#চুপকথা-২২
Zannatul Eva
বাড়িতে ফেরার পর থেকে আমি তিয়াশকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করলাম। মনের কোণে কোথাও একটা তিয়াশ আছে বলে মনে হচ্ছে বারবার। ভালোবাসি কিনা জানিনা তবে ওকে নিয়ে ভাবতে খুব ভালো লাগছে। ওর কথা মনে পড়তেই আনমনে হেসে উঠছি। রাফসানের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো এটা সত্যি কিন্তু ওর জন্য কখনও এরকম ফিল করিনি। ওর সাথে ভালোবাসার সম্পর্কটা গড়ে উঠার আগেই ও না ফেরার দেশে হারিয়ে গিয়ে আমার নামের আগে বসিয়ে দিয়ে গেল অপয়া, পোড়ামুখী। অবশ্য এখানে রাফসানের কোনো দোষ নেই। দোষ আমাদের সমাজের। এখানে বিয়ের আগে হবু বর মারা গেলে লোকে বলে, মেয়েটা বিয়ের আগেই স্বামীকে খেয়ে ফেলল! কেমন অপয়া মেয়ে! আবার কোনো মেয়ের ডিভোর্স হলেও ভাবে, মেয়েটারই বোধহয় সব দোষ ছিল। একটা মেয়ে ধর্ষণ হলে সেই মেয়েটাকেই কিন্তু লজ্জায় মুখ লুকাতে হয়। অথচ ধর্ষক কী সুন্দর ঘুরে বেড়ায় আমাদের সমাজে, আমাদের আশেপাশে। এই সমাজ পুরুষকে রেখেছে সবার উপরে। যত প্রশংসা সব পুরুষদের জন্য আর যত অপবাদ সব মেয়েদের জন্য বরাদ্দ। হায়রে অদ্ভুত সমাজ! কবে দূর হবে এই বৈষম্য? কবে?
এসব ভাবতে ভাবতেই ফোনটা বেজে উঠলো। কেন জানিনা আমার মনে হলো তিয়াশ ফোন করেছে। কিন্তু না, স্ক্রিনে আপার নামটা ভাসছে। আমি ফোন রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে আপা বলল, পায়ের কী অবস্থা।
আগের চেয়ে একটু বেটার।
অফিস যাস না আবার এই পা নিয়ে।
কিছুক্ষণ আগেই ফিরলাম অফিস থেকে।
কী! কী দরকার ছিল এই ব্যাথা পা নিয়ে যাওয়ার!
সামান্য ব্যাথার জন্য কি ঘরে বসে থাকবো? বসের ধমকানিটা তো পরে আমাকেই শুনতে হবে।
তুই পারিস বটে। এই শোন না, তিয়াশ ফোন করেছিলো তোকে?
না তো। কেন?
ধূর বাবা কোথায় ভাবলাম ফোন করে তোদের লাভ স্টোরি শুনবো তা না। এখনও বলে নি ছেলেটা।
তুই শুধু শুধুই এক্সাইটেড হচ্ছিস আপা। হতে পারে এরকম কিছুই হলো না।
হবে না মানে! আলবাত হবে। হতেই হবে। না হলেও আমি হওয়াবো।
কিন্তু ভালোবাসা কি আর জোর করে হয়!
এই শোন না, মামি মা ডাকছে। এখন রাখছি। তুই কিন্তু আমাকে সব বলবি। আর হ্যাঁ মাকে বলিস পরে কথা বলবো।
আচ্ছা।
আপার ফোন কাটতেই দেখি তিয়াশ ফোন করেছে। ধরবো? কল ধরলেই যদি আমাকে প্রপোজ করে বসে! কেমন যেন একটা ভয় ভয় লাগছে। ও আমাকে ভালোবাসে এটা জানার আগ পর্যন্ত সবটাই ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু যবে থেকে জেনেছি, ও আমাকে নিয়ে অন্য কিছু ভাবছে তখন থেকেই কেমন যেন অদ্ভুত একটা ফিলিংস হচ্ছে। যেটা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।
এসব ভাবতে ভাবতেই ফোনটা কেটে গেল। আমি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। একটা নিঃশ্বাস ফেলে ঘাড় ঘুরাতেই আবারও ফোন বেজে উঠলো। এবার সাত-পাঁচ না ভেবেই ফোনটা রিসিভ করলাম।
পা কেমন আছে?
পায়ের কাছে ফোন করে জেনে নিলেই হয়।
পায়ের মালিকের কাছেই জানতে চাইলাম।
আগের থেকে বেটার।
আচ্ছা আমরা কি কাল কফিশপে দেখা করতে পারি?
কথাটা শুনেই আমি ভয় পেয়ে গেলাম। বুঝতে বাকি রইলো না তিয়াশ আমাকে কেন কফিশপে দেখা করার জন্য বলছে। কিন্তু আমার এখন কী করা উচিত! ঠিক বুঝতে পারছি না।
হ্যালো! শুনতে পাচ্ছো আমার কথা?
আমি ভাবনা থেকে বেরিয়ে বললাম, কখন?
এনি টাইম। তোমার সুবিধে মতো সময় বের করলেই হবে।
আচ্ছা আমি জানাবো টেক্সট করে।
ওকে, নাউ বাই।
বাই।
ফোন রাখার পর থেকেই আমার কেমন যেন একটা ফিলিংস হচ্ছে। কাল যদি তিয়াশ আমাকে প্রপোজ করে, তখন কী করবো আমি? ওর বাবা হয়তো কখনও এরকম মধ্যবিত্ত পরিবারে তার ছেলের বিয়ে দিতে রাজি হবেন না। আমার মনে হয় তিয়াশকে এক্সেপ্ট করা আমার ঠিক হবে না। একটা সম্পর্ক গড়ে তোলার আগে তার ভবিষ্যৎ চিন্তাভাবনাও করতে হয়। সম্পর্কের পরিনতি ঠিক কী হবে সেটা হয়তো আমার অজানা কিন্তু কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছি। তিয়াশ এমন একটা ছেলে যাকে ভালো না বেসে থাকা যায় না। ওকে ফিরিয়ে দিতেও আমার খুব খারাপ লাগবে। কিন্তু বাস্তবতা যে বারবার চোখে আঙুল দিয়ে নিজের অবস্থানটা দেখিয়ে দেয়।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তি যেন আমার চোখের উপর এসে ভর করলো। আমি সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
_________________
তিয়াশ.
ভাই তুমি কিন্তু আমার সাথে থাকবে। তুমি না থাকলে আমি ভীষণ নার্ভাস হয়ে যাব। আর একটু শিখিয়ে দিও তো কিভাবে ওকে বলবো, আমি ওকে ভালোবাসি। মানে ডিরেক্ট আই লাভ ইউ বলাটা ভীষণ বোরিং লাগে। ভালোবাসি না বলে বোঝাতে চাই আমি মিস কাদাবতীকে ঠিক কতটা ভালোবাসি।
পিয়াসের কথা গুলো আমার কানে বিষের মতো বিধলেও আমাকে এই বিষ হজম করে নিতে হবে। নিজের ভাইয়ের স্বপ্ন ভেঙ্গে দেয়ার কোনো অধিকার আমার নেই। আমার জীবনে তিনটে মানুষ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত আমার মা। যে আমাকে সবচেয়ে বেশি বোঝে। দ্বিতীয়ত আমার ভাই। যে আমার সবচেয়ে আদরের। আর…….. মায়াবতী। যাকে আমি পৃথিবীর সব সুখ এনে দিতে চাই। আমি জানি পিয়াশ কুহুকে খুব ভালো রাখবে।
ভাই আমি কী পরবো বলো তো? কাদাবতীকে প্রপোজ করতে যাচ্ছি। একটু স্পেশাল তো দেখাতেই হবে বলো!
আমি পিয়াশের গায়ে অফ হোয়াইট শার্টটা ধরে বললাম, পারফেক্ট।
পিয়াশ বলল, দেখেছো ভাই তোমাকে ছাড়া আমার কোনো কাজই ঠিকঠাক হয় না। তুমি পাশে থাকলে আমি গোটা বিশ্ব জয় করতে পারবো। আর কাদাবতীকে প্রপোজ করা তো সামান্য ব্যাপার। শুধু তুমি পাশে থাকলেই হবে।
আমি মায়াবতীর জন্য আনা সাদা গোলাপটা বইয়ের ভাজে রেখে দিয়ে মৃদু হাসলাম। মনে মনে বললাম,
“কিছু কথা হয়তো না বলাই থেকে যায়
কিছু অনুভূতি চুপকথার মতো শুধু মন গভীরেই রয়ে যায়।”
___________________
অফিস শেষ করে সোজা কফিশপে চলে এলাম। কিন্তু তিয়াশের আসার নাম নেই। ছেলে গুলো বরাবরই এমন হয়। মেয়েদের অপেক্ষা করাতে পারদর্শী তারা। প্রায় আধাঘন্টা অপেক্ষার পর তিয়াশ এলো। ওকে দেখেই ভয়ে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিলো। জীবনে প্রথম মনে হয় আমি এতোটা ভয় পাচ্ছি। না ভূত দেখার ভয়, না এক্সামে দেরি করে পৌঁছানোর ভয়। এই ভয় একদম আলাদা। এই ভয় কিছুটা ভয়ের আর অনেকটা ভালো লাগার।
চলবে……..