ছায়াকরী পর্বঃ২৪ ◆

0
2202

# ছায়াকরী
# পর্বঃ ২৪
লেখনীতেঃ তাজরিয়ান খান তানভি

উপুর হয়ে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন নুয়ায়াম। তার দরজার বুকে একের পর শিলা বৃষ্টির মতো ঝুপঝাপ শব্দ হতে লাগল। সে উঠে বসল তূরন্ত বেগে। আঁধার কক্ষে চোখ বুলিয়ে ধাতস্থ হয়ে শ্বাস ফেলল। তোভিয়া ডেকে উঠল—

“ভাইয়া, দরজাটা খোল।”

নুয়ায়াম চমকিত হলো। পেলব, মসৃণ অদৃষ্টে ভাঁজ দেখা গেল। চোখের কোটর ক্ষুদ্র করে উৎকর্ণ হয়ে রইল। ভুল শোনেনি তো সে?
তোভিয়া পূনরায় দরজায় করাঘাত করল। অসহায় গলায় বলে উঠে—

“ভাইয়া!
দয়া করে দরজাটা খোল।”

নুয়ায়াম চট করে উঠে দাঁড়াল। অস্থির পায়ে দরজার কাছে এসে কান পাতল। ওপাশ থেকে তোভিয়ার রোদনের স্রোতের কলকল ধ্বনি যেন এক নিমিষে নাড়া দিলো নুয়ায়ামের অন্তঃকরণ। সে বিহ্বল হয়ে দরজা খুলে দাঁড়াল। চোখের পল্লব অনবরত কেঁপে যাচ্ছে। উচাটন মনে প্রশ্ন করল—

“কী হয়েছে? কাঁদছ কেন তুমি?”

তোভিয়ার সিক্ত আননে চেয়ে থাকল নুয়ায়াম। তোভিয়া ঝরঝর করে কেঁদে শ্বাস টেনে টেনে বলল—

“ভাইয়া! জেহেন!”

“কী হয়েছে জেহেনের?”

তোভিয়ার অশ্রু প্রপাতে তার গাল, গলা সব ভিজে উঠেছে। চোখের কোটর হতে উপচে নামচে জলধারা। ঠোঁট ভেঙে কেঁদে বলল—

“জেহেনের কিছু হয়েছে! তিনি ছাদে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন।”

নুয়ায়াম অবিশ্বাস্য গলায় বলল—

“এত রাতে ছাদে কী করছে জেহেন?”

“আমি জানি না, কিছু জানি না। তুমি চলো, চলো আমার সাথে। জেহেনের কিছু হয়েছে।”

ভাইয়ের হাত ধরে টানছে তোভিয়া। বোনের চোখের পানিতে নিজেই কেমন আবিষ্ট হয়ে পড়ল নুয়ায়াম। সে দ্বিরূক্তি করল না।

ছাদে পৌঁছাল তারা। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে পুরো ছাদ ফাঁকা। কেউ কোথাও নেই। তোভিয়া দিকভ্রান্তের মতো পুরো ছাদ চক্কর লাগিয়ে দিশেহারা কণ্ঠে ডেকে উঠে —

“জেহেন! জেহেন! ভাইয়া দেখনা জেহেন কোথায়?”

নুয়ায়াম শান্ত ও শীতল চোখে চাঁদের অস্পষ্ট আলোতে ছাদে চোখ বুলাল। ধীর পায়ে বাউন্ডারি দেয়ালের কোল ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে নিচ তাকাল। কিছুই দেখতে পেল না সে। তোভিয়া অপ্রকৃতিস্থের মতো ঝমঝমিয়ে কাঁদতে লাগল। এলোথেলো চুল, অস্থিতিশীল শাড়ি, সবকিছু মিলিয়ে বিধ্বস্ত সে। নুয়ায়াম আশ্বস্তকর গলায় বলল—

“শান্ত হও তোভিয়া। জেহেন হয়তো কক্ষে চলে গেছে।”

চকিতে দৃষ্টি খুলে ভাইকে দেখল তোভিয়া। তার অর্ধ নিমীলিত আঁখিপল্লব মেলে অঝোর ধারা ঝরছে। নুয়ায়ামের বলা বাক্য বোধগম্য হতেই সে সিঁড়ি বেয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো নামতে থাকে। যেন কোনো অশরীরী তাড়া করেছে তাকে! শাড়ির সাথে পা আটকে সিঁড়ির সমতল ভাগে মুখ থুবড়ে পড়ল তোভিয়া। কনুই গেঁথে গেল শক্ত মেঝেতে। কনুই আর হাতের তালু ছুঁলে গেল। তবুও উঠে দাঁড়াল সে। হুড়মুড়িয়ে উঠে ছুটতে লাগল নিজের কক্ষে।

তোভিয়া যেতেই ক্লান্ত শ্বাস ফেলে নুয়ায়াম। তার ঘুমো ঘুমো চোখ দুটো বুজে আসছে। সে সিঁড়িঘরের কাছে এসে পা উঠাতেই কেমন শিরশির করে উঠল তার দেহ। চোখের রং পালটে গেল নুয়ায়ামের। কোন এক কুহক জালে আবদ্ধ হয়ে চৈতন্যহীনের মতো সে পেছন ফিরল।
শূন্যে তাকিয়ে পা বাড়াতে লাগল নুয়ায়াম। তার চোখ দুটো ধীরে ধীরে রক্তিম রং ধারণ করল। সে কিছু সময় ঘোরগ্রস্তের মতো পদ্মফুলের প্রতিকৃতির চারপাশে পরিভ্রমণ করল। তারপর এক পা এক পা করে ছাদের কিনার ঘেঁষে হাঁটছে। নুয়ায়াম অজ্ঞাত কারণে চোখ বন্ধ করে নিল। তার বন্ধ চোখের আঁধারে ভেসে উঠল জেহেন, ছায়াকরী আর ইগলের ল/ড়া/ইয়ের দৃশ্য। কিন্তু তা অস্পষ্ট। নুয়ায়াম দেখতে পেল উড়ে আসা কোনো প্রাণী এক মনুষ্যকে তার ডানার ঝাপটায় ছাদের কোণে ছিটকে ফেলে দেয়। আর কিছু দেখার আগেই চোখ খুলে ফেলে নুয়ায়াম। ভয়ে আঁতকে উঠে সে। দৌড়ে সিঁড়িঘরের কাছে গিয়ে আবার পেছেন ফিরে তাকায়। আর দাঁড়াল না নুয়ায়াম। সে দপদপ করে সিঁড়ি ভেঙে ছুটতে লাগল। সিঁড়িঘরের ছাদে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিল ছায়াকরী। চট করেই সে তার পাখি রূপে পরিণত হলো।
,
,
,
কক্ষে প্রবেশ করে বিচলিত, উদ্বিগ্ন, মনকষ্টে নিষ্পেষিত তোভিয়া সশব্দে ডাকল—

“জেহেন! জেহেন! কোথায় আপনি?”

হেঁচকি তুলে যাচ্ছে তোভিয়া। থরথর করে কম্পিত হচ্ছে তার দেহ। আচানক তার উদরে কারো উষ্ণ ছোঁয়া এসে উপস্থিত হলো। জেহেন নিজের বক্ষপাটাতনে তোভিয়ার পিঠ ঠেকিয়ে তার চুলে নাক ডোবাল। নেশাক্ত গলায় বলল—

“কোথায় গিয়েছিলে তুমি?”

এক ঝটকায় জেহেনের দিকে ফিরে তাকাল তোভিয়া। অবিশ্রান্ত বর্ষণে সিক্ত তোভিয়া হাউমাউ করে কেঁদে উঠে জড়িয়ে ধরল জেহেনকে। দুই বাহুর বন্ধকে তাকে আবদ্ধ করে নিল জেহেন। জেহেনের উষ্ণতায় একটু স্বস্তি পেয়ে প্রশ্ন করল তোভিয়া—

“কোথায় ছিলেন আপনি? কেন ছাদে গিয়েছিলেন? কী করছিলেন আপনি ওখানে?”

জেহেন নিজের কাছ থেকে আলগা করল তোভিয়াকে। শোণিতের ঝাঁঝালো গন্ধ আর নোনতা স্বাদ টানছে জেহেনকে। সে আনম্র ভঙ্গিতে তোভিয়ার হাত টেনে নিল নিজের মুখের কাছে। তোভিয়ার আঙুলে ডগা নিজের মুখে পুরে নিল। শুঁষে নিল রক্ত। তোভিয়া বিবশ নয়নে চেয়ে আছে। তার হাতের তালুতে ঠোঁট ছুঁইয়ে চোখে হেসে বলল জেহেন—

“পদ্মকুমারীর তো বেশ সাহস!”

তোভিয়া আড়ষ্টতা কাটিয়ে রোষ নিয়ে বলল—

“আমার প্রশ্নের জবাব দিন।”

“জবাবের বদলে যদি অন্য কিছু দিই?”

তোভিয়া স্থবির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার লোচনের জলপ্রপাত থমকে গিয়েছে। দুইহাতে তোভিয়াকে এক ঝটকায় নিজের কাছে টেনে নিল জেহেন। তোভিয়ার ওষ্ঠাধরের সকল তৃষ্ণা মিটিয়ে দিলো দীর্ঘ চুম্বনের আশ্লেষে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here