চুপকথারা_বিষন্ন পর্ব-৩২

0
3451

#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ৩২|

নীড়কে ধরতে কথার রীতিমতো দৌড়াতে হচ্ছে। কিন্তু নীড় এতটাই দ্রুত হাঁটছে তবুও নীড়ের নাগাল পাচ্ছে না সে। কথা পেছনে ছুটতে ছুটতে ডাকছে,

-শুনুন, দাঁড়ান। কোথায় যাচ্ছেন আপনি? দাঁড়ান না। হঠাৎ চলে যাচ্ছেন কেন?”

কথার গলা কানে গেলেও নীড় হাঁটার গতি কমাচ্ছে না। অজানা এক রাগে তার সমস্ত শরীর রি রি করছে। ওই মানুষটার প্রতি তার রাগটা না যতটা তার থেকেও বেশি ঘৃণা। কথার পাতানো মা এই মানুষ হবে জানলে কখনও এখানে আসতে রাজি হতো না সে। এই মহিলা আর যাই হোক কারো মা হওয়ার যোগ্য না। কথার মা তো না-ই।

-শুনছেন, দাঁড়ান প্লিজ। কী হয়েছে আপনার? এমন করছেন কেন? ও জামাই!”

নীড় দাঁড়াল। কিন্তু কোনোভাবেই রাগটা কমছে না তার। কথা নীড়ের সামনে এসে দাঁড়াল। হাঁপাচ্ছে সে। নীড়ের মুখের দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টি ফেলে কিছু বুঝতে চাইল কথা। নীড়ের চোখের ভাষায় কী বুঝতে পারল সে-ই জানে। রাগ করতে পারল না কথা। অনুনয়ের সুরে বলল,

-পাতানো মা’র সাথে কথা না বলেই চলে এসেছে কেন আপনি?”

-তুমি মানুষ চিনতে শিখবে কবে, কথা?”

কথা ঠিক বুঝল না। নীড় হঠাৎ এমন রাগ দেখাচ্ছে কেন? কিছুটা বিস্ময় প্রকাশ করল সে। কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করল,

-হ্যাঁ! ”

-যাকে তাকে কেন এতটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দিতে হবে তোমার?”

-আপনি ঠিক কী বলছেন আমি না বুঝতে পারছি না। একটু পরিষ্কার করে বলবেন, যাতে আমি বুঝতে পারি।”

নীড়ের গলা চড়ে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করল নীড়। কথার সাথে চোটপাট করা যাবে না। কথা কিছুই জানে না। ওই মানুষটাকে কথা তার জীবনের অনেকটা জায়গা দিয়েছে। তাকে নিয়ে আপত্তিকর কোন মন্তব্য কথা সহ্য করতে পারবে না। নীড়ের একবার কথার দিকটা ভেবে খারাপ লাগছে। এই সরল মেয়েটাকে সবাই কেন ঠকায়! যে মানুষটাকে এতগুলো বছর সে ফেরেশতা ভেবে আসছে আসলে সে তো তার যোগ্যই না। ওই নোংরা মহিলাটার জন্য তার মা’র বিবাহিত জীবন সুখে কাটতে পারেনি। মহিলাটা তার মা’র সংসারে নজর দিয়েছিল। তার বাবাকে…ওসব কথা মনে পড়লেও রক্ত টগবগ করে ওঠে ওর।

-আপনার কী হয়েছে হ্যাঁ? হঠাৎ করে শরীর খারাপ লাগছিল? সে জন্যই কি চলে এসেছেন?”

-বাড়ি চলো কথা।”

-যাব। কিন্তু…

নীড় কথাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে ওর হাত ধরে হাঁটতে লাগল। কথা হতবুদ্ধি হয়ে নীড়ের অদ্ভুত আচরণ দেখছে। হঠাৎ কী হলো মানুষটার! এরকম আজব ব্যবহার করছে কেন? উনার এভাবে চলে আসায় পাতানো মা কী ভাবছে! না উনি এই কাজটা মোটেও ঠিক করেননি। কারো সামনে থেকে এভাবে চলে এলে সে মানুষটা অপমান বোধ করবে এটাই তো স্বাভাবিক। নীড়ের উপর কথার মনে মনে ক্ষীণ একটু অভিমান হলো।
————-
-কাল আমরা বাড়ি ফিরছি কথা।”

মাথার নিচে দু’হাত রেখে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল নীড়। কথাকে বলে এসেছিল কম করে হলেও এখানে এসে এক সপ্তাহ থাকবে। কিন্তু তাদের এখানে এসে মাত্র তিন দিনই হলো। এখনই সে যাবার কথা বলছে। কথা স্বভাবতই রাগ করবে। সে কারণেই কথাটা বলার সময় নীড় কথার দিকে তাকাল না। কথা যেন নীড়ের কথাটা ঠিক শুনতে পায়নি। নীড়ের কাছে এগিয়ে এসে বলল সে,

-কী বললেন? আবার বলুন তো শুনি। মনে হচ্ছে আমি কানে কম শুনি। সেজন্যই তো উলটাপালটা শুনছি।”

-কাল আমরা বাড়ি যাব।”

-আমরা! অসম্ভব। আপনার মন চাইলে আপনি যেতে পারেন। আমি আপনাকে আটকিয়েছি নাকি। কিন্তু আমার জবাব শুনে রাখুন। আমি কাল কিছুতেই যাব না।”

-যাবে।”

-যাব না।”

-আচ্ছা দেখা যাবে।”

-দেখা যাবে মানে?” রেগেমেগে কোমরে হাত রেখে নীড়ের কাছে আরেকটু এগিয়ে এলো কথা। “দেখা যাবে মানে কি? আমি যদি যেতে না চাই আপনি কি আমাকে জোর করে নিয়ে যাবেন?”

-দুই হাত-পা বেঁধে, মুখে কাপড় বেঁধে কোলে করে নিয়ে যাব।”

-ডাকাতি পেয়েছেন নাকি? আপনি নিজেই বলে এসেছেন অন্তত এক সপ্তাহ থাকবেন। আপনার কথার মূল্য নেই কেন?”

নীড় বাঁকা চোখে কথাকে দেখে মুচকি হেসে বলল,

-আমার কথার মূল্য আছে দেখেই ওকে রেখে যেতে চাচ্ছি না।”

নীড়ের এসব হেয়ালি কথায় কথার রাগ আরও বেড়ে যাচ্ছে। লোকটা একটা যা তা! সবসময় নিজের মর্জি ঝাড়বে। কথাও কম জেদি না। সে-ও মনে মনে জেদ করল, কাল কিছুতেই যাবে না সে।
————–
কথা গাড়ি থেকে নেমে কোনো দিকে দেখল না। সোজা বাড়িতে ঢুকে গেল। হলরুমে মতিন চাচার সাথে দেখা হলো। মতিন চাচা কথাকে দেখে একগাল হেসে জানতে চাইল,

-অত জলদি বেড়ানো শেষ নতুন বউ। যাক ভালো করছো। তোমারে ছাড়া বাড়িটা কেমন ফাঁকা লাগতেছিল। তুমি যাওয়ার পরে মনে হইতেছিল এই বাড়ির জীবন চলে গেছে। তুমি যাওয়ার পরে তোমার শ্বশুর একদিনও রাইতে খায় নায়। খাওয়ার কথা বললেই বলছে, বৌমা আমার অভ্যাস খারাপ করে দিয়েছে। ও সামনে না থাকলে খেতে ভাল্লাগে না।”

নীড় চলে আসবে। কথা নীড়ের সাথে না এসে আরও কয়েকদিন থাকতে চায় শুনে আশা কোনোভাবেই মানলো না। কথাকে এক প্রকার জোর করে নীড়ের সাথে পাঠিয়ে দিল। নিজের বাবার বাড়িতে থাকতে হলে কথাকে এখন নীড়ের মতামত নিতে হবে। পুরোটা রাস্তা মন খারাপ ছিল ওর। কান্না পাচ্ছিল। নীড় হয়তো কথার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেই ওকে কিছু বলেনি। কিন্তু এখন মতিন চাচার কথা শুনে নিজেকেই অপরাধী লাগছে কথার। এখানে যে তার একটা বাবা আছে, সেই মানুষটা যে তাকে ছাড়া কিছু বুঝে না এটা কীভাবে ভুলে গেল সে।

-বাবা কি এখন অফিসে, মতিন চাচা?”

-হ মা।”

-এখনও তো দুপুরের রান্না হয়নি তাই না? আজকের রান্না আমি করব। বাবাকে দুপুরে বাড়িতে খেতে আসতে বলে দেই।”

মতিন চাচা হাসলেন। মনে মনে বললেন, “পাগলী মেয়ে। বড় সাহেব ছেলের বউ খুঁজতে একটুও ভুল করেননি।”

সব রান্নাবান্না শেষ করে কথা মাত্রই ঘরে এসেছে। যা গরম পড়েছে! দুদণ্ড আগুনের কাছে থাকা দায়। ওড়নায় হাত মুছে কপালের ঘাম মুছছিল। হুট করে নীড় ঘরে এসে পেছন থেকে কথার কোমর জড়িয়ে ধরল। আঁতকে উঠে পেছন ফিরে কথা। হতভম্ব হয়ে নীড়ের দিকে তাকিয়ে আছে সে। কী ঘটছে বুঝতে অন্তত পাঁচ মিনিট সময় নিল কথা। নীড় হাসছে। গলায় রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে কথা বলল,

-কী করছেন আপনি! ছাড়ুন আমাকে।”

-কেন?”

-কেন মানে কী!”

-তুমি আমার বউ না? আমি তোমার একটা মাত্র বর। অধিকার আছে আমার।”

নীড়ের কথায় কথার বেহুশ হবার দশা। কিন্তু নীড় সে আগের মতই কথাকে ধরে রেখেছে। কথা কাঁচুমাচু করে নীড়ের থেকে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তা দেখে নীড় বলল,

-যতই চেষ্টা করো, আমার থেকে এই জীবনে মুক্তি পাবে না তুমি।”

-সমস্যা কী আপনার? এমন করছেন কেন? ছাড়বেন তো আমাকে নাকি! আজব…

-আমার উপর রাগ করেছ তুমি?”

-রাগ না করার মত কোন কাজ করেছেন আপনি?”

-স্বামীর উপর বউদের রাগতে নেই।”

-কোন বইয়ে লেখা আছে এটা?”

-বইটা এখনও বের হয়নি।”

-আজাইরা! আরে আপনি জোঁক নাকি? রক্ত খাবেন আমার! নইলে এমন জোঁকের মত চিপকে আছেন কেন? দূরে সরুন। আপনি আমাকে জোর করে নিয়ে এসেছেন। আপনার বাড়িতে আসার জন্য আপনার মন কাঁদছিল। আমার কি আমার বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করে না।”

-এটাই তো তোমার বাড়ি। আসলে এটা না, আমিই তোমার বাড়ি। এই নীড়ের মাঝেই তো কথার বসবাস হওয়ার উচিত তাই না।”

-নিশ্চয় আপনার মাথায় আবার জ্বর উঠেছে। দিনে দুপুরে আবোলতাবোল বকছেন। ছাড়ুন আপনার মাথায় পানি দিই।”
—————–
কথারা ফেরার দু’দিন পর খবর এলো শিউলি গুরুতর অসুস্থ। কথাকে দেখতে চাইছে সে। সোহান নিজে কথাকে নিতে এলো। কথা সোহান ভাইকে দেখে মহা খুশি।

-সোহান ভাই, তুমি কিন্তু আজ চলে যেতে পারবে না তোমাকে আজ আমি এত সহজে ছাড়ছি না।”

সোহানকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। কথাকে কীভাবে বলবে সে ভাবছে।

-কথা জলদি রেডি হয়ে নে তো। তোকে আমার সাথে যেতে হবে।”

-কোথায় যাব? কী হয়েছে সোহান ভাই?”

-কিছু হয়নি। নীড় কি বাড়িতেই আছে? ওকে একটু ডেকে দে।”

-বাড়িতে কারো কিছু হয়েছে সোহান ভাই।”

-আরে নারে, তেমন কিছু হয়নি।”

-তুমি আমার কাছে মিথ্যা বলছ কেন? তুমি মিথ্যা বললে আমি বুঝতে পারি। বলো না কী হয়েছে।”

-তোর পা,,,শিউলি খালার অবস্থা ভালো না৷ একটু আগে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। বারবার তোর নাম নিচ্ছে।”

কথার পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে গেল যেন। দু’দিন আগেও মানুষটার কাছে গিয়েছিল সে। তখন বুঝতে পারেনি মানুষটা তার শেষ দিন গুনছে। কিন্তু পাতানো মা’র যে কিছু হয়েছে এটা ঠিক বুঝতে পেরেছিল কথা। কথার কোন দিকে খেয়াল নেই। তার পাখা থাকলে সে এই মুহূর্তে মানুষটার কাছে উড়ে চলে যেত।

-চলো সোহান ভাই। দেরি করো না।”

-নীড়কে বলে যাবি না! তোর শ্বশুর।”

-এসবের সময় নেই। তুমি চলো।”

-না। নীড়কে ডাক। ওকে না জানিয়ে আমি তোকে নিয়ে যেতে পারব না।”

অসহায় চোখে সোহান ভাইকে দেখল কথা। সময় নষ্ট না করে নীড়কে ডাকতে গেল ও। নীড় বাড়িতেই ছিল। দরজার সামনে থেকেই কথা বলল,

-সোহান ভাই আমাদের নিতে এসেছে। দেরি করবেন না চলুন।”

নীড় বেরুবার জন্য রেডি হচ্ছিল। কথাকে এতটা বিচলিত দেখে জিজ্ঞেস করল,

-কী হয়েছে কথা?”

-পাতানো মা’র শরীরটা ভালো না। আমাদের যেতে হবে।”

নীড়ের চেহারা কঠিন হয়ে গেল। ওই মহিলা মরলেও তার কিছু যায় আসে না।

-তোমার ইচ্ছে হলে যেতে পারো। আমি বাধা দিব না। কিন্তু আমাকে যেতে বলো না।”

কথা হতবুদ্ধি হয়ে নীড়কে দেখছে।

-আপনি যাবেন না!”

-না।”

-একটা মানুষ তার জীবনের শেষ সময় কাটাচ্ছে এটা জেনেও আপনি তাকে দেখতে যাবেন না!”

-না।”

নীড়ের নিষ্ঠুরতা দেখে কথার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল।

-আমার সম্পর্ক গুলোর আপনার কাছে কোন মূল্য নেই, না?”

-আছে।”

-আপনি এতটা পাষাণ কেন? আপনাকে চিনতে আমার ভুল হয়েছে। না, আসলে আপনাকে আমি আজও চিনতেই পারিনি। আপনার ভেতরে মন নেই। কোন অনুভূতি বা কারো জন্য সহানুভূতি নেই। আপনি মানুষ না হয়ে পাথর হলেই ভালো হতো। সেদিনও আপনি এমনটাই করেছেন। আপনার সবকিছু আমি আপন করে নিয়েছি। কিন্তু আপনি আমার কিছুই আপন করতে পারেননি। আমাদের মাঝে দূরত্বটা কী ধনী গরিবের? নাকি অন্য কিছুর?”

-যে মানুষটার জন্য আমি আমার মা’কে হারিয়েছি, সে মানুষের প্রতি আমার মনে কীভাবে কোন সহানুভূতি থাকতে পারে কথা! আমার মায়ের মৃত্যুর পেছনে যারা দায়ী তাদেরকে আমি কীভাবে ক্ষমা করব বলো।”

-আপনার মা! আ-আপনার মা’র মৃত্যুর জন্য পা-পাতানো মা দায়ী!”

-হ্যাঁ কথা। হ্যাঁ, ওই মানুষটার জন্যই আমার মা বেঁচে থেকে প্রতিনিয়ত ধুঁকে ধুঁকে একটু একটু করে শেষ হয়েছে। তোমার মুখে মা ডাক শোনার যোগ্য না ওই মহিলা।”

চলবে_

@মায়ামহল (নিপা’র গল্প)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here