# ছায়াকরী
# পর্বঃ৩৪
লেখনীতেঃ তাজরিয়ান খান তানভি
প্রায় ঘণ্টা খানেক ধরে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আছে নুয়ায়াম। তার সমস্ত দেহ থেকে তাপ ছড়াচ্ছে। কয়েক গজ দূরের জিনিসও যেন ভস্ম হয়ে যাবে তার দেহ নিঃসৃত উত্তাপে। যেন জ্বলন্ত কুণ্ডলী সে! বায়ু বেগে ছড়ানো দাবাগ্নি!
সবকিছু স্বাভাবিকই ছিল। আচানক দেহের তাপমাত্রা বাড়তেই বিচলিত হয় নুয়ায়াম। তার চোখের রং পালটাতে থাকে। একসময় তা রক্তচক্ষুতে রূপ নেয়। দেহের শিরাগুলো ফুলতে শুরু করে। তার পেটানো শরীর, বাহুর পেশী স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুন ফুলে ওঠে। নুয়ায়াম ধাতস্থ হয়। ধীরে ধীরে শ্বাস ফেলতে থাকে। নিজের আলুথালু চিন্তাধারাকে দমন করে শান্ত হয়। হাতের তালুর দিকে তাকাতেই খেয়াল করে তার রেখাগুলো ক্রমশ পুরু হচ্ছে। নুয়ায়াম দর্পণে চোখ রাখে। নিজেকে কেমন অপরিচিত মনে হচ্ছে তার। সে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বিছানার চাদর স্পর্শ করতেই তাতে আ/গুন ধরে যায়। শিউরে ওঠে সে। তড়িঘড়ি বালিশ নিয়ে সেই জায়গা চাপা দিতেই বালিশের যে অংশে তার হাত লেগে আছে তাতে আ/গুন ধরে যায়। ভড়কে যায় নুয়ায়াম। সজোরে বালিশ ছুড়ে মারে দেয়ালে। নুয়ায়াম লম্বা করে নিঃশ্বাস ফেলছে। নিজেকে অনুভব করার চেষ্টা করছে। সে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে নিজের চারপাশে তাকাচ্ছে। তার মনে হলো তার চারপাশে কোনো অগ্নিবলয় ঘিরে আছে, যার মাঝখানে সে দাঁড়িয়ে আছে। যে কেউ এই বলয়ের সংস্পর্শে এলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে! নুয়ায়ামের মনে হলো সে নিজেই সেই অগ্নিবলয়। ধীরগতিতে ড্রেসিং টেবিলের ওপর হাত রাখতেই তার বর্ণ কালো হতে শুরু করে, যেমনটা জ্বলন্ত কয়লার স্পর্শে শুকনো কাঠের অবস্থা হয়। নুয়ায়াম দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার দেহের উত্তাপ বেড়েই চলছে। কিন্তু তাতে করে তার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। বরঞ্চ মনে হচ্ছে এই তাপ তার আশেপাশের জন্য ক্ষতিকর।
ওয়াশরুম থেকে বের হয় হয় নুয়ায়াম। তার কায়া শান্ত, শীতল। বিক্ষিপ্তচিত্ত সমাহিত। স্বাভাবিক সে। সে এগিয়ে যায় জানালার কাছে। সেখানে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে সুদূর আকাশে।
,
,
,
দীঘির পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে তোভিয়া। টলটলে পানিতে তার মুখচ্ছবি দেখা যাচ্ছে। মিষ্টি বিকেলের দুষ্ট হাসির রোদ। সূর্যের ম্লান মুখটা দেখা যাচ্ছে দীঘির মাঝ বরাবর। মৃদু হাওয়া বইতেই পাড়ের শুকনো পাতা উড়ে এসে পড়ছে দীঘির বুকে। ফুটন্ত পদ্মফুলগুলো চেয়ে আছে। আমগাছটার লম্বা পাতাটা পড়তে গেলে তার দিকে তাকিয়ে থাকে তোভিয়া। মন্থর গতিতে সে নামে দীঘির পানিতে। তোভিয়া আগ্রহ ভরে তা দেখে। পাতাটা ডুবে যায়নি। ভেসে আছে পানিতে। এ পাড়টায় গাছের সারিতে আচ্ছাদিত। তাই তার ছায়া পড়েছে দীঘিতে। উঁচু উঁচু বিস্তৃত শাখাবিশিষ্ট বৃক্ষের নিরন্তর ছায়া পড়াতে দীঘির পানির তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় শীতল। সিঁড়ির দিকটায় ফাঁকা থাকলেও পুরো দীঘি পদ্মফুলে পরিপূর্ণ। গাছের ছায়াতলে থাকা পদ্মফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে তোভিয়া। গাছের পাতারা রাজত্ব করছে সেখানে। চকিতে সে দেখল একটা অদ্ভুত সুন্দর প্রজাপতি উড়ছে লাল রঙা পদ্মফুলটিতে। তোভিয়া আনন্দিত হয়। সে খুব মনোযোগ দিয়ে সেই প্রজাপতিকে দেখে। আরও আশ্চর্য হয় প্রজাপতির পাখা দেখে। এই দিনের রোশনাইতেও তার মনে হচ্ছে আলোকিক দ্যুতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে প্রজাপতির পাখা থেকে। তোভিয়া অবাক বিস্ময়ে অনিমেষ তাকিয়ে থাকে। তার খুশি চোখ দিয়ে উপচে পড়ছে। তোভিয়ার খুশিমাখা মুখশ্রী দেখে প্রসন্ন হয় ছায়াকরী। গাছের ডালে দাঁড়িয়ে সে সবটা দেখছে।
অকস্মাৎ পানিতে বুদবুদ সৃষ্টি হলো। সেই বুদবুদের শব্দ জোরালো হতেই উড়ে যায় প্রজাপতি। তোভিয়ার মন ক্ষুণ্ণ হয়। কিন্তু পরক্ষণেই সেই বুদবুদ ধরা পড়ে তার চোখেও। সে ভীতগ্রস্ত নজরে কিয়ৎপল চেয়ে থেকে উঠে দাঁড়ায়। শাড়িতে পা ঢেকে যায় তোভিয়ার। পানিতে ডোবা সিঁড়ি পিচ্ছিল হয়ে আছে। শ্যাওলা জমে তা সবুজাভ বর্ণ ধারণ করেছে। দৈবাত সেই বুদবুদ তোভিয়ার দিকে ধেয়ে আসতেই সে হন্তিদন্তি করে উলটো হয়েই সিঁড়িতে পা তোলে। ভয়ে, সংকোচে আবিষ্ট তোভিয়ার পা পিচ্ছিল সিঁড়িতে হড়কে যায়। সে উলটো হয়ে হেলে পড়ার পূর্বেই সেখানে উপস্থিত হয় জেহেনের বক্ষস্থল। তোভিয়াকে সামলে নেয়। কিন্তু ভীতসন্ত্রস্ত তোভিয়ার মস্তিষ্ক পলেই সেই আশ্রয়স্থলের নিরাপত্তা বুঝে উঠতে না পারার দরুন সে ভড়কে যায়। বিদ্যুৎ বেগে পেছন ফিরে জেহেনকে দেখে আবার পেছাতে গেলে তার উর্ধকায় হেলে পড়ে শূন্যে। কারণ, ততক্ষণে জেহেন তার কোমড় আবদ্ধ করেছে কঠোর বন্ধনে। তোভিয়া চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। পড়ে যাওয়ার ভয়ে খামচে ধরেছে জেহেনের জামা। ভাঁজ পড়া কপাল, গুঁজ করা ঠোঁট, কুচকে যাওয়া চোখ আর ভীতসন্ত্রস্ত তোভিয়াকে দেখে আলতো হাসল জেহেন। তোভিয়ার মাথা থেকে কোমড় অবধি শূন্যে ঝুলে আছে। তার দীর্ঘ কুন্তলের ডগা ডুবে গেছে দীঘির পানিতে। ভিজে যাওয়া চুলের হেতু ভার অনুভূত হচ্ছে তার। আঁখিপল্লব সাবধানে মেলে ধরল তোভিয়া। চোখের পাল্লা উন্মুক্ত হতেই জেহেনকে দেখে চোয়াল শক্ত করে বলল—
“আপনি… আপনি কেন এখানে এসেছেন? ছাড়ুন আমাকে।”
জেহেন মৃদুহাস্য অধরে বলল–
“কে কাকে ধরে রেখেছে তার একবার চক্ষু মেলিয়া দেখুন পদ্মকুমারী।”
জেহেনের কৌতুকমাখা কথা গায়ে লাগল তোভিয়ার। সে জেহেনের জামা থেকে হাত সরিয়ে নিল। হাত আলগা করতেই আরেকটু হেলে গেল পেছনে। তার চুল আরেকটু ডুবে গেল পানিতে। জেহেন একগাল হেসে বলল—
“ছেড়ে দেবো পদ্মকুমারী? দীঘির জলে একটু রাগ ঝেড়ে আসুন। ছেড়ে দেবো?”
তোবিয়ার বুক ধকধক করছে। তার উর্ধকায় বাতাসে ঝুলে আছে। যদি জেহেন ছেড়ে দেয় তাহলে সে ধপাস করে দীঘির পানিতে পড়ে যাবে। মুখ দিয়ে কথা বের হলো না তোভিয়ার। সম্মুখে থাকা বিপদ থেকে রক্ষা পেতে তাকে চুপ থাকতে হবে। জেহেন বাঁকা হেসে হাতের চাপ শক্ত করে তোভিয়ার পিঠের দিকে ধাক্কা মারতেই, তোভিয়ার সমস্ত দেহ মিশে যায় জেহেনের সাথে। আড়ষ্টতা ঘিরে ধরল তোভিয়াকে। দুই হাত দিয়ে জেহেনের গলা জড়িয়ে ধরে ঘনঘন শ্বাস ফেলতে লাগল। ভেজা চুল তখন গড়াগড়ি খাচ্ছে নিতম্বের নিচের অংশে। শাড়ি ভিজে গেছে তোভিয়ার। বুকের খাঁজ লেপ্টে আছে জেহেনের শক্ত বক্ষের সাথে। ঘোরগ্রস্তের মতো চলে যায় কিছু সময়। তোভিয়ার শ্বাস স্বাভাবিক হতেই সে জেহেনের গলা ছেড়ে দেয়। তার কটিদেশ তখনো জেহেনের বাহু বন্ধনে আবদ্ধ। তোভিয়া আচ্ছনের মতো বলল—
“কেন এসেছেন এখানে?”
জেহেন সরল গলায় বলল—
“দীঘির পাড়ে আসতে নিষেধ করেছি তোমাকে।”
“আমি কেন শুনব আপনার কথা?”
“বাধ্য তুমি।”
“কোনো অধিকার নেই আপনার।”
“তার লিখিত দলিল আছে আমার কাছে।”
“মুক্তি চাইতেন আপনি!”
“এত সহজ নয়।”
“সত্য লুকিয়েছেন আপনি।”
জেহেন গাঢ় হাসল। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল—
“সত্য জানার সময় হয়নি তোমার।”
“মিথ্যের মায়াজালে কেন বন্দি করতে চাইছেন?”
“সত্য আপন আলোয় উদ্ভাসিত।”
“আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন?”
“নিজের চাইতেও বেশি।”
“তাহলে কেন লুকিয়ে রাখছেন নিজেকে?”
“আমি উন্মুক্ত।”
“আমাকে দূরে রাখার কারণ?”
“অতি সন্নিকটে রাখব বলে।”
“আমি সত্য জানতে চাই।”
“তুমি আমাকে ধোঁকা দিতে চেয়েছ।”
তোভিয়া মাথা নত করল। লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে বলল—
“সব জেনেও চুপ করে ছিলেন আপনি।”
“আমার সত্য তুমি। এর চেয়ে বড়ো সত্য নেই।”
তোভিয়া মাথা তুলে তাকাল। জেহেনের সবুজ চোখ দুটোতে ডুবে গেল ক্ষণকালেই। মন্থর সমীরণে তোভিয়ার চোখের ওপর উড়ে আসা কেশ আঙুলের মায়াময় স্পর্শে সরিয়ে দিলো জেহেন। ছায়া ঢাকা দীঘি পাড়ের নিস্তরঙ্গ পরিবেশে ডেকে উঠল পাখি। হাওয়া খেলতে শুরু করল। বইতে লাগল জোরালো গতিতে। পটপট করে ঝরে পড়ল কিছু শুকনো পাতা। হাওয়ার তোড় বাড়তেই তোভিয়ার ঘন পল্লবের চোখ দুটো ক্ষুদ্র হয়ে এলো। এলোমেলো হয়ে উড়তে লাগল তার চুল। শাড়ির আঁচলের আর্দ্রতা কমে আসতেই তা বাতাসের সাথে তাল মেলাতে লাগল। উড়তে লাগল বেনামী স্রোতে। তোভিয়া নিমেষহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জেহেনের দিকে।
নীলাভ আকাশে কালো মেঘের আস্ফালন। জমাট বাঁধতে শুরু করল তা। ধীরে ধীরে আকাশের বুক জুড়ে কৃষ্ণাভ মেঘের রাজত্ব শুরু। দমকা হাওয়ায় শিরশির করে উঠল তোভিয়ার শান্ত দেহ। সে তটস্থ হয়ে চাইতে লাগল এদিকওদিক।
সমীরণে নেমে এলো শীতলতা। আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস! বিধ্বংসী সমীরণে দুলতে লাগল পদ্মফুলেরা। দীঘির পানিতে অশিথিলতা। ছোটো ছোটো তরঙ্গের সৃষ্টি হলো। বাড়তে লাগল ঝড়ের তান্ডব। আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। মুহূর্তেই কিশোরী বিকেল রূপ নিলো গাঢ় তমসায়। জেহেনের ঘোরগ্রস্ত চাহনিতে নজর পড়ে তোভিয়ার। সে আলগোছে বলল—
“জেহেন, ঝড় আসবে।”
জেহেন নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল—
“আসুক। সেই ঝড়ে দূর হয়ে যাক তোমার আমার সব দূরত্ব।”
তোভিয়ার কানে ভেসে আসছে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। উত্তাল ঢেউ তুলেছে শান্ত পদ্মদীঘি। এই আঁধার পরিবেশেও জেহেনের উজ্জ্বল দুই চোখ আবেশিত করে রেখেছে তাকে। তোভিয়া অতি সন্তর্পণে নিজের ডান হাত রাখে জেহেনের হৃৎপিণ্ডের কাছে। বিমুগ্ধচিত্তে আড়ষ্ট নয়নে চেয়ে রইল। আবেগঘন এক ধ্বংসলীলার সাক্ষী যেন দুই মানব-মানবী। একে অন্যের মাঝে বিলীন হয়ে আছে। জেহেন মোলায়েম স্বরে বলল—
“মহলে চলো। আজ বর্ষণ হবে। মেঘের ডাক শুনতে পাচ্ছ?”
ভয়ং/কর বজ্রপাত হলো মুহূর্তেই। আলোর ঝলকানি পড়তেই তোভিয়া গুঁজে গেল জেহেনের বুকে। কাঁপতে শুরু করল সে। জেহেন হেসে ফেলল। বলল—
“ভয় পেয়ো না পদ্মকুমারী। আমি থাকতে কোনো ভয় নেই তোমার।”
তোভিয়া শ্বাস ফেলল। তিমিরের সেই তান্ডবলীলার শব্দে বুক কাঁপছে তোভিয়ার। জেহেন মৃদু স্বরে বলল—
“মহলে চলো, তোভিয়া। বিলম্ব হচ্ছে আমাদের।”
তোভিয়া মাথা ওপর নিচ করল। তোভিয়াকে মহলের সিঁড়িতে পৌঁছে দিলো জেহেন। ভেতরে প্রবেশ করল না। তোভিয়া জিজ্ঞেস করতেই বলল, সে একটু পর ফিরবে। তোভিয়া আর প্রশ্ন করল না। ঝড়ে শুরু হয়ে গেছে। বৃষ্টি নামবে বলে!
বৃষ্টি নামলেই হিমশীতল হয়ে যায় পদ্মমহল। যেন মাঘের শীত নামে! তোভিয়াকে তাই দ্রুত তার শাড়ি পরিবর্তন করতে হবে।
,
,
,
মহলের একপাশে ফুলের বাগান। জেহেন সেই ঝটিকা উপেক্ষা করে সেখানে আসে। খানিক সময় পরপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। জেহেনের সামনে কিছুদূরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। জেহেনের চিনতে ভুল হলো না। সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে সে। আরওয়াকে হতভম্ব করে দিয়ে তূরন্ত বেগে তার হাত ধরে টান দেয়। আরওয়া তার দিকে ফিরতেই জেহেন অন্য হাত দিয়ে আরওয়ার গলা চেপে ধরে। তদ্দণ্ডে জেহেন দেখতে পেল একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলী নেকড়ে রূপ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আরওয়া হঠাৎ হাম/লার তাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে যায়। জেহেন নিজেও বুঝতে পারেনি এমনটা হবে। সেও ঝুঁকে যায় আরওয়ার ওপর। ঠিক তৎক্ষণাৎ সেই নেকড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে জেহেনের পিঠের ওপর। দুই পায়ের ধারালো আ/ঘা/তে জেহেনকে পর্যুদস্ত করে। জেহেনে উলটে গিয়ে সরে যায় আরওয়ার ওপর থেকে। আরওয়া তুরিতে উঠে দাঁড়ায়। বাতাসে তার শুভ্র আলখাল্লা উড়ছে। তার নীল চোখ জ্বলজ্বল করতে লাগল। ক্ষোভে, ক্রোধে ফুঁসে যাচ্ছে আরওয়া। জেহেন ব্যথামিশ্রিত শব্দ করে হেলে দুলে উঠে দাঁড়ায়। সরোষে প্রশ্ন করে—-
“কারা তোমরা? কেন এসেছ এখানে?”
নেকড়েটি পূনরায় ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল জেহেনের ওপর। আরওয়া চিৎকার করে বলে উঠল—-
“না। তাকে আ/ঘা/ত করবেন না। তিনি আমাদের শত্রু নন। জেহেন, আপনি চলে যান এখান থেকে।”
“কে তুমি?”
জেহেন কড়া গলায় বলে উঠল। আরওয়া বাতাসের ছন্দে হেসে বলল—
“আরওয়া। আরওয়া আমার নাম।”
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির পানি পড়তে শুরু করেছে। তাতে ভিজে যাচ্ছে মৃত্তিকার বুক। তাতে অদ্ভুত গন্ধ ছড়িয়েছে। জেহেন লম্বা শ্বাস টেনে নিয়ে তার চিতা রূপে এলো। আরওয়া ক্ষিপ্ত হলো। অধর ছড়িয়ে শ্বাস ফেলল সে। জেহেন তার সামনের বামদিকের পা দিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগল। তার ক্ষোভিত দৃষ্টি, হিংসাত্মক অভিব্যক্তি। ভয়ং/কর ধারালো দন্তপাটি মুক্ত করে এক নিমিষে উড়ে এসে পড়ল নেকড়েটির ওপর। নেকড়েটির গলায় থাবা বসানোর পূর্বেই তাকে পাখার ধাক্কায় ফেলে দেয় আরওয়া। সুযোগ পেয়ে নেকড়েটি দ্রুত সরে যায়। জেহেন পিছুতে পিছুতে পা দিয়ে মাটি আঁকড়ে ধরে দৃঢ় হয়। আরওয়ার পিষ্ঠদেশে দৃশ্যত হয়েছে বৃহদাকার পাখা, যা পূর্বের চেয়ে দ্বিগুন প্রশস্ত। জেহেন কিড়মিড়িয়ে যাচ্ছে। আরওয়া উচ্চ গলায় বলল—
“ভুল করছেন আপনি জেহেন। ফিরে যান। আপনাকে আ/ঘা/ত করতে পারব না আমি। আমি প্রতিক্ষাবদ্ধ। তা নাহলে আমাকে আ/ঘা/ত করার যে দুঃসাহস আপনি দেখিয়েছেন, তার মূল্য দিতে হতো আপনাকে।”
ঝট করেই নিজের মানব অবতারে এলো জেহেন। আরওয়ার পাখা শুধু সাধারণ পালকে আবৃত পাখা নয়। পাখার অগ্রভাগের প্রতিটি পালকের সাথে সুক্ষ্ম, তীক্ষ্ম, সূঁচালো ত্রিভুজাকৃতির দন্ড বিদ্যমান। প্রয়োজনে সে তাই ব্যবহার করে। কিন্তু জেহেনকে আ/ঘাত করার কোনো অভিপ্রায় তার ছিল না। অসাবধানতাবশত সেই দন্ড ঢুকে যায় জেহেনের বাজুতে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। ভিজে ওঠে জেহেনের সাদা শার্ট।
আরওয়ার পাখা এখন শান্ত। টুপ করে তা তার পিঠের মধ্যে লীন হয়ে যায়। আরওয়া তার ইচ্ছে মতো পাখার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। জেহেন ফুঁসলে উঠে বলল—
“বন্ধু নও তোমরা আমার।”
“আমরা আপনার শত্রুও নই।”
“তাহলে এ লুকোচুরি কেন?”
আরওয়া নেকড়েটির দিকে তাকাতেই সেটিও মানব রূপ ধারণ করল। আরইয়াজ ক্ষীণ আওয়াজে বলল—
“ফিরে যাও জেহেন। নিজের বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ ঘটাও। আরওয়া তোমাকে রক্ষা করেছে বারংবার। তুমি অকৃতজ্ঞের মতো আচরণ করেছ। তবুও আমরা তোমাকে ক্ষমা করলাম। জেনে রাখো, তোমার সত্তার চেয়ে আমাদের সত্তা অধিক শক্তিশালী। তোমাকে রূপান্তর করা হয়েছে, কিন্তু আমরা মায়াপুরীর অধিবাসি। ফিরে যাও তুমি।”
ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো। জেহেন কিছু ঠাওর করার পূর্বেই আরইয়াজ আর আরওয়া অদৃশ্য হয়ে গেল সেখান থেকে। জেহেন স্তম্ভিত। বৃষ্টির পানি তার ক্ষ/ত স্পর্শ করতেই জ্বালা করছে তা। তোভিয়ার দেওয়া নখের আঁচড়, আরইয়াজের পায়ের থাবা আর আরওয়ার পাখার আ/ঘা/ত; বৃষ্টির পানি ধুইয়ে নিচ্ছে জেহেনের তাজা রক্ত। গড়িয়ে পড়ছে শীতল পানির সাথে। জেহেন মাথা নত করে তার পায়ের দিকে তাকাল। রক্তমিশ্রিত বৃষ্টির পানিতে নরম কাঁদায় তার পা ডেবে গেছে।
ছাদের কোণায় দাঁড়িয়ে আছে তেহজীব। বাঁকা হাসল সে। জেহেন চট করে তাকাতেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল তেহজীব।
চলবে,,,