চোখের আরশিতে সমুদ্দুর |৮

0
118

চোখের আরশিতে সমুদ্দুর |৮

সে এল। কিন্তু আমার কাছে না। আমার সামনে দিয়ে ওর স্যুইটের দিকে পা বাড়ানো রাগী মেয়েটার হাত ধরে কিছুটা জোর করে আমার রুমে নিয়ে এলাম। সে সমানে ফুঁসছে। স্যুইটের ডোর লক করে দিয়ে ওর দিকে ফিরতেই বুকে দুমদাম মারতে শুরু করলো শবনম। বাঁধা দিচ্ছি না। মারুক যত খুশী। কাজটাই এমন করেছি। শাস্তি পেতেই হবে। বড় বড় ফোটায় অশ্রু ঝরছে তার ডাগর চোখে।

— এত রাগ! বাব্বাহ! মরে যাব তো মেয়ে আর মারে না বুকে ব্যথা করছে।

কথাটা কানে যেতেই রাগে অশান্ত শবনম মারের ঝড় থামিয়ে এবার জোরে শব্দ করে কাঁদছে। বুকে হাত বুলিয়ে বলল,

— সরি সরি বেশি লেগেছে? সরি শাওকাত।

অসম্ভব আদুরে এই টোন আমার পক্ষে ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি। আলতো করে ওকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে ঠোঁটে চুমু খেলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় দু’জনের কেউ কাউকে ফিরিয়ে দেবার পথ খুঁজে পাইনি। কেটে গেল বেশ কিছুক্ষণ এভাবে।
পরিণত বয়সের দু’জন মানুষ জানে কোথায় সীমারেখা টানতে হয়। একটা সময় নিজেকে থামিয়ে দিলাম। সরে আসব শবনম নরম দু’হাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো খুব শক্ত করে যতটা ওর শক্তিতে কুলোয়। ওকে শুন্য তুলে নিয়ে সস্নেহে বললাম,

— এরচেয়ে বেশি একটুও নয়।

শবনম কাঁদোকাঁদো মিহি কন্ঠে বলল,
— মিসেস রবিন হয়ে আসিনি।

— জানি।

— তাহলে বললেন কেন?

— কারণ ওটাই আমাদের সম্পর্কের আপাতত রক্ষাকবচ। ঐটুকু মিটিয়ে ফেললে আমি নিজেকে আটকাতে পারবো না শবনম। যে ভুল রবিন করছে ঐ একই ভুল আমি তোমাকে করতে দেবো না। শাওকাত কখনো শবনমকে ভেসে যেতে দেবে না। তুমি আমার নারী।

কাঁধে মুখগুঁজে থাকা মেয়েটা ঝট করে মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো। ওর হাওয়াই মিঠাই ঠোঁট দুটোতে চোখ যেতেই নিজেকে কঠোর শাসনে দমন করতে আমার কান্না আসছে খুব। চাইলেই যা পাই তাতে আনন্দ খুব ক্ষণিকের কথাটা মনে যেই এল সামলে নিলাম নিজেকে। কিছুটা রূঢ় হয়ে বললাম,

— অবাক হওয়ার কিছুই নেই। তুমি আমারই। এখন চুপচাপ শান্ত হয়ে দাঁড়াও আমি আসছি।

স্যুইটের লিভিং রুমে শবনমকে রেখে বেডরুমে এসে আমার লাগেজ থেকে একটি শাড়ীর প্যাকেট বের করেছি। এই শাড়ীটি আম্মুর জন্য কেনা। ভারি ব্যক্তিত্বের মণিপুরী শাড়ীটি শবনমকে ওর স্কার্টের ওপরেই পরাতে শুরু করেছি তা দেখে সে আমায় সন্দেহ প্রবণ চোখে দেখছে। মুখে কিছু বলছে না। মা বোনের সাজুগুজু জিনিসপত্র দিয়ে একটু সাজিয়ে দিলাম। সাজগোজ খুব একটা বুঝি না। আন্দাজেই যা করা। তারপর আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে বললাম,

— দেখো।

— শাড়ী পরাতে এক্সপার্ট বাঃ! কী বলেছিলেন যেন উমম প্রেম করেননি। কোনো নারী আসেনি ব্লা ব্লা… মিথ্যুক ছেলে!

হাসি আটকে শবনমে গালে দুই আঙুলে আলতো চড় মেরে আয়নায় মুখ ঘুরিয়ে দিলাম।

— বাজে কথা বাদ দিয়ে আরশিতে তাকাও।

সে আয়নায় না তাকিয়ে তাকালো আমার চোখে। বলল,

— আমার আরশিতে সমুদ্দুর।

ভয়ানক চমকে উঠেছি। কিছুটা অপ্রস্তুত। শবনমকে বুকে চেপে ধরে আড়ালে নিজের চোখদুটো মুছে নিয়েছি ওরই পরনের শাড়ীর আঁচলে। সে প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
— স্কার্টে সত্যিই উগ্র লাগছিল শাওকাত?

— না। অনেক বেশি সুন্দর আর বেইবি গার্ল লাগছিল। ছোট্ট পুতুল একটা যা আমার পাশে বেমানান।

— শাড়ীতে মানাই?

— হ্যাঁ। একটু বড় আর ভারি ব্যক্তিত্বের লাগো। কেমন সাজিয়েছি বললে নাতো। পছন্দ হয়নি?

একথায় বুক থেকে মাথা তুলে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেজা কন্ঠে বলল,
— আমাকে মনে থাকবে শাওকাত? যখন আমি থাকব না মনে পড়বে আমায়?

সোফায় বসিয়ে দিলাম শবনমকে। মাঝখানে সেন্টার টেবিলের দূরত্ব রেখে মুখোমুখি হলাম ওর।
— কোথায় হারাতে চাও বলো? ইচ্ছে করে যোগাযোগ বন্ধ করতে চাইলে মোস্ট ওয়েলকাম। তুমি পারো। নিজের তো নও যে শাসনের বেড়িতে বেঁধে আটকে দেবো।

— ছোট্ট একটা প্রশ্নের জবাব এত ভারি! আমি চলে যাব শাওকাত। না বলে যেতে মন চাইছে না তাই…।

— যে বলে যায় সে আসলে কোথাও যায় না। থেকেই যায়। হয়তো শরীরে। কিংবা মনে। থাকে সে। খুব ভালোভাবে থাকে। হীনমন্যতা নিয়ে আমাকে স্মরণ করো না শবনম। সম্পর্কটা বাধ্য হয়ে জন্ম নেয়নি। রবিনের অবজ্ঞা অবহেলা পেয়ে তুমি কাছে এসেছ আমি নই। আমাকে বাধ্য করেনি কেউ। জানতামও না তুমি কে।

চেহারা লাল হয়ে গেল শবনমের। লজ্জায় নাকি অপমানে বোঝা গেল না। তড়িৎ বেগে স্যুইটের দরজার দিকে পা বাড়ালো। চলার গতির বাতাসে ওড়া ওর শাড়ীর আঁচলে চোখ রেখে এলোমেলো কন্ঠে আবৃত্তি করে উঠলাম,

“তোমাকে যখন দেখি, তার চেয়ে বেশি দেখি

যখন দেখি না।

শুকনো ফুলের মালা যে-রকম বলে দেয়

সে এসেছে…

চড়ুই পাখিরা জানে

আমি কার প্রতীক্ষায় বসে আছি

এলাচের দানা জানে

কার ঠোঁট গন্ধময় হবে-

তুমি ব্যস্ত, তুমি একা, তুমি অন্তরাল ভালোবাসো

সন্ন্যাসীর মতো হাহাকার করে উঠি

দেখা দাও, দেখা দাও,

পরমুহূর্তেই ফের চোখ মুছি

হেসে বলি

তুমি যেখানেই যাও, আমি সঙ্গে আছি!”

দরজার কপাটে কপাল ঠেকিয়ে আবৃত্তি শুনছিল শবনম। শেষ হতেই উল্টো ঘুরে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার বাড়িয়ে দেয়া দু’হাতের উপর। পড়েই শিশুর মত চেঁচিয়ে কান্না শুরু করলো।

— আপনি খুব খারাপ অনেক বেশি খারাপ। আই হেইট ইউ শাওকাত।

— জানি। বাট আই লাভ য়্যু ছোট্ট মেয়ে।

— আমাকে ছেড়ে চলে যান খারাপ মানুষ।

— যাব মেয়ে যাব। খুব শীঘ্রই তোমায় ছেড়ে চলে যাবে তোমার খারাপ মানুষ।

(চলবে)

©মাহমুদা সুলতানা মবিন একা
___________________
বিঃদ্রঃ কবিতাটি লিখেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here