চেরি ব্লসমের সাথে এক সন্ধ্যা পর্ব: ৪৩

0
1334

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪৩
____________

মিতুলের হৃদয় এখনও উথাল-পাথাল। ক্ষণে ক্ষণে জোহানকে মনে পড়ছে। কালকে সন্ধ্যায় জোহানের বলা প্রতিটা কথা স্পষ্ট ভাবে মনে গেঁথে আছে ওর। আচ্ছা জোহানের সামনে কীভাবে পড়বে আজকে? লজ্জাতেই যে মরে যাবে ও।
মিতুল আয়নায় ভালো করে একবার নিজের লজ্জামাখা মুখটা দেখলো। চেহারার অবস্থা কেমন যেন হয়ে গেছে। রাতে কিছু খায়নি। ঘুমটাও ঠিক মতো হয়নি রাতে। শেষ রাতের দিকে ফ্লোরে পড়ে পড়ে একটু ঘুমাতে শুরু করেছিল, তাও আবার দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুমটা ভেঙে গেল। ফজরের নামাজটা পড়ে একটু ঘুমাতে চাইলো, তাও কোনো লাভ হলো না। অনেকক্ষণ যাবত বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করে শেষমেশ উঠে যেতে হলো। তারপর সেই থেকে রুমের এ মাথা থেকে ও মাথা পায়চারি করে এখন এই আয়নার সামনে দাঁড়ালো।
পেটের বেহাল দশা। যেহেতু রাতে কিছু খায়নি। বেলাও হয়েছে অনেক। পেট এখন খিদেতে মরিয়া। এখন খাবার না খেলেই নয়। রুমে বসে বসে লজ্জা পেলে চলবে না। বাইরে গিয়ে খেতে হবে।
মিতুল ধীর পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে এলো।
দরজা খুলে প্যাসেজওয়ের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত উঁকি দিলো। কেউ নেই। মিতুল রুম থেকে বের হয়ে আস্তে করে দরজা লাগিয়ে দিলো।

জায়িনের রুম অতিক্রম করে আসার সময়ই রুম থেকে জায়িন বের হলো। দেখা হয়ে গেল জায়িনের সাথে। চোখাচোখি হলো। মিতুলের মনে পড়ে গেল জায়িনকে নিয়ে দেখা বাজে স্বপ্নটার কথা। আজকেই জায়িনকে নিয়ে স্বপ্ন দেখলো, আর আজকে রুম থেকে বের হয়েই জায়িনকে দেখলো প্রথমে! কেন? দেখা না হলে কি হতো না?
মিতুল সৌজন্য স্বরূপ জিজ্ঞেস করলো,
“অফিসে যাচ্ছ তুমি?”

জায়িন মাথা নেড়ে বললো,
“হুম, অফিসে।”
এর থেকে বেশি কিছু বললো না। মিতুলের আগে আগে চলে গেল সে।

মিতুলের জায়িনকে চরম বেয়াদব মনে হলো। এত সংক্ষিপ্ত কথায় উত্তর দিয়ে কীভাবে চলে যেতে পারলো জায়িন? ও যেমন একটা প্রশ্ন করেছে, তেমন করে তো জায়িনেরও একটা প্রশ্ন করা উচিত ছিল ওকে। তাই না? কিন্তু না, অহংকারীটার তো দেমাগে পা পড়ে না মাটিতে।

হলরুমে নেমেই মিতুল এদিক ওদিক উন্দ্বিগ্ন দৃষ্টি বুলাতে লাগলো। জোহান আশেপাশে কোথাও আছে কি না সেটা দেখছে। চারপাশে উন্দ্বিগ্ন দৃষ্টি রেখে এগিয়ে এসে ডাইনিং রুমের দরজার সামনে থমকে গেল।
ডাইনিং রুমে জোহান!
মিতুল দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো দ্রুত। ইশ, জোহান এখানে! এই সময় ও ডাইনিংএ কেন? আগে খেয়ে বেরিয়ে যেতে পারলো না? মিতুল উঁকি দিলো দরজা দিয়ে। তবে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না, আবার লুকিয়ে পড়লো। বুকের ভিতর ছটফট করছে। কী করে জোহানের সামনে যাবে? যদি যায়ও পরিস্থিতিটা কেমন হবে?
মিতুল একটু সময় নিয়ে ভাবলো, আচ্ছা ও কি এমন একটা ভাণ করবে যেন কালকে কিছুই হয়নি? এটা করা ঠিক হবে? ওহ না। এটা পারবে না ও।
মিতুল আবারও দরজা দিয়ে উঁকি দিলো। এবার বেশি সময় তাকিয়ে থাকলো। জোহানের হাতে মোবাইল। মোবাইল টিপছে। অন্যদিকে কোনো ধ্যান জ্ঞান নেই ওর। গায়ে সাদা একটা হুডি। মিতুলের মনে হলো আজকে জোহানকে খুব সুন্দর লাগছে। যদিও জোহান সবসময়ই সুন্দর। তবুও আজকে যেন একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। ওই বাদামি চুল, বাদামি চোখ, বাচ্চা মতন মুখ সব কিছুই আকর্ষণীয়। মিতুল কিছুক্ষণ বিভোর চোখে তাকিয়ে রইল।
জোহান একটু নড়েচড়ে বসতেই ওর সম্বিৎ ফিরলো। ও চকিতে লুকিয়ে পড়লো দেয়ালের আড়ালে।
এটা কী করছিল ও? জোহানকে নির্লজ্জ মেয়ের মতো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল? জোহানকে কেন এভাবে দেখছিল? সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছে না কি ও?
মিতুল একটু সময় লুকিয়ে থেকে আবার উঁকি দিলো। ওর হৃদস্পন্দন শিথিল। চোখ জোড়ায় জোহানকে দেখার একরাশ মুগ্ধতা। জোহানের ওই মিষ্টি মুখের মায়াতে হারিয়ে যাচ্ছে ও ধীরে ধীরে। চোখের পর্দায় আলতো করে কল্পনারা ভিড় জমাচ্ছে। ও দেখতে পাচ্ছে,
জোহান চেয়ার ছেড়ে উঠে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। জোহানের মাথার উপর থেকে চেরি পুষ্প ঝরছে একের পর এক। পুষ্প বৃষ্টিতে ভিজছে জোহান। আর নিজের বাদামি চোখ জোড়ার কোমল দৃষ্টি ওর উপর স্থাপিত করে এগিয়ে আসছে। ওকে এই দেয়ালের আড়াল থেকে হাত ধরে বের করে নিজের সাথে নিয়ে যাবে। জোহান এসে ওর সামনে দাঁড়ালো। জোহানের উপর এখনও পুষ্পবৃষ্টি ঝরছে। জোহান ওর দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিলো। ও অবাক হয়ে তাকালো একবার জোহানের মুখপানে। দুজনের চোখে চোখে যেন কিছু কথা হলো। মিতুল জোহানের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরার জন্য হাত উঠালো। জোহানের হাতে হাতটা রাখতে যাবে এর মাঝেই শুনতে পেল,
“মিতুল! এই মিতুল!”

ক্যামিলার ডাকে মিতুলের কল্পনা জগতের কড়া নড়লো। কল্পনা জগৎ থেকে ফিরে এলো নিজ বাস্তব জগতে। ভীষণ রকম হকচকিয়ে গেল। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো ক্যামিলা ওর পাশে দাঁড়িয়ে। মিতুল দ্রুত ডাইনিং রুমে বসে থাকা জোহানের দিকে তাকালো।
জোহান ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মিতুলের মনে হলো ওর চারপাশটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এটা কী করলো ও? জোহানকে নির্লজ্জের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিল, আবার তা ধরাও পড়ে গেল! এটা কী করলো? জোহান, ক্যামিলা দুজনে কী ভাববে ওকে? মিতুলের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছা করছে। চুরি করে ধরা পড়ে যাওয়ার মতো লাগছে ওর!

জোহান মিতুলকে দাঁড়ানো দেখে বললো,
“তোমার সাথে ব্রেকফাস্ট করবো বলে অনেকক্ষণ হলো এখানে বসে আছি। এত দেরি হলো কেন তোমার?”

মিতুল কিছু বলতে পারল না, শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

ক্যামিলা পাশ থেকে একটু নিচু স্বরে বললো,
“অনেকক্ষণ ধরে দেখছিলাম জোহানকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছো তুমি। বলি, জোহানকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার কী আছে? ওকে দেখতে চাইলে তো সামনে বসে বসেই দেখতে পারো। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার তো কোনো দরকার নেই।”
ক্যামিলা হেসে ডাইনিং রুমে ঢুকে গেল।

মিতুল ভালোই বিব্রত অবস্থায় পড়লো। ক্যামিলা ওকে নিয়ে মজা করলো?

“কী হলো? দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভিতরে এসো।”
ক্যামিলা ভিতরে আসার তাগিদ করলো মিতুলকে।

মিতুল প্রবেশ করলো। জোহানের সামনা সামনি একটা চেয়ারে বসলো।
জোহান বললো,
“ওখানে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলে আমায়?”

জোহানের কথায় ভারী লজ্জায় পড়ে গেল মিতুল। বলার মতো কিছু পেল না। বলবে কী? অস্বীকার তো করতে পারবে না। হাতে-নাতে ধরা পড়েছে। তাও জোহান একা থাকলে অস্বীকার করতে পারতো কথাটা। কিন্তু ক্যামিলা?

মিতুলের লজ্জা মাখা মুখ দেখে জোহান আর এ নিয়ে কথা বাড়ালো না।
ক্যামিলা খাবার সার্ফ করে দিচ্ছে।
জোহান হঠাৎ করে বললো,
“তুমি ওখানে বসলে কেন? এখানে এসে আমার পাশে বসো।”

জোহানের কথায় মিতুল চমকে উঠলো। একবার জোহানের দিকে তাকালো, আরেক বার ক্যামিলার দিকে। ক্যামিলা এখানে থাকতে জোহান এ কেমন কথা বলছে?

“তুমি এখনও ওখানে বসে আছো? বললাম তো আমার পাশে এসে বসো।”

মিতুল জোহানের পাশে গিয়ে বসা তো দূরের থাক, নিজ জায়গা থেকে একটু নড়লোও না। জোহানের পাশে গিয়ে বসার কথা তো দুঃস্বপ্নেও ভাববে না।

জোহান মিতুলকে স্থির দেখে বললো,
“ঠিক আছে, তোমার আসতে হবে না, আমিই আসছি।”
বলে জোহান নিজের চেয়ার ছেড়ে মিতুলের কাছে চলে এলো। মিতুলের ডান পাশে থাকা চেয়ারটা নিয়ে একেবারে মিতুলের কাছ ঘেঁষে বসলো।
মিতুল একটু নড়েচড়ে উঠলো। ক্যামিলার দিকে চোখ যেতে দেখলো ক্যামিলা মিটিমিটি হাসছে। মিতুলের মনে হলো ও লজ্জায় শেষ হয়ে যাবে। জোহান এ কেমন আচরণ করলো ক্যামিলার সামনে বসে? কী ভাবছে ক্যামিলা? ইশরে! এই মুখ এখন কোথায় লুকাবে ও?

জোহান কাঁটাচামচে পাস্তা গাঁথতে গাঁথতে বললো,
“আজকে আমি খাইয়ে দেবো তোমায়।”

মিতুল এবার অবাকের উপরও অবাক হলো। কী বলছে জোহান এসব? খাইয়ে দেবে মানে? মিতুলের লজ্জায় মরে যায় যায় অবস্থা হলো! ক্যামিলা এখানে আছে, আর জোহান ওকে খাইয়ে দেবে? জোহান কী ধরণের পাগলামি শুরু করলো! জোহান কি বোঝে না কোথায় কী বলতে হয়? উহ! এত অবুঝ কেন ছেলেটা!

জোহান চামচে গাঁথা পাস্তা মিতুলের সামনে ধরে বললো,
“হাঁ করো।”

মিতুল জোহানের দিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে বললো,
“কী করছো তুমি এটা? ক্যামিলা আছে এখানে। ওর সামনে বসে এমন করতে পারো কীভাবে?”

জোহান স্বাভাবিক কণ্ঠেই বললো,
“তো কী হয়েছে? সিস জানে আমাদের ব্যাপারে। ইট’স ও কে। হাঁ করো তুমি।”

মিতুলের মাথা ঘুরছে। ক্যামিলা জানে মানে? জোহান কালকের ব্যাপারে ক্যামিলাকে সব বলে দিয়েছে? কীভাবে এমন করে একটা মানুষকে বলে দিতে পারলো? লজ্জা, শরম নেই ওর?

“তুলতুল, ওপেন ইওর মাউথ।”

মিতুলের সংশয় হচ্ছে। কী করে জোহানের হাতে খাবে ও? পারবে না। মিতুল ঝড়ের বেগে ছো মেরে জোহানের হাত থেকে চামচটা নিয়ে, নিজ হাতেই খেয়ে নিলো।

জোহান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
“এটা কী করলে তুমি?”

_______________

বসন্তকালীন বৃষ্টি হচ্ছে। রিমঝিম ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। চারিপাশ বৃষ্টির শব্দে মাতোয়ারা। বন্ধ উইন্ডোর গ্লাসে বৃষ্টির পানি হানা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। মিতুলের ভালোই লাগছে। বন্ধ উইন্ডোর আড়াল থেকে ঝাপসা ভাবে লনের চেরি গাছগুলোকে দেখছে ও। পাপড়ি তো আরও অনেক ঝরে যাবে এই বৃষ্টিতে! সেটা ভেবে কিছুটা খারাপ লাগছে ওর।

জোহান মিতুলের রুমের দরজা খোলা পেয়ে ঢুকে পড়লো। রুমে প্রবেশের সময়ই জোহানকে দেখলো মিতুল। মিতুলের রাগ হলো। বললো,
“কারো রুমে ঢুকতে হলে নক করে ঢুকতে হয়। জানো না সেটা?”

জোহান মিতুলের কথায় কোনো ভ্রুক্ষেপ করলো না। কাছে এসে বললো,
“হেই তুলতুল, সাইকেলে করে ঘুরতে যাবে?”

মিতুলের রাগ আরও কিছুটা বৃদ্ধি পেল।
“ফাজলামো করছো আমার সাথে? এই বৃষ্টির মাঝে সাইকেল নিয়ে ঘুরতে যাব আমরা?”

“ফাজলামো করছি না। সিরিয়াসলি বলছি। যাবে কি না সাইকেল ভ্রমণে?”

মিতুলের ভ্রু কুঁচকে গেল। সিরিয়াসলি বলছে জোহান?
“বাইরে এত বৃষ্টি, শীত এর মাঝে সাইকেলে ঘুরতে যাবে তুমি?”

“হুম, অনেক ঘুরেছি আমি। বৃষ্টির মাঝেও দিব্যি সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায়।”

“সে গেলে তুমি যাও, আমি যাব না। এই বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধানোর শখ জাগেনি আমার।”

“জ্বর আসবে না।”

“কী করে বলছো তুমি? তুমি কি জ্যোতিষী? ভবিষ্যৎ বাণী করলে ভেজার আগেই?”

“জ্যোতিষী তো নই আমি। তবুও গ্যারান্টি দিলাম। চলো।”

মিতুল এর আগে কখনো বৃষ্টিতে সাইকেল করে ঘোরেনি। আজকে একটু ঘুরে দেখার ইচ্ছা হচ্ছে বৈ কি। তবে এই শীত, বৃষ্টির মাঝে সাইকেলে ঘুরতে যাওয়ার দুঃসাহস ও দেখাতে পারবে না।
“যাব না আমি। যেই শীত পড়েছে, তাতে বৃষ্টিতে ভিজলে হাত পা জমে ফ্রিজ হয়ে যাবে।”

“কিছুই হবে না। প্রথমে এমন মনে হলেও, একটু ভিজলেই দেখবে কোনো শীত নেই।”

“বোকা পেয়েছো আমায়?”

“তুমি তো বোকাই। ভেবেছিলাম বুদ্ধিমান হবে একটু। কিন্তু না, হলে না।”

রাগে মিতুলের মাথা গরম হয়ে গেল। চেঁচিয়ে বললো,
“হ্যাঁ, আমি তো বোকাই। তো এই বোকা মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে যাবে কেন? কোনো বুদ্ধিমতী মেয়ে নিয়ে ঘোরো না। ওই যে মেয়েটা, কী যেন নাম? ওই যে জড়িয়ে ধরেছিল তোমায়? ওকে নিয়ে ঘুরে বেড়াও।”

“এখনও ওর কথা মনে পুষে রেখেছো? ওয়াও!”

“এখানে ‘ওয়াও’ বলার কী আছে?”

“আছে অনেক কিছু। সে তুমি বুঝবে না। এখন এমন করো না। চলো আমার সাথে। তোমার খুব ভয় করলে তোমাকে রেইন কোট পরিয়ে নেবো।”

“তুমি কি পাগল? এই শীত, বৃষ্টির মাঝে আসলেই কি ঘুরতে যাওয়া সম্ভব? আর না হয় যাওয়া সম্ভব হলোই, তাই বলে কি আমরা ঘুরতে যেতে পারি? বাড়ির লোকরা কী বলবে? আজকে সবাই উপস্থিত আছে বাড়িতে। আর তাছাড়া তুমি ক্যামিলাকে তো সব বলেই দিয়েছো। গত পরশু দিন আবার ওর সামনে বসে আমাকে খাইয়ে দিতে চাইছিলে। তুমি কীভাবে অমন করতে পারলে? নির্লজ্জ কোথাকার!”

“খাইয়ে দিতে চাইছিলাম, খাইয়ে তো দিতে পারিনি। তুমিই তো খেলে না।”

মিতুল কিছু না বলে নীরব রইল। ওর ইচ্ছা করছে ঘুরতে যেতে। কিন্তু জোহানের কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। দেখা যাবে সত্যিই হাত পা জমে যাবে।

“কী? যাবে?” জোহান জিজ্ঞেস করলো আবার।

“না, যাব না।”

“ঠিক আছে, তাহলে আমি একা চলে যাচ্ছি।”
বলে যাওয়ার জন্য ঘুরলো জোহান।

মিতুল পিছন থেকে বলে উঠলো,
“খবরদার! কোথাও যাবে না। এই ঠাণ্ডায় বাইরে বের হলে যে অসুখ করবে, সেটা সুনিশ্চিত।”

জোহান একটু হেসে মিতুলের দিকে ফিরে তাকালো। বললো,
“আমার তুলতুল দেখছি আমার প্রতি খুব যত্নশীল হয়ে পড়েছে!”

মিতুল একটু লজ্জা পেল। সেই সাথে একটু চিন্তিতও হলো। জোহান যা বললো তা কি সত্যি? ও কি জোহানের প্রতি খুব যত্নশীল হয়ে পড়ছে?

জোহান বললো,
“চলো।”

“তোমাকে না বললাম আমরা যাব না সাইকেল ভ্রমণে। আবারও তুমি…”

“সাইকেল ভ্রমণে নয়। বারান্দায় চলো।”

“বারান্দায়! বারান্দাতেও বৃষ্টি।”

“একটুখানি বৃষ্টির ঝাপটায় কিছু হবে না। চলো।”

মিতুল আর না করতে পারলো না।

বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই বৃষ্টির অসংখ্য ছিটকে আসা ফোঁটা ওদের পায়ের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। শীতল বাতাসে মিতুলের হাত, পা কেঁপে উঠলো। শীত বাতাস নাকে ঢুকে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেবে বলে মনে হচ্ছে। মিতুল বললো,
“এত শীতল পরিবেশের মাঝে তুমি কীভাবে সাইকেল নিয়ে বাইরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারলে? এখানে দাঁড়িয়েই তো হাত পা জমে যাচ্ছে। এই বৃষ্টির মাঝে বাইরে গেলে নির্ঘাত মরে যেতাম দুজন।”
মিতুল গায়ের জ্যাকেটটা আরও ভালো করে আঁকড়ে ধরলো।

জোহান শীত কম্পিত মিতুলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো রেলিংয়ের দিকে।
মিতুল পিছন থেকে চমকিত কণ্ঠে ডেকে উঠলো,
“জোহান!”

জোহান একেবারে রেলিং এর সাথে মিশে ঘুরে দাঁড়ালো মিতুলের দিকে। বৃষ্টির পানি এখন খুব ভালো ভাবে লাগছে জোহানের গায়ে। ভিজিয়ে দিচ্ছে জোহানের গায়ের জ্যাকেট এবং জোহানকে।
মিতুল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। জোহানকে সত্যিই পাগল মনে হচ্ছে ওর। এই শীতের মাঝে অহেতুক বৃষ্টিতে ভিজছে কেন?

জোহান বললো,
“তোমাকে নিয়ে আজকে বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু কানাডার আজকের এই আবহাওয়াটা বড্ড বেপরোয়া। আমার ইচ্ছা বুঝলো না। জানি না তুমি থাকতে আর বৃষ্টি হবে কি না। তবে সমস্যা নেই। কানাডার বৃষ্টিতে না হোক, বাংলাদেশের বৃষ্টিতে প্রথম ভিজবো তোমার সাথে।”

মিতুল বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে। ওর মনের মাঝে মিষ্টি একটা অনুভূতি ছেয়ে গেল। চেরি ব্লসমের পাপড়ির মতো নিষ্পাপ, কোমল সেই অনুভূতি। মিতুল শান্ত, ধীর কণ্ঠে বললো,
“জোহান ভিজে যাচ্ছ তো তুমি। এখানে ফিরে এসো।”

জোহান হেসে বললো,
“আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। অনেক ভিজেছি আমি এই বৃষ্টিতে। আমার কিছু হয় না। আমি অনায়াসে ভিজতে পারি। আজ কানাডার বৃষ্টিতে একা ভিজছি। কিন্তু কোনো একদিন আমরা দুজন মিলেই ভিজবো। বাংলাদেশের বৃষ্টিতে ভিজবো দুজন একসাথে।”

মিতুল বিমোহিত চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই বলতে পারলো না।
জোহান রেলিংয়ের কাছ থেকে মিতুলের কাছে এগিয়ে এলো। ঝুঁকে মিতুলের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো,
“আমার লিটল এঞ্জেল কি অপেক্ষা করবে, আমার সাথে বাংলাদেশের বৃষ্টিতে ভেজার জন্য?”

জোহানের মুখ থেকে ‘আমার লিটল এঞ্জেল’ কথাটা শুনে মিতুলের হৃদয় শিহরিত হলো। বাইরের এই শীতল পরিবেশের সাথে সাথে ওর মনও শীতলতায় ছেয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির বৃষ্টি এই যে সবকিছু ভিজিয়ে দিচ্ছে নিজ পরশে, ঠিক তেমন করে ওর মনও ভিজছে। সুখময় বৃষ্টির ধারাতে প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে ওর মনের আঙিনা। লিটল এঞ্জেল! জোহানের লিটল এঞ্জেল ও!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here