#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪৫
____________
আজকে রিভার ভ্যালি পার্ক ঘুরতে যাচ্ছে মিতুল। জোহানের সাথে। বিকেল পর্যন্ত সেখানেই কাটাবে। এটা কিছুটা বনভোজনের মতো। মিতুলের আসলে জোহানের সাথে রিভার ভ্যালি পার্ক ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিল না। রেশমী আন্টি এবং ক্যামিলার সাথে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শপে অনেক কিছু কেনাকাটা করতে হবে দেখে রেশমী আন্টি যেতে পারবেন না। রেশমী আন্টির পার্কে যাওয়া বাড়িতে বসেই নাকোচ হলো তাই। এরপর কথা হলো, শুধু ও এবং ক্যামিলা যাবে। কথা অনুযায়ী বাড়ি থেকে বের হলো ক্যামিলার সাথে। ওদের গাড়িটা যখন এলাকা থেকে বের হওয়ার পথে, তখন হঠাৎ জোহানকে দেখা গেল। হাত দিয়ে ইশারা করে গাড়ি থামালো জোহান। ক্যামিলা রাস্তার পাশে পার্কিং সাইডে গাড়ি থামিয়ে নেমে গেল গাড়ি থেকে। জোহান উঠে বসলো সেখানে। আর ক্যামিলার জায়গা হলো পিছনে।
মিতুল অবাক হয়েছিল এই কাণ্ডে। ও চুপচাপ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলো সবটা। জোহান ওদের সাথে পার্কে যাবে এমন কোনো কথা হয়নি। জোহান খুব সকাল বেলা বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। যাওয়ার সময় বলেছিল, খুব ইম্পরট্যান্ট একটা জায়গায় যাচ্ছে। সারাদিন সেখানেই থাকবে। কেউ যেন ওকে মিস না করে আবার। মিস করার কথাটা যে মিতুলকে ইঙ্গিত করে বলেছিল, সেটা মিতুল বুঝতে পেরেছিল। সকাল বেলা অমন করে বিদায় জানিয়ে চলে গিয়ে এখন আবার এখানে এসে এই কাণ্ড ঘটালো।
জোহান গাড়িতে উঠে বসার পর মিতুল ভেবেছিল ওর এবং ক্যামিলার সাথে হয়তো জোহানও যাবে পার্কে। হ্যাঁ, জোহান যাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু ক্যামিলা যাচ্ছে না। ক্যামিলাকে তার বাড়ি পর্যন্ত ড্রপ করে দিলো জোহান। ক্যামিলা সাধারণত নিজ বাড়িতে খুব কম আসে। রেশমী আন্টিদের বাড়িতেই থাকে সবসময়। ক্যামিলার বাড়ি এডমন্টনের ভিতরেই।
জোহান ক্যামিলাকে বাড়িতে ছেড়ে দেওয়ায় মিতুল জিজ্ঞেস করেছিল,
“ক্যামিলা যাবে না আমাদের সাথে?”
জোহান উত্তর দিলো,
“না, শুধু তুমি আর আমি যাব। কেন? আমার একার সাথে যেতে সমস্যা আছে তোমার?”
মিতুল জোহানের কথার উত্তর দেয়নি তখন। জোহানের সাথে যেতে ওর কী সমস্যা থাকবে। বরং ভালো লাগছে।
ক্যামিলার সাথে না কি জোহানের আগেই কথা হয়েছে এ ব্যাপারে। বাড়িতে যখন ঘুরতে যাওয়া নিয়ে কথা হচ্ছিল, মিতুল তখন জোহানের নামটাও বলতে চাইছিল। কিন্তু রেশমী আন্টির সামনে সেটা মোটেই পারেনি। কিন্তু দেখো কী আজব কাণ্ড! জোহানের পার্কে যাওয়ার কোনো নাম গন্ধ না থাকলেও, সেই জোহানের সাথেই যাচ্ছে ও এখন। মিতুলের মনটা বেশ খুশি খুশি লাগছে।
অল্প কিছুক্ষণের ভিতরই পার্কে পৌঁছে গেল ওরা। এই পার্কে প্রবেশ করতে ওদের অনেক পথ হেঁটে উপর থেকে নিচে নামতে হলো। এটা অনেকটা পাহাড়ে হাইকিং করবার মতো। কারণ, নদীর পাড়ে অবস্থিত হওয়ায় এই পার্কটা শহরের মূল ভূখন্ড থেকে কিছুটা নিচে অবস্থিত। পার্ক থেকে যাওয়ার সময়ও ওদের আবার একই পথ অবলম্বন করতে হবে। পার্কের হাইকিং এর পথটি একটি ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলে গিয়েছে।
মিতুলরা নিজেদের সাথে নিয়ে আসা প্রয়োজনীয় সবকিছু ঘাসের চাদরে মোড়ানো ওপেন প্লেসে এনে রাখলো। প্রয়োজনীয় বলতে, ঘাসের উপরে বিছানোর জন্য একটা চাদর, একটা বালিশ এবং কিছু খাদ্য দ্রব্য।
জোহান বললো,
“চলো, আগে পার্কটা একটু ঘুরে দেখি।”
“এগুলো এখানে রেখে যাব? যদি কেউ নিয়ে যায়?”
“ওহ মিতুল, কে নেবে তোমার এসব জিনিস পত্র? তাকিয়ে দেখো, সবাই সবার প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে এসেছে। কেউ হাত দেবে না তোমার এগুলোয়।”
মিতুল আশেপাশে একবার তাকিয়ে দেখলো। বেশি না, মাত্র সাত-আট জন মানুষ ওপেন স্পেসগুলোতে শুয়ে বসে আছে।
মিতুল বললো,
“ঠিক আছে, চলো।”
পার্কটা ঘুরে দেখার সময় আরও অনেক মানুষকে চোখে পড়লো। তবে উইকেন্ডে এখানে মানুষের যে আনাগোনা থাকবে তার কাছে এটা খুবই নগণ্য।
রিভার ভ্যালি পার্কের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নর্থ সাস্কাচোয়েন রিভার। এই রিভারটি পার্কের মূল আকর্ষণ।
ওরা দুজন কিছুক্ষণ নদীর ধার ধরে হাঁটলো। মৃদু বাতাসের চলাচল মনে প্রশান্তির ছোঁয়া এনে দিলো মিতুলের।
জোহান বললো,
“এখানে বাতাসের গতিবেগ মাঝে মধ্যে খুবই প্রবল হয়। তখন নদীর ধারে হাঁটলে বিরক্ত ছাড়া আর কিছুই ফিল করতে পারবে না।”
“তুমি এই পার্কে এর আগে কতবার এসেছো?”
“এসেছিলাম বেশ কয়েকবার। একা এসেছি, আবার ফ্রেন্ডসদের সাথেও এসেছি। ফ্রেন্ডসরা মিলে পিকনিক করেছিলাম এখানে।”
“ও।” মিতুল আর কিছু বললো না। নীরব হয়ে গেল পরিবেশ।
এই রিভারটির এক পাশে পার্ক এবং অন্যপাশে ঘন জঙ্গল। জোহান বললো,
“এলাকার লোকজন প্রায়ই এখানে মর্নিং ওয়াক, ইভিনিং ওয়াক করতে আসে।”
মিতুল লক্ষ্য করলো নদীর ধারে বসবার ব্যবস্থা আছে। হয়তো নদীর ধারে বসে শান্ত সময় পার করবার জন্যই এই ব্যবস্থা। ওরা দুজন এগিয়ে এসে একটা বেঞ্চির উপর বসলো।
কিছুক্ষণ এখানে বসে থেকে নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করলো। তারপর আশেপাশে কিছু জায়গা ঘুরে আবার ফেরত এলো ওপেন প্লেসে। ওপেন প্লেসগুলোতে মানুষ জনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। মিতুল দেখলো ওদিকটায় একজন মা তার দুইটি যমজ সন্তান নিয়ে বসে আছে। মিতুলের ভুল না হলে বাচ্চা দুটির বয়স দুই বছরের বেশি না। মিতুল কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল মা এবং বাচ্চা দুটোর দিকে।
“ওদিকে তাকিয়ে কী দেখছো?” মিতুলকে দূরে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো জোহান।
“কিছু না।”
মিতুল ঘাসের উপর জোহানের বিছিয়ে দেওয়া চাদরটার উপর শুয়ে পড়লো। ওপেন প্লেসে থাকা মানুষগুলো ওদের থেকে দূরে নিজেদের অবস্থান করেছে। সকলেই একে অপরের থেকে বেশ দূরবর্তী।
মিতুল বড়ো করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করলো। শান্তি শান্তি লাগছে। এমন খোলা জায়গায়, বাতাসের মৃদু চলাচলের মাঝে এর আগে কখনো শোয়া হয়নি ওর।
মিতুল বেশ কিছুক্ষণ চোখ বুজে রইল। এর মাঝে হঠাৎ জোহানও শুয়ে পড়লো ওর পাশে। মিতুল ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই ধরফর করে উঠে গেল।
“এ কি! এখানে শুয়েছো কেন? একটা মেয়ের পাশে কীভাবে এমন করে শুয়ে পড়তে পারো তুমি? লজ্জা নেই তোমার?”
“কী করবো? তুমিই তো মাত্র একটা চাদর আর একটা বালিশ নিয়ে এসেছো।”
“তো? একটা চাদর আর একটা বালিশই তো নিয়ে আসবো। আমি আর ক্যামিলা তো এই একটা চাদর আর বালিশেই শুতে পারতাম। বালিশটা বড়ো দেখে এনেছি। ক্যামিলার জায়গায় যে হুট করে তুমি আসবে এখানে, সেটা কে জানতো? তুমি কি বলে কয়ে এসেছিলে?”
“তাহলে এখন আমি কী করবো? তুমি আমাকে এই চাদর এবং বালিশ থেকে বঞ্চিত করবে?”
“হ্যাঁ, অবশ্যই।”
বলে উঠে দাঁড়ালো মিতুল। তারপর জোহানের এক হাত ধরে টানাটানি করে জোহানকে চাদর থেকে নামিয়ে ঘাসের উপর এনে ফেললো।
“শুধু ঘাসের উপর থাকবে তুমি।”
জোহান উঠে বসে বললো,
“এভাবে টর্চার করছো তুমি তুলতুল? আমার জন্য কি তোমার মায়া নেই?”
“না নেই।”
বলে মিতুল একাই পুরো চাদর হস্তক্ষেপ করে শুয়ে পড়লো।
জোহান বললো,
“এটা ঠিক করছো না তুমি।”
মিতুল জোহানের কথাকে গ্রাহ্য না করে চোখ বুজলো।
জোহান একটু ভেবে বললো,
“চলো চাদরটা আধা আধা ভাগ করি।”
মিতুল জোহানের কথা কানেই তুললো না।
জোহান নিজের প্রতি এমন অবহেলা দেখে বললো,
“তোমাকে বিয়ে করার পর আমার অবস্থা কী হবে, সেটা ভেবে আমি এখনই শিহরিত।”
জোহানের কথা মিতুলের কান পর্যন্তই পৌঁছলো না। জোহানও আর কিছু বললো না। মিতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে নিঝুম হাসলো। ওপেন প্লেসে বেশিরভাগ জায়গায়তেই রৌদ্র। এ রোদ গায়ে লাগার মতো নয়। বরং এই রোদ গায়ে জড়িয়ে শুয়ে থাকার মাঝেই শান্তি। ওরা গাছের ছায়ায় চাদর না বিছিয়ে রোদের মাঝেই বিছিয়েছে। রোদটা শান্ত, নিবিড় হলেও মিতুলের মুখখানিতে রোদের দখলদারি ভালো লাগলো না জোহানের। জোহান হাত দিয়ে মিতুলের মুখের উপর পড়া রোদকে আড়াল করলো। ছায়া দিলো মিতুলের মুখে।
মিতুল চোখ বুজে থাকলেও বেশ বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। চোখ মেলে তাকালো ও।
জোহান বললো,
“কী দেখছো? যত্ন নিচ্ছি তোমার।”
মিতুল হেসে ফেললো। মাথার নিচ থেকে বালিশটা সরিয়ে পাশে ঘাসের উপর রেখে বললো,
“নাও। বালিশটা দিলাম তোমায়।”
জোহানও একটু হেসে মিতুলের দেওয়া বালিশে শুয়ে পড়লো ঘাসের উপর। পরিষ্কার ঘাস। চাদরের প্রয়োজন পড়ে না। জোহান গা থেকে খুলে রাখা কোটটা মুখের উপর দিয়ে নিলো।
জোহানের দেখাদেখি মিতুলও নিজের ওড়না দিয়ে মুখ ঢাকলো।
জোহান কোটের নিচ থেকে বললো,
“ডোন্ট ও্যরি তুলতুল। আমাদের যখন বিয়ে হয়ে যাবে, তখন আমরা আবার ঘুরতে এসে এক বালিশ আর এক চাদরে শোবো।”
মিতুলের গাল দুটো লাল হয়ে উঠলো লজ্জায়। যদিও তা ঢাকা পড়ে রইল ওড়নার আড়ালে। যত দিন যাচ্ছে ও ততোই বুঝতে পারছে, জোহানের লজ্জা আসলে বড্ড কম। বিয়ের কথা কী করে এমন ভাবে বলে দিলো? লজ্জা থাকলে কি কেউ এভাবে বিয়ের কথা বলে দিতে পারে?
____________
বিকেলের আলো পড়ে গেছে। প্রকৃতিতে অন্ধকারের বিরাজ হবে এরপর।
মিতুলের মন একটু খারাপ। জায়িনের সাথে বাইরে ডিনারে যেতে ইচ্ছা করছে না ওর। ওই অহংকারীটার সাথে কী করে একা একা ডিনার করবে? ভাবতেই মাথায় যন্ত্রণা ধরে যাচ্ছে। জায়িন আবার নিজ থেকে ওকে শাড়ি পরতে বলেছে। শাড়ি পরতেও ওর ভীষণ অনিচ্ছা। কিন্তু জায়িন নিজ থেকে বলার পরও যদি শাড়ি না পরে, তবে কেমন হবে? শত হলেও ও এখন জায়িনদের বাড়িতে থাকছে। জায়িনদের একজন অতিথি ও।
মিতুল অনিচ্ছা সত্ত্বেও জায়িনের দেওয়া হলুদ রঙা শাড়িটা পরলো। সাজতে ইচ্ছা করলো না, তারপরও শাড়ি পরেছে বলে সাজলো হালকা-পাতলা।
শাড়ি পরে মিতুল প্রথমেই দেখাতে এলো জোহানকে। জোহান বেডে হেলান দিয়ে মোবাইলে গেমস খেলছিল। মিতুলকে দেখতে পেয়ে মিতুলের দিকে মনোনিবেশ করলো।
মিতুল মনে একটা চাপা আনন্দ নিয়ে বললো,
“কেমন লাগছে আমায়?”
জোহান বিরক্ত মুখে বললো,
“আবারও শাড়ি পরেছো তুমি?”
মিতুলের মন থেকে চাপা আনন্দটুকু বিলীন হয়ে গেল। মন খারাপ হলো একটু। ওর ধারণা ছিল জোহান আজকে ওর প্রশংসা করবে। যেহেতু ওরা এখন রিলেশনশিপে আছে। কিন্তু জোহান ওর ধারণা মিথ্যা করে দিলো। আজ পর্যন্ত শুধরালো না জোহান। মিতুল বললো,
“আমাকে কি খুবই খারাপ দেখাচ্ছে?”
“খারাপ দেখাচ্ছে আমি কি সেটা বলেছি?”
জোহান একটু থামলো। পরে আবার বললো,
“এই সন্ধ্যায় শাড়ি পরেছো কেন? কোথায় যাচ্ছ শাড়ি পরে? কার্লের কাছে যাচ্ছ না কি আবার? আমি থাকতে এখনও কার্লকে মনে জায়গা দিয়ে রেখেছো?”
মিতুলের রাগ হলো।
“আমি কি বলেছি আমি কার্লের কাছে যাচ্ছি? এত অগ্রিম বোঝো কেন তুমি? আমি কার্লের কাছে না, তোমার ব্রাদারের সাথে ডিনারে যাচ্ছি।”
“ব্রাদারের সাথে? ডিনারে?”
“হুম।”
“কেন?”
“মানুষ কেন যায় ডিনারে?”
জোহান আর মিতুলের প্রশ্নের উত্তর দিলো না। বললো,
“ঠিক আছে যাও।”
মিতুল জোহানের রুম থেকে বেরোনো দিলে জোহান ডাকলো আবার।
“শোনো…”
“কী?”
“সুন্দর লাগছে তোমায়।”
মিতুল লজ্জা পেল। মন খারাপের রেশটুকুও কেটে গেল। কিছু না বলেই দ্রুত বেরিয়ে এলো জোহানের রুম থেকে। জোহানের মুখের প্রশংসা যে এত লজ্জাদায়ক হবে জানতো না ও।
মিতুল নিচে নেমে দেখলো জায়িন রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর জন্যই অপেক্ষা করছিল।
মিতুল কাছে আসতেই জায়িন একবার ওকে ভালো করে দেখে বললো,
“ঠিকই ধরেছিলাম। এই শাড়িতে খুবই সুন্দর লাগছে তোমাকে।”
জায়িনের মুখের প্রশংসা অতটাও ভালো লাগলো না মিতুলের। মিতুল একটু হেসে ধন্যবাদ জানালো জায়িনকে।
জায়িন মিতুলকে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট কারি কাবাবে নিয়ে এসেছে। এটা এডমন্টনের একটি হালাল রেস্টুরেন্ট। এখানে এসে যা অর্ডার করার তা সব জায়িনই করলো। মিতুলকে কী খাবে জিজ্ঞেস করতে মিতুল কিছু বলতেই পারলো না।
জায়িন অনেক কিছুই অর্ডার করলো। নান, তান্দুরী চিকেন, চিকেন বিরিয়ানি, ল্যাম কোরমা, সমুচা, রসমালাই ইত্যাদি।
মিতুলের কোনো কিছুই খেতে ইচ্ছা করছে না। জায়িনের সাথে এখানে বসে থাকতেই অস্বস্তিতে মরে যাচ্ছে ও। এই জায়িনের সাথে কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না। জায়িনের জায়গায় এখন জোহান থাকলে কী ভালোই না হতো!
মিতুল এমনিতেই অস্বস্তিতে ভুগছিল। এর মধ্যে আবার জায়িন একটা আজব প্রশ্ন করে বসলো।
“আচ্ছা মিতুল, তোমার কি বয়ফ্রেন্ড আছে?”
পৃথিবীতে এত প্রশ্ন থাকতে জায়িন এটা ছাড়া আর কিছু পেল না জিজ্ঞেস করার জন্য? হঠাৎ করে এই প্রশ্ন উঠলো কোত্থেকে?
মিতুল খুব কষ্টে মুখের বিরিয়ানির অংশটুকু গিললো। ওর মনে বার বার জোহানের নামটা উদয় হচ্ছে। জায়িন নিশ্চয়ই এই একটা প্রশ্ন করে থামবে না। ও যদি বলে, হ্যাঁ আছে। জায়িন পরে নিশ্চয়ই আবার জিজ্ঞেস করবে,
‘কে সে?’
‘কোথায় থাকে?’
‘কী করে?’
জায়িনের সামনে জোহানের কথা কী করে বলবে ও? বানিয়ে অন্য কারো নাম বলতে গেলেও বিরাট ঝামেলা। ধ্যাত!
জোহানের কথা তো আর ঘুণাক্ষরেও জায়িনের সামনে বলবে না। জায়িনকে বললে এটা রেশমী আন্টির কানেও পৌঁছে যাবে। এরপর রেশমী আন্টির কান থেকে মায়ের কান। মা যদি জানে ও কানাডা এসে প্রেম করে বেড়াচ্ছে, তাহলে বাংলাদেশ ফিরে যে ওর জায়গা আর ঘরে হবে না সেটা নিশ্চিত।
মিতুল এর থেকে সহজভাবে বলে দিলো,
“আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই।”
জায়িন একটু বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললো,
“তাই?”
“হ্যাঁ।”
জায়িন একটু হেসে বললো,
“দ্যাট’স গুড! আমিও মোটেই এসব প্রেম ভালোবাসা পছন্দ করি না। এগুলো ফালতু বিষয় ছাড়া আর কিছুই না। অযথাই সময় নষ্ট।”
জায়িনের কথা শুনে মিতুল অবাক। প্রেম-ভালোবাসা পছন্দ করে না জায়িন? কিন্তু ও তো জোহানের কাছ থেকে শুনেছে জায়িনের না কি দুই দুইটা রিলেশন ছিল। মিতুল নিজের কৌতূহল আর চেপে রাখতে পারলো না। বললো,
“শুনলাম তোমার না কি দুই দুইটা গার্লফ্রেন্ড ছিল?”
মিতুলের কথা কানে আসতেই জায়িনের মুখে গাম্ভীর্য ছেয়ে গেল। একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো ও। মুহূর্তেই আবার সেটা কাটিয়ে উঠে কাঠ গলায় বললো,
“আমার দুই দুইটা গার্লফ্রেন্ড ছিল এ কথা কে বলেছে তোমায়?”
মিতুলের হকচকিয়ে যেতে হলো। ইশ কথাটা বলেও ঝামেলায় পড়ে গেল। এখন কী বলবে? কার কথা বলবে? মিতুল ভুলেও জোহানের নাম মুখে আনলো না। বললো,
“ফে-ফ্রেডি…ফ্রেডি বলেছে।”
জায়িনের ভ্রু কুঁচকে গেল।
“ফ্রেডি?”
মিতুল দ্রুত মাথা নেড়ে সায় দিলো। কিন্তু ওর মনে সংশয় হচ্ছে। এভাবে মিথ্যা বলা কি ঠিক হলো? জায়িন যদি এ ব্যাপারে ফ্রেডির কাছে কিছু জানতে চায়?
জায়িন খানিক গম্ভীর ভাবে কী যেন ভাবলো। তারপর বললো,
“হ্যাঁ, ছিল দুটো রিলেশন। তা অনেক আগের । আর খুবই অল্প সময়ের জন্য। যখন বুঝতে পেরেছিলাম এসব রিলেশন, গার্লফ্রেন্ড সময় নষ্টের একটা মাধ্যম ছাড়া আর কিছুই নয়, তখন ব্রেকআপ করেছিলাম।”
“ও তাই? তুমি ব্রেকআপ করেছিলে?”
মিতুলের কথায় জায়িন থমকে গেল। ফ্রেডি কি দুটো গার্লফ্রেন্ড ছিল এর পাশাপাশি ওর গার্লফ্রেন্ডরা নিজ থেকে ব্রেকআপ করে চলে গিয়েছিল, সেটাও বলে দিয়েছে? জায়িন আমতা আমতা করে বললো,
“না মানে…একটা ব্রেকআপ আমি করেছিলাম। আরেকটা আমার ফার্স্ট গার্লফ্রেন্ড।”
“ও ।”
মিতুল এটুকু বলেই থেমে গেল। জায়িনের সাথে এ নিয়ে আর কথা বাড়াতে ইচ্ছা করছে না।
মিতুলরা ডিনার শেষে এখন রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার পথে। মিতুল দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি যে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার পথে ওর কার্লের সাথে দেখা হয়ে যাবে। কার্লের সামনা সামনি পড়তেই মিতুল থমকে দাঁড়ালো। কার্লের সাথে চোখাচোখি হতেই ভিতরটা অজানা কারণেই দুলে উঠলো। মিতুল কার্লের পাশে নজর দিলো। অলিভার দাঁড়িয়ে কার্লের সাথে। অলিভারের দিকে তাকাতেই অলিভার হাসি মুখে বললো,
“হাই রাবা!”
মিতুলের মনে হলো ‘রাবা’ ডাকটির মতো তিক্ত আর কিছু নেই এই পৃথিবীতে।
(চলবে)