#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ৩৪|
[এডিট ছাড়া পর্ব। বানান ভুল ক্ষমা করবেন]
নীড় ভেবেছে কথা হয়তো এতক্ষণে বাড়ি চলে এসেছে। কিন্তু সে বাড়ি ফিরে দেখে কথা এখনও ফিরেনি। কথাকে না পেয়ে রাগ হলো নীড়ের। বাইরের একটা মানুষের জন্য নিজের স্বামীর কথা শুনবে না! মতিন চাচা নীড়কে রাতে খাবার জন্য ডাকতে এসেছে। নীড় তার সমস্ত রাগ ঘরের জিনিসপত্রের উপর ঝেড়েছে। মতিন চাচা রুমের এই অবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলেন।
-কী হইছে তোমার? ঘর উলটপালট করতাছো কেন? দুইদিন পরপর তোমার কী হয় কও তো!”
-তুমি এখন যাও তো।”
-কেন যামু? যা যা উলটপালট করছো সব আবার গুছাইয়া রাখো। এক্ষুনি রাখ। নতুন বউ আইসা দেখলে রাগ করব।”
-করুক রাগ। ওর রাগ দিয়ে কার কী আসে যায়? আমি কি তোমার নতুন বউয়ের রাগকে ভয় পাই? এই ঘর আমার। আমি ভেঙে ফেলব, পুড়িয়ে ফেলব তাতে ওর কী? এটা ওর বাড়ি থাকলে যখন তখন চলে যেতে পারত না।”
নীড়ের হঠাৎ রাগের কারণ মতিন চাচা ঠিক বুঝতে পারছে না। অনেকদিন ধরে নীড় ভালোই থাকছে। রাগ করছে না। বেশি রাত করে বাড়ি ফিরছে না। খাওয়া দাওয়াও ঠিকমতো করছে। ওর জীবনটা যেন একটা নিয়মের মধ্যে চলে এসেছে। যা আগে ছিল না। সবই অবশ্য নতুন বউয়ের জন্যই হয়েছে। মেয়েটা নীড়কে একটু একটু করে পাল্টে দিয়েছে। ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবীর দুর্বোধ্য জিনিসও জয় করা যায়। কথা সেটাই করে দেখিয়েছে।
-তুমি কি নতুন বউরে আনতে যাইবা?”
-কেন যাব আমি? আমার এত ঠেকা কিসের? আসতে মন চাইলে আসবে। মন না চাইলে ফিরতে হবে না।”
-রাইত হইছে তো একলা মেয়ে মানুষ কেমনে আসব।”
-সেটা আমার ভাবনার বিষয় না। যার সাথে গেছে তার সাথে ফিরবে। যাবার সময় কি আমার অনুমতি নিয়ে গেছে?”
নীড় মতিন চাচার সামনে থেকে রেগেমেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
-নতুন বউ বাপের বাড়ি গেছে দেখেই কি বাবার এত রাগ!” হাসলেন মতিন চাচা, “পাগল ছেলে! বউকে ছাড়া একদিনও থাকতে পারছে না।”
নীড় নিজে ড্রাইভ করে কথাদের বাড়িতে আসার সময়ও ভাবছিল কথার মা’র কাছে মেয়ের সব কর্ম কীর্তি বলে দিবে। তখন তিনিই বুঝবেন কীভাবে মেয়েকে লাইনে আনতে হবে। কিন্তু এসে দেখে কথা এখানেও নেই। আশা নীড়কে দেখে দুনিয়ায় সব কৈফিয়ত দিতে বসে গেছে।
-মেয়েটা আমার কোন কথা শুনে না বাবা। অন্যের জন্য ওর যত দরদ। কে না কার কী হলো তাতে ওর খাওয়া ঘুম হারাম। ওই মহিলা তোর নিজের মা? নাকি রক্তের কেউ হয়? তারপরও দেখো সকাল থেকে ওখানে পড়ে আছে। ওকে বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য আমি একটু আগেও জোড়াজুড়ি করে এসেছি।”
নীড় শাশুড়ির সামনে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকলেও ভেতরে রাগে ফেটে যাচ্ছে ও। কথার সাহস কমাতে হবে তাকে। অনেক ছাড় দিয়ে ফেলেছে। ওর মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করেই এতদিন ওর সবরকম বাড়াবাড়ি মেনে নিয়েছে। কিন্তু আর না। ঘরের বউকে বেশি ছাড় দিতে নেই।
-তুমি ঘরে গিয়ে বসো বাবা। আমি শিমুলকে পাঠাচ্ছি। নইলে আমি নিজেই গিয়ে ওকে আসতে বলছি। তুমি বসো।”
-না। আপনার যেতে হবে না। আমিই যাচ্ছি।”
-তুমি যাবে!”
-হ্যাঁ।”
-বাড়ি চেনো তুমি?”
-হুম।”
————-
গলিটা আজ এত শুনশান লাগছে যে জায়গাটুকু পেরুতে নীড়ের কেমন যেন লাগছে। এখনও তো রাত তেমন হয়নি। তাহলে আজকে পথে একটা কুকুরও নেই কেন? বাড়িতে ঢোকার মুহূর্তেও হয়তো নীড় ভাবেনি এই বাড়িতে বসবাসরত একমাত্র ব্যক্তিটি আজ মারা গেছে। ঘরের ভেতরে ঢুকলো না সে। বাইরে দাঁড়িয়েই কথাকে ডাকলো।
-কথা। কথা বেরিয়ে এসো।”
নিশ্চুপ। আশেপাশে কোন শব্দ নেই। কথা কি তার ডাক শুনতে পায়নি? নীড় আবার ডাকলো।
-কথা বাইরে এসো।”
নীড়ের ডাকার দুই মিনিট পর কথা বেরিয়ে এলো। কথাকে দেখে নীড় অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে। কথার চোখ মুখ ফোলে ওকে চেনার উপায় নেই। মনে মনে চেপে রাখা রাগটুকু হাওয়াই মিঠাইয়ের মত এক নিমিষে গলে গেল। নীড় হন্তদন্ত হয়ে কথার কাছে ছুটে গেল।
-কথা, কী হয়েছে তোমার? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”
-আপনি আসতে এত দেরি করলেন কেন?”
নীড় বুঝতে পারল না কথা কী বলেছে। কারণ ওর গলার স্বর বসে গেছে। স্পষ্ট করে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
-কী বলছ কথা?”
-আপনাকে দেখার এক সমু্দ্র আকাঙ্ক্ষা বুকে নিয়ে মানুষটা চলে গেছে।”
নীড় কথাটা শুনেও বিশ্বাস করল না। শুধু ভেতর থেকে একটা কাঁপুনি অনুভব করল।
-পাতানো মা নেই।” বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল কথা। নীড় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর কথাকে সান্ত্বনা দিতে ওর মাথায় হাত রাখল। কথা নীড়ের হাত জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদছে। বেশ অনেকটা সময় এভাবেই কাটল।
-বাড়ি চলো কথা।”
অশ্রুসজল চোখে নীড়ের দিকে তাকাল কথা। নীড়ের মুখে কিছু খোঁজার চেষ্টা করল। নীড় কথার বাহু ধরে ওকে তোলার চেষ্টা করে বলল,
-চলো।”
-হু।”
গাড়িতে কথা একদম চুপচাপ বসে ছিল। নীড় আড়চোখে বারবার ওকেই দেখছে। না কথার মাঝে কোনরকম পরিবর্তন আসছে না। কাছের কাউকে হারানোর কষ্ট নীড়ও জানে। তাই এই মুহূর্তে কথাকে একা ছেড়ে দিল সে। নীড় নিজেও যে বিশেষ ভালো নেই তা কাউকে বুঝতে দিতে চায় না। মানুষটাকে সে ঘৃণা করত ঠিকই। কিন্তু আজ নীড় বুঝতে পারছে সেই ঘৃণার আড়ালেও কোথাও না কোথাও মানুষটার জন্য তার মনে টান ছিল। নইলে উনার মৃত্যুতে নীড়ের কেন কষ্ট হবে? মানব হৃদয় বড় আজব চিজ। ঘৃণার আড়ালেও ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে। আবার ভালোবাসার আড়ালে বেইমানি।
————–
নীড় ভেবেছিল কথা কয়েক দিনের মধ্যেই শিউলির মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠবে। কিন্তু বাস্তবে এমনটা হচ্ছে না। কথা যেন কেমন মিইয়ে গেছে। সেই আগের হাসিখুশি প্রাণচঞ্চল কথাকে আর দেখা যাচ্ছে না। নীড় নানা ভাবে কথাকে বুঝিয়েছে। ওকে এই ব্যাপারটা ভুলিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।
বাগানে চেয়ারে পা তুলে গুটিসুটি মেরে বসে আছে কথা। ওর দৃষ্টি অজানা কোন কিছুতে আবদ্ধ। রুমে কথাকে খুঁজে না পেয়ে বাগানে চলে গেল নীড়। পেছন থেকে ওকে ডাকল।
-কথা! এখানে তুমি? আমি আরও তোমাকে ভেতরে খুঁজছিলাম।”
নীড় এসে কথার পাশের চেয়ারটায় বসল। নীড়ের আগমণেও কথার ধ্যান ভাঙেনি। নীড় কথাকে দেখল। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মেয়েটা এমন হয়ে যাচ্ছে কেন?
-কী দেখছ কথা?”
নীড়ের দিকে ফিরল কথা। নীড়ের কথাটা যেন শুনেনি সে ওরকম ভাবে তাকাল।
-কী দেখছিলে?”
-হু? কিছু না।”
আবার গভীর ভাবনায় তলিয়ে গেল কথা। কিছুটা সময় নীড় কথাকে খুব ভালো করে লক্ষ করল।
-কী ভাবছো কথ?”
-হু, কিছু না।”
-চলো ভেতরে যাই।”
-জীবন কত অদ্ভুত না? মানুষ এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে আসার সময়ই জানে সে চিরকাল এখানে থাকতে পারবে না। নির্দিষ্ট একটা সময়ের পর তাকে ঠিক চলে যেতে হবে। এটা জেনেও মানুষের বাঁচার আগ্রহ এতটুকুও কমে না। এই অল্প সময়টাতে মানুষ কতকিছু অর্জন করার স্বপ্ন দেখে। কত মায়া! ছোট্ট এই জীবনে সুখ দুঃখ হাসি কান্না কতশত স্মৃতি তৈরি হয়। আচ্ছা মৃত্যুর পরের জীবনটা কেমন? পাতানো মা ওখানে কেমন আছে।”
কথাগুলো বলার সময় নীড় কথার চোখের দিকে চেয়ে ছিল। বুকটা কেঁপে উঠল তার৷ মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে জানার জন্য কৌতূহলে ওর চোখ চকচক করছে। কথা কি মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে? ওর চোখ দু’টো প্রাণহীন লাগছে কেন? ওর কথাবার্তার ধরণের অস্বাভাবিকতা লক্ষ করা যাচ্ছে। নীড় উঠে দাঁড়াল। কথার একটা হাত শক্ত করে ধরে ওকেও টেনে তুললো।
-আজেবাজে চিন্তাভাবনা মাথা থেকে বের করো। এখনও আরও অনেক বছর বাঁচবে তুমি। তাই এসব চিন্তাভাবনা তোমার জন্য নিষিদ্ধ।”
বছর কয়েক আগে নীড়েরও এমন কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল। নাহিদ চৌধুরী তাকে দেশের নামকরা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গেছে। অল্প দিনে সে সেরেও উঠেছে। তখন কি কেউ ভেবেছিল আজ দীর্ঘদিন পর নীড়ের তার বউয়ের জন্য আবার ওই লোকের সাহায্য নিতে হবে।
লোকটা কথাকে না দেখেই ওর সম্পর্কে নীড়ের মুখে শুনে বলে দিল,
“এটা তেমন কিছু না। যে মারা গেছে সে তোমার ওয়াইফের মনের অনেকটা কাছে ছিল। তাই তাকে ভুলতে সময় লাগছে। ওকে আগের থেকে একটু বেশি করে টাইম দাও। আরেকটা কাজও করতে পারো। বউকে নিয়ে দূরে কোথাও থেকে হাওয়া বদল করে আসো। জানোই তো, মেয়েদের মন মোমের মতো হয়। ওরা যেমন সহজে কষ্ট পেয়ে যায়৷ আবার সহজে খুশিও হয়ে যায়। তুমি বরং ওকে সুন্দর নিরিবিলি কোন পরিবেশ থেকে ঘুরিয়ে আনো। তারপরও যদি সমস্যা দূর না হয় তাহলে তো আমি আছিই।”
নীড় এটাই করবে ভাবছে। তাছাড়া বিয়ের পরে কথাকে নিয়ে কোথাও যায়নি নীড়। ওদের দু’জনের এমন কোন একান্ত মুহূর্ত নেই যা সুন্দর সুখকর স্মৃতি হয়ে মনের পাতায় রয়ে যাবে।
-কথা ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে নাও।”
কথা আগের মত আগ্রহ দেখাল না ঠিক আছে কিন্তু এটা জানতে চাইল,
-কেন? কোথায় যাব আমরা?”
-ঘুরতে।”
-আমার ইচ্ছে নেই।”
-আমার তো ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে।”
-তাহলে আপনি যান।”
-বউকে একা বাড়িতে রেখে গেলে আমার মন ঘুরাঘুরিতে লাগবে?”
কথা চুপ করে রইল। তার সত্যিই কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।
-তোমার সমুদ্র পছন্দ নাকি পাহাড়?”
-পাহাড়।”
-তাহলে এইদিক দিয়ে তোমার পছন্দের সাথে আমার পছন্দ মিল আছে।”
কথা যেতে রাজি না হলেও নীড় ওকে জোর করে নিয়ে যাবে। নীড় নিজেই ব্যাগ গুছিয়ে নিল। কথা উদাস মুখে নীড়ের কাজকর্ম দেখে গেছে। রাতে বাসে উঠবে ওরা। সারারাত জার্নি করে সকালে গিয়ে পৌঁছুবে। কথা যতদিন না আগের মত হাসিখুশি হচ্ছে ততদিন ফিরবে না। যা আছে কপালে। রাত এগারোটার আরও পরে কথার বাবার বাড়ি থেকে খবর এলো। শিমুল ফোনে কী বলল নীড় শুনেনি। কিন্তু কথা যে অধৈর্য হয়ে উঠছে তা লক্ষ করল।
-আপু তুমি কি এখন একটু আসতে পারবে?”
-কেন? কীভাবে হয়েছে? তোর কথা বেজে যাচ্ছে কেন শিমুল।”
-কিছু হয়নি। তুমি দুলাভাইকে নিয়ে এখন একটু আসো প্লিজ।”
-কিছু হয়নি তাহলে এত রাতে কেন বাড়ি যেতে বলছিস।”
কথা বুঝতে পারছে শিমুল কান্না চাপার চেষ্টা করছে।
-কাল রাত থেকে সোহান ভাইকে পাওয়া যাচ্ছে না আপু। রাতে না ফিরলে ওর কাকা ভেবেছে হয়তো কোন বন্ধুর বাড়িতে আছে। আজ সারাটা দিনেও সোহান ভাই ফিরেনি। এখন রাত বারোটা বাজে প্রায়৷ সোহান ভাইয়ের কোন খোঁজই পাওয়া যাচ্ছে না। ওর ফোনটাও বন্ধ। আমরা কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না।”
চলবে_
@মায়ামহল (নিপা’র গল্প)