শিউলিবেলা পর্বঃ১১

0
636

শিউলিবেলা
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ ১১

অরিত্রীর সম্মতি পাবার পর পিথিউশা বললো,

-“আপনি হয়তো আমার পরিবার সম্পর্কে টুকটাক জানেন, যেহেতু আমরা দুজনেই আশ্রমের ফান্ডের সঙ্গে যুক্ত আছি… কি, জানেন তো?”

অরিত্রী আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বললো,

-“জ্বী, জেবুন্নেসা আন্টির কাছে আপনার এবং আপনার পরিবারের ব্যাপারে কিছুটা শুনেছি।”

মুচকি হাসে পিথিউশা, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

-“আপনি বাইরের মানুষের কাছে যা শুনেছেন তা আমার বর্তমান, নিঃসন্দেহে বলা যায় আমার বর্তমান পুষ্পাচ্ছাদিত বাগানের চেয়ে কম মনোরম নয়। কিন্তু ফুলের অগোচরে যেমন কাঁটা থাকে তেমনি আমার এই গুছানো বর্তমানের আড়ালে একটা অতীত আছে, অন্ধকার অতীত… এ দুর্বিসহ অতীতের পাতা সকলের সম্মুখে উম্মোচন করা যায় না। আপনাকে আমি আমার জীবনের একাংশ বানানোর ইচ্ছা পোষণ করছি বলেই সাহস করে আপনার সামনে অতীত হাতড়াতে বসলাম। কারন আমি চাই না আমার জীবনের সঙ্গে জড়ানোর পর আমার অতীত সম্বন্ধে আপনি অন্য কারো কাছ থেকে কোনো তথ্য পান। আমি চাই আমার যা তথ্য তা আমার দিক থেকেই সরাসরি আপনার কাছে সরবরাহিত হোক।”

গড়গড় করে একটানে কথাগুলো বলে থামলো পিথিউশা, তার চেহারা থমথমে। যেনো চেহারাজুড়ে এক টুকরো ঘন কালো মেঘের ছায়া… অরিত্রী একমনে পিথিউশার কথা শুনছিলো, তার মনে একত্রে কৌতুহল এবং শঙ্কা দু’টোই কাজ করছে। কি আছে মানুষটার অতীতে! অরিত্রীর কৌতুহল টের পেয়ে পিথিউশা বলে,

-“পি. টি. উষা, নামটা শুনেছেন?”

অরিত্রী অতি বিস্ময়ে পিথিউশার দিকে তাকায়, এতো গুরুতর মুহূর্তে এ কেমন প্রশ্ন! নিজেকে সামলে বলে,

-“হ্যাঁ… কথার মাঝে হঠাৎ এ প্রশ্ন?”

পিথিউশা গম্ভীরস্বরে বলে,

-“প্রশ্ন যখন করেছি তার পেছনে কারনতো নিশ্চয়ই আছে। কারন ছাড়া প্রশ্ন হয়?”

অরিত্রীর উত্তরের অপেক্ষা না করে পিথিউশা আবার বলে,

-“আমার জন্ম কোথায়, কার গর্ভে আমার বেড়ে ওঠা, আমার জন্মদাতা কে? এর একটা প্রশ্নের উত্তরও আমার জানা নেই। আমার স্মৃতিতে কোনো সুখকর শৈশব নেই, পিতামাতার দেয়া নিজস্ব কোনো নাম নেই।”

অতি বিস্ময়ে পিথিউশার দিকে তাকায় অরিত্রী, তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে এমন অদ্ভুত কথা সে আগে কখনো শুনে নি! অরিত্রীর প্রতিক্রিয়াকে উপেক্ষা করে পিথিউশা তার কথা অব্যাহত রাখে…

-“এখনো মনে পড়ে, স্টেশনে ভিক্ষা করতাম আমি। এর ওর কাছে খাবার চাইতাম, দু’বেলা খাবার জুটাতে মানুষের সামনে হাত পাততে হতো, পা ধরতে হতো, কেউ কেউ বিরক্ত হয়ে চড়-লাথি মারতো। পরার জন্য কোনো জামাকাপড় ছিলো না… আমার জন্ম এমন এক সমাজে যেখানে আমাকে জন্ম থেকেই চুপচাপ সহ্য করতে শেখানো হয়েছে। আমাকে কেউ ভালোবেসে কোলেপিঠে করে বড় করে নি, মানুষের লাথি উষ্টা খেয়ে আমার বেড়ে ওঠা, আমার শিক্ষক নির্মম বাস্তবতা। অল্প বয়সেই অনেকটা বুঝতে শিখেছিলাম আমি, আস্তে আস্তে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞতার কৌটা ভারী হতে লাগলো। কমলাপুর রেলস্টেশন ছিলো আমার আবাসস্থল, আর ওখানকার একটা ঝুপড়ি চায়ের দোকানের দোকানদার ছিলেন আমার একমাত্র অভিভাবক।”

কথা বলতে বলতে একটু থামে পিথিউশা, দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করে,

-“ওনার সঙ্গেও আমার রক্তের সম্পর্ক নেই তবে আত্মার সম্পর্ক আছে। একবার স্টেশনের এক কোনায় জ্বরে কাতরাচ্ছিলাম, চাচা আমাকে তুলে নিয়ে তার দোকানে থাকতে দিলো। জ্বর সারার পর আমাকে আর স্টেশনের মেঝেতে শুতে দিতেন না, রাতে দোকান বন্ধ করার পর তার ঝুপড়ি দোকানের মাচার উপরে আমরা দুজনে ঘুমাতাম। অতিবাহিত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা যেনো বাপ-ছেলে হয়ে উঠলাম। চাচা খুব ভালো দৌঁড়াতেন, স্কুলে পড়াকালীন ন্যাশনাল লেভেলে দৌঁড়ানোর ভীষণ ইচ্ছে ছিলো কিন্তু অর্থাভাবে সে সুযোগ পান নি। একদিন আমাকে দৌঁড়ে এক পকেটমারকে ধরতে দেখে উচ্ছসিত হয়ে বললেন, “বাবু, তুই তো দেখি জুনিয়র পি.টি. উষা। কি ভালো দৌঁড়াস রে! আমার টাকা থাকলে তোকে নিশ্চিত ন্যাশনাল লেভেলে দৌঁড়াতে পাঠাতাম।” তারপর থেকে মানুষটা আমাকে আর কখনো বাবু ডাকেন নি, জুনিয়র পি. টি. উষা ডাকতেন। আস্তে আস্তে স্টেশনের সকলে আমাকে এ নামেই চিনতে লাগলো।”

পিথিউশার দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিলিয়ে যায়, অরিত্রী ক্ষীণস্বরে প্রশ্ন করে,

-“কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে হক পরিবার, জার্নিটা নিশ্চয়ই সহজ ছিলো না? জুনিয়র পি.টি. উষা থেকে আজকের ফটোজার্নালিস্ট পিথিউশা, কি করে এতোদূর এলেন?”

পিথিউশার থমথমে চেহারার দিকে তাকিয়ে মায়া হয় অরিত্রীর, যার চেহারায় এতো মায়া তার জীবনে এমন একটা অধ্যায় কি না থাকলে হতো না! পরক্ষণে ভাবে, বিধাতার পরিকল্পনা আমাদের চিন্তাধারার পরিসীমার বাহিরে, তাইতো আমরা কেবল অভিযোগ করি, আগে পরে দেখি না, বিবেচনা করি না। হয়তো পিথিউশার জীবনে এমন তিক্ত অতীত ছিলো বলেই বর্তমানটা মসৃণ। অরিত্রী হালকা কেশে জিজ্ঞেস করে,

-“চুপ করে আছেন যে? প্রশ্নটা করে অনধিকার চর্চা করলাম বুঝি?”

পিথিউশা অরিত্রীর দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়, মুচকি হেসে বলে,

-“অনধিকার চর্চা কেনো হবে, আমি তো আজ আপনাকে এ তথ্যগুলো জানাতেই এসেছি। আসলে আমার অতীত এতোটাই তিক্ত যে, এ নিয়ে কথা বলতে গেলে গলায় কথা আটকে যায়, দম বন্ধ লাগে।”

অরিত্রী ইতস্তত করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, কিন্তু দাঁড়ানোর আগেই তার হাত ধরে বসিয়ে দেয় পিথিউশা। শান্ত অথচ গম্ভীরস্বরে বলে,

-“যাবেন না, আমার কষ্ট হলেও আমি আপনাকে সবটা জানাতে চাই। এতোবছরে আমার ভেতরে জমানো কথাগুলো একমাত্র আপনাকেই বলতে পারি আমি… জানি না কেনো, তবে আপনাকে আমি ভীষণ ভরসা করি।”

মুহূর্তেই অরিত্রীর নিজেকে পাপী মনে হতে লাগলো, সে প্রথমদিন থেকে সামনে বসে থাকা মানুষটা সঙ্গে মিথ্যাচার করছে অথচ মানুষটা অকপটে বলে দিলো সে অরিত্রীকে ভরসা করে। অরিত্রী সত্যটা বলার জন্য মুখ খুলবে তখনই পিথিউশা বললো,

-“আমি ভালো দৌঁড়াতাম, বললাম তো। স্টেশনে প্রায়ই পকেটমাররা টাকা মারতো, আমি অনেকবার দৌঁড়ে ধরিয়ে দিয়েছিলাম কয়েকজনকে। এভাবেই একদিন এক পকেটমারকে ধরিয়ে দেবার সময় পরিচয় হয় আমার দাদু মহসীনুল হকের সঙ্গে। অন্য সবার মতো তিনি আমাকে রাস্তার ছেলে ভেবে ঘৃণা করে দূরে সরিয়ে দেন নি, কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তোমার নাম কি বাবু? এখানে কোথায় থাকো?” আমি হাতের ইশারায় রহমত চাচার ঝুপড়ি দোকানটা দেখিয়ে বলেছিলাম, “আমার চাচার সঙ্গে থাকি।” উনি এরপর চাচার সঙ্গে কথা বললেন, আমাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলেন। চাচা যখন আমাকে সবটা জানালো তখন আমি সরাসরি মানা করলাম। একটা অযাচিত জীবন চাচ্ছিলাম না, তাছাড়া চাচাকে ছেড়ে আসতেও মন চাইছিলো না।”
-“তারপর?”

পিথিউশা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, চোখের কোণে জমা জল মুছে বলে,

-“আমি স্টেশন ছেড়ে, চাচাকে ছেড়ে আসতে না চাইলেও চাচা চেয়েছিলেন আমি ওই জায়গাটা ছেড়ে দেই। তখন উপলব্ধি করতে না পারলেও বর্তমানের পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমি অনুধাবন করেছি, রক্তের সম্পর্কের কেউ না হয়েও চাচা আমার জন্য উত্তম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। রাতে ঘুমানোর সময় চাচা আমাকে কাছে ডেকে মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, “শোন বাবা, এ জীবনটা কোনো জীবনই নয়। তোর মেধা আছে, শারিরীক সামর্থ্য আছে, একটা ভালো পরিবেশ পেলে তুই সফল হবি। আমার কোনো পরিবার নেই, তুইই আমার একমাত্র পরিবার। তুই বড় কিছু হলে আমি গর্ব করে বলতে পারবো আমার ছেলে বড়মাপের মানুষ। তাছাড়া ওই বাড়িতে গেলে তুই মা-বাবা পাবি, দাদু পাবি, তোর একটা সম্পূর্ণ পরিবার হবে। আমি তো কোথাও যাচ্ছি না বাবা, তুই গিয়ে দেখ একবার, ভালো না লাগলে আমার কাছে ফিরে আসবি।” অনেক বোঝানোর পর চাচার কথায় রাজি হলাম, হক পরিবারে আমার আগমন যেনো উৎসব বয়ে আনলো। বাবা-মা, দাদু প্রত্যেকে আমার গ্রুমিং নিয়ে ব্যস্ত। আমার তখন হাতেখড়ি হয় নি, মা আমার পড়াশুনা, খাওয়া-দাওয়া, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে ব্যস্ত। বাবা আমার পোশাক, চলাফেরা এসবের তত্ত্বাবধান করতেন। আর দাদু আমার সৎ ও সুন্দর চারিত্রিক গঠণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন।”

অরিত্রী মুচকি হাসলো, প্রফুল্ল স্বরে বললো,

-“বাহ, আপনার একটা ভালো কাজ আপনাকে একটা পরিবার এনে দিলো। কি রোমাঞ্চকর জীবন আপনার…”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here