চুপকথা-২
Zannatul Eva
তিয়াশ.
বাসায় ফেরার পর থেকে একনাগাড়ে ভেবে যাচ্ছি বাবাকে কিভাবে বলবো যে আমি রিয়াকে বিয়ে করতে চাই না। এ সময়ে বাবা নিজের কাজে ব্যস্ত থাকেন। তাও গুটিগুটি পায়ে বাবার রুমে গেলাম। বাবা ল্যাপটপে মুখ গুজে বসে আছে। আমি দরজায় নক করে বললাম, ভেতরে আসবো?
বাবা হালকা কেশে বলল, এসো। কিছু বলবে?
আমি শান্ত গলায় বললাম, জ্বী। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল।
বাবা ল্যাপটপটা সাইডে রেখে বলল, বলো কী বলতে চাও।
আমি এখন বিয়েটা করতে চাইছি না। একচুয়েলি আমি আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই।
বাবা গম্ভীর স্বরে বললেন, তো তুমি কী এখন অন্যের পায়ে দাঁড়িয়ে আছো?
আমি নিচু স্বরে বললাম, অনেকটা সেরকমই।
বাবা রাগি স্বরে বললেন, মানে?
আমি তো এখন কিছুই করি না। চাকরির জন্য বিভিন্ন কোম্পানিতে চেষ্টা করতে চাই৷ নিজের একটা আইডেন্টিটি তৈরি করতে চাই।
শরীফ আহমেদের একমাত্র ছেলে অন্যের কোম্পানিতে চাকরি করবে? হাউ ফানি! তোমার চাকরি করার কী দরকার! তোমার বাবার এতো বড় বিজনেস। তুমি চাইলে আমার বিজনেস দেখাশোনা করো। তোমার কী মনে হয় আমি আমার ছেলেকে অন্যের আন্ডারে কাজ করতে দিবো? আমার এতো কষ্টের বিজনেসটা আজ এতো বড় পজিশনে দাঁড় করিয়েছি। তা কী এই দিন দেখার জন্য? লিসেন মাই সন, আমি আমার শৈশবে যেই কষ্ট করেছি আমি চাই না তুমিও সেই একই কষ্ট করো। কাল থেকে তুমি আমার অফিসে জয়েন করবে। আমি সবাইকে বলে রাখবো। সবাই তোমাকে হেল্প করবে। ইজ ইট ক্লিয়ার?
জ্বী বাবা।
আমার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। কিন্তু আমি কিছু বলতে পারছি না। ছোট বেলা থেকে এটাই হয়ে আসছে আমার সাথে। জীবনের প্রত্যেকটা ডিসিশন বাবা একাই কেন নিয়ে নেয়! আমার জীবন। সেখানে আমার কোনো সে থাকতে পারে না!
কুহু.
রেস্তোরাঁর ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ভাইয়া কাল আমি আপনাদের এখানে একটা ফোন ফেলে চলে গিয়েছিলাম৷ আপনারা কী ফোনটা পেয়েছেন?
মনে মনে শুধু বলে যাচ্ছিলাম, ফোনটা যেন পেয়ে যাই। এ মাসে এমনিতেই টানাটানিতে পড়ে যাবো। তার মধ্যে যদি ফোনটা যায় তাহলে আরও সমস্যা হবে। ক্যাশ কাউন্টারের লোকটার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি বোধহয় কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ পর উনি বললেন, একটা বাটন ফোন?
হ্যাঁ হ্যাঁ ভাইয়া। পেয়েছেন?
আপনার ভাগ্য ভালো। আমরা বলে পেয়ে গেলেন। অন্য কোথাও হলে এই ফোন আর পেতেন না। এতো বড় উপকার করলাম সেই খাতিরে মাঝেমধ্যে আসবেন এখানে।
আমি মৃদু হেসে বললাম, এখানে যাদের আসা যাওয়া তারা আমার এই ভাঙ্গাচোরা বাটন ফোনটা কেন মেরে দিবে বলুন! সবাই স্মার্ট ফোন ইউজ করে।
লোকটা অট্টহাসি দিয়ে বলল, এ জগতে সেই বেশি চায়, যার অনেক আছে। তাছাড়া আপনিও তো বাটন ফোন ইউজ করেন। তা বলে কী রেস্তোরাঁয় আসতে নেই?
অবশ্য ভুল কিছু বলেনি লোকটা। তবে আমার এখানে আসা হয় তন্নীর জন্য। বড় বড় রেস্তোরাঁ ছাড়া তন্নীর আবার খাবার মুখে রোচে না৷ রোজই আমাকে ধরে বেঁধে নিয়ে আসে। নিজে গাণ্ডেপিণ্ডে গিলবে সাথে আমাকেও। অবশ্য পকেটে টাকা থাকলে খরচ করতে গায়ে লাগে না। অল্প অল্প করে কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। সেটা দিয়ে কাল পথচারী শিশুদের ভালো মন্দ খাইয়েছি। অনেক দিনের আশা ছিল আমার একটা ভালো রেস্তোরাঁয় ওদের খাওয়াবো। ওদেরও তো ইচ্ছে করে ভালো মন্দ খেতে। এ মাসের টিউশনির বেতন গুলো একটু আগেভাগে চেয়ে নিতে হবে। ডাব্বুকে একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করতে হবে। কত টাকার দরকার! আজকে ওই জুতার কোম্পানির অফিসটায় একবার যেতেই হবে। যদি একটা বেশি বেতনে চাকরি জোগার হয় তাহলে এই চাকরিটা ছেড়ে দিবো।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে রিকশার জন্য দাঁড়ালাম। এমন সময় পেছন থেকে একজন ডেকে বলল, আপনি সেই না! কাল পার্স ফেলে চলে যাচ্ছিলেন।
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, লম্বা মতো একটা ছেলে। পরনে লাইট ব্লু জিন্স, অলিভ কালার টি-শার্ট আর পায়ে হাই নেক কেডস। মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভালো কোনো পরিবারের ছেলে। অনেকটা বড়লোকের আদুরে ছেলেদের মতন। কাল এতোটা খেয়াল করে দেখিনি।
আমি একটা হাসি দিয়ে বললাম, হ্যাঁ আমি সেই। আর শুধু পার্স না কাল আমি নিজের ফোনটাও ফেলে গিয়েছিলাম। ভাগ্য ভালো পেয়ে গেলাম।
ছেলেটা অবাক হয়ে বলল, পেলেন!! আজকাল ফোন টোন হারালে পাওয়া যায় না সচরাচর। ইউ আর লাকি।
আমি হেসে বললাম, এই ভাঙ্গাচোরা ফোনটা হয়তো কারো নজর কাড়তে পারেনি৷ তবে আমার কাছে এটা অনেক বেশি দামী। টিউশনির টাকা জমিয়ে কিনেছিলাম তো তাই।
ছেলেটা কিছুক্ষণ আমার ফোনটার দিকে তাকিয়ে রইলো। হয়তো ভাবছে এ যুগের মেয়ে হয়ে এমন কম দামী ভাঙ্গাচোরা ফোন কেন চালাই৷ এ তো প্রথম না। এর আগেও আমি এরকম সিচুয়েশনে পড়েছিলাম। আমাকে দেখতে আসা এক পাত্র তো মুখের উপরই বলে দিয়েছিলো আমি ভীষণ ব্যাকডেটেট। সেই সম্বোন্ধটা ক্যান্সেল হয়ে যাওয়া পর মা ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছিলো। মায়ের জীবনে একটাই টার্গেট আমাকে বিয়ে দেয়া। সারাক্ষণ এই বিয়ে নিয়ে চিন্তা করে নিজের শরীরটা আরও খারাপ করে ফেলছে।
আমি আমার ভাবনার জগৎ থেকে বেরোতেই ছেলেটা বলল, অবশ্যই দামী হওয়া উচিত। নিজের উপার্জনে কেনা যে কোনো জিনিসই ভীষণ দামী হয়। এই যে আমাকে দেখুন। গাড়ি বাবার, বাড়ি বাবার, হাতের ফোনটাও বাবার দেয়া। এমনকি পরনের টি-শার্টটাও বাবার কিনে দেয়া। সেদিক থেকে আপনি ভীষণ লাকি। আপনাকে কারো উপর ডিপেন্ড করতে হয় না।
আমি মৃদু হাসলাম। বললাম, আপনার মাথার উপর বটগাছ আছে তাই আপনার রোদ ভালো লাগে। অথচ কেউ কেউ একটু খানি ছায়ার অভাবে দিনশেষে বড্ড হাঁপিয়ে উঠে। আসলে আমাদের একেক জনের জীবনের সংজ্ঞা একেক রকম৷
ছেলেটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। রিকশা আসতেই আমি আমার গন্তব্যে চলে গেলাম।
তিয়াশ.
কে তুমি? শুধু নাম ছাড়া তোমার সম্পর্কে আর কিছুই জানিনা। তবে তুমি যে খুব দায়িত্ববান একটা মেয়ে সেটা বেশ আন্দাজ করতে পারছি। কী জানি একদিনের দেখায় কেন আমি আবার এখানে ছুটে চলে এলাম তোমাকে দেখবো বলে। ফাইনালি দেখা হয়েও গেল। সব কিছু নাকি উপর থেকে সেট করা থাকে। আমাদের দেখা হওয়াটাও কী তাই? কে জানে! হয়তো। হয়তো না।
এরমধ্যেই রিয়ার ফোন এলো। ফোন ধরলে এখনি জিজ্ঞেস করবে বাবাকে বলেছি কিনা। কী করবো এখন! ধরবো? অনেক ভেবে চিন্তে ফোন রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে রিয়া বলল, বলেছেন?
বলেছিলাম। কিন্তু বাবা বললেন চাকরি করার দরকার নেই বিজনেস দেখাশোনা করতে।
আমি আপনার কথা জিজ্ঞেস করিনি। আপনি কী আপনার বাবাকে বলেছেন যে আপনি আমায় বিয়ে করতে চান না?
আপনি আমার উপরে সবটা চাপিয়ে দিচ্ছেন কেন বলুন তো? আপনিও তো বলতে পারেন। নিজের প্রেমিককে বিয়ে করার জন্য এটুকু রিস্ক নিতে পারছেন না!
রিয়া রেগেমেগে ফোন কেটে দিলো। কী অদ্ভুত মেয়েরে বাবা! নিজের প্রেম সাকসেসফুল করার চাকরি আমার কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে নিজে দিব্যি আছে। ওদিকে বিয়ে করবো না বললে যে সমস্ত চাপ আমার উপর দিয়েই যাবে সেটার কী হবে! হাহ তিয়াশ! নিজের তো কিছু হলো না৷ তুই এখন বরং অন্যের প্রেম সাকসেসফুল করার চাকরি কর। সেটাই তোর জন্য ভালো।
তবে রেস্তোরাঁর মেয়েটা বারবার আমাকে ভাবাচ্ছে। কেন ভাবাচ্ছে জানিনা। কিন্তু বারংবার আমাকে ভাবনার অতল গভীরে ফেলে দিচ্ছে। আজও ওকে মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। চোখেমুখে কী যেন এক মায়া খেলা করে। হাসলেই গালে টোল পড়ে। তখন এক অদ্ভুত সৌন্দর্য মিলেমিশে আরও মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। সেই মুগ্ধতা কেবল আমাকেই ঘায়েল করেছে! নাকি আমার আগে অন্য কেউ এই মায়াবতীর মুগ্ধতায় মুগ্ধ হয়ে বসে আছে! এটা জানা জরুরি৷ জানতে হলে আমাকে আবারও এই রেস্তোরাঁয় আসতে হবে। হয়তো গল্পের শুরুটা এখান থেকে হবে।
তবে এখন আমাকে বাবার অফিসে যেতে হবে। আজকেই জয়েন করার কথা ছিল। যদি জানো আমি এখনও অফিস যাই নি তাহলে আবার ভাষণ দেয়া শুরু হয়ে যাবে।
কিন্তু অফিসে গিয়ে কোনো লাভ হলো না। আমার জন্য অফিসে কোনো কাজ নেই। আমি শুধু রোবটের মতো চেয়ারে বসে থাকবো। এই জন্যই বাবা আমাকে অফিস জয়েন করতে বলেছিলো!
ম্যানেজার বললেন, আজ প্রথম দিন তাই স্যার আমাকে বলেছেন আপনাকে শুধু অফিসটা ঘুরিয়ে দেখাতে আর সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে।
ঠিক আছে। চলুন আগে সবার সাথে দেখা করে আসি।
সবার সাথে কথা বলে আমি আমার কেবিনে এসে বসলাম। কিছুক্ষণ পর ম্যানেজার এসে বললেন, স্যার একজন চাকরির খোঁজে এসেছে। পাঠাবো?
পাঠিয়ে দিন। আর হ্যাঁ আমাকে আপনি না বলে তুমি করে বলবেন। আমি আপনার ছেলের বয়সী।
ম্যানেজার একটা হাসি দিয়ে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর একজন দরজায় নক করলো। আমি তাকে ভেতরে আসতে বললাম। তবে তাকে দেখে তৃতীয় বারের মতো আমার চোখ আটকে গেল। এই তো সেই মায়াবতী। এবার ও নিজেই আমার সামনে চলে এলো। ঘুরে ফিরে আমাদের আবারও দেখা হয়ে গেল। পরনে গোলাপি রঙের সেলোয়ার-কামিজ, কপালে ম্যাচিং টিপ আর হাত ভর্তি চুরি, খোলা চুল। দু’হাতে ফাইল আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে হতাশার ছাপ।আমাকে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। শান্ত গলায় বলল, আপনি!!
চলবে………