চোখের আরশিতে সুমুদ্দুর |৭
ফেরার পথে মৃন্ময়ীর আচরণ কেমন অপ্রকৃতস্থ হয়ে গেল। সে নিজের ছোট্ট দুই মেয়েকে রেবেকা আর নজরুলের কোলে তুলে দিয়ে নিজে এসে আমার গা ঘেঁষে বসেছে।
— কী হলো এভাবে বসলি যে? তোর বাচ্চাগুলো কী ভাববে তোকে আমাকে এভাবে দেখে।
— যা খুশী ভাবুক। ওরা ওদের পাপার ভক্ত বেশি। কায়সার না থাকলে তখন আসে আমার সাথে ভাব জমাতে।
— এমন করে বলছিস যেন ওরা তোর পেটে না অন্য মেয়ের পেটে এসেছিল। দেখ ঠিকঠাক মা হতে না পারলে একটা সময় আফসোসের সীমা থাকবে না।
— চিন্তা করিস না তোর বাচ্চার মা হবো যখন নিখুঁত মা হয়ে দেখাবো।
বিষম খাওয়ার অবস্থা হলো গাড়ীর ভেতরে বসে থাকা সবার। কারণ কথাটা মৃন্ময়ী বেশ জোরেই বলেছে। আমি অবাক হইনি। এই প্রলাপ বহু আগে থেকে বকে সে। শুনে হাসতাম। এবার হাসি এল না। রাগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। হটাতই আমার ঘাড়ে মাথা রেখে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসা মৃন্ময়ীকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে বা’হাতে চড় কষালাম ওর বা’গালে। কঠিন গলায় মাইক্রোর ড্রাইভারকে বললাম গাড়ী থামাতে। থামালো। গাড়ী থেকে নেমে সামনের সীটে বসা আমার আরেক বন্ধু নিয়াজকে বললাম ব্যাক সীটে আমার জায়গায় গিয়ে বসতে। আমি বসব ফ্রন্টে।
নিয়াজ নেমে পেছনের সীটে গেলে আমি বসে ড্রাইভারকে তাড়া দিলাম যতদ্রুত সম্ভব হোটেল সায়মনে যেতে। মৃন্ময়ী মূর্তির মত ফ্রন্ট মিররে চোখ রেখে আমায় দেখছে।
বন্ধুদের মধ্যে নিয়াজ একটু লুচু টাইপের। আমাদের মধ্যে একমাত্র সেই বিয়ে করেছে ওদের মফস্বল শহর থেকে অনেক ভেতরে অজপাড়াগাঁয়ের অল্প বয়সী এক মেয়েকে। কনে নিতান্তই বাচ্চা ছিল বিয়ের সময় তাই তুলে আনেনি। বর্তমানে ওদের বিয়ের বয়স পাঁচ বছর হতে চলল। ছয়মাস হলো বউ তুলেছে ঘরে। এবার মেট্রিক দিয়েছে সতেরোতে পা দেয়া মেয়েটি। নাম টিয়া। নিয়াজ নামক স্বামী প্রেমে অন্ধ এই মেয়ে। নিয়াজ দেখতেও মা শা আল্লাহ সুদর্শন বললেও কম হবে। নিজের বন্ধু বলে বলছি না। নিয়াজের শারীরিক গঠন আমাদের সব ছেলে বন্ধুদের মাথাব্যথার কারণ। বয়স ত্রিশ পেরোলেই ছেলেরা যতই নিয়ম মেনে চলুক পেটে হালকা ভুড়ির ভাঁজ পড়বেই। দুইবেলা জিম, জগিং করি আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের বন্ধু বান্ধবী সবাই। মোটামুটি সবাই বিবাহিত। আমিই কেবল লেট ম্যারেজ।
বাচ্চা হবার পর বান্ধবীরা সবাই কমবেশি মুটিয়ে গেছে। তাতে কী, জিম, জগিংয়ের কারণে চেহারার ধার অটুট। সেইসঙ্গে শরীরের জেল্লা বেড়ে দ্বিগুন। কেউ কারো চেয়ে কম না।
বন্ধু বান্ধবীদের দুই গ্রুপেই নীরব প্রতিযোগিতা চলে বডি ফিটনেস নিয়ে। এদিক দিয়ে নিয়াজ আমাদের ছেলেদের মাঝে ঈর্ষণীয় সুদর্শন। দেখতে খুববেশি হলে টেনেটুনে তেইশ চব্বিশের সদ্য যৌবনে পা ফেলা যুবক লাগে।
পরিচিত ফ্রেন্ড সার্কেলে বন্ধু নিয়াজ চৌধুরী বেশ জনপ্রিয় সুপুরুষ ব্যক্তিত্বে ও ব্যবহারের কারণে। চরিত্রের লুচু দোষটুকু বাদ দিলে অত্যন্ত পরোপকারী এবং বন্ধু অনন্ত প্রাণ নিয়াজ। মোটামুটি সবাই আমরা উপকারী হিসেবে ওর কাছে ঋণী।
এইমুহূর্তে সে মৃন্ময়ীকে সামলাতে ব্যস্ত। ফ্রন্ট মিররে আড়চোখে চেয়ে দেখি নিয়াজের সপ্তদশী বউ মাইক্রোর একদম পেছনের সীটের কর্ণারে নজরুলের ওয়াইফ রেবেকার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। ওর নিষ্পাপ মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে আচমকা শবনমের চেহারা ভেসে উঠলো আমার চোখে।
বিয়ের মাস পেরোনোর আগেই শবনমের সাথে বিট্রে করে বসেছি কীভাবে ভেবে ভেবে দশ আঙুলে মাথার চুল খামচে ধরে পাগল হয়ে যাচ্ছি। কী পরিমাণ উন্মাদনায় শবনমকে মাত্র একবেলার মধ্যে বিয়ে করে ঘরে তুলেছি। সেই মেয়েটিকেই হানিমুনে এনে হোটেল রুমে সম্পূর্ণ একলা ফেলে নিজে এসেছি বন্ধুদের সাথে আরেক বন্ধুর বিয়েতে এনজয় করতে। ছিঃ! ভাবতেই ঘেন্না ধরে গেল নিজের উপর।
শবনমকে সাথে নিয়ে এলে কী হত? কেন নিয়ে আসিনি? কত্তবড় ভুল করে ফেলেছি ইয়া আল্লাহ! আত্ম দগ্ধে পোড়ার কী শেষ হবে কখনো? সবাই বউ নিয়ে এসেছে অথচ আমি আমার নবপরিণীতাকে… আর ভাবতে পারছি না!
কতশত বার কল করছি শবনম রিসিভ করছে না। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজের রিপ্লাই দিচ্ছে না। শুধু সীন করে রাখছিল। এখন তো তাও না। আজকে সারাদিনে কোনো মেসেজ সীন করেনি শবনম। বোঝাই যায় সায়মনের অনুষ্ঠানে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত সে। আমাকে স্মরণ করার সময় কোথায় ওর। ভীষণ অভিমান হলো। শবনম তুমি আমায় এই দুইদিনে ভুলে যাওনি তো? নাহ কিছুতে না। তুমি চাইলেও আমি তোমাকে রবিন ইফতেখারকে কিছুতে ভুলতে দেবো না। আমার তুমি চাই। শুধুই তুমি।
বুকের ভেতরে আত্মগ্লানিতে জ্বলছি শবনমকে মিস করে। ক্লান্তিতে বুঁজে আসছে চোখজোড়া। নোংরা সত্যটা হলো এই ক্লান্তি কোনো অবসাদের নয়। কিংবা দুশ্চিন্তারও না। এই ক্লান্তি মাত্রাতিরিক্ত শারীরিক সম্ভোগের। মৃন্ময়ী আমার সাথে ওর সুদীর্ঘ নয়টি বছরের দূরত্বের তৃষ্ণা যেন দুইদিনেই আদায় করে নেয়ার পণ করেছিল। ওর আগ্রাসন থেকে নিজেকে ফেরাতে পারিনি। কী এক অদ্ভুত যন্ত্রণার পথ ধরে হাঁটছি আমি। ফিজিক্যালি মৃন্ময়ী তীব্রভাবে টানে।
বাট, ব্রেইন মাইন্ড অলওভার ব্লকড ওয়ান এন্ড অনলি ডিজায়ার(Desire)…শী’জ শবনম। মাই শবনম।
কী করব আমি এখন…ওহ গড হেল্প মী!
সীটে গা এলিয়ে দিতেই ক্লান্তিতে চোখ বুঁজে এল। নিভু নিভু চোখ মুদে নেয়ার আগে ফ্রন্ট মিররে পেছনের সবাইকে দেখার জন্য এক নজর দিয়েছি। মোটামুটি সবারই চোখ বন্ধ। রেস্ট নিচ্ছে। দুটো দিন রাজুর বিয়ে নিয়ে খুব হৈহল্লায় পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয়া হয়নি কারোরি। মৃন্ময়ীর মেয়ে দুটো নজরুল আর রেবেকার কোলে আরামসে মুখে আঙুল দিয়ে ঘুমুচ্ছে।
সবাইকে দেখে নেয়া শেষে মৃন্ময়ীকে দেখছি। নিয়াজের চওড়া বুকের পুরোটাই দখল নিয়ে ঘুমুচ্ছে মৃন্ময়ী। একহাতে মৃন্ময়ীকে জড়িয়ে অন্য হাতের আঙুল দিয়ে মৃন্ময়ীর ঠোঁটে আঙুল বুলিয়ে খেলছে নিয়াজ। চোখেমুখে ওর দুষ্টুমির হাসি ঝিলিক। আমার চোখে চোখ পড়তেই নিয়াজ চোখ টিপে হাসছে।
বা’হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল উঁচু করে ঠোঁট বাঁকিয়ে নিঃশব্দে গ্রিট করল,
— চিয়ার্স!
ঘৃণা করারও সুযোগ পাইনি কারণ ঠিক ঐমুহূর্তে মৃন্ময়ীর হাজব্যাণ্ড ডাঃ কায়সারের কল এসেছে আমার মোবাইলে। কারো ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে ইয়ারফোনে খুব আস্তে করে বললাম,
— আসসালামু আলাইকুম কায়সার ভাই কেমন আছেন?
বিধ্বস্ত গুরুগম্ভীর কন্ঠে জবাব দিলেন,
— সদ্য মাতৃহারা সন্তান যেমন থাকে আর কী। পারডন মী, সালামের জবাব দেয়া হয়নি রবিন ভাই। ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ!
মনেমনে দমে গেছি অপরাধবোধে। ক্ষীণস্বরে বললাম,
— সরি ভাই পাশে থাকতে পারিনি দুর্ভাগ্য আমার।
— কী যে বলেন রবিন ভাই আপনি দুর্ভাগা হবেন কেন! বরং আপনার কাছে আমি এবং আমার ফ্যামিলি চিরকৃতজ্ঞ।
— এভাবে বলছেন কেন কায়সার ভাই। কৃতজ্ঞতার কী করেছি?
— আমার মেয়ে দুটোকে ওদের বাবার অভাব বুঝতে দেননি সেজন্য। ওরা আপনার সাথে ওদের পিক শেয়ার করেছে আমাকে। আপনি নাকি ওদের পাপার মত টেক কেয়ার করেছেন রাজু ভাইয়ের বিয়েতে। রাতে ওদেরকে গল্প বলে ঘুম পাড়িয়েছেন ইত্যাদি এইসব ছোট্ট ছোট্ট মুহূর্তগুলো ওরা ফোনে বলেছে। সেল্ফি তুলে শেয়ার করেছে। সত্যিই মন থেকে কৃতজ্ঞ রবিন ভাই। আমার মেয়ে দুটো কখনো বাবা ছাড়া রাতে ঘুমোয়নি। মায়ের মৃত্যু, গেস্ট এটেন্ড এগুলো নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত গেল দুটো দিন। আপনাদের খবর নেয়ার সময়ই পাইনি। একবার অবশ্য আপনার মিসেসের সাথে কথা হয়েছে সেলফোনে। মৃন্ময়ীকে রিচ করা যায়নি। ইশশ আমি একচেটিয়া কথা বলে যাচ্ছি। রবিন ভাই আর য়্যু দেয়ার?
ঘাম ছুটে গেল কায়সার ভাইয়ের মুখে বাচ্চারা বেডরুমের ফটো শেয়ার করেছে শুনে। অস্বস্তিতে দমবন্ধ হবার যোগাড়। জড়তা নিয়ে অস্ফুটস্বরে কেবল উচ্চারণ করলাম,
— ইয়াহ!
উনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। ছোট্ট করে বললেন,
— আমি আমার মেয়ে দুটোকে নিতে আসছি রবিন ভাই। আগামীকাল ওদের দীদার কুলখানি। প্লেনের রিটার্ন টিকিট নিয়েছি। আজই ব্যাক করব। কিছুক্ষণের মধ্যে প্লেন টেক অফ করবে। মৃন্ময়ীকে বলবেন আমার মেয়ে দুটোকে যেন শবনম ভাবীর কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করে।
— আর মৃন্ময়ী! ওকে নেবেন না?
— নাহ। ও থাকুক। আমি এমনিতেও চেম্বার করে ওকে আলাদা সময় দিতে পারি না। আপনাদের সাথে বেড়াচ্ছে বেড়াক। বেড়িয়ে আসুক। সময়টা উপভোগ করুক। যা আমি পারিনি সেটা ওর বন্ধুরা ফুলফিল করছে। শূন্যতা কোনো না কোনোভাবে পূরণ হয়েই যায় রবিন ভাই।
আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ মৃন্ময়ীর ফ্রেন্ড সার্কেলের সবার কাছে। বিশেষ করে আপনার প্রতি। আমার বাচ্চা দুটোকে প্যাম্পারিংয়ের জন্য। ওরা খুবই প্লীজড। আমিও। রাখি কেমন? প্লেন টেক অফ করছে রবিন ভাই। সী আ!
আমাকে স্তব্ধ করে দিয়ে কায়সার ভাই কল লাইন কাট অফ করলেন। সমগ্র শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো অজানা আশঙ্কায়। ড্রাইভারকে ধমক দিয়ে বললাম,
— ফ্রন্ট মিররে পেছনে না তাকিয়ে সামনে ফোকাস করুন। দ্রুত পৌঁছাতে হবে আমাদের। এইজন্য এক্সট্রা চার্জ পে করব আমি। হারি আপ!
কিছু না বলে মুচকি হেসে ড্রাইভার মাইক্রোতে স্পীড তুলল। ক্লান্তিতে বুঁজে আসা আমার চোখ দুটোয় নিজের ওপর রাগে শ্বাপদ হয়ে জ্বলছে। সময়টাকে যদি ফরোয়ার্ড করে দুটো দিন পিছিয়ে নেয়া যেত। আমি শুধরে নিতে পারতাম সবকিছু। অন্তত নিজেকে। ফেরার কী কোনো উপায় নেই?
ড্রাইভার অল্প ভলিউমে মিউজিক প্লে করলো। একবার মনে হলো উইদাউট পারমিশন মিউজিক প্লে করার জন্য ধমক দিই। কিন্তু পরক্ষণেই গানের লিরিক শুনে থমকে গেছি।
“যদি আরেকটু সময় পেতাম
কথা রাখবার
পাশে থাকবার
কারণে বা অকারণে
নাম ধরে কাছে ডাকবার
আরেকটু রঙে যদি
হৃদয়কে রাঙিয়ে যেতাম
যদি আরেকটু সময় পেতাম…”
(চলবে)
©মাহমুদা সুলতানা মবিন একা