# ছায়াকরী
# পর্বঃ৩৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
সতেজ, মোলায়েম প্রভাতের এক মোহিত রূপ। বিবস্নানের নরম হলুদাভ কিরণে চিকচিক করছে কচি পাতারা। মৃদু সমীরণে দুলে উঠছে খিলখিলিয়ে। দূরের ওই নীলাভ অম্বরের বুকে অরঞ্জিত জলদ। এক ঝাঁক পাখির উড়ে যাওয়া।
আধশোয়া বসে আছে জেহেন। তার বুকের কাছেই মাথা রাখা তোভিয়ার। সকালের মিহি রোদ ব্যালকনির গ্রিল গলিয়ে টপটপ করে পড়ছে তার মেঝেতে। হাওয়ার তোড় চুক করে ছুঁইছে জানালার গ্রিল। পর্দা উড়তেই তাতে নজর ফেলে জেহেন। তোভিয়া সচল হয়। ঘুমের রেশ ক্রমশ কমছে। কাত হতেই অনুভূত হলো শক্ত কিছু। তোভিয়ার ঘুম কেটে যায়। আঁখিপল্লব উন্মুক্ত করতেই দেখে জেহেন মোহবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখ নামায় তোভিয়া। ধীরগতিতে উঠে বসে। সোজা হয় জেহেন। বলল—
” এখন কেমন লাগছে?”
উত্তর দিলো না তোভিয়া। রাতের সেই ভয়াবহ দৃশ্য চক্ষুদর্পণে ভেসে উঠল। তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নামে সে। জেহেন ত্রস্তে বলে উঠে —
“কোথায় যাচ্ছ?”
তোভিয়া নিরুত্তর। তার অশিথিল পদযুগল থামলো না। দরজার কাছে পৌঁছাতেই তার হাত আঁকড়ে ধরল জেহেন। চোয়াল দৃঢ় করে বলল—
“কোথায় যাচ্ছ?”
তোভিয়া রাগে পুড়ে যাচ্ছে। চোখের পাতা পূর্ণ প্রশস্ত করে বলল—
“হাতটা ছাড়ুন আমার।”
“কোথায় যাচ্ছ তুমি?”
“ভাইয়ার কক্ষে।”
“কেন?”
তোভিয়া শ্লেষমিশ্রিত হাসল। তাচ্ছিল্যের সুরে বলল—
“তা আপনার না জানলেও চলবে।”
“আমার কথা শোনো, তোভিয়া।”
হাত ঝাড়া মেরে সরালো তোভিয়া। দীপ্ত কণ্ঠে বলল—
“কোনো কথা শুনব না আমি আপনার। আর নিতে পারছি না আমি। কোনো দায়িত্ব নেই আপনার?”
“কী বলতে চাইছ তুমি?”
“কিছুই নয়।”
তোভিয়া দরজার নকে হাত দিলে তা জোরপূর্বক সরিয়ে নিল জেহেন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হিসহিসিয়ে বলল—
“কেন করছ এসব তুমি?”
অঙ্গনার দেহের কম্পন, রাগের আস্ফালন চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে জেহেনের। তোভিয়া কঠোর কণ্ঠে বলল—
“কেন বুঝতে পারছেন না? এই মহলে কী হচ্ছে আপনি জানেন? আপনার কেন আমার কথা বিশ্বাস হয় না?”
জেহেন হতাশ শ্বাস ফেলল। স্বাভাবিক গলায় বলল—
“আমি কখন বললাম, যে আমি তোমার কথা বিশ্বাস করিনি?”
“করেননি। করেননি আপনি বিশ্বাস। আপনি আমার কোনো কথাই বিশ্বাস করেন না। কারণ, আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন না। বিশ্বাসের সৃষ্টি কোথা থেকে হয় আপনি জানেন? ভালোবাসা থেকে। কিন্তু আপনি আমাকে ভালোবাসেন না। আপনি আসলে কাউকেই ভালোবাসেন না। শুধু নিজেকে ভালোবাসেন। তাই আজকের পর আমার কোনো সমস্যা আমি আপনাকে বলব না। আমার ওপর ন্যস্ত আপনার সকল কর্তৃত্ব আমি তুলে নিলাম।”
জেহেন চোখ ভার করে তাকিয়ে আছে। তীক্ষ্ণ চাহনি, জোরালো শ্বাস। তোভিয়া ফুঁসতে ফুঁসতে বলল—
“আমি ভাইয়ার কাছে যাচ্ছি। এই মহল স্বাভাবিক নয়। আমার আম্মি আর ভাইয়ার কোনো ক্ষ/তি আমি হতে দেবো না।”
জেহেন বিতৃষ্ণা গলায় বলল—
“কী করবে তুমি, কী করবে? কী করতে পারবে নুয়ায়াম? যে নিজেকে পানি থেকে বাঁচাতে পারে না, সে অন্য কাউকে কী করে বাঁচাবে?”
তোভিয়া রোষের সাথে তাকাল। জেহেন কণ্ঠ শীতল করে বলল—
“আমার কথা শোনো,তোভিয়া। নুয়ায়াম এমনিতেই চিন্তিত। তাই আমি ওকে কিছু জানাতে চাইছি না। আমি বিশ্বাস করি তোমাকে।”
“কী বিশ্বাস করেন আপনি? আপনাকে বলেছি, ওই পদ্মদিঘিতে কেউ আছে। আপনি আমার কথা মেনে নেননি। কাল রাতে আমি যা দেখেছি তা মিথ্যে নয়। ওই বিশাল সাপ এই মহলে কী করে এলো?”
“আমি জানি না।”
“কারণ, আপনি জানতে চান না। আপনি তো ক্ষমতাবান। কেউ আপনার কিছু করতে পারবে না। কিন্তু বাকিরা? তাদের কী হবে? তারা ঝুঁকিতে আছে। আপনার কিছুই করতে হবে না। আমি ভাইয়াকে জানাব, তেহজীবকে জানাব। তেহজীব আপনার চেয়ে উত্তম। অন্তত আমাকে অবিশ্বাস করবে না।”
জেহেন সরোষে তোভিয়ার বাজু চেপে ধরে খরখরে গলায় বলল—
“কোথাও যাবে না তুমি। তেহজীবের কাছে তো একদমই নয়। ভেবো না আমি কিছু আঁচ করতি পারিনি। ”
তোভিয়া দগদগে গলায় বলল—
“কী বলতে চাইছেন আপনি?”
জেহেন বক্র হেসে বলল—
“পদ্মকুমারী, নির্বোধ নয়।”
“আপনি….।”
উষরের বুকে নামলো তুমুল বর্ষা। তৃষ্ণার্ত পথিকের চাতকের তৃষ্ণা মেটাতে এক পশলা বর্ষণ হলো। অভাবিতরূপে গহন আশ্লেষে তোভিয়ার অধরোষ্ঠে নিজের শাষন কায়েম করল জেহেন। ক্রোধে জর্জরিত তোভিয়া ভয়ানক কান্ড করে বসল। তার ধারালো নখ গেঁথে দিলো জেহেনের গ্রীবাদেশে। তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না জেহেন। দীর্ঘ সময় পর তোভিয়ার কাছ থেকে সরে এলো সে। রোষিত যোষিতার রক্তচক্ষু দেখে অধর বিস্তৃত করল জেহেন। আলগোছে নিজের ঘাড়ের রক্ত মুছে নিল আঙুলের ডগা দিয়ে। তা ঠোঁটের ভাঁজে দিয়ে নিশ্চল দৃষ্টিতে তোভিয়াকে দেখল। ঘৃণায় চোখ সরিয়ে নিল তোভিয়া। জেহেন সুডোল গলায় বলল—
“প্রয়োজনে আমাকে আ/ঘা/ত করতেও পদ্মকুমারী দ্বিধাবোধ করবে না।
তুমি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো তো তোভিয়া?”
তোভিয়া ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। জেহেন গম্ভীর শ্বাস ফেলে বলল—
“এখনো সময় আছে, ভেবে নাও। আমি হয়তো পদ্মকুমারীর যোগ্য নই।”
জেহেন ধীরপায়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। সেখানেই ধপাস করে বসে পড়ল তোভিয়া। কী করবে সে?
,
,
,
সিঁড়ি বেয়ে উদাসচিত্তে নামছে জেহেন। নিচে আসতেই চোখে পড়ল অনিতাকে। অনিতাকে অন্যরকম লাগছে। জেহেন ডাকল—
” অনিতা!”
অনিতা মহলের সদর দরজার সামনের দাঁড়িয়ে কী যেন দেখছিল। তার মনোনিবেশ ছিল বাইরের দিকে। জেহেনের কণ্ঠে চমকে পেছন ফিরে বলল—
“জি।”
“কী করছ তুমি?”
“কিছু না।”
“কী দেখছিলে?”
অনিতা চোখ নামিয়ে ইতিউতি করে বলল—
“তেমন কিছু নয়। মহলের বাইরের সিঁড়িতে একটা বিড়ালকে দেখেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে কোথায় যেন চলে গেল।”
“বিড়াল পালন করার শখ জেগেছে?”
জেহেনের মুখ নিঃসৃত বাক্য ব্যঙ্গাত্মক মনে হলো অনিতার কাছে। সে ইতস্তত করে বলল—
“তেমন কিছু নয়।”
“তোমার হাতে কী হয়েছে?”
অনিতার হাতের কনুইয়ের দিকে লম্বা লম্বা দুটো আঁচড়ের দাগ। সে চট করে হাত ঘুরিয়ে বলল—
“ওই….ওই বিড়ালটা আঁচড় কেটেছে। তাই তো ওকে খুঁজছিলাম।”
জেহেন ভালো করেই বুঝতে পেরেছে ওই দাগ বিড়ালের আঁচড়ের নয়। কেউ যেন সেখানকার চামড়া তুলে নিয়েছে! অনিতা দ্রুত পায়ে প্রস্থান করল সেই স্থান। জেহেনের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তুরিতে সপ্রতিভ হলো। পকেটে হাত দিয়ে পালক দুটো বের করে দেখল। তারপর আবার পকেটে গুঁজে রাখল। আপাতত সে নিজেকে ছাড়া কাউকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেবে না। জেহেন দেখতে পেল তেহজীবকে। সে বাইরের দিক থেকে মহলে প্রবেশ করছে। তাকে দেখেও যেন না দেখার গভীর প্রয়াস। নিজের গরজেই প্রশ্ন করল জেহেন—-
“কখন ফিরেছ তুমি?”
থমকে গেল তেহজীব। চোখ তুলে তাকাল। আর তক্ষুণি তেহজীবের রক্তকণিকা টগবগ করে ফুটতে শুরু করল। তার শিরা- উপশিরা ফুলতে শুরু করেছে। নিজের রাগকে দমন করল তেহজীব। কপট হেসে বলল—
“আজ সকালেই ফিরে এসেছি। তুমি কী করে জানলে?”
জেহেন তাড়া দিয়ে বলল—
“বাবা, কী পাঠিয়েছেন?”
তেহজীব অবাক হয়ে চাইল। বিস্ময় নিয়ে বলল—
“কে পাঠিয়েছেন?”
জেহেনে কপাল কুঁচকাল। তার সমান্তরাল ললাটে দীর্ঘ ভাঁজ ফুটে উঠল। সে নম্র স্বরে মেহেকের বলা কথাগুলো বলতেই হো হো করে হেসে উঠল তেহজীব। হাসতে হাসতে বলল—
“আরে না। আমি আমার বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তার বোনের বিবাহ ছিল।”
জেহেন সন্ধানী চোখে তাকিয়ে বলল–
“তাহলে ছোটো বেগম আমাকে মিথ্যে বলেছে?”
“না। আম্মিকে বলা হয়নি। তুমি তো জানো, আম্মি আমাকে যখন তখন যেখানে সেখানে যেতে দেয় না। তার ওপর দীঘাগড় অনেক দূরের পথ। ”
“বাবার সাথে কথা হয়েছে তোমার? কবে ফিরবেন তিনি?”
“জানি না।”
“কেন?”
“তুমি ইচ্ছে করলেই তার সাথে যোগাযোগ করতে পারো। পারো না?”
জেহেন ক্ষোভ নিয়ে বলল—-
“তিনি কী কখনো সেই চেষ্টা করেছেন?”
“তুমিও করোনি। তিনি ফিরবেন। অতি সত্ত্বর ফিরবেন। অপেক্ষা করো।”
তেহজীব পা বাড়াল। জেহেন তার দাদার মতো। কোনো ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস সে ব্যবহার করে না। কিন্তু মনে তার ক্ষোভও। জোহায়ের আমেরিকা যাওয়ার পর থেকে তার সাথে কোনো যোগাযোগ রাখেনি। এমনকি কথাও হয়নি তাদের মধ্যে। শুধু মাঝে মাঝে মেহেক বা তেহজীবের কাছ থেকে বাবা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ বিষয়ে ধারণা পেত সে। তবে জোবায়ের হাসনাত জেহেনকে যা দিয়েছেন তা আর কেউ জানে না। এর বড়ো কারণ, অধিক বুদ্ধিমান ব্যক্তিও সময়ে সবচেয়ে বড়ো নির্বোধ হয়ে যায়। যা ঘটেছে তেহজীবদের ক্ষেত্রে।
চলবে,,,