চেরি ব্লসমের সাথে এক সন্ধ্যা পর্ব: ০৯

0
1181

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ০৯
_____________

“তো তুমি ব্যাংলাডেশ থেকে এসেছো?”

মিতুল মাথা নাড়িয়ে বললো,
“হুম। তুমি চেনো বাংলাদেশ?”

“না, ওরকম ভাবে চিনি না। তবে একটু আধটু জানি দেশটা সম্পর্কে। শুনেছি খুব সুন্দর একটি কান্ট্রি।” কার্ল কফির মগে চুমুক দিয়ে আবার বললো,
“জানো তো, আমার এখানে একজন বেঙ্গলি ফ্রেন্ড আছে। ওর নাম সিয়ম। খুব ভালো সম্পর্ক ওর সাথে আমার। ও সহজ সরল একটি ছেলে। ব্যাংলাডেশ থেকে পড়তে এসেছে এখানে। মাঝে মাঝে ব্যাংলাডেশ নিয়ে কথা হয় ওর সাথে। টরোন্টো থাকাকালীন অনেক সময় ওর সাথে ছিলাম আমি।”

“টরোন্টোতে থাকতে তুমি?”

“হ্যাঁ। এডমন্টনে এসেছি মাত্র দশ কী পনেরো দিন হলো।”

“তো টরোন্টো থেকে এডমন্টনে কেন আসতে হলো তোমার?”

“আমার হোমল্যান্ড এই এডমন্টন। আমার ফ্যামিলি এখানেই থাকে। আমার পাপা আমাকে টরোন্টো থেকে এডমন্টনে চলে আসার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। আর তাছাড়া আরও একটা বিশেষ কারণ আছে যার জন্য আমি এডমন্টনে এসেছি।” কার্লের কণ্ঠে কিছুটা খুশির রেশ অনুভব করা গেল।

“কী বিশেষ কারণ?” মিতুলের খুব করে জানতে ইচ্ছা করলো।

“সেটা এখন বলবো না। সময় হলে বলবো। তুমি তো বেশ অনেক দিনই আছো কানাডাতে। আশা করি তুমি আমার বিশেষ কারণটা জানবে এবং দেখবে।”

মিতুল মৃদু হেসে বললো,
“ঠিক আছে।”

“আচ্ছা, তোমাদের দেশের কী যেন একটা পোশাক আছে না ট্র্যাডিশনাল? মেয়েরা পরে। কী যেন বলে ওটাকে স…স…”

“শাড়ি?”

“হ্যাঁ, ওটাই। পোশাকটা পছন্দ আমার। এক ওল্ড দম্পতিকে চিনতাম আমি। মিস্টার এন্ড মিসেস খান। ওনারা ব্যাংলাডেশি ছিলেন। মিসেস খানকে প্রায়ই দেখতাম ওই ট্র্যাডিশনাল পোশাকটি পরতে। তার কাছ থেকেই জেনেছিলাম ওটাকে শ…শারি বলে।”

কার্লের কথা শুনতে কেন যেন খুব ভালো লাগছে মিতুলের। কী সুন্দর করে কথা বলে! সারাদিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা এই কণ্ঠ কানের কাছে বসে বকবক করতে থাকলেও বিরক্তি আসবে না। কার্ল বাংলাদেশ সম্পর্কেও কত সুন্দর করে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো। কত সহজে মিশে গেল ওর সাথে। অহংকারের ছিটেফোঁটাও নেই একদম। মিতুলের ইচ্ছা হলো একদিন ও একটা শাড়ি পরে কার্লকে দেখায়!

______________

জোহান ঠিক ঘরের প্রবেশ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। মিতুল এখনও বাড়ির বাইরে। মিতুলের জন্যই ও দাঁড়িয়ে আছে। মিতুল আসলেই মিতুলকে ধরবে।
মিতুল বাড়িতে ফিরলো আরও বেশ কিছুক্ষণ পর। ঘড়িতে তখন ৭ টা পিএম। তখনও চারিদিক আলোকিত, উজ্জ্বল।
মিতুলকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ও খুব আনন্দিত। অবশ্য আনন্দিত থাকবেই বা না কেন? নিজের প্রিয় ধূসর চোখার সাথে ছিল, আনন্দ তো হওয়ারই কথা।
তবে ওই আনন্দ জোহানকে করে তুলছে বিষাক্ত। জোহানের চোখ কিছুতেই ওর এত আনন্দিত, চঞ্চলা মুখ সহ্য করতে পারছে না।

“দাঁড়াও।”

মিতুল জোহানকে দরজার কাছে দাঁড়ানো দেখেও, না দেখার ভাণ করে ওর পাশ থেকে চলে যাচ্ছিল। জোহানের রাগান্বিত কণ্ঠ ও কে জোহানের দিকে তাকাতে বাধ্য করলো।

মিতুল ত্যাড়া গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“কী?”

“কোথায় ছিলে সারা বিকেল?”

“আমার যেখানে খুশি, আমি সেখানে ছিলাম। এই প্রশ্ন আমাকে কেন করছো তুমি?”

“কার সাথে ছিলে?”

“আশ্চর্য! তুমি একের পর এক প্রশ্ন করছো কেন আমায়? তুমি কি আমার অভিভাবক?”

“কোথায় ছিলে?”

আবারও জোহানের একই প্রশ্নে মিতুল অতিষ্ঠ হয়ে বললো,
“জাহান্নামের চৌরাস্তায় ছিলাম আমি, তোমার কোনো সমস্যা? আজকে খুব নাচতে নাচতে জিজ্ঞেস করছো কোথায় ছিলাম আমি। আর সেদিন? সেদিন তুমি নিজে কী করলে? মাঝপথে আমায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছিলে, মনে নেই সেটা? কই সেদিন তো জিজ্ঞেস করোনি কোথায় ছিলাম আমি, কীভাবে বাড়ি ফিরেছি! তাহলে আজ কেন এত আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইছো? আর জানতে চাইলেই কি আমি বলবো না কি?”

মিতুল ঘরে ঢোকা দিলে জোহান মিতুলের এক হাত টেনে ধরলো।
মিতুলের মাথা তাৎক্ষণিক গরম হয়ে গেল। জ্বলন্ত চোখে তাকালো জোহানের দিকে। মিতুলের জ্বলন্ত চোখ জোড়া দেখার সময় জোহানের নেই। ওর দৃষ্টি এখন মিতুলের মাথায় একটি ক্ষুদ্র আকারের ক্লিপের দিকে। ক্লিপটা ভালো করে দেখার জন্যই মিতুলকে থামিয়েছে। জোহানের ধারণা এটাও ওই কার্ল দিয়েছে মিতুলকে। যেমন করে হেয়ার রাবার দিয়েছিল, তেমন করে আবার হেয়ার ক্লিপও দেয়া শুরু করেছে স্টুপিডটা!

মিতুল জোহানের হাত থেকে নিজের হাতটা এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলো।
“এটা কোন ধরণের বেয়াদবি, হ্যাঁ?”

জোহান ওর কথায় কর্ণপাত করলো না।
“এই হেয়ার ক্লিপটা কোথায় পেয়েছো তুমি?”

মিতুল বিদ্রূপ ভাবে তাকালো জোহানের দিকে।
“পৃথিবীতে হাজার হাজার হেয়ার ক্লিপ আছে। এখন একটা হেয়ার ক্লিপ নিয়ে মাথা ব্যথা তোমার?”

“বলো, কোথায় পেয়েছ এটা?”

“এক্সকিউজ মি! আমি সামর্থ্যহীন নই যে সামান্য একটা হেয়ার ক্লিপ কেনার সামর্থ্য থাকবে না আমার। এটা আমি কিনেছি। যেদিন তুমি আমায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছিলে, সেদিন শপে গিয়ে কিনেছি এটা। আর তাছাড়া আমার কাছে হেয়ার ক্লিপের অভাব নেই। চাইলে তা দিয়ে নিজেও একটা হেয়ার ক্লিপের দোকান খুলতে পারি।”

জোহান মিতুলের থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। লনের দিকে শূন্য দৃষ্টি স্থাপন করে বললো,
“গেট লস্ট।”

মিতুলের ভ্রু কুঁচকে এলো। নিজে হাত ধরে থামিয়ে, নিজেই চলে যেতে বলছে? মিতুলের কুঁচকানো ভ্রু জোড়া হঠাৎ প্রসারিত হয়ে উঠে বিস্ময়ের রূপ নিলো। জোহান কি ওকে কোনো রকম ভাবে অপমান করছে না কি? এটা কি ওদের মানুষকে অপমান করার কোনো আধুনিক টেকনিক? মিতুল অপমান বোধ করলো। আধুনিক টেকনিক খাটিয়ে এখন অপমান করছে? খবিশ! মিতুল দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকলো।

হলরুম থেকে যাওয়ার সময় ক্যামিলা এগিয়ে এলো কাছে।
“এ কী, তোমায় যে আমি বললাম, বন্ধুর সাথে আড্ডা শেষ করে আমাকে কল দিতে, আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেবো।”

ক্যামিলার টেইক কেয়ার দেখে মিতুলের অপমান বোধ একটু কমে এলো।
“তার দরকার ছিল না, ক্যামিলা। কার্ল আমাকে উবারে উঠিয়ে দিয়েছিল। অযথা আবার তোমাকে ফোন করে পেইন দেওয়া উচিত মনে হয়নি আমার।”

“এটাকে পেইন বলছো কেন? এখানে পেইনের কী আছে? রাবার্তাকে(বাড়ির দ্বিতীয় মেইড) পাঠিয়ে দিতাম আমি গাড়ি নিয়ে। ওর বিশেষ কোনো কাজ ছিল না।”

মিতুল বিষয়টাকে ধামাচাপা দিতে চাইলো,
“ঠিক আছে থাক ওসব কথা। আমাকে এক গ্লাস সফট ড্রিঙ্কস বানিয়ে দাও। জানোই তো তোমার হাতের ড্রিঙ্কস প্রিয় আমার।”
মিতুল একটু উজ্জ্বল হাসি উপহার দেওয়ার চেষ্টা করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো।

রুমের দরজা খুলে রুমে ঢুকতে গিয়ে দেখলো, বাড়ির ডলের মতো সাদা লোমের বিড়ালটা ঠিক ওর পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। চুপি চুপি কখন যেন এসেছে পিছু পিছু। মিতুল বিড়ালটাকে কোলে তুলে নিলো। কী কিউট! বিড়ালটা আপোষেই ওর কোলে চলে এসেছে। মিতুল বিড়ালের সাথে ভাব জমাতে চাইলো।
“হোয়াট’স ইওর নেম?”

বিড়াল তো আর মিতুলের কথার উত্তর দিতে পারে না। আর এই বিড়ালটি এতটাই শান্ত যে মিউ মিউ করেও ডাকলো না একবার।

“কোন দেশি কিটি তুমি? জাপানিজ না কি?” মিতুলের কৌতূহল হলো।
বিড়ালটি সুবোধ বালকের মতো মিতুলের কোলে জড়োসড়ো হয়ে নিশ্চুপ বসে রইল।

“স্যারি!” একটা পুরুষ কণ্ঠের ডাকে বিড়ালটি লাফ দিয়ে মিতুলের কোল থেকে নেমে দৌঁড়ে চলে গেল।
জায়িনের পায়ের কাছে গিয়ে থামলো। জায়িন কোলে তুলে নিলো বিড়ালটিকে।

“ও তোমার বিড়াল বুঝি?” বাংলাতেই প্রশ্ন করলো মিতুল। দেখতে চাইছে ঠিক কতটা বাংলা জানে।

“হ্যাঁ।” বাংলাতেই বললো জায়িন।

“ওর নাম ‘স্যারি’?

“হুম।”

“কোন দেশি বিড়াল স্যারি?”

“কানাডিয়ান।”

মিতুল বিস্ময় নিয়ে বললো,
“ও তাই? আমি তো ভেবেছিলাম জাপানিজ! আমার বড়ো ভাইয়ের একটা জাপানিজ বিড়াল ছিল, প্রায় ওর মতো দেখতে।”

“ওহ…” জায়িন একটু বিরতি নিয়ে বললো,
“কানাডা কেমন লাগছে?”

“ভালোই। তবে এখানের দর্শনীয় স্থান গুলো তো এখনও দেখা হয়নি আমার।”

জায়িন কথা বলার মতো আর কিছু পাচ্ছে না। কী বলা উচিত ঠিক বুঝতে পারছে না!
মিতুলও জায়িনের নীরবতা দেখে আর কিছু বলতে পারছে না।
জায়িন বলার মতো কিছু না পেয়ে কয়েক সেকেন্ড নীরব দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল।
যা মিতুলের জন্য অপমানজনক হলো। একটা মানুষ এভাবে কীভাবে চলে যেতে পারে? ওর কথার জবাবে কিছু তো অবশ্যই বলা উচিত ছিল তার। আবারও কি নিজের অহংকার দেখালো না কি? অপমান করার জন্যই কি কিছু বললো না?
মিতুল বুঝতে পারছে না এই অপমান জিনিসটা ও কে ছাড়তে ছাড়তেও ছাড়ে না কেন!

________________

রাতের অন্ধকারে আবারও একবার জোহানকে জঙ্গলের ভিতর ঢুকতে দেখবে ভাবতে পারেনি মিতুল। আজকে স্পষ্ট দেখেছে জোহানকে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকতে। জোহানের পরনে খয়েরি টি শার্ট আর থ্রি কোয়াটার প্যান্ট ছিল। বিকেলে ওই পোশাকই পরা দেখেছিল জোহানকে। আজকে জোৎস্না ছিল না, গার্ডেনের লাইট জ্বলছিল। তাতেই স্পষ্ট দেখতে পায় জোহানকে। ঘটনাটা মিতুল দেখে কিচেনে বসে। ফ্রিজ থেকে জুস নিতে এসেছিল কিচেনে। তখন ব্যাক সাইডের জানালা থেকে চোখ পড়ে গার্ডেনে। প্রথমে মানুষটি কে তা বুঝতে পারেনি। ভেবেছিল কেউ হয়তো গার্ডেনে হাঁটাহাঁটি করছে। কিন্তু হঠাৎ করে কেন যেন ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে হয়নি ওর। ও ছুটে যায় জানালার কাছে। জোহান তখনও ঢুকে পড়েনি জঙ্গলে। জঙ্গলে ঢোকার রাস্তা থেকে খানিক দূরে ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে জোহানের দেহটি সেদিনের মতো জঙ্গলের অন্ধকারে তলিয়ে যায়। মিতুল ওই মুহূর্তে অনুভব করে ভয়। ভীষণ ভয়। এতটাই ভয় পেয়েছিল যে হাত পা অসাড় লাগছিল ওর। মনে হচ্ছিল আর দাঁড়াতে পারবে না। নিজের সব শক্তি শেষ হওয়ার আগে ছুটে আসে নিজের রুমে।
মিতুলের হৃদয় ভয়ে ধুক ধুক করছে এখনও। ওই জঙ্গলে যাওয়ার রহস্যটা কী? জোহান কেন যায় ওই জঙ্গলে? মিতুলের মনে হচ্ছে আর যাই হোক না কেন ওই জঙ্গলে ভালো কিছু নেই। যা আছে তা কেবল মানুষের ভয়ের কারণ। কিন্তু ভয়ের মতো কী আছে ওই জঙ্গলে? মিতুল ভেবে উঠতে পারে না।
রাতে ওই ঘন কালো জঙ্গলে ঢোকা নিশ্চয়ই মুখের কথা নয়। আর কেনই বা ঢুকবে? তাও এক দিন নয়, দুই দুই দিন দেখলো ঢুকতে।
আচ্ছা…ও কোনো সিরিয়াল কিলারের কাছে এসে পড়েনি তো? জোহান কোনো সিরিয়াল কিলার নয়তো? যে মানুষকে হত্যা করে ওই জঙ্গলে লাশ গুম করে দেয়!
কথাটি মনে হতে মিতুল আঁতকে ওঠে। মুখ তীব্র ভয়ের ভীত ছায়ায় ছেয়ে যায়। আতঙ্ক চেপে ধরে চারিদিক থেকে। হাত পা কাঁপতে শুরু করে। শরীর ঘামতে থাকে অনবরত। দু চোখে ভয়, মনে সংশয়, ক্ষুদ্র জীবনের মায়া মিতুলকে অসহ্য, অসহনীয় যন্ত্রণার গভীর কূপে ঠেলে দেয়।
সত্যিই ওই জঙ্গলে কী আছে?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here