# ছায়াকরী
# পর্বঃ ২৯
লেখনীতেঃ তাজরিয়ান খান তানভি
নিচে নেমে এলো আরইয়াজ আর নুয়ায়াম। নুয়ায়াম অবাক দৃষ্টিতে দেখছে সব। কাঠের বাড়িটির সৌন্দর্য তাকে বারংবার মোহিত করছে। নিচ তলার সিঁড়ির একপাশে রান্নাঘর অন্যপাশে খোলা কক্ষ। যার কোণার দিকটায় চেয়ার-টেবিল পেতে রাখা। সেই খোলা কক্ষের একপাশে একটি দরজা। সেখানে আরেকটি কক্ষ। নুয়ায়াম শব্দহীন পায়ে আরইয়াজের পিছু পিছু হেঁটে আসছে, আর চোখ জুড়িয়ে সব দেখছে। চেয়ার -টেবিল পেতে রাখা জায়গাটুকুতে গাঢ় দৃষ্টি ফেলে নুয়ায়াম। মাঝের টেবিলে একটি ছোট্ট মূর্তি রাখা। নুয়ায়ামের মনে হলো সে কোথাও দেখেছে এই মূর্তি, কিন্তু মনে করতে পারছে না। নুয়ায়ামের অস্থির হৃদয় আরওয়াকে খুঁজতে লাগল। এলোথেলো নজর বুলিয়ে নিল সে সম্পূর্ণ জায়গাটুকুতে। আরইয়াজ পরিষ্কার গলায় বললেন—
“তুমি কী চিন্তিত?”
নুয়ায়াম জবাব দিলো—
“না।”
“এসো তাহলে।”
ঘর থেকে বের হতেই চওড়া দাওয়াতে চোখ আটকে নুয়ায়ামের। দাওয়ার ওপরে ছন আর কাঠের আচ্ছাদন। সেই আচ্ছাদনের চার কোণাতে চারটি লণ্ঠন জ্বালানো। বাহারি রঙের কাচ দিয়ে ঘেরা সেই লণ্ঠনের হলুদ অনল যা পুরো দাওয়া আলোকিত করে রেখেছে। যেই বাঁশের খুঁটির ওপর ভর দিয়ে দাওয়ার ছাদ তৈরি করা তাতে অপরাজিতা ফুলের লতা জড়িয়ে আছে। চকিতে নুয়ায়ামের নাসিকারন্ধ্রে একটা মিষ্টি গন্ধ নাড়া দেয়। সে অধৈর্য নয়নযুগল এদিক-ওদিক ঘোরাতে থাকে। আরওয়া এসে দাঁড়িয়েছে নুয়ায়ামের সান্নিধ্যে। তার হাতে হ্যাজাক বাতি। অচিরেই প্রশ্ন করল নুয়ায়াম—
“এই বাতি কোথায় পেলেন?”
আরইয়াজ উত্তর দিলো—
“একটা এন্টিক শপ থেকে এনেছিলাম। ভেবেছিলাম শুধু সংগ্রহে রাখব। কিন্তু এটা যে চমৎকারভাবে কাজ করবে ভাবতে পারিনি। আজ এই অন্ধকার পথে এটাই তোমার আর আরওয়ার সঙ্গী হবে।”
আরওয়ার অধরে মোহমুগ্ধ হাসি যা ধরা দিলো নুয়ায়ামের চক্ষু দর্পণে। সে উৎকর্ণ হয়ে আছে কখন আরওয়া কথা বলবে!
দাওয়ার লণ্ঠনে এক ঝাঁক পোকারা ঘুরপাক খাচ্ছে। আঁধার ভেদ করেছে লণ্ঠনের আলো। দাওয়ার সামনের বিস্তীর্ণ ভূমিতে ঠিকরে পড়ছে তা। আরওয়া স্নিগ্ধ স্বরে বলল–
“দেরি হচ্ছে আমাদের মামা।”
আরইয়াজ সম্মতিসূচক মাথা নাড়াল। বলল—
“এগিয়ে যাও তোমরা। ”
নুয়ায়ামের মুগ্ধতা কাটেনি। আরওয়ার বসন্তদূতের মতো সুরেলি কণ্ঠে সে বিবশ হয়ে পড়ল। আরওয়া গলায় ছড়িয়ে থাকা ওড়নাটা মাথায় তুলে নিল। তার অবগুণ্ঠিত মুখখানাতে কী এক জাদুকরী মায়ায় নিচ্ছিদ্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে রইল নুয়ায়াম! আরওয়া দু’কদম সামনে এগিয়ে এলো। নুয়ায়াম চোখের পলক ফেলে। চমকিত নজর তার। নির্মল হাসল আরওয়া। মোহমুগ্ধ কণ্ঠে বলল—
“চলুন।”
আরওয়া হাঁটতে শুরু করে। দাওয়া থেকে সিঁড়ির ধাপ পেরোতেই পেছন ফিরে নুয়ায়ামকে দেখে। নুয়ায়াম পাথর মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। হ্যাজাক বাতির আলো উজ্জ্বল হলো। আরওয়াকে এখন নুয়ায়ামের কাছে অশরীরী মনে হচ্ছে। আরওয়ার পেছনে জমাট অন্ধকারের এক ভ/য়ং/কর জঙ্গল। তার মাঝেই এক উদ্ভাসিত আলোক পিণ্ডের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে সে। নুয়ায়ামের বক্ষস্পন্দন ক্ষণে ক্ষণে তার গতি বাড়াচ্ছে। আরইয়াজ বলে উঠলেন—
“দেরি হচ্ছে নুয়ায়াম। অনেক পথ বাকি।”
নুয়ায়াম অস্পষ্ট আর বিভ্রান্ত গলায় বলল—
“হুম।”
সে ধীরপায়ে এগিয়ে যেতে লাগল। দাওয়ায় দাঁড়িয়ে আছেন আরইয়াজ। সময়ের প্রবাহে তার চোখের দৃশ্যপট থেকে বিলীন হচ্ছে আরওয়া আর নুয়ায়ামের অবয়ব। মুহুর্তেই কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলি পাকিয়ে আরইয়াজ রূপ নিল এক নে/ক/ড়েতে।
,
,
,
পাতার মর্মরধ্বনিতে একটু পরপর কেঁপে উঠে নুয়ায়াম। তার সামনেই বিনা দ্বিধায় হেঁটে যাচ্ছে আরওয়া। ঘন জঙ্গলের মাঝে সংকীর্ণ মৃত্তিকার রাস্তা। একটুখানি জায়গাতে একজন মানুষই এক সময়ে হেঁটে যেতে পারবে। নুয়ায়াম কিছু ঠাওর করতে পারছে না ঠিকমতো। আধো আলো- আঁধারে ওই হ্যাজাক বাতির উজ্জ্বল প্রভাতে সে সম্মোহিতের ন্যায় আরওয়ার পিছু পিছু চলছে।
আকাশের কোনে জেগে উঠেছে বিধু। তার রূপের পসরাতে কোনো কার্পণ্য নেই। সেই রূপ টুকটুক করে ছুঁয়ে যাচ্ছে নুয়ায়ামের অনিয়ন্ত্রিত মস্তিষ্ক। দুইপাশের জঙ্গলের ভেতর থেকে কেমন অদ্ভুত, তীক্ষ্ম, অবোধ্য শব্দরা কিলকিল করছে। নুয়ায়ামের পা স্থির হয়। কারণ সে ঘাড় ঘোরাতেই অন্ধকার জঙ্গলে কিছু একটা জ্বলতে দেখেছে। যেই রাস্তা ধরে তারা হেঁটে চলছে তার দুই পাশে হাত বাড়ালেই লতাপাতার ঝাড়।
নুয়ায়ামের পায়ের গতি থেমে যাওয়াতে আরওয়ার পদযুগল স্থির হয়। সে পেছন ফিরে। অকস্মাৎ তাকে দেখে ভয় পেয়ে যায় নুয়ায়াম। তার চোখ জোড়া প্রশস্ত হয়। আরওয়া ছোট্ট ছোট্ট পায়ে নুয়ায়ামের কাছে এগিয়ে আসে।
গহন অরণ্যের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে দুই মানব-মানবী। এক ছটাক আলো হয়েছে তাদের সঙ্গী। প্রভঞ্জনে মেখে আছে শীতলতা। জঙ্গল থেকে থেমে থেমে গা ছমছমে আওয়াজ আসছে। তারা টুক করে নুয়ায়ামের হৃৎপিণ্ড হলকে দেয়।
আরওয়া তার পাতলা ঠোঁটের ভাঁজ খুলে বলল—
“দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
আরওয়ার দেহের ঘ্রাণে নুয়ায়াম বাক হারিয়ে ফেলল। নীলাভ মনি দুটো ঈষৎ জ্বলে উঠে আরওয়ার। আচানক নুয়ায়ামের শিড়দাঁড়া বেয়ে তুষারশীতল স্রোত নেমে গেল। সে অনুরণিত অধরে বলল—
“ওওওওখানে কিছু ছিল!”
আরওয়া হিম স্বরে বলল—
“আপনি কী ভয় পাচ্ছেন?”
নুয়ায়াম আমতা আমতা করে বলল—
“না মা…নে…।”
সমীরণে আলোড়ন তুলে হেসে উঠে আরওয়া। ভয়াতুর চাহনিতে তাকে দেখে নুয়ায়াম। নীল নয়নার কলহাস্যে যেন আঁধার ফুড়ে যাচ্ছে। নুয়ায়ামের মনে হলো কোনো দৈব শক্তি আরওয়াকে নিয়ন্ত্রন করছে। সে প্রস্ফুটিত চোখে চেয়ে আছে।
আরওয়া শুধাল—
“ভয় পাচ্ছেন?”
নুয়ায়াম থতমত গলায় বলল—
” আপনারা এই জঙ্গলে থাকেন কেন?”
আরওয়া স্নিগ্ধ গলায় বলল—
“কেন? জঙ্গল ভালো নয়?”
“না…মানে…. জঙ্গল তো পশুদের জন্য। আর মানুষ…।”
“আর মানুষ কী?”
আরওয়ার কণ্ঠ কেমন অপার্থিব শোনালো! নুয়ায়ামর ভীতিগ্রস্ত মস্তিষ্কের স্নায়ু ছোটাছুটি শুরু করেছে। বুকের ডিবডিব শব্দ অন্ধকার নিস্তব্ধতাকে জাগিয়ে তুলছে। আরওয়া মোলায়েম হেসে বলল—
“রাজকুমার কী ভয় পাচ্ছেন? এত সুন্দর পরিবেশে কেউ ভয় পায়?”
নুয়ায়াম দৃঢ়চিত্তে ফট করে উত্তর দিলো —
“আমি রাজকুমার নই। এই জঙ্গল…।”
চকিতে ঘাড় বাকিয়ে তাকাল নুয়ায়াম। বাম পাশের জঙ্গলের ঝাড়ে টিমটিম বাতি জ্বলছে। আবছা আলো-আঁধারের এই মোহাচ্ছন্ন পরিবেশ নুয়ায়ামকে অসাড় করে দিচ্ছে ক্রমশ। তার মনুষ্যসত্তা হতপ্রায়। টিমটিমে আলো উজ্জ্বল হচ্ছে। সেই আলো উৎস উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে, এমনটাই মনে হচ্ছে নুয়ায়ামের। আর তা ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
ঘন তমসার সেই আকাশরাণির ঝকঝকে কিরণ আর হ্যাজাক বাতির সীমাবদ্ধ আলোতে নুয়ায়াম স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে একটা প্রজাপতি উড়ে এসে আরওয়া কাঁধে বসেছে। অনুপলের জন্যও নিজের দৃষ্টি ফেরায়নি নুয়ায়াম। সে ভড়কে দু’কদম পিছিয়ে যায়। আরওয়া আলতো করে কাঁধে বসা প্রজাপতিটাকে নিজের আঙুলের ডগায় নিয়ে আসে। প্রজাপতিটা অতি আদরের সাথে আরওয়া হাতের আঙুলের ওপর বসে পাখা দোলাতে থাকে। নুয়ায়াম চমকিত। প্রজাপতির ডানাতে আলো জ্বলছে! রঙ বেরঙের আলো। চট করেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো—-
“এটা কী করে সম্ভব?”
আরওয়া মধুর গলায় বলল—
“কেন সম্ভব নয়?”
নুয়ায়াম প্রশ্নাত্মক চোখে চেয়ে বলল—-
“প্রজাপতির পাখাতে আলো! ইটস নট পসিবল।”
আরওয়া ভুবন ভোলানো হাসে। তার হাসিতে হৃৎকম্পন থমকে যায় নুয়ায়ামের। সে ক্ষীণ শ্বাস নিচ্ছে। আরওয়া গ্রীবাভঙ্গি বদলে তাকাল জঙ্গলের ঝোপঝাড়ে। আলতো হাসল সে। তারপর সোজা হয়ে নুয়ায়ামের দিকে তাকাল। নুয়ায়াম বিভ্রম নিয়ে অনিমেষ চেয়ে আছে। স্থির দৃষ্টি হেতু তার চোখ কচকচ করে উঠে। রং পাল্টাতে শুরু করে চোখের মনি। ধূসর চোখ পীতাভ বর্ণ ধারণ করল। আরওয়া আলগোছে নুয়ায়ামের হাত ধরে। তীব্র এক শিহরণ বয়ে যায় নুয়ায়ামের স্থির কায়াতে। আরওয়া স্নেহার্দ্র গলায় বলল—
“ও আমার বন্ধু। আমাদের প্রতিদিন দেখা হয়, কথাও হয়।
নুয়ায়াম রোবটের মতো বলল—
“মানুষের সাথে পশুর বন্ধুত্ব ! সম্ভব?”
আরওয়া চমৎকার হাসল। ঝনঝন করে কেঁপে উঠল নুয়ায়ামের হৃদপ্রকোষ্ঠ। প্রজাপতিটাকে নুয়ায়ামের হাতের তালুতে রাখল আরওয়া। নুয়ায়াম রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে আছে। আবছা আলোতে প্রজাপতির পাখা দুটো এক দলা আলোর মহাবতার মনে হচ্ছে। আরওয়া একটু দূরে সরে দাঁড়াল। নুয়ায়াম চমকিত চোখে অবলোকন করল তা। আরওয়া হেসে ওঠে। শ্বাসরোধ হয়ে আসে নুয়ায়ামের। তার মস্তিষ্ক কাজ করছে না। আরওয়া হাসি হাসি চোখে তাকিয়ে মুখ দিয়ে হালকা শব্দ করল। নুয়ায়াম চড়ুই পাখির মতো ছটফট করে মাথা নাড়াতে লাগল। দুই পাশের অন্ধকার ঝোপঝাড় থেকে গুচ্ছ গুচ্ছ আলোর দল উড়ে আসতে লাগল। নুয়ায়ামের মনে হলো আকাশ নেমে এসেছে বসুমতির বুকে। আর এই জ্বলন্ত আলোর দল হলো তারকারাজি। পলেই তাদের দুই পাশের জঙ্গলের ঝাড় থেকে শ’খানেক প্রজাপতি উড়ে এসে সম্মোহিতের ন্যায় জড়িয়ে ধরতে লাগল আরওয়ার সমস্ত দেহ। নুয়ায়াম মুখ ফুলিয়ে শ্বাস আটকে দু’কদম পিছিয়ে আসে। ভুরভুর করে সহস্র প্রজাপতি জড়িয়ে নিল আরওয়াকে। তার শুভ্র বসনে আবৃত দেহ প্রজাপতির আলোর মায়ায় লীন হয়ে গেল। নুয়ায়াম উচ্চ আওয়াজে ডেকে উঠে—
“আরওয়া!”
দাঁড়িয়ে যায় আরওয়া। তার অস্থির পা দুটো স্থির হয়। সে পেছন ফিরল। নুয়ায়াম দাঁড়িয়ে আছে। আরওয়া প্রশ্ন ছুড়ল—
“কী হয়েছে?”
সম্বিৎ ফিরে পেল নুয়ায়াম। তার সপ্রতিভ মস্তিষ্ক টের পেল আরওয়া তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে এলোমেলো চাহনিতে চারপাশ দেখতে লাগল। সবকিছু স্বাভাবিক। তাহলে এতক্ষণ যা ঘটল তা কী মিথ্যে না কী মায়া?
আরওয়া নরম পায়ে সামনে এগিয়ে এসে বলল—
“চলুন, আমাদের দেরি হচ্ছে। জঙ্গলের পরিবেশে আপনি অভ্যস্ত নন। ভয় পাবেন না। আমি আছি আপনার সাথে। শুধু দৃষ্টি উন্মুক্ত রেখে দৃঢ় মস্তিষ্কে আমাকে অনুসরণ করুন। চোখ বন্ধ করবেন না। আর অন্য কোথাও মনোনিবেশ করবেন না। পূনরায় মায়ায় পড়তে পারেন। বনোসা আশেপাশেই আছে। নিশ্চয়ই ঘ্রাণ পাচ্ছেন? তাতে একদম মনোযোগ দেবেন না। চলুন।”
নুয়ায়াম কথা বলল না। সে নিজেকে সংযমিত রেখে আরওয়ার কথা অনুসরণ করল। চলতে লাগল তার পিছু পিছু।
চাঁদের পেলব, স্নিগ্ধ, মোহনীয় কিরণে সয়লাম পথ। সেখানেই দাঁড় করানো নুয়ায়ামের গাড়ি। গহন জঙ্গল থেকে খানিকটা দূরে সরে এসেছে আরওয়া আর নুয়ায়াম। এখানে গাছপালা থাকলেও ততটা ঘন নয়। চাঁদের আলোয় নিজের ছায়াকে মৃত্তিকার বুকে দেখার পূর্বেই হ্যাজাক বাতির উজ্জ্বল আলো তা আড়াল করত চাইছে বারংবার। দুইজন থমকে গেল। আরওয়া সরল গলায় বলল—
“ওই যে আপনার গাড়ি। আপনি নিশ্চিন্তে যেতে পারেন।”
“ধন্যবাদ।”
আরওয়া অধর প্রসারিত করল। নুয়ায়াম কিছুক্ষণ ম্লান দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আরওয়ার দিকে। আরওয়া একটু জোরালো গলায় বলল—
“দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আপনার যাওয়ার সময় হয়েছে।”
“জি।”
নুয়ায়াম পা বাড়াল। কিছু একটা হচ্ছে তার অন্তঃকরণে। এলোথেলো ভাবনা, অস্থির চোখের পল্লব, কম্পিত ওষ্ঠাধর। গাড়ির কাছে যেতেই সে আবার তাকাল আরওয়ার দিকে। মুখটা অস্পষ্ট আরওয়ার। শুধু তার দেহাবয়ব স্পষ্টত। তবুও চেয়ে রইল নুয়ায়াম। চকিতে সে অধৈর্য পায়ে ছুটে এলো আরওয়ার কাছে। আরওয়া বিচলিত নয়। অত্যন্ত শান্ত গলায় শুধাল—
“কিছু বলবেন?”
“আমি কী আপনার হাতটা একটু ধরতে পারি?”
আরওয়া চোখে হাসল। তা সম্মতি না কী আপত্তি তা বুঝতে পারল না নুয়ায়াম। সে অপেক্ষা করল। আরওয়া তার হাত বাড়িয়ে দিলো। প্রসন্ন গলায় বলল—
“অবশ্যই।”
ধীরগতিতে আরওয়ার হাতটা ছুঁয়ে দিলো নুয়ায়াম। শুধু ছুঁয়ে নয়। আরওয়ার আঙুলের ডগাগুলো নিজের হাতের মধ্যেই আবদ্ধ করে নিল। কিন্তু চট করেই নুয়ায়ামের অনুভূত হলো তার শরীরে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। তরতর করে তপ্ত হচ্ছে তার দেহ। নুয়ায়াম ঝট করে হাত ছেড়ে দেয় আরওয়ার। দ্রুত ছুটে যায় গাড়ির কাছে। গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে বসে সে। গলায় আটকে গেছে শ্বাস। আরওয়াকে ছুঁতেই তার হাত জ্বলে উঠে, যেন মনে হলো সে কোনো অগ্নিকুণ্ডতে হাত দিয়েছে। নুয়ায়াম তাকাল আরওয়ার দিকে। আরওয়া ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। নুয়ায়াম গাড়ি স্টার্ট করল। বুক কাঁপছে তার।
আঁধার কালো জঙ্গল ভেদ করে হেঁটে আসা কৃষ্ণকায় নে/কড়েটি আরওয়ার পাশে দাঁড়াল। অকস্মাৎ ধোঁয়ার কুন্ডলি পাকিয়ে রূপ নিল মানব অবতারে। আরওয়া ছোট্ট শ্বাস ফেলে হাতে থাকা হ্যাজাক বাতিটি আরইয়াজের হাতে দিলো। মিহি গলায় বলল—
“আমাকে যেতে হবে। নিজের খেয়াল রাখবেন।”
আরইয়াজ খুশির সাথে বললেন—
“অবশ্যই। ”
আরওয়া দ্রুতবেগে সামনে এগিয়ে যেতেই তার মানবদেহ পাখিতে রূপান্তরিত হয়। সে উড়তে থাকে নিজ উদ্দেশ্যে। নুয়ায়ামের গাড়ির ওপরেই হয় তার স্থান।
,
,
,
ছাদের কোণ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে জেহেন। তার অশিথিল, উৎপীড়িত, চিন্তিত দৃষ্টি দিঘীর শান্ত বুকে। চাঁদের আলোতে স্পষ্টত ভেসে থাকা পদ্মের দিকে চেয়ে আছে সে। ছায়াকরীকে আজ সারাদিনও সে দেখতে পায়নি। এতে অবশ্য তার চিত্তের ভাবনাগুলো দৃঢ় হচ্ছে যে, ছায়াকরীই সে যে নুয়ায়ামকে ফিরিয়ে নিতে এসেছে। কিন্তু তাকে কেন বারবার শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করছে? যদি সত্যিই ছায়াকরী তাদের বন্ধু হয় তাহলে কেন তার সামনে ধরা দিচ্ছে না?
“জেহেন, জেহেন!”
তোভিয়ার উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে ধ্যান ছুটে জেহেনের। সে দিঘীর বুক থেকে চোখ সরিয়ে ছাদের দরজার দিকে তাকাল। ব্যস্তপায়ে এগিয়ে আসছে তোভিয়া। চোখে-মুখে আতঙ্ক। বিচলিত গলায় বলল—
“ভাইয়া এখনো ফেরেনি জেহেন। আপনি একটু এগিয়ে গিয়ে দেখে আসুন না, দয়া করে।”
“ও কোথায় আমি তো জানি না।””
“আপনি একটু..।”
কণ্ঠ থেমে যায় তোভিয়ার। চঞ্চল পা জোড়া চালিয়ে ছাদের কিণারের দাঁড়ায়। গাড়ি শব্দ শুনতে পেয়েছে তারা। জেহেন সরস গলায় বলল—
“এসেছে তোমার ভাই। যেতে পারো।”
সেকেন্ড ব্যয় করল না তোভিয়া। তার অধৈর্য পায়ের সাথে যেন বাতাসের বেগ তাল মিলিয়েছে। জেহেন শ্বাস ফেলল। ফ্যাকাশে গলায় বলল—
“তোমার খুব কষ্ট হবে তোভিয়া। যখন জানতে পারবে যাকে তুমি এত বছর নিজের সহোদর বলে জানো, সে আসলে তোমার কেউ নয়, খুব কষ্ট হবে তোমার। কেন এত অবুঝ তুমি পদ্মকুমারী? জানো না এই মহলে কী ঘটছে! জানো না কারা অবস্থান করছে তোমার আশেপাশে! কেন আছেন তারা? কী চায় তারা? উত্তর নেই কোনো।”
চলবে,,,