# ছায়াকরী
# পর্বঃ৭
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
জ্বালেপোড়া শুরু হয়েছে অনিতার ইনসানি দেহে। তার রক্তে জবজবে গলদেশ, হাতের ক্ষতরা এখন শুষ্ক। জমাট রক্ত আর ছোপ ছোপ দাগ তুলোর সাহায্যে মুছে দিচ্ছে তেহজীব। অনিতা রুষ্ট, দাম্ভিক, তপ্ত চোখে স্থির চাহনিতে চেয়ে আছে। তেহজীব গলার স্বর নরম করে বলল—
“নিজের খেয়াল রাখতে শেখোনি এখনো!”
অনিতা কথা বলল না। রাগে, ক্ষোভে তার মাথার রগ ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম। সে দাবানল জ্বলা বিক্ষুব্ধ চিত্তে বসে রইল। তেহজীব হাতের কাজ শেষ করল। অনিতার ক্ষত জায়গাতে বনজ ঔষধের প্রলেপ লাগিয়ে দিলো। দ্রুত সেরে উঠবে সে। তেহজীব উঠে দাড়ায়। অনিতা বসা থেকে শির উঁচু করে টলমলে চোখে তাকাতেই কটাক্ষ করে বলে উঠে তেহজীব—
“একটা বিড়ালের সাথে লড়ার ক্ষমতা নেই তোমার! বেগমরাণি জানতে পারলে কী হবে, জানো? নিজেকে আরও কঠোর করতে হবে তোমার। এসব ছোটোখাটো প্রাণি তোমাকে আঘাত করার ক্ষমতা রাখে না। ”
তেহজীব নীরব শব্দে প্রস্থান করল। অনিতার চোখ জ্বলে উঠে। বিক্ষিপ্ত চিত্তের মতো সবকিছু দলিয়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে তার!
,
,
,
দরজার পাটাতনে ঠকঠক আওয়াজ হলো। সচেতন হলো নুয়ায়াম। চটজলদি শার্ট গলিয়ে নিল গায়ে। ছায়াকরী বিছানার ওপর এলোথেলো পায়ে হাঁটছে। এই অলোকসুন্দর পুরুষটির নিরাবরন দেহ ছায়াকরীর ব্রীড়িত হওয়ার একমাত্র কারণ। নুয়ায়াম কক্ষে বেশিরভাগ সময় অসংবৃত বক্ষে থাকে। কারণে -অকারণে ছুঁয়ে দেয় ছায়াকরীর উষ্ণ, তপ্ত, পালক আবৃত নরম, তুলতুলে, পেলব দেহ। মাঝে মাঝে আঙুলের ডগার আদর মেখে দেয় ছায়াকরীর রক্তিম ঠোঁটে। নুয়ায়াম অহোরাত্রি তার পীতাভ তারকা বিশিষ্ট নেত্রযুগলের নিচ্ছিদ্র ছায়াতলে রাখে ছায়াকরীকে। ছায়াকরীর মনে হয় তার সর্বাঙ্গ নুয়ায়ামের ওই বিধ্বংসী চাহনিতে নিঃশেষ হয়ে যাবে!
দরজা খুলল নুয়ায়াম। তার চোখ হেসে উঠে। তোভিয়ার উদাস চাহনি ঈক্ষিত হতেই নিষ্প্রভ হয় তার চাহনি। কুঞ্চিত কপাল, প্রশ্নাত্মক চাহনিতে বোনকে ভেতরে আসতে বলল নুয়ায়াম। তোভিয়া নিস্পৃহ, নিবাত। তাকে বিছানার ওপর বসাল নুয়ায়াম। নিজে দুই হাঁটু মেঝেতে ঠেসে বোনের সামনে বসল। বিধুবদনে অমানিশা! শঙ্কিত, ভীতগ্রস্ত নুয়ায়াম। সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলল—
“কী হয়েছে তোমার?”
তোভিয়ার ফ্যাকাশে চোখের চাহনিতে বড়ই পীড়িত হলো নুয়ায়াম। অনুগত সহযোগীর মতো তাকাল সে। তোভিয়ার দুই হাত নিজের দুই হাতে তুলে নিলো। একই সময়ে দুই চোখে ছুঁইয়ে ধরে। আলতো চুমু খায় হাতের তালুতে। আদুরে ভাবাবেশ নিয়ে প্রশ্ন করে—
“জানতে পারি, পদ্মকুমারীর বিষণ্ণতার কারণ? আমি কী তার বিষণ্ণতার আঁধার কাটানো চিলতে রোদ হতে পারি?”
তোভিয়া আনম্র দৃষ্টি তুলে ধরে সংকুচিত স্বরে বলল—
“তুমি বেগমরাণির সাথে কথা বলবে না?”
নুয়ায়াম অকপট হেসে বলল—
“জেহেন?”
“হুম।”
“বলেছি।”
এক আকাশ খুশির অরঞ্জিত মেঘ টুপ করে ছুঁয়ে গেল তোভিয়ার অন্তঃকরণ। সে উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলল—
“সত্যি! কী বলেছেন তিনি?”
“সম্মতি দিয়েছেন।”
তোভিয়ার মনের গহীন থেকে হুরহুর করে বেরিয়ে যেতে লাগল স্তুপ করা মন খারাপের হাওয়া, বিলীন হতে লাগল জেহেনকে না পাওয়ার শঙ্কা। সেই শূন্য স্থান পূর্ণ হতে লাগল চাঁদ নিশার অকৃত্তিম চাঁদ জোছনায়, স্নিগ্ধ, মন কেমন করা মিষ্টি সমীরণে। খুশিতে ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরল তোভিয়া। আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বলল—
“আমি প্রসন্ন!”
নুয়ায়াম নরম হেসে বলল—
“তোমার প্রসন্নতায় আমি তৃপ্ত।”
তোভিয়া সোজা হয়ে বসে। তার চোখের তারায় ঝিলমিল করছে খুশির মাতাল হাওয়া। ছায়াকরী আলতো স্বরে ডেকে উঠল। চকিতে দুই জোড়া চোখ তাকাল তার দিকে। ছায়াকরীকে হাতের তালুতে উঠিয়ে নিল তোভিয়া। মিষ্টি করে হেসে বলল—
“ছায়াকরী আসতেই সব ভালো ভালো হচ্ছে। তাই না ভাইয়া?”
তোভিয়ার কাছ থেকে নিয়ে নিজের করতল বন্দি করল ছায়াকরীকে নুয়ায়াম। নাকের ডগা ছায়াকরীর গলার কাছটায় স্পর্শ করিয়ে চাপা স্বরে বলল—
“ছায়াকরী, শুনতে পাচ্ছ? তোমার নাম তার মান রেখেছে। ”
মৃদু ছন্দে হেসে উঠে তোভিয়া।
,
,
,
সুবিশাল শয়নকক্ষ! জ্বাজল্যতায় সমাকীর্ণ! দেয়ালে খোদাই করা কারুকাজ। যে কারো চোখের ওপর হামলে পড়বে এই কক্ষের অতিশয় ভাস্বর, দীপ্তিময়, চির অম্লান করা নিঁখুদ ঐশ্বরিক, কুহক অভিরাম! বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি করা দরজা। তাতে সূক্ষ্মভাবে লাগানো বিভিন্ন রঙা সফেদ পাথর। পুরো দরজার কারুকাজে মাঝ বরাবর থেকে বিভেদ রাখা। সেই বর্ডারে চুনি পাথরের সমাবেশ। কাঁচের আস্তরন দেওয়া আছে দুই খন্ডে। বিশেষ ধরনের কাঠের মাঝে কাঁচ সম্বলিত দরজা।
দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে তোভিয়া। অতি সন্তর্পণে। যেন কোনো রকম ছন্দের উৎপন্ন না হয়। সে ধীরপায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কক্ষের মাঝে পর্দা টানানো। এপাশ থেকে ওপাশ দেখার জো নেই। পর্দার ঘনত্ব অত্যন্ত গাঢ়! পর্দার ওপাশটাতে থাকেন তোভিয়ার দাদা। তিনি শয্যাশায়ী। তার নিরবচ্ছিন্ন পরিচর্যার জন্য রাখা হয়েছে দুইজন ভৃত্যকে। তারা সর্বদা তার সেবায় নিয়োজিত থাকেন। তাকে দেখার জন্য সপ্তাহে একবার সুযোগ পান এই বাড়ির কনিষ্ঠ সদস্যরা।
তোভিয়া সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্ধেক কক্ষে বেগমরাণির আলাদা সাম্রাজ্য। তার বিশাল পালঙ্কের শিয়রে পদ্মখচিত তারকা। পালঙ্কের অদূরে রাখা পদ্মফুলের আকৃতির আসন। বেগমরাণি সেখানেই বসে আছেন। তার পরনে কালো রঙের আলখাল্লা। তিনি নিমগ্ন হয়ে হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন নিজ হাতে রাখা মূষিকের( ইদুর) ওপর। পরম যত্নে, মমতায়। মূষিকটি প্রলুব্ধ! বেগমরাণির আদরের জন্য।
তোভিয়া পদযুগল থামাল। বেগমরাণির পুরো কক্ষজুড়ে গালিচা বিছানো। সেই গালিচায় পদচারনায় শব্দ হয় না। শব্দ পছন্দ করেন না বেগমরাণি। তিনি তোভিয়ার দাদার দ্বিতীয়পক্ষ। তার কোনো সন্তান নেই। তোভিয়ার দাদী মৃত্যুবরণ করার পর, এই অলোকিক, নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের অধিকারিণীকে তোভিয়ার দাদা বিয়ে করেন। বয়সটা নিছক সংখ্যামাত্র। প্রমাণ করলেন বেগমরাণি। তার টলটলে আনন, স্বচ্ছ নেত্রযুগল, গোলাপি আভার কায়াতে ঝরে পড়ে নৈসর্গিক সৌন্দর্য! বেগমরাণি আরামের সাথে বসে আছেন পদ্মাসনে। কোমল হেসে আড় চোখে দেখে নিলেন তোভিয়াকে। তোভিয়া বেগমরাণির সামনে গালিচায় হাঁটু ভাজ করে তার ওপর ভর দিয়ে বসল।
তোমিয়া বিনম্র গলায় বলল—-
“আমি কৃতজ্ঞ আপনার প্রতি।”
বেগমরাণি মূষিকটির ওপর দৃষ্টি স্থির রেখে গাঢ় স্বরে বললেন—
“জেহেনকে সামলানোর আস্ফালন দেখিয়েছ তুমি! আমি বিস্মিত হয়েছি।”
“ক্ষমা করবেন বেগমরাণি। আমি তাকে ভালোবাসি।”
“পদ্মনন্দিনী, তুমি নিজের সচেতন মস্তিষ্ক আছ তো?”
“জি।”
“এই পদ্মমহলের পাঁচ পুরুষের আবর্তনে জন্ম নেওয়া প্রথম কন্যা তুমি। এই পদ্মমহলের পদ্মকুমারী। আমি তোমার ওপর ভরসা রাখতে পারি পদ্মনন্দিনী?”
“জি, বেগমরাণি।”
“আমি প্রসন্ন হলাম তোমার দৃঢ়তায়। তুমি আসতে পারো।”
“ধন্যবাদ, বেগমরাণি।”
“হুম।”
তোভিয়া উঠে দাড়ায়। বিনা শব্দে প্রস্থান করে বেগমরাণির কক্ষ।
চলবে,,,