চুপকথারা_বিষন্ন পর্ব-৩৫ শেষ পর্ব

0
4122

#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
#শেষ পর্ব

কথার অস্থিরতা দেখে নীড় মাঝরাতেই কথাকে নিয়ে ওদের বাড়িতে এলো। পাড়ার কোন একজন মানুষও সোহানকে স্নেহ করে না এমনটা হতেই পারে না। ওর নিখোঁজ হওয়া নিয়ে ওকে খুঁজতে সবাই নানান দিকে বেরিয়ে পড়েছে। ছেলেটা বাতাসে মিলিয়ে গেল নাকি! দুইটা রাত ধরে কোথায় আছে কেউ জানে না। শিমুল কথাকে দেখে চেপে রাখা কান্না কেঁদে ফেলল।

-আপু জানি না সোহান ভাইয়ের কী হয়েছে। ওকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।”

কথা নিজেই স্তম্ভিত। এই তো কিছু দিন আগে পাতানো মা চলে গেল। এখন কি সোহান ভাইও?
নীড় শিমুলকে শান্ত করে জানতে চাইল।

-থানায় মিসিং রিপোর্ট করিয়েছ?”

-না।” সোহানের চাচা মোটামুটি বয়স্ক লোকটা এগিয়ে এলো। বলল,

-আমরা ভাবিনি ওর সাথে কিছু হয়েছে। ভেবেছি হয়তো কোন বন্ধুর বাড়িতে গেছে। কিন্তু দুই দিনেও কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।”

-আচ্ছা। আপনারা টেনশন করবেন না। শিমুল তুমি আমার সাথে থানায় চলো। আর আপনারা ওর বন্ধুদের বাড়িতে খোঁজ করতে থাকুন।”

কথার চোখের সামনে এতকিছু হচ্ছে কিন্তু এতেও যেন তার কোন ভাবান্তর নেই। কাঠের পুতুলের মত ফাঁকা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। রাত তখন তিনটার ঘরে। পুলিশ এসেছিল। কিন্তু তাতেও তেমন কোন লাভ হয়নি। সোহান ভাইয়ের ছবি নিয়ে গেছে ওরা। কথা পলাশকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিল। হঠাৎ কী মনে করে দাঁড়িয়ে গেল সে। ব্যস্ত হয়ে কোথাও যেতে লাগল। নীড় ওর হাত ধরে জিজ্ঞেস করল,

-কোথায় যাচ্ছ তুমি?”

-আমি জানি সোহান ভাইকে কোথায় পাওয়া যাবে।”

-হ্যাঁ!”

-হ্যাঁ। আমি জানি সোহান ভাই কোথায় আছে। আপনি আমার সাথে চলুন।”

শুধু নীড় না বাকিরাও কথার সাথে এলো। কথা যা মনে করেছিল তা-ই ঠিক। সোহান সত্যিই ওই ভাঙা পুলের উপর বসে আছে। ওর দৃষ্টি আকাশের দিকে। ওকে দেখতে পেয়ে অনেকটা দূর থেকেই কথা ডেকে উঠল,

-সোহান ভাই!”

সোহান পেছনে ফিরল। কিন্তু অন্ধকারে কাউকে দেখতে পেল না। কথা দৌড়ে ওর কাছে চলে এলো

-তুমি এখানে কী করছ সোহান ভাই?”

-কে? কথা?”

-হুম। তুমি বাড়ি ফিরছ না কেন?”

-তুই এত রাতে কার সাথে এখানে এসেছিস?”

-সবাই এসেছে। তুমি জানো সবাই তোমাকে পাগলের মত খুঁজছে। পুলিশেও খবর দেওয়া হয়েছে। তুমি বাড়ি ফিরোনি কেন?”

হঠাৎ সোহান ছেলেমানুষের মত কাঁদতে লাগল। কথা হতভম্ব হয়ে গেল।

-তোমার কী হয়েছে সোহান ভাই?”

-কথা রে আমি নিঃশেষ হয়ে গেছি।”

-কী হয়েছে বলো।”

-আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বনটাও হারিয়ে গেছে। নুড়ি,,,

-কী হয়েছে নুড়ি আপার? বলো সোহান ভাই।”

-নুড়ি আর নেই।”

সোহান ভাইয়ের মুখে এমন কিছু শোনার জন্য কথা প্রস্তুত ছিল না। তাই এই কথাটাও সে বিশ্বাস করতে পারল না।

-কী বাজে বকছ! কে তোমাকে এসব ফালতু কথা বলেছে।”

-পরিবারের সাথে বেড়াতে গিয়েছিল। আসার পথে ওদের গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে। নুড়িকে বাঁচানো যায়নি। ওর ছোট ভাইটাও কোমায় চলে গেছে। দুই ছেলেকে হারিয়ে ওর বাবা মা বেঁচে থেকেও এখন মরার মতোই।”

ঝট করে নুড়ি আপার মুখটা মনে করে নিল কথা। নুড়ির আপার হাসিটা এখনও ওর চোখে ভাসছে। ওর বিয়েতে আসতে পারেনি বলে কত আফসোস করেছিল। কথা দিয়েছিল সোহান ভাইয়ের সাথে তার শ্বশুরবাড়ি যাবে। সেই নুড়ি আপা নেই। কথা থরথর করে কাঁপছে। ও পড়ে যাওয়ার আগে নীড় ওকে ধরে ফেলল। সোহান আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে।
———–
লোকটার সাথে দেখা করার জন্য দীর্ঘ এক ঘন্টা বসে থাকতে হয়েছে নীড়ের। এমন না যে লোকটা তাকে চিনে না। সে যে দেশে স্বনামধন্য বিজনেসম্যান নাহিদ চৌধুরীর একমাত্র ছেলে লোকটা এই কথা খুব ভালো করেই জানে। তবুও তাকে তেমন কোন বিশেষ খাতির করছে না। মানুষটার কাছে উনার সব রোগীই সমান গুরুত্বপূর্ণ। উনার কাছে এই নিয়ে চার বার এসেছে নীড়। তিনবার কথাকে সাথে এনেছে। এইবার একা। নীড়ের ডাক পড়লে পর্দা সরিয়ে ভেতরে এলো সে। মানুষটা এখনও ঠিক আগের মতই আছে। তিন চার বছর আগে ঠিক যেমনটা ছিল। নীড়কে দেখে রাশেদুজ্জামান হাসলেন। বললেন,

-আজ তো তোমার আসার কথা ছিল না।”

-এসেছি।”

-তা নিশ্চয় কোন জরুরি দরকারেই এসেছ।”

-হুম।”

-বসো, বসো। বলো কী নিবে? চা কফি নাকি অন্য কিছুর ব্যবস্থা করব।”

-না। আমার কিছু লাগবে না।”

-ঠিক আছে। তা তুমি ঘরের ছেলে। তোমার সাথে ফর্মালিটি করার প্রয়োজনও নেই।”

নীড় লোকটার সামনের চেয়ারে বসল। ওকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। ওর চিন্তার কারণ মানুষটাও বুঝতে পারছে।

-তোমার বাবা কেমন আছেন?”

-ভালো।”

-ওর ভালো থাকার তো কথা না। বৌমার জন্য ফোনে দিনরাত আমার মাথা খায়। কথাকে নিয়ে এলে না আজ!”

-না। আঙ্কেল, কথা কি কখনও স্বাভাবিক হয়ে উঠবে না? গত সপ্তাহেও আপনি বলেছেন, তেমন কিছু নাকি ওর হয়নি। সামান্য সমস্যা। কিন্তু আমার কাছে কেন সামান্য সমস্যা মনে হচ্ছে না। কথাকে একেক সময় সম্পূর্ণ আলাদা চরিত্রের মানুষ মনে হয়। ওর মাঝে যেন অনেকগুলো মানুষের বসবাস। আমি গুগল করে দেখেছি। ওর সমস্যাটা সামান্য না। আপনি কেন আমার কাছে পরিষ্কার করে সবকিছু বলছেন না। আমি তো জানিই কথার বাজে একটা অসুখ বেঁধেছে। আমি চাই ও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠুক।”

নীড়কে এতটা অধৈর্য হয়ে উঠতে দেখে রাশেদুজ্জামান ওকে শান্ত হতে বললেন।

-দেখো নীড় মানুষের শরীরের রোগ ঔষধ দিয়ে দূর করে ফেলা যায়। কিন্তু মনের রোগ সেটা অন্য ব্যাপার। মনের রোগ সারবার জন্য সময়ের প্রয়োজন হয়। তুমি এখনই এতটা অধৈর্য হয়ে গেলে তো চলবে না।”

-অধৈর্য না আঙ্কেল। আমি শুধু এটা জানতে চাচ্ছি কথার সম্পূর্ণ ঠিক হওয়ার চান্স কতটা? ওর মানসিক অবস্থার দিনদিন অবনতি ঘটছে। এখন অনেক কিছুই ভুলে যাচ্ছে সে।”

-কথার রোগটা Multiple Personality Disorder বা বহুব্যক্তিত্ব। নির্যাতন বা ডিলিউসনের মাত্রা ব্যক্তির সহ্য ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে তখন এই রোগ দেখা দিতে পারে। মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এটি একটি মানসিক রোগ যা রোগীর ব্যক্তিত্বে দ্বৈততা আনয়ন করে থাকে। ফলে একে দ্বৈতসত্তাজনিত সমস্যাও বলা হয়ে থাকে। রোগী নিজের স্মৃতি, ব্যক্তিত্ব ও বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলে সাময়িককালের জন্য পরিচিত অথবা সম্পূর্ণ অলীক কোন স্মৃতি, ব্যক্তিত্ব বা বৈশিষ্ট্য ধারণ করে থাকে। একাধিক ব্যক্তিত্বে বেলায় Dissociative Identity Disorder বলা হয়। তোমার ভাষ্যমতে কথার মাঝে তুমি এই পর্যন্ত একটি ব্যক্তিত্ব দেখেছ। কিন্তু হতে পারে আরও সত্তা থাকতে পারে। আরও দু’টি বা তিনটি। আমার এখনও ওদের মাঝে থেকে কারো সাথেই সাক্ষাৎ হয়নি। আমার কাছে যতক্ষন থাকে কথাকে তখন একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষই মনে হয়।”

-কিন্তু আঙ্কেল আমি নিজে দেখেছি ও কেমন পাল্টে যায়। আলাদা একজন মানুষ হয়ে যায়। ওর চরিত্রের সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভীষণ বদমেজাজি। আপনি কি এটা বিশ্বাস করবেন, ছোট বেলায় কথা ওর সৎ মামাকে ছাঁদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। আমার শাশুড়ী এটা নিজের মুখে স্বীকার করেছেন। আমাদের বিয়ের পরের একটা ঘটনা বলি, আমার কুকুর জ্যাকিকে কথা সাধারণত ভীষণ ভয় পায়। কখনও ওর কাছে যায় না। জ্যাকি দূর থেকে ওর দিকে তাকালেও পালিয়ে বাঁচে। কিন্তু সেই কথাই বাগানে জ্যাকিকে একা পেয়ে পর একটা পা ভেঙে দিয়েছে। রমিজা নিজে এটা দেখেছে। তারপর থেকে আমিও লক্ষ করেছি জ্যাকি কথাকে দেখলেই ভয় পেয়ে চেঁচামেচি করে। মাঝের কিছুটা সময় কথা ঠিকই ছিল। এই তো এক মাস আগে পরপর দুটো র্দুঘটনার পর কথার সমস্যাটা অনেকগুণ বেড়ে গেছে। এখন দিনে একাধিক বার ও নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।”

নীড়ের গলায় কান্না দলা পাকিয়ে উঠছে। চুপ করে গেল ও। রাশেদুজ্জামান অন্যমনস্ক হয়ে কিছু ভাবছেন। দীর্ঘ সময় পর তিনি মুখ খুললেন।

-কথার অসুখটা খুব সম্ভবত ছোটবেলা থেকে ওর মাঝে বাসা বেধেছে। যখন ওর আসল মা মারা গেছে তখন থেকেই। ওর সাথে এমন কোন অন্যায় হয়েছে যার প্রতিবাদ ও নিজে করতে পারেনি। সে থেকে তার অবচেতন মন এমন কোন সত্তা গড়ে নিয়েছে যে কথার মত দূর্বল না। কথার হয়ে প্রতিবাদ করেছে সে। রোগটা সময়ের সাথে সাথে ওর মন মস্তিষ্কের গেঁড়ে বসেছে।”

-কথা কীভাবে সুস্থ হবে আঙ্কেল?”

-সুস্থ? হু, বলা মুশকিল। রোগটার বয়স দীর্ঘকাল। এক দুই মাসে যে চলে যাবে না এটা তুমিও বুঝো। তুমি কেন টেনশন করছ সেটা আমিও বুঝতে পারছি।”

-কথা চার মাসের প্রেগন্যান্ট। আমাদের বাচ্চাটার কোন ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই তো?”

-কোন মা-ই নিজের সন্তানের ক্ষতি করবে না। কিন্তু কথা সেই সময়টাতে নিজের মধ্যে থাকে না। হয়তো নিজের অজান্তে ক্ষতি করতেও পারে। কথা যাতে এমন কিছু করতে না পারে এজন্য চব্বিশ ঘণ্টা ওর উপর কাউকে না কাউকে নজর রাখতে হবে।”

নীড় সত্যিই এসব আর সহ্য করতে পারছে না। কথা তাকে কতটা ভালোবাসে তা সে জানে। কিন্তু যখন কথা নিজের মধ্যে থাকে না তখন এমন এমন সব আচরণ করে যা নীড়ের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয় না। সে মুহূর্তে নীড় কথার প্রতি কঠোর হলে ওর মাঝের অন্যজন ওর বাচ্চাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।

-আপনি যেভাবেই হোক কথাকে ঠিক করে দিন আঙ্কেল।”

-আমার হাতে তো কিছুই নেই রে বাবা। তবে আমি আমার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাব। কথার খুব বেশি মন খারাপ হলে বা ও কষ্ট পেলেই তো বাকি চরিত্রগুলো বেরিয়ে আসে। তোমরা সবাই ওকে যত পারো হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করো। কোন বিষয় নিয়ে ওর মন খারাপ হতে দিও না।”

-হুম।”

-সোমবারে একবার আমার কাছে এসো। না থাক, বারবার আমার কাছে নিয়ে এলে ওর মনেও সন্দেহ ঢুকবে। তুমি বরং কথাকে নিয়ে আমার বাড়িতে এসো।”
———
নীড় ঘরে এসে কথাকে দেখতে না পেয়ে অস্থির হয়ে গেল। কোথায় গেছে কথা? ওয়াশরুমে দেখে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখনই বেডের উপর ওর চোখ পড়ে। কিছু রাখা আছে ওখানে। নীড় বক্সটা হাতে নিল। কোনরকমে রেপিং পেপার টেনে ছিঁড়ে সবার উপরে একটা চিরকুট পেল। চিরকুটের লেখা আছে,

“শুভ জন্মদিন সতীন কুত্তা ও কুত্তার মালিক। দেখুন তো গিফট পছন্দ হয়েছে কিনা। পছন্দ না হলেও বউয়ের দেয়া গিফট। ভালোবেসে যত্ন করে রাখবেন। অনাদর হলে খবর আছে।”

নীড় স্বস্তির শ্বাস নিল। আজ তার জন্মদিন! মনেই ছিল না। তার জীবনে যে ঝড় যাচ্ছে জন্মদিনের কথা মনে না থাকাটাই স্বাভাবিক।

-কিন্তু কথা কোথায়?”

কথা জ্যাকির গায়ের লোমে বিলি কাটছে। জ্যাকি শান্ত ছেলের মত কথার পেটে মুখ লাগিয়ে শুয়ে আছে। বাচ্চাটা পেটে আসার পর থেকেই জ্যাকি একজন মানুষের মত কথার খেয়াল রাখতে শুধু করেছে। এটা দেখে প্রথম দিকে কথা তো ভীষণ অবাক। এখন সে আর জ্যাকিকে ভয় পায় না। জ্যাকি সর্বক্ষণ ছায়ার মতো ওর সাথে লেগে থাকে। কথাকে নিয়ে নীড়ের দুশ্চিন্তার কারণ কি জ্যাকিও বুঝতে পেরেছে?

-তুই তো কোন সাধারণ কুত্তা না। তুই আমার একমাত্র সতীন। আমার বরের দ্বিতীয় কুত্তী বউ তুই।”

“কুত্তী বউ!” কথাটা বলে কথা নিজেই খিলখিল করে হাসতে লাগল।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here