# ছায়াকরী
# পর্বঃ৪১
লেখনীতেঃ তাজরিয়ান খান তানভি
তোভিয়া মোহগ্রস্ত। তার দেহের তাপ এখন বদ্ধ কক্ষের তাপমাত্রার সাথে মিশে গেছে। জেহেনের ছোড়া কথায় সে উৎকণ্ঠিত। ছোটো ছোটো পায়ে এগিয়ে গেল সে কাপড়ে ঢাকা বস্তটির কাছে। প্রতিটি পদক্ষেপ যেন বরফের গর্তে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। কিন্তু এই শীতল পরিবেশ তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন আনলো না। সে অনুদ্বেগ, নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে। বস্তুটির কাছে এসে দাঁড়াতেই পদযুগল থমকে দিলো তোভিয়া। তার পাশেই আনুগত্য ভৃত্যের মতো তাকে অনুসরণ করছে জেহেন। তোভিয়া ক্ষীণ স্বরে প্রশ্ন করল—
“এটা কী জেহেন?”
জেহেন নরম হাসল। তোভিয়ার অতি সন্নিকটি এসে বলল—
“রাণী! এই বরফ রাজ্যের রাণী।”
তোভিয়া চমকে তাকাল জেহেনের দিকে। ভয় জড়ানো কণ্ঠে বলল—
“ভয় দেখাচ্ছেন আমাকে?”
জেহেন মিষ্টি হেসে বলল—
“উহু, পদ্মকুমারীকে ভয় দেখানোর দুঃসাহস এই অধমের নেই।”
তোভিয়া মুখ বাঁকাল। চটপটে গলায় বলল—
“এখানে কেন নিয়ে এসেছেন আমাকে? এসব কে করেছে? আপনি?”
জেহেন সরল গলায় বলল—
“না।”
“তাহলে?”
“বাবা করেছেন। এসব বাবার সৃষ্ট।”
তোভিয়া আকাশ ছোঁয়া বিস্ময় নিয়ে বলল—
“কাকারাজ করেছেন?”
জেহেন চোখের পলক ফেলে নীরব সম্মতি দিলো। তোভিয়া ঝট করে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল—
“আপনি কী করে এসব জেনেছেন? আর একজন মানুষের পক্ষে এসব তৈরি করা কী করে সম্ভব! এই গুপ্তকক্ষ সম্পর্কে আর কে জানে?”
জেহেন মিহি হাসল। আলগোছে তোভিয়ার কাছ থেকে সরে এসে সেই শুভ্র কাপড়ে আচ্ছাদিত অবয়বটির সামনে এসে দাঁড়াল। অবয়বটির পাশেই একটা টেবিল রাখা। তার ওপরে একপাশে কিছু বই, আরেক পাশে কিছু কাচের পাত্র, টিউব রাখা। টেবিলের সাথেই একটি চেয়ার পাতা। জেহেন হালকা ঝুঁকে যায়। চেয়ারের পাশ কাটিয়ে টেবিলের তলা হাতড়ে সেখানে কিছুতে চাপ দিতেই ঝড়ের বেগে সেই কাপড় ওপরে উঠে গেল। ভড়কে গিয়ে পিছিয়ে যায় তোভিয়া। একটি নারীমূর্তি ! তোভিয়া রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে আছে।
মূর্তিটির মাথার প্রায় একহাত ওপরে একটা গোলাকার চাকতি তৈরি করা। চাকতিটি কক্ষের ছাদ থেকে একটা লম্বা দণ্ডের সাথে লাগানো, যা তাকে ওই অবস্থায় থাকতে সাহায্য করে। চাকতিটি থেকে মূর্তির চারপাশে বক্রাকৃতির চারটি লোহার দণ্ড। এর ওপরে কাপড়ের আচ্ছাদন থাকে, যাতে করে কাপড় কোনোভাবেই মূর্তিটির দেহ স্পর্শ করতে না পারে।
নারীমূর্তিটি অদ্ভুত সুন্দর! তার মুখাবয়বে আছে অত্যাশ্চর্য দুটো চোখ, যা মনে হচ্ছে জীবন্ত! পদ্মলোচনে কী অমোঘ টান! স্থির পল্লবে গূঢ় কম্পন, যা বিভ্রমকে সত্যে পরিণত করছে। তীক্ষ্ম নাসিকা, যেন পাখির শাণিত ঠোঁট! বুকে বিঁধে গিয়ে শ্বাস রোধ করে দেবে! ক্ষুদ্রাকার, পাতলা, হৃদয়াকৃতির ওষ্ঠাধর। যেন প্রথম দর্শনেই মনে হবে, ওই ওষ্ঠাধরের আলতো ছোঁয়া পেয়েই জীবন সার্থক! গোলাকার মুখচ্ছবির চিবুকের দিক কিঞ্চিৎ লম্বাটে। চিবুকের মাঝ বরাবর সুক্ষ্ম গর্ত। দুই ভ্রূয়ের পাশে তারকা আঁকা। কণ্ঠদেশ দীর্ঘকায়। তাতে যেন দাম্ভিকতার জৌলুস ! শাড়ি পরিহিত সেই মূর্তিটির দেহের কোণায় কোণায় যৌবনের উচ্ছ্বাস। নিটোল বক্ষযুগলের উর্ধ্বাংশ অনাবৃত। স্ফীত, নয়নাভিরাম বুকের ভাঁজ যেকোনো মানবের চিত্তবিভ্রম ঘটাবে। আঁচলকে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় তার দেহে স্থাপন করা হয়েছে। সুগঠিত কটিদেশ সংলগ্ন অসংবৃত উদরের মধ্যখানে সুডোল নাভীকমলের গভীরতা যেকোনো পুরুষ হৃদয়ে খঞ্জরের আ/ঘা/ত হানতে বাধ্য! কিশোরী নারী অবয়বটি কোনো প্রাপ্তবয়স্ক জীবন্ত নারীকে এক চুটকিতে পরাজিত করবে।
তোভিয়ার হাত-পা ঝিমঝিম করছে। বুকের শ্বাস দীর্ঘ হচ্ছে। অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে তার চোখের পাল্লা। চোখের কোটরে স্থির চাহনি হেতু জল জমেছে । জেহেন দুই হাত পেছনে দিয়ে বুকের পাটা উন্নত করে দাঁড়িয়ে আছে। আলতো গলায় রহস্য করে বলল—
” জাগতিক মায়া, যার পদতলের ছায়া,
হারিণী রূপ, এক নিমেষে নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ
চারু সে, অবিনাশী সে, দেহ যার কামাগ্নি
কালঘুম যার হৃদক্রিয়া, কুহকী ভামিনী।”
তোভিয়ার বুক সমানতালে উঁচুনিচু হচ্ছে। সে ব্যগ্র কণ্ঠে বলল—
“আমি যাব, আমি থাকব না এখানে। নিয়ে চলুন আমাকে।”
তোভিয়া তুরিতে পেছন ফিরতেই তার পথ আগলে দাঁড়ায় জেহেন। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল—
“এত ভয় কেন পদ্মকুমারীর? ভয় পাবেন না পদ্মকুমারী, আপনার ছায়াকর, আপনার সাথেই আছে।”
জেহেন মাথাটা একটু নিচু করে। তোভিয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বলল—
“এসব কী বলছেন আপনি? ”
তোভিয়াকে জড়িয়ে ধরল জেহেন। ফিসফিসিয়ে বলল—
“আমি আছি তো তোভিয়া। আমার সত্য, তোমার প্রশ্নের উত্তর। এসো আমার সাথে।”
তোভিয়ার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে মূর্তিটির নিকটে নিয়ে দাঁড় করায় জেহেন। বলল—-
“এই মূর্তি বাবা তৈরি করেছেন। জানি না কত বছর আগে! কিন্তু দেখো, মনে হচ্ছে জীবন্ত!”
তোভিয়া জড়বস্তর মতো চেয়ে রইল। একে মূর্তি বললে ভুল হবে। গায়ের চামড়া অবধি মানুষের মতো! মূর্তিটির দাঁড়ানো ভঙ্গিতেও মানবচক্ষু ভুল করে ফেলবে তাকে মানুষ ভেবে। তোভিয়া বিস্ময় নিয়ে মূর্তিটিকে ছুঁতে গেলে গলা বাড়িয়ে বলে উঠে জেহেন—
“হাত দিয়ো না। ঝলসে যাবে হাত।”
তোভিয়া ঝট করে হাত সরিয়ে নেয়। বিভ্রম নিয়ে তাকাল জেহেনের দিকে। তোভিয়ার চোখের প্রশ্নের বিপরীতে বলল সে—
“দেখতে মানুষের মতো হলেও বিষাক্ত সে। হাত লাগাতেই বিগলিত হতে থাকবে, সাথে ঝলসে যাবে তোমার হাত। বাবা বোধহয়, এই বরফশীতল কক্ষের উপযোগী করে তৈরি করেছেন এই মূর্তি। মানুষের স্পর্শের কিঞ্চিৎ উষ্ণতায় তা বিগলে যায়। তবে আশ্চর্যের বিষয়, হাত সরাতেই তা পূর্বের আকার ধারণ করবে!
তোভিয়া ঘোরগ্রস্তের ন্যায় তাকিয়ে আছে। ছোট্ট করে প্রশ্ন করল—
“কাকারাজ কেন মূর্তি তৈরি করেছেন? আর আপনি কী করে জানলেন এসব? আপনি তো সব ভুলে গিয়েছিলেন!”
জেহেন ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। গরগর করে বলল—
“হ্যাঁ। মহলে ফিরে আসার পূর্বের কিছুই আমার মনে নেই। তবে এই কক্ষের খোঁজ আমি কিছুদিন পূর্বেই পেয়েছি।”
জেহেন তোভিয়ার গলা থেকে সেই লকেট খুলে নিল। পকেট থেকে চাবি বের করে তার সরু অংশ ঢুকিয়ে দিলো লকেটের ভেতরে। চারকোণা আকৃতির লকেটটি ভেতরে ফাঁপা। সেটির ওপরে একটা ডিজাইন খচিত। যার মধ্যভাগ উঁচু। তাতে আঙুল দিয়ে চাপ দিলে ফাঁপা অংশে খুবই সুক্ষ্মভাবে থাকা কপাট খুলে যায়। যাতে আস্ত চাবিটি লুকিয়ে রাখা যাবে। রাদিয়াত থেকে লকেট পাওয়ার পর জেহেন বারংবার এর তাৎপর্য নিয়ে ভেবেছে। হঠাৎ একদিন হাতের মুষ্টিতে রেখে চাপ দিতেই চট করে খুলে যায় সেই কপাট। সেখান থেকে টুপ করে বেরিয়ে আসে এই চাবি। চাবির গায়েও নকশা আঁকা। এই নকশাও উন্মাদের মতো খুঁজে বের করেছে জেহেন। পেয়েছে তার আলমিরার মধ্যে। জেহেনের শয়নকক্ষ পূর্বে তার বাবা-মা ব্যবহার করত। কিন্তু সে ফিরে আসার কিছুদিন পর জোহায়ের পূনরায় বিবাহ করেন। যার দরুন এই কক্ষের অধিকার পায় জেহেন। তার প্রখর স্মৃতিশক্তি বেশি সময় নেয়নি এই লকেটের রহস্য উদঘাটন করতে। জেহেন চাবিটি পূনরায় তার পকেটে নিয়ে নেয়। লকেটটির চেইন তার হাত থেকে ঝুলে আছে। লকেটটির উঁচু অংশটি আঙুলের সাহায্যে সাবধানে ঘুরাতেই তা থেকে রঙ বেরঙের দ্যুতি বিচ্ছুরিত হলো। যেটুকু অংশে দ্যুতি পড়ছে সেখানে ছোটো ছোটো প্রজাপতি দেখা যাচ্ছে। তারা মন খুলে উড়ছে। জেহেন দ্যুতির উৎস বন্ধ করে দিলো। গায়েব হয়ে গেল প্রজাপতিরা। লকেটটি তোভিয়ার গলায় পরিয়ে দিয়ে মৃদু হাসল জেহেন।
তোভিয়া সংকীর্ণ গলায় বলল—
” এই লকেট সাধারণ নয়। দাদাজান তাই আপনাকে দিয়েছেন। তাহল আমাকে কেন পরিয়ে দিচ্ছেন?”
“কারণ, আমি যতটা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ তারচেয়ে বেশি অমূল্য তুমি আমার কাছে।”
তোভিয়া মায়াময় চোখে চেয়ে বলল–
“কে এই নারী? কাকারাজ কেন তার মূর্তি গড়েছেন? কাকিআম্মিকে তিনি ভালোবাসেন না?”
জেহেন পেলব গলায় বলল—
“জানা নেই। এসো, দেখাচ্ছি তোমাকে।”
মূর্তিটির ঠিক পেছনে কক্ষের দেয়ালের সাথে সংযুক্ত করে দেওয়া একটি বইয়ের তাক। সেখানে শ’খানেক বইয়ের সমাবেশ। জেহেন হড়বড় করে কয়েকটা বই তুলে নিল। সেগুলো টেবিলের ওপর রেখে খুলল। তোভিয়া আশ্চর্য চোখে চেয়ে আছে। তার কাছে সব যেন ভ্রম মনে হচ্ছে। জেহেন ফটফট করে একের পর পাতা উলটালো। সেখানো অস্পষ্ট অক্ষরে কিছু লেখা। সেই অক্ষর বা শব্দ কোনোটার সাথেই তারা পরিচিত
নয়। জেহেন ব্যস্ত গলায় বলল—
“সম্ভবত এগুলো বাবা স্বয়ং লিখেছেন। এই যে দেখো, এখানে, এই মূর্তি সম্পর্কে লেখা আছে। কিন্তু….।”
“কিন্তু কী? পড়ে দেখুন কী লিখেছেন কাকারাজ। কে এই নারী?”
জেহেন আশাহত গলায় ক্ষুণ্ণ মনে বলল—
“সম্ভব নয়। এ ভাষা আমার জানা নেই। বাবা তার সব সৃষ্টির বিষয়ে লিখে রেখেছেন। কিন্তু তার কিছুই আমার বোধগম্য নয়। এ ভাষা তিনি কোথায় শিখেছেন, ধারণা করতে পারছি না আমি।”
তোভিয়া ছটফটে গলায় বলল—
“তাহলে?”
“বাবা ফিরে আসা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।”
তোভিয়ার কৌতূহল মনে চাপা পড়ল। কিন্তু তা ছাই চাপা আ/গুনের মতো সয়ে সয়ে জ্বলতে লাগল। সে সহজ ভঙ্গিতে একটা বই তুলে নিয়ে তা দেখতে লাগল। সেই মূর্তি, কী নিঁখুতভাবে আঁকা! তার পাশে অজ্ঞাত অক্ষরে অনেক কিছু লেখা। তোভিয়া বইয়ের পৃষ্ঠা উলটাতে লাগল। কিছু পৃষ্ঠা উল্টাতেই একটা পাতায় তার চোখ আটকে গেল। সেখানে একটা চিত্র আঁকা।
গোলাকার এক বলয়। তার মাঝে একটা প্রস্ফুটিত পদ্মফুল। ছড়িয়ে আছে সগর্বে । ফুলটি থেকে বিভাসিত ময়ূখ বিচ্ছুরিত হচ্ছে। তা ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে উর্ধ্বাকাশে। পদ্মফুলটির প্রতিটি পাঁপড়িতে লেগে আছে প্রজাপতি।
অভূতপূর্ব চিত্র দেখে গলা শুকিয়ে এলো তোভিয়ার। সে মিইয়ে চোখে চাইল জেহেনের দিকে। জেহেন ভ্রূ কুঞ্চি করে বলল—
“কী হয়েছে?”
তোভিয়া চোখ লুকাল। যেন চুরি করে ধরা খেয়েছে সে। জেহেন প্রানোচ্ছল গলায় বলল—
“এই চিত্র মূর্তিটির পিঠের ওপরও আছে। দেখো।”
তোভিয়া মূর্তিটির দিকে তাকাল। তার পিষ্ঠদেশ উন্মুক্ত। বামপাশে কাঁধের কাছে সেই চিত্র অঙ্কিত। তোভিয়ার বুক ভার হলো। ঝিমুনি দিয়ে উঠল মস্তিষ্ক। টালমাটাল হতেই তাকে আঁকড়ে ধরল জেহেন।
“তুমি ঠিক আছ তো?”
তোভিয়া নিস্তরঙ্গ গলায় বলল—
“কাকারাজ কেন করলেন এসব? এই নারীমূর্তি, এই বরফশীতল কক্ষ, ওই প্রাণীগুলো… এসব কেন করলেন?”
“জানা নেই আমার।”
” কাকারাজ তাহলে অনেক বুদ্ধিমান ছিলেন। তিনি কতকিছু জানতেন। এমনকি অন্য ভাষাও। এই লকেট তো দাদাজান আম্মিকে দিয়েছেন। তার মানে দাদাজানও এই কক্ষ সম্পর্কে অবগত।”
“হয়তো।”
” আমার ভালো লাগছে না জেহেন। দয়া করে চলুন এখান থেকে।”
জেহেনের হাত সরিয়ে পা বাড়াল তোভিয়া। কয়েক কদম যেতেই তাকে আটকানোর জন্য তার হাত টেনে ধরে জেহেন। হেচকা টানে ফিরতেই তোভিয়ার কাঁধের ধাক্কায় কাঠের তাক হতে একটা পাত্র নিচে পড়ে যায়। তাতে ছিল ছোট্ট একটা সাপের মৃতদেহ। কাচের পাত্রটি মেঝেতে পড়তেই বিক্ষিপ্ত হলো। দ্রবণ ছড়িয়ে পড়ল। ভেতরে থাকা সাপের দেহটি দেখেই আঁতকে ওঠে তোভিয়া। চিৎকার করতে গেলে তার মুখ চেপে ধরে জেহেন। তোভিয়া বুক কাঁপিয়ে শ্বাস ফেলছে। তাকে একরকম বক্ষের সাথে পিষে ধরল জেহেন। তোভিয়ার চোখে জল ছেপে আসে। নিস্তব্ধ, নিরাক পরিবেশের শীতলতার মাঝে এক ছটাক উষ্ণতায় মন কেমন করে উঠল তোভিয়ার। সে অনুনয় করে বলল—
“এখান থেকে চলুন জেহেন। আমার ভালো লাগছে না।”
বিশাল কক্ষটির একপাশে আরও একটা দরজা আছে। হতপ্রায় তোভিয়াকে নিয়ে সেই দরজা ঠেলে কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে জেহেন। তোভিয়া চমকে ওঠে। অনুপলেই চকচক করে ওঠে তার চোখ। কক্ষটির ভেতরে সুগন্ধের ছড়াছড়ি। আলোয় ঝলমল করছে।নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশ! একটা ছোট্ট বিছানা পাতা। জেহেন তোভিয়াকে সেখানে বসাল। নিজেও হাঁটু মুড়ে তোভিয়ার সামনে বসে বলল—
” এখানে বসো, আমি আসছি।”
টিমটিম শ্বাস নিয়ে বলল তোভিয়া—-
“কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”
“কোথাও না। তোমার জন্য একটা জিনিস আনব। অপেক্ষা করো আমার জন্য।”
তোভিয়ার কপালে গাঢ় চুম্বন করল জেহেন। সাহস দিয়ে বলল—
“ভয় পেয়ো না। এখানেই আমি।”
তোভিয়া নিষ্প্রভ, পাংশুবর্ণ মুখটা তুলে জেহেনকে দেখল। জেহেন উঠে গিয়ে কক্ষের বাইরে এলো। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে কাঠের তাকে কাছে গিয়ে দাঁড়াল। একদম নিচের সারিতে ছোটো ছোটো পাত্র আছে। একটু আগে পড়ে যাওয়া কাচের পাত্রটি গায়েব। তাতে একটুও বিচলিত হলো না জেহেন। মেঝে শুঁষে নিয়েছে তা। এই সম্পর্কে অবগত সে। তার বাবার তৈরি এই গুপ্তকক্ষ কোনো মায়াজগত থেকে কম নয়। জেহেন নিচু হতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে অমসৃণ নারী কণ্ঠে ডেকে উঠল কেউ।
“জেহেন!”
জেহেন ঝুঁকল না। হেঁটে গিয়ে কক্ষের ওপাশে থাকা পর্দার ঠিক মাঝ বরাবর দাঁড়াল। দুই পাশে পর্দা সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল সে। জেহেন মুচকি হাসল।
পর্দার ভেতরে আরেকটি কক্ষ। যা বরফে আচ্ছাদিত। তিনধারে বরফের দেয়াল। মেঝেও বরফের। তা স্থির। বিগলিত হচ্ছে না। শুভ্র, শীতল ধোঁয়ার ভেতর থেকে প্রকট হলো এক নারী। সম্মুখ ভাগে লম্বা করে পুরু কাচের দেয়াল। তার সাথেই লোহার তৈরি দরজা। যা অনেকটা কারাগারের মতো। সারি সারি লোহার তৈরি খুটি। ভেতরের নারীকে বাইরে বেরিয়ে আসতে হলে প্রথমে ওই দুর্ভেদ্য কাচ তারপর এই লোহার কারাগার ভাঙতে হবে। জেহেন দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। মিষ্টি হেসে বলল—
“কেমন আছেন?”
নারীটির সম্পূর্ণ দেহ ধবধবে সাদা। তাকে দেখলে মনে হবে রক্তশূন্য কোনো মানবী। শুভ্র বরফের সংসর্গ তাকে আরও বেশি শুভ্র করে তুলেছে। তিনি জোর গলায় বললেন—-
“আমার জোহায়েরকে চাই। কোথায় সে? তোমাদের কাউকে ছাড়ব না আমি।”
জেহেন প্রগলভা হেসে বলল—
“ধী….রে। তোভিয়া শুনতে পাবে। আপনাকে দেখলে ও ভয় পেয়ে যাবে। তাই গলার স্বর নামিয়ে কথা বলুন।
চলবে,,,