ছায়াকরী পর্বঃ২৬

0
613

# ছায়াকরী
# পর্বঃ২৬
লেখনীতেঃ তাজরিয়ান খান তানভি

ইগলটি যখন তার ভয়াল পাখা নিয়ে জেহেনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তৎক্ষণাৎ সে তার পশু রূপে রূপান্তরিত হয়। ইগলটির পাখা আ/ঘা/ত করল জেহেনের মুখে। ছায়াকরী স্থির দাঁড়িয়ে রইল। জেহেন কিছুটা পিছিয়ে যেতেই তার পেছনের দিকে পা ঠেকে যায় বাউন্ডারি দেয়ালে। জেহেনকে আ/ঘা/ত করেই খানিক দূরত্ব রেখে দাঁড়ায় ইগলটি। তার লালাভ কমলা চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। ইগলটি তার দুই পাখা মেলতেই তা আরও বিস্তৃত হলো। জেহেনের সবুজ চোখ তার উজ্জ্বলতা বাড়াচ্ছে। কালো আর বাদামী রঙের মিশেলের পালকে আচ্ছাদিত ইগলটির ক্ষুব্ধ দৃষ্টি জেহেনের দিকে। জেহেন চৌকস চোখে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তার কর্ণদ্বয় সচেতন হয়ে আছে ছায়াকরীর বলা কথাতে। ইগলটি পূনরায় তার চৌখালো ঠোঁট ফাঁক করে জেহেনের দিকে এগিয়ে আসতেই তার সামনে এসে দাঁড়ায় ছায়াকরী। ছায়াকরী তার দুই শুভ্র পাখা মিলিত করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। জেহেন সরে আসে ছায়াকরীর পেছন থেকে। সে চট করেই তার মানব অবতরে এসে ইগলটির পিঠে ছায়াকরীর হাত থেকে নেওয়া পাতলা, ধা/রা/লো ছু/রিটা ঢু/কি/য়ে দেয়। ভ/য়ং/কর আর্তনাদ করে পায়ের এক ঝটকায় জেহেনকে আর পাখার ঝাপটায় ছায়াকরীকে ছুড়ে ফেলে। পদ্মফুলের প্রতিকৃতির ওপর উড়ে গিয়ে বসে ইগলটি। তার বিক্ষুব্ধ, ক্রোধিত দৃষ্টির আগুন জ্বলা চাহনি ছায়াকরী আর জেহেনের দিকে। জেহেন নাক কুঁচকে ফোঁস ফোঁস করছে। হাওয়ার তোড় বাড়তে থাকে। সেই হাওয়াতেই লুপ্ত হয়ে যায় ইগলটি। জেহেন ধাতস্থ নজরে তাকাল ছায়াকরীর দিকে। পেছন দিকে হেলে থাকা জেহেন ঝট করে উঠে দাঁড়ায়। ছায়াকরী নিস্তেজ। তারা অরঞ্জিত পাখা রঞ্জিত। জেহেন দ্রুত আসতেই ছায়াকরী তার পাখি রূপে উড়ে যায়। সে কিছু সময় অপলক চেয়ে রইল। তারপর তটস্থ পায়ে ছাদ থেকে নেমে আসে।

স্মৃতিমন্থনে নিমগ্ন জেহেনের ভাবনার সুতো কাটে তোভিয়ার ডাকে। জেহেন সচল চোখে তাকাল। রাদিয়াতকে নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছে তোভিয়া। তোভিয়ার জলসিক্ত চোখের আবেশ দৃষ্টিগোচর হলো জেহেনের। রাদিয়াত অনেকটা স্বাভাবিক আচরণ করছে। কোনো কথা না বললেও সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে খেয়েছে, তোভিয়ার চোখে-মুখে হাত বুলিয়ে দিয়েছে। জেহেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মা-মেয়ের আহ্লাদীপনা দেখেছে শুধু।

” চলুন, আম্মির খাওয়া শেষ।”

জেহেন পকেটে হাত গুঁজে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। পকেট থেকে হাত বের করে হালকা ঝুঁকে বলল—

“তুমি যাও, আমি আসছি।”

তোভিয়া রাদিয়াতের দিকে তাকাল। রাদিয়াত বিছানাতে আঁখি নিবদ্ধ করে রেখেছে। স্থির, নিষ্কম্প, অটল চাহনি। তোভিয়া দৃষ্টিভঙ্গি বদলে জেহেনের দিকে তাকিয়ে বলল—

” এখানে থাকা কী ঠিক হবে আপনার?”

“ভয় পেয়ো না। সাবধানে থাকব আমি।”

“হুম।”

তোভিয়া মায়ের দিকে তাকাতে তাকাতে কক্ষ থেকে বের হয়। জেহেন ধীরগতিতে রাদিয়াতের সামনে বসে। জেহেনকে দেখেই চোখের জল ছেড়ে দেয় রাদিয়াত। বিধুর স্বরে বলল—

“আমার তোভিয়ার খেয়াল রেখো!”

জেহেন আলতো হেসে বলল—

“রাখব। কেমন আছেন আপনি?”

রাদিয়াত মাথা নিচু করল। কোনো প্রতিক্রিয়া করল না।জেহেন পূনরায় নরম স্বরে বলল—

“কেমন আছেন আম্মি?”

রাদিয়াত চমকে তাকাল। জেহেন চোখে হেসে বলল—

“তোভিয়া আর আমার বিবাহ হয়েছে। সেই হিসেবে তো আমি আপনার মেয়ে জামাই। অধিকার আছে আমার। আমার আম্মিকে তো আমার মনে নেই। সব তো জানেন আপনি।”

রাদিয়াত তার বাম হাতটা উঠিয়ে জেহেনের আননে বুলিয়ে বলল—

“তোমরা এখান থেকে চলে যাও। অনেক দূরে চলে যাও।”

“কে এসেছিল আপনার কাছে? সে এখন কোথায়? নুয়ায়ামকে দাদাজান কেন নিয়ে এসেছেন এই মহলে?”

“জানি না আমি। যে এসেছিল, সে বলেছে, বাবাকে তিনি সব বলেছেন। বাবা সব জেনেই নুয়ায়ামকে এখানে নিয়ে এসেছেন।”

“নুয়ায়াম তো কারো ক্ষতি করেনি। তাহলে কেন আপনি ওকে সহ্য করতে পারেন না?”

ঝমঝমিয়ে কেঁদে ফেলে রাদিয়াত। ধরা গলায় বলল—

“নুয়ায়াম আসার পর থেকেই এসব শুরু হয়েছে।”

“কিন্তু, ও তো শিশু ছিল। ও তো কিছুই করেনি।”

“কেউ তো করেছে। তারা নুয়ায়ামের জন্যই এসেছে। নুয়ায়াম সাধারণ কেউ নয়।”

“সাধারণ তো আমিও নই। তাহলে আমাকে কেন ভরসা করছেন?”

“কারণ……।”

রাদিয়াত থেমে গেলেন। জেহেন শব্দ শুনতে পেল। কোনো কিছু উড়ে যাওয়ার শব্দ। সে ব্যগ্র হয়ে উঠে এলো জানালার কাছে। কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। তবে সে আশাও করেনি। কিন্তু ভয় পাচ্ছে, যে বা যারা এসব করছে, তাদের জন্য রাদিয়াত একদম সুবিধার নয়। জেহেনের মস্তিষ্কে তোলপাড় শুরু হলো। দুটো মানুষকে সে একা কী করে রক্ষা করবে? বাকিদের নিয়ে সে ভাবছে না আপাতত। ছায়াকরীকেও সে পুরোপুরি বিশ্বাস করে না। ছায়াকরী কে, তার এখানে আসার উদ্দেশ্য সবকিছুই অজানা তার। জেহেন তার সব প্রশ্নের উত্তর চায়।
,
,
,
নুয়ায়ামের মুখের কাছেই আসতেই অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। ছায়াকরী তার ছোট্ট পাখনা মেলে লাগাতার ঘুরতে লাগল সা/পটির মাথার চারপাশে। বিভ্রান্ত হলো সা/পটি। সে নিজেই বিব্রত হলো। নুয়ায়াম অস্পষ্ট আওয়াজে স্বগতোক্তি করল–

“ছায়াকরী! সেভ মি!”

ছায়াকরী ভেবে পাচ্ছে না কী করবে। তাকে তার নারী অবয়বে আসা জরুরি। কিন্তু নুয়ায়াম তাকে দেখে ফেললে তার প্রতি যে বিশ্বাস আছে তা ভেঙ্গে যাবে। বড়ো কথা, সহজ জীবনযাপন করা নুয়ায়াম ভয় পেয়ে যাবে। ছায়াকরী একটা ঝোঁপের ওপর বসে কুচকুচে কালো সা/পটির চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। চকিতে আঁধার নেমে এলো মায়ায় আচ্ছন্ন কৃত্রিম জঙ্গলে। নুয়ায়ম ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল। ধীরে ধীরে সে দেখার ক্ষমতা হারাচ্ছে। সা/পটি নেমে এলো নুয়ায়ামের পা থেকে। সে আঁধারেই জ্বলজ্বলে দুই জোড়া চোখ দেখছে নুয়ায়াম। অকস্মাৎ সে উঠে দাঁড়াল। তার হাত-পায়ে জড়িয়ে থাকা লতাপাতা তাকে বাঁধন থেকে মুক্ত করে দিলো। নুয়ায়াম ভয়কাতুরে চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। তার চোখ ক্রমশ রক্তিম হচ্ছে। একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে নুয়ায়াম। তার চোখের দর্পণে ভেসে উঠছে সেই সা/প আর এক নারী অবয়ব। কিন্তু নারী মুখটি স্পষ্টত হওয়ার পূর্বেই এক তেজী হাওয়ার স্রোত নাড়িয়ে দেয় তাকে। নুয়ায়াম দৈবাৎ আসা ঝড়ো হাওয়া সামলাতে না পেরে উলটে পড়ে যেতেই তার কপালে আ/ঘা/ত লাগে। একটা পাথরের কোণা লেগে যায়। নুয়ায়াম আর উঠতে পারল না।

রৌশনাইতে উজ্জ্বল হলো সব। মায়া আচ্ছন্ন জঙ্গল হারিয়ে গেল এক নিমিষেই। ছায়াকরী তার নারী অবয়বে দাঁড়িয়ে আছে। সা/পটি তার সত্তা পরিবর্তন করল। কালো বলয় থেকে বেরিয়ে এলো এক পুরুষ অবতার। ছায়াকরী রাগের অগ্নি বিচ্ছুরণ করে বলল—

“যুবরাজ মায়ং এর ছায়াও কারো সংস্পর্শে আসতে দেবো না আমি।”

ছায়াকরীর পিষ্ঠদেশ হতে চকিতে বেরিয়ে এলো তার বৃহদাকার শুভ্র পাখনা। তার নীলাক্ষী হতে নীল রঙের রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়ে পুরুষ অবয়বটিকে ঘিরে ধরল। পুরুষ অবয়বটি নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত হতেই ছায়াকরী বাতাসের বেগে উড়ে এসে তার গলায় পা দিয়ে চেপে ধরে। পুরুষ অবয়বটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ছায়াকরী ক্রোধে বিহ্বল হয়ে তার হাত বাম হাত শূন্যে ছড়াতেই সেখানে দৃশ্যমান হয় এক ধা/রা/লো তরবারি। তরবারির নিঁখুত ঘা/তে/ই শিরচ্ছেদ ঘটে পুরুষ অবয়বটির।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here