চোখের আরশিতে সমুদ্দুর |৯
স্যুইট থেকে বের হয়ে করিডর অতিক্রম করার সময় সামনা-সামনি দেখা হয়ে গেল ডাঃ কায়সারের সাথে। শাওকাত ওদের স্যুইট থেকে বেরোয়নি এখনও, ওর মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিল। কায়সার ভাইকে দেখে চিনতে কষ্ট হল, সদ্য মা হারানো এক বিধ্বস্ত সন্তান। আমার আব্বু আম্মু আছে সেকারণেই হয়ত ওনার ব্যথায় ব্যথিত হবার সাধ্য নেই। কায়সার ভাই বুঝি চিনলেন না আমাকে, পাশ কাটিয়ে আমার আর রবিনের স্যুইটের দিকে চললেন।
— ডাঃ কায়সার!
— ইয়েস!
বলেই থেমে পাশ ফিরে তাকালেন, নির্বাক তাকিয়েই রইলেন কয়েক সেকেন্ড, বিস্মিত হলেন।
— মিসেস ইফতেখার রাইট!
ওহ শবনম সরি ডিয়ার রিকন করতে পারিনি সরি সরি আই’ম এক্সট্রিমলি সরি!!
— ইট’স ওকে, নো ওরিস! কেমন আছেন কায়সার ভাই? অবান্তর প্রশ্ন তবু জানতে ইচ্ছে করছে।
— আপনার কাছেই এসেছি আমি। আমার মেয়ে দুটো কী ফিরেছে মহেশখালী থেকে?
কায়সার ভাই আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে চাইছেন। খারাপ লাগলেও এমুহূর্তে স্বাভাবিকভাবে নিয়েছি।
— ওরা এখনও ফেরেনি।
— ওহ তাই! মিস্টার ইফতেখারকে বললাম একটু তাড়াতাড়ি আসতে, এল না কী করি বলুন তো!
— তাড়া কেন?
— আজই ব্যাক করব
আম্মার কুলখানি আগামীকাল, যেতেই হবে।
— কল করে দেখুন তাহলে কতদূর এল।
— হুম দেখছি। এনিওয়ে, আপনি কোথাও যাচ্ছিলেন।
— হ্যাঁ, একজন সতীর্থের সাথে সী-বিচে যাচ্ছি, সমুদ্রে সূর্যাস্ত দেখব।
— সতীর্থ!! এখানে দেখা হয়ে গেল, বাঃ দারুণ তো!
— পূর্ব পরিচিত নই,
তবে মন বলছে চিনি তারে বহুকাল ধরে।
কথা বলতে ভুলে গেলেন কায়সার ভাই হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলেন আমার চোখে চোখ রেখে। এবং দ্রুতই সামলে নিয়ে হাসলেন একটু।
— অত্যন্ত খুশী হয়েছি শবনম আপনাকে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে দেখে।
এরইমধ্যে শাওকাত চলে এসেছে। আমাকে কায়সার ভাইয়ের সাথে কথা বলতে দেখে এড়িয়ে নত দৃষ্টিতে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইল। কায়সার ভাইয়ের সামনে এভাবে নিজেকে ছোট করে যাবে শাওকাত, মন সায় দিল না। ডান হাত দিয়ে ওর বাঁ’হাতের রিস্ট ধরে কায়সার ভাইয়ের দিকে চেয়ে বললাম,
— ইনিই আমার সতীর্থ হন কায়সার ভাই। ওঁর নাম শাওকাত।
থমকে দাঁড়ালো শাওকাত কিছুটা অবাক হয়ে দেখল আমাদের দু’জনকে। হেসে পরিচয় করিয়ে দিলাম ওদের। অস্বস্তি নিয়ে শেকহ্যান্ড করলেও খুব দ্রুতই ওরা একে অন্যের সাথে মানিয়ে নিয়ে ভাব বিনিময়ে শুভাকাঙ্ক্ষী হতে সময় নেয়নি। হেঁটে সী-বীচে পৌঁছতে পৌঁছতে সদাহাস্যজ্বল ব্যক্তিত্বের অধিকারী কায়সার ভাই লাজুক মুখচোরা শাওকাতের অস্বস্তি কাটিয়ে ফেললে না চাইতেই এঁদের মাঝখানে আমি হয়ে গেছি অনাকাঙ্ক্ষিত। মুখ বুজে দু’জন শুভাকাঙ্ক্ষীর কথাবার্তা শুনছি।
কায়সার ভাই
শাওকাতকে আমার ফিয়ান্সে হিসেবে অনার করলেন যদিও তা মুখে প্রকাশ করলেন না, আচার আচরণ দিয়ে বোঝালেন। এতে করে শাওকাত ও আমার মাঝে তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতিতে কথা বলা সহজ হল, অনেকটাই।
সী-বীচে পৌঁছে ওদের রেখে আমি হাতে শাড়ির কুচি পায়ের গোড়ালির উপর তুলে নিয়ে দৌড়।
সমুদ্রের
আছড়ে পড়া ফেনিল ঢেউয়ে পা ডুবিয়ে সূর্যাস্ত দেখছি। ওরা দুজনের কেউ এল না কাছে, অদূরে সাজানো এক স্পটে দাঁড়িয়েছে
হয়ত ওখানে কোনো ফিল্মের শুটিং হবে। ডিনার ডেটের মত করে অদ্ভুত সুন্দর সাজিয়েছে স্পটটিকে, রংবেরঙের কৃত্রিম আলোয় ভাসছে চারদিক। অবাক কাণ্ড স্পটের আশেপাশের কোনো শুটিং টিমের দেখা মিলছে না।
সম্পূর্ণ ফ্লাওয়ার ডেকোরেটেড স্পটের সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে আমি ভুলেই গেলাম, সূর্যাস্ত দেখতে এসেছি।
শাওকাতের উপস্থিতি টের পাইনি যতক্ষণ না সে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
— অল অফ ইওরস মাই ডিওড্রপ্স।
— এই আয়োজন আমার জন্যে!
বিস্ময়াভিভূত হয়ে দেখছি শাওকাতকে, সে মুচকি হেসে আমার গাল টিপে দিল। তারপর হাত ধরে নিয়ে চলল আমার জন্য সাজানো সুসজ্জিত মনোরম জায়গাটিতে।
কাছাকাছি আসতেই কায়সার ভাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে বাও করে স্বাগত জানালেন। চোখে পানি চলে এল
এমন করে স্পেশ্যাল ফিল করায়নি কেউ কখনও আগে।
খুব ইচ্ছে করছে শাওকাতকে জড়িয়ে ধরি ওর চোখে চোখ রেখে বলি চাওয়ার চেয়ে পাওয়ার পাল্লা ভারি করে দিয়েছ তুমি, আঃ তুমি করে কী ওকে ডাকব কোনোদিন!
অপলক চেয়ে দেখছে আমায় সুপুরুষটি। তাকে বুঝতে দেয়া জরুরী কতটা খুশী হয়েছি আমি, তাঁর এ আয়োজনে।
আলগোছে ওর পেটের কাছটায় শার্ট খামচে ধরেছি সেও আমার খামচে ধরা হাতটি নিজের মুঠোতে পুরে নিয়ে হালকা চাপ দিয়ে অনুভব করালো আমার অনুভূতির খবর, তার অজানা নয়। লজ্জায় উষ্ণ হয়ে উঠল মন।
চোখ নামিয়ে বালুর সৈকতে দৃষ্টি ছোটাছুটি করে পালাতে চাইল, সে কী বুঝবে লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠা উষ্ণ অনুভূতিগুলো? বোঝার কথা নয়।
প্রকাশে যে ভীষণ বাঁধা
কেউ মেনে নেবে না বিপক্ষ মনোভাব ব্যক্ত করে অবৈধ নাম দিয়ে গাল দেবে মুখভ’রে বলবে, ছিঃ কুলটা মুখপুড়ি মরলি না কেন আগে।
— তো থাকুন আপনারা
আমি যাই, গিয়ে দেখি বাচ্চারা এল কিনা।
কায়সার ভাইয়ের কথার পিঠে আমি বলে ফেললাম,
— আমাকেও
আপনার সঙ্গে নিন কায়সার ভাই। আমি ঢাকায় ফিরতে চাই দমবন্ধ করা এ পরিবেশ থেকে।
— এই সত্যি যাবেন!
এই মুহূর্তটুকু ফেলে শাওকাতকে ছেড়ে যেতে মন চাইবে আপনার, মন কাঁদবে না? দেখুন এখনি কী হাল করেছেন মানুষটার।
আমরা দুজনেই শাওকাতের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতেই সে নিজেকে সামলে নিয়ে হাসল। বলল,
— নিয়ে যান ভাই প্লেনে এক্সট্রা সীট পেলে নিয়ে যাওয়াই ভাল, পরিবেশটা সত্যিই দমবন্ধ হবার মত।
সাথে সাথে আমার ভুলটা ধরে ফেললাম কী যে হল শাওকাতের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বললাম,
— সরি আমি সেটা বোঝাতে চাইনি কেন বুঝতে পারছেন না, কষ্ট হচ্ছে আমার।
বিমর্ষচিত্তে শাওকাত ধীরে টেনে টেনে বলল,
— তোমার কষ্ট
কমাতেই নিজের সবটুকু দিয়ে
এই সন্ধ্যা সাজিয়েছিলাম শবনম, তুমি বোঝোনি।
— এই আপনারা মান-অভিমান করার অনেক সময় পাবেন, না পেলে আমি টাইম ক্রিয়েট করে দেব কিন্তু শবনম বোকা মেয়ে এই মুহূর্তটা, সাগর জলে ভাসাবেন না।
আমি স্পট ছেড়ে যেতে চাইছি আপনাদের স্পেস দেয়ার জন্য, আমার কী আমিতো এমন মজাদার ফ্লাওয়ার কেক গাপুসগুপুস খেতে পারলেই, পোয়াবারো হই।
বলেই আর দেরি করলেন না কায়সায় ভাই উপুড় হয়ে ঝুঁকে পড়লেন ক্যান্ডেল লাইট কাপল ডিনারের ডেকোরেটেড টেবিলের ওপর। সেখানে একটি রোজকেক রূপালী তবকে সাজানো, কেকের ওপরে লিখা,
“মাই ডিওড্রপস”
কায়সার ভাই ড্রপ্সের পাশেই বসানো গোলাপ ক্রিম তুলে মুখে পুরলে আমি আর শাওকাত দুজনেই শব্দ করে হেসে ফেললাম। শাওকাত শক্ত করে আমাকে নিজের পাঁজরের পাশে পিষে ফেলার উপক্রম করল, রাগ কমেনি ছেলের।
…
হোটেল সায়মনের সামনে আমাদের বয়ে আনা গাড়ীটা থামল যখন, চারদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমেছে। তবে,
বর্ণিল আলো ঝলকানি আর ক্রিসমাসের অভ্যর্থনায় ভুলেই গেলাম মনের মধ্যে কী ঝড় বইছিল। বন্ধুরা সবাই সী-প্যালেসে ফেরার আগে এখানেই নামল। আমাকে একপাশে টেনে নিয়ে নিয়াজ রাগে কটমট করে বলল,
— মৃন্ময়ীর জন্য শবনম ভাবীকে তুই ত্যাগ করার আগে আমি তোর জানাজায় শরীক হওয়া পছন্দ করব।
দেখলি তো আমরা বন্ধুরা চাইলেই মৃন্ময়ীর সান্নিধ্য পেতে পারি। বন্ধু তো সবাই, তুই একলা না।
(চলবে)
©মাহমুদা সুলতানা মবিন একা