#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৪৭
পৌষের শেষভাগ৷ হিম বাতাসের অহর্নিশ আনাগোনা। পাতা কাঁপছে থরথর করে। তুলোরাশি মিইয়ে আছে নিস্তব্ধ আকাশের অন্তরালে৷ মধ্যখানে অর্ধবৃত্ত চাঁদটি তাকিয়ে আছে নিষ্পাপ পলকে। দীর্ঘ রজনী কাটছে আলসেভাবে। গায়ে পাতলা এক চাদর জড়িয়ে বই সামনে নিয়ে পড়ছে স্পর্শী। ফাইনাল সেমিস্টার চলছে তার। পরশুদিন ‘ইনওর্গান কেমিস্ট্রি’ পরীক্ষা তার। ঘন্টাখানেক হলো একটানা পড়ে চলেছে সে। এর মাঝে হাতে গোনা কয়েকটা মাত্র চ্যাপ্টারই শেষ করতে পেরেছে সে। কেন যেন পড়ায় মন নেই তার। হয়তো হাতে আরেকটা দিন সময় আছে বলে। কাল সব পড়ে নিবে ভেবে মস্তিষ্ক ঝিমুচ্ছে। আঁখি জোড়ায়ও তন্দ্রা লেপ্টে আছে আষ্টেপৃষ্টে৷ নেত্রপল্লব লেগে আসছে বারংবার। শত চেষ্টা করেও তন্দ্রাভাব কাটাতে না পেরে স্পর্শী ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকায় নিজের ডান দিকে। ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে অবসন্ন কন্ঠে বলে সে, “আর পারছি না। আমি ঘুমোতে গেলাম।”
এতক্ষণ ধরে নির্বাণ স্পর্শীকে ভিডিও কলে রেখেই নিজের কাজ করছিল, সাথে স্পর্শী পড়ায় কোথাও আটকে গেলে সেটা বুঝিয়েও দিচ্ছিল। স্পর্শী কন্ঠস্বর শোনামাত্র নির্বাণ চোখ তুলে তাকায়। শানিত কন্ঠে বলে, “একদম না৷ এখনো অনেক পড়া বাকি আছে তোমার। এগুলো শেষ করবে কখন তুমি?”
স্পর্শী মুখ ছোট করে বলে, “কাল সকালে উঠে পড়ে নিব। সময়ের মধ্যে সব চ্যাপ্টারও শেষ করে ফেলব। প্রমিস! আপাতত ঘুমের জ্বালায় মারা যাচ্ছি আমি। ঘুমাবো!”
“সকালের আশায় কোন জিনিস রাখতে মানা করেছি তোমায়। পড়া এভাবে খালি পিছাবে শেষ আর হবে না। পরে দেখা যাবে পরীক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছে কিন্তু তোমার পড়া আর শেষ হয়নি।”
“হবে না এমন। সত্যি!”
“না মানে না। এই চ্যাপ্টার শেষ করে তারপর ঘুমাবে তুমি৷ ঘুম বেশি পেলে চোখে-মুখে পানি দিয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করে নাও। দেখবে আর ঘুম পাচ্ছে না।”
স্পর্শীর মুখশ্রী পাংশুটে দেখায়। বলে, “আমার আর এনার্জি নেই।”
“স্পর্শী! যাও বলছি৷ কোন বাহানা শুনতে চাই না আমি।”
স্পর্শী মুখ বিকৃতি করে উঠে দাঁড়ায়। বিরবির করে বলে, “ধ্যাৎ! ভাল্লাগে না।”
কথাটা বলতে বলতে স্পর্শী রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে নির্বাণ পিছন থেকে ডাক দেয়, “স্পর্শী শুনো!”
স্পর্শী পিছনে ঘুরে দাঁড়ায়৷ গম্ভীরমুখে বলে, “আবার কি?”
“মা কি এখনো জেগে আছে?”
স্পর্শী ভ্রু কুটি সংকুচিত করে একপলক নির্বাণের তাকায়। অতঃপর ঘড়ির দিকে তাকায়। বারোটার বেশি বাজে। সে বলে, “হ্যাঁ জেগে আছে৷ এসময় মা একটা নাটক দেখে, ড্রয়িংরুমে হবে নিশ্চয়ই।”
“তাহলে মাকে বল কফি করে দিতে একটু। সে করে দিবে।”
মুহূর্তেই স্পর্শী সুধীর হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। নির্বাণের চিন্তা কোথায় সেটা বুঝতে পেরে স্মিত কন্ঠে বলে, “আমি ঠিক আছি। কফি লাগলে নিজেই বানাতে পারব।”
নির্বাণ কন্ঠে আক্রোশ মিশিয়ে বলে, “পাকনামো করতে বলা হয়নি তোমাকে। যা বলছি তা কর। নাহলে আমি নিজেই মাকে ফোন দিব এখন।”
স্পর্শী তটস্থ হয়ে বলে, “আপনি কি পাগল? এতটুকু বিষয়ের জন্য মাকে ফোন দেয় কেউ?”
নির্বাণ গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলে, “আমার দৌড় কতদূর সেই ধারণা আদৌ আছে তোমার? নেই তো। তাই যা বলছি সেটা কর। মাকে গিয়ে বল কফি করে দিতে।”
স্পর্শী মুখ ফুলালো। প্রখর দৃষ্টিতে তাকিয়ে গটগট করে চলে গেল বাহিরে। সাহেলাকে এক কাপ কফি দিতে বলে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতে থাকে সে। মনে পড়ে তার নির্বাণের সাথে কাটানো সেই মুহূর্তগুলো। এক্সিবিশন শেষে আরও চারদিন নির্বাণের কাছে ছিল সে। সেই সময়টুকু নির্বাণ তার যত্নে কোন ত্রুটি রাখেনি। আগলে রেখেছিল খুব সন্তর্পণে। অফিস থাকাকালীন ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছে প্রতি প্রহরে। সাথে যখন ছিল তখন তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিসের খেয়াল ছিল নির্বাণের-ই। সেখান থেকে তার ফিরে আসতে ইচ্ছে না করলেও আসতে হয়েছিল বাধ্য হয়ে। সামনে পরীক্ষা, পড়া বাকি যে। বাসায় আসার পর তাকে পড়ানোর দায়িত্ব নির্বাণ নিজ থেকেই পালন করতে শুরু করে। পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর স্পর্শীর রাত জেগে যতটুকু সময় পড়ে ততটুকু সময় নির্বাণও অপরপাশে নেট সংযোগের মাধ্যমে তার সাথে জেগে থাকে আর নিজের কাজগুলো করে। কদাচিৎ স্পর্শী আটকে গেলে তাকে বুঝিয়ে দেয়, ইমপোর্টেন্ট টপিকগুলো রি-মার্ক করে দেয়। সব ভেবে স্পর্শীর ঠোঁটের কোণ প্রসারিত হয়।
মিনিট দশেক পর হাতে একটা কফি নিয়ে আসলো সে। ল্যাপটপ দরজার দিকে মুখ করে রাখায় নির্বাণ দেখতে পেল স্পর্শীকে। ক্ষণেই বলে ওঠে সে, “আস্তে-ধীরে আসো৷ পড়ে যাবে কফি, পরে অঘটনটা ঘটাবে। হাত এখনো সাড়েনি তোমার।”
স্পর্শী স্থির হয়ে দাঁড়ায়, এক ঝলক তাকায় বা হাতের দিকে। ঝলসে গিয়ে চামড়া উঠে গিয়েছে সেখানে। চারপাশ কালসেটে হয়ে কুঁচকে আছে কেমন করে৷ জ্বালা করে না এখন তেমন তবে বীভৎস দেখায় তার নিকট। কতদিনে যে ঠিক হবে এটা যে জানে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে। ম্রিয়মাণ নয়নে তাকায় সামনে, “কিছু হবে না।”
কথার বিপরীতে নির্বাণ অসন্তোষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। এমন সময় পার্শিয়া দরজা সামনে এসে দাঁড়ায়। মৃদু কন্ঠে শব্দ করে। স্পর্শী ঘাড় ঘুরিয়ে পার্শিয়াকে দেখে ডাকে নিজের কাছে৷ ঠিক সে মুহূর্তে পার্শিয়া ল্যাপটপের স্ক্রিনে নির্বাণকে দেখে মুখ ঝামটা মেরে অন্যদিকে চলে গেল। নির্বাণ লক্ষ করে বিষয়টা। অভিব্যক্তি স্বাভাবিক রেখে আনমনে আওড়ায়, “ওর কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি? সমস্যা কি আমার সাথে? আজিব!”
পার্শিয়ার এমন ব্যবহারে স্পর্শী হাসে। পিছ থেকে আর ডাক দেয় না সে। দরজা ভিড়িয়ে চুপচাপ খাটে গিয়ে বসে। কফি খেতে খেতে পুনরায় পড়া শুরু করে। রেডক্স স্ট্যাবিলিটি এন্ড রেডক্স রিয়্যাকশন চ্যাপ্টার পড়ার সময় এক জায়গায় আটকে যায় স্পর্শী। সে নির্বাণকে সেই টপিকটা বুঝিয়ে দিতে বললে নির্বাণ নিজের স্ক্রিন শেয়ার দিয়ে বোর্ডে পুরো টপিকসটা ডিটেইলসে বুঝিয়ে দিতে থাকে। স্পর্শী মনোযোগ দিয়ে বুঝতে থাকে সে-টা। আঁখিপল্লবে পুনরায় তন্দ্রা ভর করতেই বালিশ সামনে টেনে উপর হয়ে শুয়ে পড়ে সে। মিনিট কয়েক গড়াতেই নিষুপ্তিছন্নে নিমজ্জিত হয় সে। ঈষৎ মুহূর্ত পর নির্বাণ বোঝানোর ফাঁকে জিজ্ঞেস করে, “এই জিনিসটা বুঝেছ তুমি?”
উত্তর আসে না এপাশ থেকে। নির্বাণ পুনরায় প্রশ্ন করে, এবারও সাড়াশব্দ পায় না সে। নির্বাণ ভিডিও কনফারেন্সে ফিরে এসে দেখতে পায় মুখের সামনে ল্যাপটপ রেখে স্পর্শী ঘুমিয়ে পড়েছে। এক গাছি চুল এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরো মুখশ্রী জুড়ে। বাচ্চা বাচ্চা লাগছে পুরা। ঘুম ভাঙ্গায় না আর সে। স্মিত মুখে তাকিয়ে থাকে। আকস্মিক তার ইচ্ছে করে স্পর্শীর চুলগুলো গুছিয়ে দিয়ে তাকে নিজের কাছে টেনে নিতে৷ কিন্তু এটা যে এই মুহূর্তে সম্ভব নয়৷ নির্বাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মোহগ্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো স্ক্রিনের দিকে। ক্ষণেই নিজেকে ছন্নছাড়া লাগলো তার। মস্তিষ্ক হলো শূণ্য। আনমনে আওড়ায় সে, “মনোহারিণীর সম্মোহনের সামনে মদ্যপনেশাও অতি নগন্য।”
__________________
এডমিশনের কিছু কাজে বের হয়েছে স্পৃহা। কিছু ফরমালিটি পূরণ করা বাকি আছে তার। শত চেষ্টা করেও পাবলিকে সুবিধা করতে পারেনি সে। এর জন্য তার মন ক্ষুণ্ণ হয়েছিল বটে কিন্তু পরবর্তীতে মা-বাবা-বোনের কথায় সাহস পায় সে। ব্যর্থতা ভুলে কাছেই একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে নে সে। কাজ শেষে স্পৃহা বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিবে এমন সময় নাহিদ তার সামনে এসে হাজির হয়। নাহিদকে দেখামাত্র স্পৃহা পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নেয়। অকস্মাৎ নাহিদ স্পৃহার হাত চেপে ধরে বলে, “এদিক আসো আমার সাথে। কথা আছে।”
স্পৃহা হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলে, “কিন্তু আমার নেই। হাত ছাড়ুন আমার, বাসায় যাব আমি।”
নাহিদ শুনে না। হাতের বাঁধন আরও দৃঢ় করে বলে, “বাড়াবাড়ি করবে না স্পৃহা। আমি শুধু একটাবার তোমার সাথে কথা বলতে চাই। কথাটুকু শুনো আমার। এরপর চৌরাস্তায় যাও আর জাহান্নামে যাও আই রিয়ালি ডোন্ট কেয়ার।”
নাহিদের কথা শুনে স্পৃহা একমুহূর্তের জন্য থমকায়। অভিমান হয় রাজ্যসম। নয়নের তারা চিকচিক করে উঠে। এতটাই নিষ্ঠুর বুঝি মানুষটা? কি অবলীলায় বলে দিল কথাগুলো সে। কই আগে তো এভাবে কথা বলতো না তার সাথে। তাদের প্রণয়ের শুরুতে সে যতই রাগ-অভিমান দেখাতো না কেন বুঝতো সে। তাহলে আজ নয় কেন? তার মানে কি সত্যিই শুরু থেকে সবটা মিথ্যে ছিল? সব ছলনা ছিল? রাগে-ক্ষোভে দাঁতে দাঁত চেপে তাকায় সে নাহিদের পানে। হাত মোচড়াতে থাকে ছাড়া পাবার আশায়। দুইজনের হাবভাব নজর কাড়া হওয়ায় যাতায়াতকৃত সকলে আড়চোখে তাদের দেখতে শুরু করে। নাহিদ সেটা লক্ষ্য করে বলে, “রাস্তায় আছি আমরা তামাশা কর না। চল আমার সাথে। আমাকে জোর করতে আর বাধ্য কর না।”
স্পৃহা কিছু বলতে নেয় কিন্তু পরক্ষণে নাহিদের ক্রোধান্বিত রক্তিম নেত্রের দিকে তাকিয়ে আর বলার সাহস পায় না। এর মূখ্য কারণ সে কখনো নাহিদকে রাগতে দেখে নি। তার সামনে তো এক্কেবারেই না। উপরন্তু স্পৃহার মনও টানছে নাহিদের সাথে যেতে৷ তাই অবশেষে সে রাজি হলো নাহিদের সাথে যেতে। নাহিদ আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে একটা রিকশা ঠিক করে স্পৃহাকে নিয়ে সেটায় উঠে পড়ে।
#চলবে
এই পর্বের ‘বর্ধিতাংশ’ কালকের মধ্যেই দেওয়ার চেষ্টা করব।