। কথা ওর দিকে না দেখে বলেই যাচ্ছে,
-মনে মনে ভাবছেন কী এক শ্বশুরবাড়ি পেলাম! গরিবের গরিব! বিয়ে করে আমি তো পুরাই ফেঁসে গেলাম।”
-হুম ফেঁসেছি ঠিকই। কিন্তু সেটা অন্য ভাবে।”
-কিছু বললেন?”
-না। কথা, ওসব রাখো। নিচে বিছানা করতে হবে না। দু’জন দিব্যি এই খাটে এঁটে যাব। তুমি শুধু শুধু আমাকে নিয়ে এত বেশি কেন ভাবো? আমার সমস্যা হবে কি-না সেটা আমি দেখে নিব। তোমাকে যা বলেছি তা করো। নইলে এখন শাশুড়ি মা’কে ডেকে দেখাব, উনার মেয়ে আমার কথা শুনছে না।”
-আপনি তো ভীষণ বাজে! আপনার ভালোর জন্যই তো আমি…
-আমার ভালো তুমি আমার থেকে বেশি বুঝো?”
———-
কথা গুটিসুটি মেরে নীড়ের বুকে ঘুমিয়ে আছে। এই মেয়েটার জাতীয় দলের হয়ে ফুটবল খেলা উচিত ছিল। দেশকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে দিতে পারত। একেক লাথি দিয়ে ওকে খাট থেকে ফেলে দেওয়ার উপক্রম করেছিল। এখন কেমন শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে। নীড় অপলক চোখে কথাকে দেখছে। কথা নড়ে উঠলে নীড় চোখ বন্ধ করে নিল। ঘুম ভেঙে নিজেকে এই পরিস্থিতিতে দেখে ছিটকে সরে গেল কথা। হুড়মুড়িয়ে খাট থেকে নেমে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নীড় চোখ বুজেই হেসে ফেলল।
-পাগলী একটা!”
কথা আজ নীড়কে বিশেষ একজনের সাথে দেখা করাতে নিয়ে যাবে। যাবার আগে কোনকিছুই বলল না কার সাথে দেখা করাতে চাচ্ছে সে৷ কিন্তু নীড় জানে। মানুষটা কথার মনের খুব কাছের। কথার পাতানো মা। নিজের মা’কে হারিয়ে সৎ মায়ের লাঞ্ছনা সহ্য করে ওই মানুষটার থেকেই তো মায়ের ভালোবাসা পেয়েছে কথা। নীড় নিজেও মানুষটাকে দেখছে চায়। কথাকে এতটা ভালোবাসা দেওয়ার জন্য মানুষটাকে ধন্যবাদ দিতে চায়।
-উমহ,,হাতটা টনটন করছে। ব্যথাও করছে একটু একটু।”
-কেন? কী হয়েছে?”
-কেউ একজন পুরোটা রাত আমার হাতকে বালিশ বানিয়ে নিয়েছিল।”
কথা বুঝতে পারল নীড় তার কথাই বলছে। তার দোষ কি? সে কি জেনে-বুঝে করেছে নাকি? উনিই তো জোর করলেন। কথা এই বিষয়টা এড়িয়ে গেল।
-গলিটা নোংরা। আপনার কষ্ট হচ্ছে তাই না? নাকে ধরে তাড়াতাড়ি পা চালান। এইতো এসেই পড়েছি।”
বাড়ির ভেতরে ঢুকে বাইরে থেকেই কথা ডাকল।
-ও পাতানো মা। কই গো তুমি?”
শিউলির শরীরটা দিন দিন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। এখন তো বিছানা ছেড়ে উঠতেই কষ্ট হয়। তবুও কথার গলা শুনে সময় নিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিল।
-বাড়ির মানুষ কই! এসে দেখবে না কে এসেছে।”
-কথা, ঘরে আয় মা।”
মানুষটার গলাটা কয়েকদিনে এরকম পাল্টে গেল কীভাবে? চেনাই যাচ্ছে না। পাতানো মা’র গলা তো এরকম ভাঙা ছিল না। ওর অসুখটা কি সারেনি?
কথা ঘরে ঢুকলো। নীড় বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকল।
-কী হয়েছে তোমার?”
-কিছু হয়নি রে। কবে এসেছিস তুই?”
-গতবারও তুমি এই কথা বলেছ। কিছু হয়নি তোমার। তাহলে স্বাস্থ্যের এই দশা কী করে হলো?”
-বয়স হচ্ছে স্বাস্থ্য আর কত ভালো থাকবে। একা এসেছিস?”
-না। তুমি সবসময় কথা ঘুরিয়ে নেও।”
-জামাইও এসেছে? কই ও। ওকে তুই বাইরে একা দাঁড় করিয়ে রেখেছিস! হায়, তোর কবে বোঝ হবে।”
নীড় এসেছে শুনেই কেমন চঞ্চল হয়ে উঠল শিউলি। তার নীড় এসেছে। সেই ছোট্ট নীড়। নিজের হাতে যাকে খাইয়েছে। বড় করেছে। আজ কতটা বড় হয়েছে ও? দেখতে কেমন হয়েছে!
-নীড়কে ঘরে আসতে বল। ওকে আমার কাছে নিয়ে আয়।”
-অত অস্থির হচ্ছ কেন তুমি! শান্ত হয়ে বসো তো।”
কথা ঘর থেকেই গলা উঁচিয়ে ডাকল,
-শুনছেন, বাইরে দাঁড়িয়ে না থেকে ভেতরে আসুন।”
নীড় ইতস্তত করছিল। এভাবে কোন মহিলার ঘরে যাওয়া অস্বস্তিকর। কিন্তু এখানে সে এসেছে তো এই কারণেই। শিউলিও নীড়কে ডাকল।
-এসো বাবা। লজ্জা পেয়ো না।”
নীড় ঘরে এসে যে মানুষটাকে দেখল, তাকে দেখে পুরোপুরি বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। এখানে আসার আগে বা এখানে এসে এই সময়টুকু বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে একটা বারের জন্যও এটা ভাবে এই মানুষটাকে দেখতে এসেছে সে। এত বছর পর নিজের অজান্তে এই মানুষটার সামনে দাঁড়াতে হবে। নীড়কে দেখে শিউলি চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না। তার চোখ অশ্রুসিক্ত। নীড় কয়েক মুহূর্ত ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে গেল। ওর এরকম আচরণে কথা যথেষ্ট হতভম্ব। শিউলি মুখ চেপে কাঁদছে। নীড় এখনও তাকে ক্ষমা করেনি। শিউলি ভেবেছিল এতদিনে হয়তো নীড়ের রাগে ভাটা পড়েছে। কিন্তু না। কথা উঠে নীড়কে ডাকতে ডাকতে দরজা পর্যন্ত এলো। পেছন থেকে নীড়কে ডেকে যাচ্ছে সে।
-শুনছেন, চলে যাচ্ছেন কেন আপনি? দাঁড়ান। শুনুন।”
কথা শিউলির দিকে তাকাল। কিছুই বুঝতে পারছে না সে। শিউলিকেই সে জিজ্ঞেস করছে,
-উনি চলে যাচ্ছে কেন? হঠাৎ কী হলো উনার?”
চলবে_
@মায়ামহল (নিপা’র গল্প)