শিউলিবেলা পর্বঃ১০

0
492

শিউলিবেলা
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ ১০

অনেক ভাবনা-চিন্তার পর পিথিউশা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো অরিত্রীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলার কিন্তু শেষমেশ আর বের হওয়াই হলো না। পিঠের ব্যথায় সারাটা দিন বিছানায় শুয়েই কাটাতে হলো। রাতেও খুব একটা ভালো ঘুম হলো না তার, বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে রাতটা পার করে দিলো। ফজরের আযান শুনে নামাজ পড়লো, ছাদে গিয়ে সূর্যোদয় দেখলো, তারপর সিদ্ধান্ত নিলো গতদিন যে কথা বলা হয় নি, তা আজ নিশ্চয়ই বলবে পিথিউশা। এই দোটানার ইতি ঘটা জরুরি। মনে মনে পিথিউশা আরো একটা সিদ্ধান্ত নিলো, আজ যতো যা’ই হোক না কেনো ঈশানের মুখদর্শন করবে না সে…

১৫
মাথায় হ্যাট পরা ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে যখন গার্ড শুটিং স্পটে এসে পৌঁছালো অতসীর চোখ তখন কোটর থেকে বের হয়ে আসবার অবস্থা। ডিরেক্টর সাহেব যখন ছেলেটার মাথার হ্যাট সরালেন অতসী তখন শব্দ করে হেসে ফেললো, বহুবছর পর সে এমন মন খুলে হেসেছে। সেট এর অনেকেই তা তার দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলো। একটা শর্ট ব্রেক নিলো অতসী, তারপর ঈশানের হাত ধরে সবার আড়ালে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-“নিউ প্রফেশন বুঝি? কি প্রফেশন? চুরি করা?”

একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করলো,

-“তা এখান থেকে কি চুরি করবেন বলে ঠিক করেছেন? লিপস্টিক? মেকাপ আইটেম? কস্টিউম?”

হাসির দমকে কথা বলার সময় বারংবার কাঁপছিলো অতসী, ঈশান অনেক চেষ্টা করেও রাগ সংবরন করতে পারছিলো না। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললো,

-“চুরি করতে যাবো কেনো? প্রথমবার কাউকে জ্যাকেট পড়তে দেখছেন?”

অতসী হাসে, হাসির রেখা পূর্বের তুলনায় ক্রমশ প্রশস্ত হয়। তার সঙ্গে প্রথমবারের মতো ঈশান লক্ষ্য করে অতসীকে হাসলে দারুণ লাগে। তার চারিত্রিক কাঠিন্য তখন মেঘের মতো উড়ে যায়, তাকে পুষ্পকড়ির মতো সতেজ বোধ হয়। ঈশানকে নিজের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে অতসী কিছুটা লজ্জা পায়, লজ্জা ঢাকার জন্য পূর্বের গাম্ভীর্যপূর্ণ স্বরে বলে,

-“মানছি শেষরাতের দিকে একটু ঠান্ডা পড়ে, এই মৌসুমে মাঝে মাঝে একটু বৃষ্টিও হয় কিন্তু তাই বলে এই রোদের মধ্যে কেউ এমন জ্যাকেট পরে, গলায় মাফলার আর মাথায় হ্যাট পরে ঘুরে না। আপনাকে দেখে দুটো জিনিস মনে হচ্ছে। এক, চোর-বাটপার… দুই, কোনো সাংবাদিক, যে কি না শুটিং সেট এর আশেপাশে ঘুরঘুর করে রগরগে কিছু মশলাদার খবরের জন্য।”

ঈশান হতাশ গলায় বললো,

-“আমি দুটোর একটাও নই, সত্যি বলতে এসব পরে অনেক গরম লাগছে। কিন্তু…”

অতসী হাসি চেপে আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করে,

-“কিন্তু কি?”

ঈশান মাথা থেকে গলা পর্যন্ত পেছানো মাফলারটা খুলে অতসীকে নিজের মাথার ফোলা জায়গাটা দেখালো, তারপর নিস্তেজ গলায় বললো,

-“আপনার হবু বরের সুনাম করার পুরষ্কার। মাথায় এমন আলু নিয়ে রাস্তায় বের হই কি করে বলুন? আমার মতো বেকারের আছে বলতে তো এই ফাস্টক্লাস চেহারাটাই তাই না? সেটাও যদি চলে যায় তবে কপালে বউ জুটবে বলুন?”

ঈশানের গলার স্বরে হতাশা স্পষ্ট, অতসী ঠোঁট টিপে হাসে, রসিকতা করে বলে,

-“আপনার যাবতীয় কথাবার্তায় আমার মনে হচ্ছে আপনার পরিবার অতি নিরীহ একটা পরিবার। আপনাদের পরিবারের ছেলেরা বিয়ে করার জন্য মেয়ে পায় না। তাইতো আপনি এখানে সেখানে মেয়ে খুঁজে বেড়ান। যেমন কিছুদিন আগে আপনার ভাইয়ের জন্য আমাকে ঠিক করতে চাইলেন আর এখন মাথা সামান্য ফুলে গেছে বলে নিজের বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হচ্ছেন।”

ঈশানকে বোকার মতো নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মায়া হলো অতসীর। জিজ্ঞেস করলো,
-“কেনো বলুন তো? জীবনে বিয়েই সব? বিয়ে না করলে আপনার জীবন চলবে না? নিজের কদর করতে শিখুন, আপনি নিজেকে সম্মান করতে না শিখলে অন্য কেউ আপনাকে সম্মান করবে কেনো?”

ঈশান অতসীর কথার প্রসঙ্গের পাশ কাটিয়ে বলে,

-“আমার ভাইয়াকে বিয়ে করবেন না আপনি? সেদিন যে বললাম, কিছু তো জানালেন না…”

অতসী বেশ বিরক্ত হয়, বিরক্তি চেপে স্বাভাবিক স্বরে বলে,

-“শুনুন জনাব, আপনার ভাইয়ের প্রতি আমার বিন্দুপরিমান আগ্রহ নেই। আমার যতো আগ্রহ সব আপনার উপর, তবে বিয়ে করার মতো আগ্রহ এখন অবধি জন্মায় নি। ভবিষ্যতের কথা বলতে পারছি না, ভবিষ্যতে এই সেক্টরে আগ্রহ জন্মাতেও পারে। যাই হোক, আমার ব্রেক শেষ… আমি আসছি।”

যাবার জন্য সামনে পা বাড়ায় অতসী। যেতে যেতে পেছন ফিরে তাকায়।,মুচকি হেসে বলে,

-“একটা জরুরি কথা, এসব ফালতু জিনিস দ্রুত খুলুন তো। একেবারে সার্কাসের জোকার মনে হচ্ছে। আপনি এমনিতেই যথেষ্ট সুদর্শন…”

অতসীর প্রশংসায় ঈশানের মনে প্রফুল্লতা ফিরে এলো, গা থেকে জ্যাকেট খুলে হাতে নিলো, মাফলার সুন্দর করে গলায় প্যাঁচালো, হ্যাটটা উঁচু করে রে গুণগুণ করে গান ধরলো। এতোকিছুর মাঝে ঈশান খেয়ালই করলো না, অতসী নামক মানুষটার সামান্য একটা মন্তব্য তার মনের মেঘ কাটানোর জন্য যথেষ্ট…

১৬
বেগুনী পাড় সাদা শাড়ীতে অন্যদিনের তুলনায় আজ একটু বেশিই উজ্জল মনে হচ্ছে অরিত্রীকে। পিথিউশার আগমনে তার চেহারার চাকচিক্য পূর্বের তুলনায় দ্বিগুন বেড়ে গেলো। অরিত্রীর ঠিক এক হাত সামনে এসে থামলো পিথিউশা, সাদা পাঞ্জাবীতে তাকেও আজ বেশ উজ্জ্বল লাগছে, কেমন একটা পবিত্র পবিত্র ভাব। পিথিউশা মুচকি হেসে শান্তস্বরে বললো,

-“আপনাকে আমার অনেক কিছু জানানোর আছে অতসী, দয়া করে আপনি আজকের পুরোটা সময় আমাকে দেবেন?”

অরিত্রী বেশ কিছুদিন ধরে চাইছিলো পিথিউশাকে একান্তে সবটা খুলে বলতে, যেহেতু সুযোগটা আপনাআপনি চলে এলো তাই আর হাতছাড়া করলো না। সম্মতি জানাতে বললো,

-“এদিকটায় বাচ্চারা খেলা করছে। আশ্রমের পেছনে একটা পুকুর আছে, পুকুরপাড়ে লোকসমাগম কম। সেখানে গিয়ে বসা যায়…”

অরিত্রীর সম্মতি পেয়ে আর অপেক্ষা করলো না পিথিউশা, মুচকি হেসে হাঁটতে শুরু করলো। তার পাশাপাশি হাঁটছে অরিত্রী, মন চাইছে দুই ইঞ্চি দূরত্ব গুছিয়ে অরিত্রীর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিতে কিন্তু অরিত্রীর মনোভাব নিশ্চিত না হয়ে এই ঔদ্ধত্য প্রদর্শণের কোনো মানে হয় না। তাই মনের ইচ্ছাকে মনেই চাপা দিলো পিথিউশা…

পুকুরপাড়ে বসে বসে পানিতে ঢিল ছুঁড়ছে অরিত্রী, তার বা পিথিউশা কারো মুখে কোনো কথা নেই! অথচ দু’জনেরই বলার আছে অনেক কথা… পিথিউশাই প্রথম কথা শুরু করলো। পকেট থেকে একমুঠো শুকনো শিউলি ফুল অরিত্রীর মুখের সামনে তুলে ধরে বললো,

-“কিছু মনে পড়ে অতসী? এমনই কিছু ফুল আপনার বাড়ির বাহিরে রেখে এসেছিলাম কিছুদিন আগে, সঙ্গে চিরকুট। আসলে ব্যাপারটা ছেলেমানুষি হলেও অন্তর্মুখী ব্যাক্তিত্বের অধিকারী আমার মতো মানুষের দ্বারা আপনার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এর থেকে ভালো কোনো উপায় মাথায় আসছিলো না। আমার আচরনে আপনি বিরক্তিবোধ করে থাকলে দুঃখিত।”

মুহূর্তে অরিত্রীর বুকটা ধক করে উঠলো, যা কথা গুছিয়ে রেখেছিলো সব গুলিয়ে গেলো, কাজের ব্যস্ততায় সে বেনামী চিরকুটদাতাকে ভুলেই গিয়েছিলো। পিথিউশাই যে সে ব্যক্তি, এ ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয় নি। কিন্তু এ মুহূর্তে অতসীর প্রতি পিথিউশার একনিষ্ঠতা উপলব্ধি করে অরিত্রী সত্য প্রকাশ করার মনোবাসনা ত্যাগ করলো। নিরবে শুনতে লাগলো সামনে বসে থাকা মানুষটার কথা।

পিথিউশার চোখের ইশারায় ফুলগুলো নিতে বললো অরিত্রীকে, অরিত্রী আঁচল পেতে ফুলগুলো গ্রহণ করলো। মুচকি হেসে পিথিউশা বললো,

-“আপনাকে আমি পছন্দ করি এটুকু বুঝতে নিশ্চয়ই এ মুহূর্তে কোনো সমস্যা হচ্ছে না আপনার? আপনি হ্যাঁ বললেই সম্পর্কটা শুরু করা যায়, কিন্তু আমার মতে একজন মানুষকে পছন্দ করা আর সারাজীবন একত্রে কাটানোর মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য আছে। তাই আজকে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে আপনাকে আমার ব্যাপারে জানাতে এসেছি। আমি বলছি না যে, সবটা শুনার পর আপনাকে আমার প্রস্তাবে রাজি হতে হবে, আমি কেবল অনুরোধ করছি ধৈর্য্য ধরে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটা শুনুন। সবটা শোনার পর হ্যাঁ বা না বলার অধিকার একান্ত আপনার। আপনি আমার সম্পূর্ণ কথা শুনবেন, আমি কি আপনার কাছ থেকে এটুকু আশা করতে পারি?”

অরিত্রী উপর-নিচ মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। সে জানে সামনে বসে থাকা মানুষটা তার নয়, মানুষটা যে কথাগুলো বলছে তা’ও তাকে উদ্দেশ্য করে নয়। তবুও অবাধ্য মনের কাছে মস্তিষ্কের সকল যুক্তি হার মানে, মন জানতে চায় সামনে বসে থাকা মানুষটার মনের কথা। পিথিউশাকে কাছ থেকে জানবার লোভ সামলাতে ব্যর্থ হয় অরিত্রী, নিরবে অতসী হবার অভিনয় অব্যাহত রাখে সে…

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here