চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব-৪৬

0
1999

#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৪৬

নিশুতি রাত। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে একের ঘর ছাপিয়ে চলেছে সামনের দিকে। নক্ষত্র ভরা আকাশের নিচে রাস্তার ধারে বেওয়ারিশ কুকুর ডেকে চলেছে অনাবরত। থেমে থেমে উত্তরা বাতাস বইছে। পাতা দুলছে। নিষুপ্তিচ্ছন্ন শহরে কোথাও আলো জ্বলছে, কোথাও আবার জ্বলছে না। নির্বাণ চুলো নিভায়। কপালে জমে থাকা নোনা পানির বিন্দুকণা মুছে নিয়ে হাত ধুয়ে নেয়। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে যায় রুমে দিকে। রুমে এসে সর্বপ্রথম চোখ যায় তার বিছানায় শুয়ে থাকা কৃষ্ণকলিটার দিকে। মুখশ্রী পাংশুটে,ম্রিয়মান দেখাচ্ছে। চোখের নিচে খাদ ফুটে জঠেছে। ঠোঁট দু’টো শুকিয়ে চৌচির হয়ে আছে যেন। নির্বাণ বিমর্ষচিত্তে তাকিয়ে থাকে। বক্ষঃস্থলে চলতে থাকে অসহ্যনীয় দহনক্রিয়া। সাথে রাগ হয় প্রচুর৷ ঘটনা ঘটাকালীন নির্বাণের ইচ্ছে করেছিল স্পর্শীকে আচ্ছামত বকতে। কানের নিচে দিতে দুই একটা। কেন সে রান্না করতে গিয়েছিল? কে বলেছিল তাকে রান্না করতে? এত কেয়ারলেস কেন সে? সে কি বুঝে না তার কষ্ট তাকে কত পীড়া দেয়? বুঝে না সে? ষ্টুপিড মেয়ে একটা। এমন হাজারো প্রশ্ন করতে। কিন্তু পারেনি। স্পর্শীর করুণ মুখখানি, তপ্ত জলের বর্ষণ আর আর্তনাদ দূর্বল করে তুলে তাকে। পারে না কণ্ঠস্বর উঁচিয়ে সামান্যটুকু কিছু বলতে। মেয়েটার সাথে গলাবাজি করার ক্ষমতা যে তার নেই৷ কিন্তু তাই বলে যে রাগ ঠান্ডা পড়ে গিয়েছে তা নয়। নিজেকে সামলে নিয়ে আলগোছে গিয়ে স্পর্শীর মাথার পাশে বসে। চুলের মাঝে হাত গলিয়ে দিয়ে মন্থর কন্ঠে ডাকে, “স্পর্শী উঠো। খেয়ে নাও একটু।”

স্পর্শী মৃদুশব্দ করে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। সাড়াশব্দ করে না কোন। নির্বাণ পুনরায় ডাকে, “এই স্পর্শী উঠো। উঠতে বলছি না তোমায়।”

তথাপি স্পর্শী উঠে না৷ মেয়েটা প্রচন্ড ঘুমকাতুরে। অনেক ডাকাডাকির পর স্পর্শী সজাগ হয়। অর্ধ-নিভন্ত চোখে তাকায় নির্বাণের দিকে, “ঘুমাতে দিন না৷ ঘুমাবো আমি।”

নির্বাণ স্পর্শীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “খেয়ে নাও। তারপর ঘুমাও৷ নাহলে শরীর খারাপ করবে।”

স্পর্শী বাচ্চাদের মত নাকচ করে উঠে, “উহু! ঘুমাব আমি।”

নির্বাণ একপ্রকার গায়ের জোর খাঁটিয়েই স্পর্শীকে শ্ল্যা থেকে আধশোয়া করে বসায়৷ স্পর্শী তখনও ঘুমে ঢুলছে। নেত্রপল্লব লেগে আসছে বারংবার৷ নির্বাণ বলে, “যাও মুখ ধুয়ে আসো। তারপর খাবে।”

রাজ্যসব বিরক্তি নিয়ে স্পর্শী নির্বাণের দিকে তাকায়৷ অপ্রসন্ন কন্ঠে বলে, “বললাম তো খাব না। খিদে নেই। ঘুমাব আমি।”

অকস্মাৎ নির্বাণের কন্ঠ গুরুগম্ভীর শোনায়, “আমার কথা শুনবে না তুমি?”

ব্যস! নির্বাণের এতটুকু কথাই যথেষ্ট ছিল স্পর্শীকে বাধ্য করতে। স্পর্শী চোখ টান টান করে তাকায়৷ মিহি কন্ঠে বলে, “যাচ্ছি।”

স্পর্শী অবচেতন মনে হাতের উপর ভর দিয়ে নামতে নিলে নির্বাণ বলে উঠে, “আরেহ কি করছো? হাতে জোর দিচ্ছ কেন?”

স্পর্শী ভড়কে উঠে। চটজলদি তাকায় বা হাতের দিকে। সে বেমালুম ব্যথার কথা ভুলে বসেছিল। মনে ছিল না বিধায় হয়তো দহন যন্ত্রণাও অনুভব হয়নি। মনে পড়েই যেন জ্বালা বাড়লো। হাতের চামড়া টানছে খুব। স্পর্শী ঠোঁট কাঁমড়ে সহ্য করে সবটা। অতঃপর তার খেয়াল হয়, ক্ষতস্থানটা তার শুভ্র কাপড়ে বাঁধা। খুব সূক্ষ্মভাবে, নিবিড়ভাবে। স্পর্শীর কপালের মধ্যখান সংকীর্ণ হয়ে আসে। সে নির্বাণের দিকে তাকায়। বুঝতে আর দেরি নেই তার হাতটি কে গজ কাপড় দিয়ে বেঁধে দিয়েছে। নির্বাণ শান্ত কন্ঠে বলে, “আসো! আমি তোমাকে ওয়াশরুমে নিয়ে যাচ্ছি৷”

কথাটা বলে নির্বাণ স্পর্শীকে ধরে। তাকে ধীরে-সুস্থে বিছানা থেকে নামিয়ে ওয়াশরুম পর্যন্ত দিয়ে আসে। বলে, “হাতটা সাবধানে রেখ৷”

স্পর্শী মাথায় নাড়ায়। ফ্রেশ হয়ে আসতেই নির্বাণ স্পর্শীকে নিজের সামনে বসায়। হাত প্লেট নিয়ে ভাত মেখে স্পর্শীর মুখে তুলে দেয়। বলে, “হা কর।”

স্পর্শী চোখ বড় বড় করে অনাবরত নেত্রপল্লব ফেলে। ঘটনাক্রমে বুঝতে পেরে সে মাথা নুয়ে ফেলে। বলে, “ডান হাত ঠিক আছে আমার। আমি নিজ হাতে খেতে পারব। আপনার কষ্ট করতে হবে না।”

নির্বাণ রোষানল দৃষ্টিতে তাকায়,”এত বুঝতে বলা হয়নি তোমায়। যেটা বলেছি সেটা কর।”

স্পর্শী দ্বিতীয়বার কথা বলার জন্য মুখ খুলতেই নির্বাণ ভাতের দলাটা পুরে দেয় তার মুখে। স্পর্শী উপায়ন্তর না পেয়ে খেতে শুরু করে। নির্বাণও কথা না বাড়িয়ে স্পর্শীকে খায়িয়ে দিতে মনোযোগী হয়৷ স্পর্শী বলে, “আপনি খাবেন না?”

“পরে খাব আমি। তুমি খাও।”

হঠাৎ স্পর্শীর মনে এক প্রশ্ন খেলে যায়, তার হাত থেকে তো পাতিল পড়ে গিয়ে সকল ভাত নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাহলে ভাত রাঁধলো কে? নির্বাণ? স্পর্শী জিজ্ঞেস করে ওঠে, “ভাত কে করেছে? আপনি?”

নির্বাণ এক শব্দে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ।”

স্পর্শী বিস্মিত হয়, “আপনি রান্নাও জানেন?”

নির্বাণ ভাত মাখাতে মাখাতে বলে, “তেমন না। ভাত,ডাল,ডিম ভাজি করতে জানি শুধু। মা শিখিয়েছিলেন।”

“অহ।”

নির্বাণ উত্তর দেয় না৷ নীরবে স্পর্শীকে খায়িয়ে দিতে থাকে৷ নির্বাণের হাবভাবেত পরিবর্তন নজর কাড়ে স্পর্শীর। মনে প্রশ্ন জাগে তখনই, “নির্বাণ কি তার উপর রেগে আছে?” উত্তর পরিষ্কার৷ নির্বাণ রেগে আছে তার প্রতি। তাও ভীষণভাবে। তার মুখের অভিব্যক্তি স্পষ্ট জানান দিচ্ছে কথাটা। স্পর্শীর ইচ্ছে করলো নির্বাণকে প্রশ্ন করার কিন্তু সাহস হলো না। সে নির্বাণের ভয়াবহ রাগ সম্পর্কে অবগত৷ যদিও বিয়ের পর এই পর্যন্ত তার সাথে নির্বাণ সেরকম রাগ দেখায়নি তবুও কখন মোড় কোন দিকে ঘুরে যায় বলা তো যায় না। স্পর্শী তপ্তশ্বাস ফেলে চুপচাপ বাকি খাবারটুকু খেয়ে নেয়।
খাওয়া শেষে নির্বাণ স্পর্শীর দিকে পানি এগিয়ে দেয়। স্পর্শী পান করার পর মুহূর্তে নির্বাণ রাশভারি কণ্ঠ তার কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হয়, “সাবধানে কাজ করতে শিখো। ব্যথা তোমার একার না অন্যেরও হয়। তাই বলছি, তোমাকে যেন আমি পরবর্তীতে কখনো রান্না করতে না দেখি। নাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না। এন্ড আই মিন ইট।”

শীতল কন্ঠে বলা বাক্যসমূহ প্রখর, শাণিত শোনায়। রন্ধ্রের উষ্ণ রক্ত শৈথিল্য করতে এতটুকুই যথেষ্ট। স্পর্শী মাথা দুলায়। আপাতত নির্বাণের কথায় সায় জানানো ছাড়া তার কোন উপায় নেই। নির্বাণ এবার উঠে দাঁড়ায়। রুম থেকে প্রস্থান করার প্রস্তুতি নিয়ে বলে, ” কাল সকালে ডাক্তারের কাছে যাবে আমার সাথে। হাতটা বেশ বাজেভাবে পুড়ে গিয়েছে। এভাবে সারবে না।”

স্পর্শী কিছু বলার পূর্বেই নির্বাণ কক্ষ ত্যাগ করে। বাহিরে এসে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। স্পর্শীর হাতের চামড়া যে খানিকটা উঠে গিয়েছে সেই কথা চেপে যায় সে। আপাতত আর টেনশন বাড়াতে চাচ্ছে না। তখন বাসায় কোনপ্রকার সরঞ্জামাদি না থাকায় নির্বাণ দারোয়ানকে বলে সেগুলো আনায়। অতঃপর স্পর্শীর হাত ক্লিন করার সময় দেখতে পায় মাঝ দিয়ে চামড়া কিছুটা উঠে গিয়ে চারপাশে কালসিটে হয়ে গিয়েছে। ফোস্কা পড়েছে বাজেভাবে৷ বার্ণ ক্রীম লাগাতেও নির্বাণের হাত কেঁপেছিল তার ঠকঠক করে। চোখ জ্বালা করছিল তীব্রভাবে।

____________________

ফোন বেজে চলেছে প্রায় মিনিট ধরে। কিন্তু তুলছে না কেউ। এমন নয় যে আশেপাশে মানুষ নেই বা রিংটোন শুনছে না কেউ। শুনছে তবে ইচ্ছে করেই ধরছে না। শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিক৷ অবশেষে সপ্তমবারের মত ফোনটি বেজে উঠতেই কলটি রিসিভ করা হয়। অপরপাশ থেকে দৃঢ় এক পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে আসে, “আমার ফোন ধরছো না কেন তুমি? কতবার কল করেছি আমি সে হিসাব আছে?”

মানবীটি কথা বলে না। নিরুত্তর থাকে। কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে অপরপাশ থেকে অধৈর্য যুবকটি পুনরায় বলে ওঠে, “কথা বলছো না কেন তুমি? স্পৃহা কথা বল। ফোন ধরছিলে না কেন আমার?”

স্পৃহা নির্বিকার থাকে, “আপনার কল যে আমার ধরতেই হবে এমন কথা ছিল কি? ছিল না তো, তাহলে? ”

নাহিদ থমকায়। কণ্ঠস্বর নামিয়ে বলে, “কথা তো আমাকে কষ্ট দেওয়ারও ছিল না। তাহলে দিচ্ছ কেন?”

“আপনি যে দিচ্ছেন সেটার বেলায় কিছু না? আমি দিলেই দোষ?”

“আমি তোমায় কষ্ট দেয়নি। আর না কখনো দিব। তুমি শুধু একবার আমাকে এক্সপ্লেইন করার সুযোগ দাও, আমি বুঝিয়ে বলছি সব।”

স্পৃহা তেঁতে উঠে বলে, “কি বুঝাবেন আর আপনি আমাকে? সবকিছু তো জানা আমার।”

নাহিদ কাতর কন্ঠে বলে, “তুমি একপাক্ষিক জানো। যেটা সম্পূর্ণ সত্য না, এর উর্ধ্বেও অনেক কিছু জানার আছে তোমার।”

“আর কিছু জানার প্রয়োজন নেই আমার। যতটুকু জেনেছি তাই অনেক। আর সহ্য করার ক্ষমতা নেই আমার। আমাকে এখন আমার মত থাকতে দিন।”

নাহিদ কন্ঠস্বর উঁচিয়ে বলে, “আর কত দিব? একমাস সময় কি খুব বেশি নয়? প্রথম দিকে বুঝবে না বলে এতটা সময় দিয়েছি, পরিস্থিতি ঠান্ডা হওয়ার অপেক্ষায়। কিন্তু তুমি এখনো আমার কথা শুনতে নারাজ। করবোটা কি আমি? হাল ছেড়ে বসে থাকব?”

“হাল ধরে রাখতে বলেনি কেউ আপনাকে। ছেড়ে দিন। আর একটা কথা, আমি আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক না। তাই পরবর্তীতে আমাকে আর ফোন করবেন না।”

কথাটা বলে স্পৃহা নাহিদ আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিয়ে ফোনটা অফ করে পাশে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। সব বিষাক্ত লাগছে এখন তার কাছে। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা যেন তার। নিজের অস্থির মনকে কাবু করতে না পেরে ডুকরে কেঁদে উঠে সে। নিজের রাগ, দুঃখ সব একসাথে বিসর্জন দিতে থাকে। এদিকে, নাহিদ হাতে ফোন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার সামনের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থেকে হতাশাজনক নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সে। হরিদ্রাভ আলো মাথায় নিয়ে হাঁটা দেয় নিজ পথে। আফসোস! স্পৃহা জানলোও না দীর্ঘ একঘন্টা যাবৎ ছেলেটা তার বাসার নিচেই দাঁড়িয়ে ছিল। তার সাথে কিঞ্চিৎ পরিমাণ কথা বলার আশায়।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here