চুপকথা পর্ব-১

0
4443

#চুপকথা-১
Zannatul Eva

তিয়াশ.
রিয়ার সাথে আজ প্রথম দেখা করতে যাচ্ছি। আমি তিয়াশ আহমেদ। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। ছোট বেলা থেকে বাবাকে নিজের বিজনেস আর টাকা ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে দেখিনি৷ তার যে একটা ছেলে আছে সেটা তাকে রোজ মনে করিয়ে দিতে হতো। হঠাৎ করেই বাবার নিজে থেকে মনে হলো ছেলে বড় হয়েছে। এবার বিয়ে করাতে হবে। আর তাই আমার জন্য গোটা বিশেক মেয়ে দেখার পর ফাইনালি নিজেরই বন্ধুর মেয়ে রিয়ার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছেন। অবশ্য আমার মনে হয় না এটা আদৌও আমার বিয়ে। কারন আমাকে একবারের জন্যও জিজ্ঞেস করা হয় নি আমার রিয়াকে পছন্দ হয়েছে কিনা। ইনফ্যাক্ট আমি এখন বিয়ে করতে চাই কিনা সেটাও আমাকে জিজ্ঞেস করা হয় নি। ছোটবেলা থেকে বাবাই আমার জীবনের সব ডিসিশন নেয়। কী রঙের জামার সাথে কী রঙের জুতো পরবো সেটাও বাবাই ঠিক করে দেয়। আমার জীবনে মায়ের ভূমিকা খুবই কম। মায়ের অবস্থাও আমারই মতন। বাবার মুখের উপরে কিচ্ছু বলতে পারে না৷

কফিশপে এসেই দেখলাম রিয়া বসে আছে। কনফার্ম হওয়ার জন্য নিজের মোবাইল থেকে রিয়ার ছবিটায় আরও একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। হ্যাঁ এটা রিয়াই। আস্তে আস্তে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। ওয়েস্টার্ন ড্রেসে রিয়াকে বেশ আকর্ষনীয় লাগলেও আমার ওকে একদমই ভালো লাগছে না৷ ওকে আমার মেয়ে মনে হচ্ছে না। চুল গুলো শর্ট কাট দেয়া। মেয়েদের চুল থাকবে লম্বা লম্বা। পরনে থাকবে সেলোয়ার-কামিজ কিংবা শাড়ি, কপালে টিপ, হাত ভর্তি চুরি। যে প্রথম দেখাতেই বুকের মধ্যে একটা বসন্তের শীতল হাওয়া বইয়ে দিবে। অবশ্য ভুলটা আমারই। নিজে থেকে আজ পর্যন্ত কাউকে পছন্দ করতে পারলাম না৷ কী করে করতাম! তেমন কাউকে এখনও খুঁজেই পেলাম না৷ পেলেও বা কী হতো! বাবার পছন্দের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাধ্য তো আমার নেই। নিজেকে মাঝে মাঝে বড্ড বেশি হোপলেস মনে হয়৷

আমি আমার ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে এসে রিয়াকে প্রশ্ন করলাম, কী খাবেন বলুন। আমি অর্ডার করছি।

রিয়া খুব বিরক্ত হয়ে বলল, প্লিজ খাওয়া দাওয়ার কথা ছাড়ুন। আমি এখানে খেতে আসি নি।

জানি কেন এসেছেন। খেতে খেতেই না হয় কথা বলা যাক।

রিয়া ওর মোবাইল থেকে একটা ছেলের ছবি বের করে আমাকে দেখিয়ে বলল, লুক মাই বয়ফ্রেন্ড সানি। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। ওকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনাকেও না।

আমি মনে মনে খুব খুশি হলেও বেশিক্ষণ খুশি থাকতে পারলাম না। বাবার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই বললাম, তাহলে আপনি আপনার বাবাকে কেন বলছেন না যে আপনি এই বিয়েটা করতে চান না।

রিয়া মুখ ভার করে বলল, আমি বাবাকে ভীষণ ভয় পাই৷ বাবা প্রেম-ভালোবাসার কথা শুনলে ভীষণ রেগে যান। তার ধারনা প্রেমের বিয়ে গুলো টিকে কম। এই জন্য আমাকে বারবার করে বলে দিয়েছিলেন যে, প্রেম শব্দটা আমার জন্য নিষিদ্ধ। কিন্তু মন তো কারো নিষেধ মানে না৷ মনের তো কোনো গন্ডি নেই। সে তার আপন গতিতে চলে। ঠিক যতদূর ইচ্ছে ততোদূর পর্যন্ত।

আমি খুব আগ্রহ নিয়ে বললাম, তাহলে কী করবেন?

রিয়া আমার হাত ধরে বলল, আপনিই আমার একমাত্র ভরসা। আপনি প্লিজ বাসায় গিয়ে বলবেন যে, আমাকে আপনার পছন্দ হয় নি।

আমি ইতস্ততভাবে রিয়ার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, একই সমস্যা আমারও। আমি বাবার কথাতেই আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি। এই বিয়েতে আমারও মত নেই। আসলে আমি এখনই বিয়ে করতে চাইছি না। কিন্তু বাবাকে কী করে বোঝাই!

যেভাবেই হোক বোঝান। আপনার উপর আমার বাঁচা মরা ডিপেন্ড করছে।

একথা বলেই রিয়া কফিশপ থেকে বেরিয়ে গেল। আমি কিছুক্ষণ কফিশপে বসে রইলাম৷ কফি খেতে খেতে ভাবছিলাম বাবাকে ঠিক কী বলে বিয়েটা বন্ধ করবো। ঠিক এমন সময় কাঁচের ওপাশে চোখ আটকে গেল। একটা মেয়ে রেস্তোরাঁয় কিছু পথচারী শিশুর সাথে বসে খাবার খাচ্ছিলো। এ যুগের মেয়েরা সচরাচর বয়ফ্রেন্ড কিংবা বন্ধুবান্ধব নিয়েই রেস্তোরাঁয় খেতে আসে। সেখানে মেয়েটি পথচারী শিশুরদের সাথে এক টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছে। আবার বাচ্চাটাকে খাইয়েও দিচ্ছে। এরকম একটা দৃশ্য দেখে চোখ না আটকে থাকার উপায় আছে? আমারও চোখ আটকেছে এই দৃশ্যে। আমি কফিশপ থেকে বেরিয়ে পাশের রেস্তোরাঁর দিকে যাচ্ছিলাম। ইতোমধ্যেই এক বৃদ্ধ লোক এসে হাত পাতলো আমার সামনে। আমি একবার বৃদ্ধ লোকটির দিকে তাকালাম আরেকবার মেয়েটির দিকে তাকালাম। বৃদ্ধ লোকটিকে বললাম, খাওয়া হয়েছে?

বৃদ্ধ লোকটি না সূচক মাথা নাড়ালেন।

আমি বললাম, চলুন আজ আমি আপনাকে খাওয়াবো। একথা বলেই তাকে নিয়ে রেস্তোরাঁর ভেতরে গেলাম। বৃদ্ধ লোকটির জন্য খাবার অর্ডার করলাম। মেয়েটি তখন রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। তাড়াহুড়োয় পার্সটা ফেলেই চলে যাচ্ছিলো। আমি তাকে পেছন থেকে ডেকে বললাম, এক্সকিউজ মি! আপনার পার্সটা ফেলে চলে যাচ্ছেন।

মেয়েটি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলল, ওহ! দেখেছেন তারাহুরোয় কখন হাত থেকে পরে গেছে টের পাই নি। অনেক ধন্যবাদ।

খুব কাছ থেকে মেয়েটিকে দেখার সুযোগ পেলাম। স্কাই ব্লু রঙের সেলোয়ার-কামিজ, হাত ভরা চুরি, কপালে ম্যাচিং টিপ, খোলা চুল। হাসলেই ডান গালে টোল পরে। একটু আগে যখন আমাকে হেসে ধন্যবাদ দিচ্ছিলো তখন খেয়াল করেছিলাম ব্যাপারটা। আমি কিছু একটা বোধহয় অনুভব করলাম। প্রথম দেখায় বুকের মধ্যে বসন্তের শীতল হাওয়া বইয়ে দেয়ার মতন।

আমি মৃদু স্বরে বললাম, আপনি কি রোজ এখানে আসেন?

মেয়েটি আবারও হাসলো। সঙ্গে সঙ্গেই তার ডান গালে আবারও সেই টোল পড়া হাসি দেখে আমি আবারও কিছু একটা অনুভব করলাম।
সে মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ। অফিস শেষে সোজা এখানেই চলে আসি।

রেস্তোরাঁর বাইরে থেকে একটা মেয়ে ওর নাম ধরে ডাকলো, কুহু তাড়াতাড়ি আয়।

সে আমাকে পুনরায় ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেল। আমি অবাক হয়ে তার চলে যাওয়া দেখছিলাম। আর মনে মনে তার নামটা বলছিলাম, কুহু…..

আমি জানিনা আমার কী হয়েছে। আমি শুধু জানি আমাকে যে করেই হোক এই বিয়েটা আটকাতে হবে। তবে আমি জানি এটা খুব সহজ হবে না আমার জন্য।
_________________________________

কুহু.
বাড়িতে ফেরার পর প্রত্যেক দিন দেখবো আমার রুমটা অগোছালো হয়ে আছে। সকালে গুছিয়ে অফিস যাই আর ফিরে এসে দেখি সব লণ্ডভণ্ড হয়ে থাকে। কিন্তু সেই জন্য আমি মোটেও রাগ করি না। এ বাড়িতে একজনই আছে যে আমার সব কিছু এলোমেলো করে দিলেও তার মুখটা দেখার পর আমি সব ভুলে যাই। সে আর কেউ নয়। আমার বড় আপার একমাত্র ছেলে মুন্না। আদর করে আমি ওকে ডাব্বু সোনা বলে ডাকি। ডাব্বুর বয়স সাড়ে পাঁচ বছর। ডাব্বু যখন পেটে ছিল তখন বড় আপার সাথে দুলাভাইয়ের ডিভোর্স হয়ে যায়। ডাব্বুর জন্মের পর থেকে আমি প্রমিজ করেছিলাম, ওকে আমি এতো আদরে বড় করে তুলবো যাতে ও কখনও বলতে না পারে ওর বাবা নেই।

আমি কুহু। পুরো নাম কুহেলিকা। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরতে কোনো রকমে একটা চাকরি জোগার করেছি। এই চাকরিটার জন্যই আমাদের সংসারটা টিকে আছে। মা যদিও মাঝে মাঝে খুব তিক্ত হয়ে যায়। বড় আপা পড়াশোনাটা শেষ করেনি বলে চাকরির জন্য ট্রাই করতে পারেনা। তখন বারবার করে বলেছিলাম বিয়ে দেয়ার আগে একটু ভালো করে খোঁজ খবর নিতে। কেউ শোনেনি আমার কথা। এরপর কী হলো! হাজারটা অশান্তি, বড় আপার পড়াশোনা বন্ধ আর শেষে ডিভোর্স।

কিরে অফিস থেকে কখন ফিরলি?

এই তো বড় আপা মাত্রই ফিরলাম।

বড় আপা আমতা আমতা করে বলল, দেখছিস আজকেও ডাব্বুটা তোর ঘরের মধ্যে তান্ডব চালিয়েছে। কেন যে ওকে এতো আশকারা দিস তুই!

আমার ডাব্বু সোনার জন্য আমি সব করতে পারি। এই সামান্য ঘর এলোমেলো করা নিয়ে আমি ওকে বকবো? তুই ভাবলি কী করে বড় আপা!

বড় আপা আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বলল, তুই আর তোর ডাব্বু। দুটোই এক।

আমি মৃদু হেসে পার্সটা টেবিলের উপর রাখলাম। হঠাৎ মনে পড়লো ফোনটা তো নেই! আরে কোথায় রাখলাম! পার্সটা খুলে দেখি ভেতরেও নেই। এটা আবার কোথায় ফেলে দিয়ে এলাম!!

বড় আপা কপাল কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কী রে কী হয়েছে? কিছু খুঁজছিস?

হ্যাঁ রে। আমার ফোনটা পাচ্ছি না। কোথায় ফেলে এলাম বলতো?

অফিসে নিশ্চয়ই।

আরে না। অফিস থেকে ফোন নিয়েই বেরিয়েছি।

তাহলে কোথায় হারালি?

মনে পড়েছে। অফিস থেকে বেরিয়ে রেস্তোরাঁয় ঢুকেছিলাম। সেখানেই হয়তো ফেলে এসেছি। ইশশ! একবার পার্সও ফেলেছিলাম। এক ভদ্রলোক ডেকে বললেন পার্সের কথা৷ এখন দেখ ফোনটাও ফেলে রেখে এসেছি।

এখন আর ওই ফোন পাবি বলে মনে হচ্ছে না। ওটা গেছে।

তাও একবার গিয়ে দেখি। যদি ওই ভদ্রলোকের মতো কেউ পেয়ে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই পাবো।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here