জঠর পর্বঃ২

0
2205

#জঠর
#পর্বঃ২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

শরতের বিকেলের শুভ্র নীলাভ ঝলমলে আকাশের মতো দুই চোখে চেয়ে আছে পিউলী। উচ্ছ্বাসিত অন্ত:করণে নিত্যতার অভিলাষ। বারংবার হৃদপ্রকোষ্ঠে মাতৃস্নেহের অনুপস্থিতিতে কাতর হওয়া দুঃখের সমুদ্রে পালতোলা নৌকা পেয়েছে সে। মা পেয়েছে পিউলী।

ঊষরে আকস্মিক মৃগতৃঞ্চিকার মতো নায়েলের বিয়ের কথা শুনেছিল হৃতি। কিন্তু সেই মৃগতৃঞ্চিকা সত্যরূপে তার সামনে দৃশ্যমান হতেই বিচলিত, উৎপীড়িত সে। ঘন বর্ষার অবিশ্রান্ত ঝুমঝুম বৃষ্টিতে সিক্ত তার আঁখিদ্বয়। হাঁপিয়ে উঠতেই নিজের ঘরের দিকে তটস্থ পায়ে ছুটে যায়। পিউলী বাবার মুখের তাকাল। তার চোখে উদ্ভূত প্রশ্নের উত্তর দিতে অপারগ নায়েল। মিষ্টি করে হেসে বলল—

“ঘরে যাও মামুনি। পাপা আসছি।”

মাথা ঝাঁকায় পিউলী। ছোট্ট ছোট্ট কদম ফেলে নিজ গন্তব্য হেঁটে চলে। রাগের নগ্ন প্রকাশ ঘটালেন সায়েরা। দগ্ধ গলায় বললেন—

“বিয়ে যখন করতেই হবে তাহলে আমার মেয়েটাকেই বিয়ে করতে। কম কীসে হৃতি? পিউলীর মা হওয়ার যোগ্যতা নেই ওর না- কি তোমার স্ত্রীর?”

নায়েল সংকীর্ণ গলায় প্রত্যুক্তি করে—

“খালামনি, আমি আপনাকে আগেও বলেছি। হৃতিকে সবসময় আমি বোনের মতোই দেখেছি। আমার পক্ষে ওকে বিয়ে করা কখনোই সম্ভব নয়।”

“তাহলে ওই বাইরের মেয়েটাকে বিয়ে করলে কেন?”

নায়েল অনুদ্বেগ গলায় বলল—

“কারণ, পিউলী চেয়েছে।”

নায়েল ওঠে পড়ে। নিজ কক্ষের দিকে পদযুগল বাড়ায়। সায়েরা সম্পর্কে নায়েলের মা হলেও তাকে সে খালামনি বলেই ডাকে। নায়েলের মা মারা যাওয়ার পর তার বাবা নওশাদ সাহেব সায়েরাকে বিয়ে করেন। সায়েরা ডিবোর্সী ছিল। হৃতি তার বোনের সন্তান। এখানে থেকে পড়ালেখা করে সে। হৃতির বাবা,মা গ্রামে থাকে। সায়েরা চেয়েছিলেন হৃতিকেই যেন নায়েল বিয়ে করে। কিন্তু তার সেই আশায় পানি ঢেলে দিল পিউলী।

নওশাদ সাহেব নির্লিপ্ত। উদাসীন হয়ে বসে আছেন তিনি। নায়েল তার মেয়েকে নিয়ে ওভার পজেসিভ। সায়েরা খসখসে গলায় বললেন—

“আপনি কিছু বলছেন না কেন? এসব ঝামেলার কী দরকার ছিল?”

নওশাদ সাহেব মাথা তুললেন। মিহি গলায় বললেন—

“কী বলতে চাইছ তুমি?”

জ্বলে ওঠল সায়েরা। রুষ্ট গলায় বলল—

“নায়েল কেন ওই মেয়েটাকে বিয়ে করে আনলো? আমার মেয়েকে বিয়ে করতে ওর কী সমস্যা?”

নওশাদ সাহেব শ্বাস ফেললেন। চাপা গলায় বললেন—

“পিউলী ওই মেয়েটাকেই ওর মা হিসেবে চেয়েছে। মেয়েটা আমাদের জন্য যা করেছে তা ভোলা যাবে না। আর বিয়ে করার ব্যাপারটা একান্ত নায়েলের সিদ্ধান্ত। তাতে হস্তক্ষেপ করা আমি সমীচীন মনে করছি না।”

সায়েরা সরোষে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন—

“ভাবুন তো, যদি ওই মেয়ে কোনোভাবে নায়েলের সন্তানের মা হয় তখন কী হবে?”

শঙ্কিত আঁখিপল্লবে তীব্র ভয়ের প্রকট হলো। নওশাদ সাহেবের অন্তঃরিন্দ্রিয়তে উচাটন শুরু হলো। ত্রস্ত গলায় বলে উঠলেন—

“নায়েল সবকিছু ভেবেচিন্তে- ই করেছে। মেয়েটাকে সব জানিয়ে রাখবে হয়তো।”

“যদি আমার কথাই সত্যি হয় তখন? পুরুষ মানুষ ও। কতদিন নিজেকে আটকে রাখবে নারী দেহের স্বাধ থেকে?”

গর্জে উঠলেন নওশাদ সাহেব। দারাজ গলায় বললেন—

“মুখে লাগাম লাগাও। জন্ম না দিলেও সম্পর্কে ও তোমার ছেলে। একটু তো লেহাজ করো সম্পর্কের। আর ভুলে যেয়ো না লুবানা এখনো বেঁচে আছে।”

কাউচ থেকে হন্তিদন্তি হয়ে উঠলেন নওশাদ সাহেব। স্ত্রীর এমন বেহুদা কথায় তার মস্তিষ্কে যন্ত্রণা শুরু হলো।
,
,
,
হাজারো স্বপ্নের ভীড়ে মেয়েদের অন্যতম স্বপ্ন সংসার, স্বামী, সন্তান। নিজের হাতে গড়া ছোট্ট বাবুই পাখির বাসা, আদরে ভরা স্বামী, ভালোবাসার প্রতীক সন্তানকে নিয়ে সহস্র মেয়ের বুকের হৃদগহীনে থাকে সুপ্ত বাসনা। তা আজ এক নিমিষে শেষ হয়ে গেছে অর্হিতার।

অর্হিতার চোখে জল নেই। ভাগ্যকে দোষ দেওয়া ছেড়ে দিয়েছে সে অনেক আগেই, যখন তার বাবা, মা মারা গেছে তখন থেকে। আত্মীয়-স্বজনরা নামের সাহায্য করতেও এক পা এগিয়ে আসেনি। দুঃসম্পর্কের এই মামা, মামি-ই সেদিন তাদের দুই ভাইবোনকে আশ্রয় দিয়েছিল। পড়ালেখা করছে অতি কষ্টে। যখন থেকে নিজের উপর ভরসা তৈরি হলো তখন থেকেই টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ চালাতে শুরু করে। মামা, মামি এমনিতে তো তাকে দু’বেলা খেতে দেয়নি। বাড়ির সব কাজ করিয়ে নিয়েছে তার বিনিময়ে। নাজুক নারী হাত হয়েছে খরা মৃত্তিকা।

আফসোস হচ্ছে অর্হিতার। মাস খানেক আগ বান্ধবীর বাবাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েই পরিচয় নায়েলের সাথে। পরিচয় বললে ভুল হবে। পিউলীর জন্য দিগ্বিবিদিক শূন্য হয়ে রক্তের জন্য দৌড়ে বেরাচ্ছিল নায়েল। সেই পরিস্থিতিতেই স্বর্গদূত হয়ে উপস্থিত হয় অর্হিতা। তার রক্তেই নতুন জীবন পায় পিউলী।

ভেজানো দরজা মেলে ভেতরে ঢুকে নায়েল। তাকে দেখেই খলবলিয়ে ওঠে অর্হিতা। গজগজ করে বলল—

“উপকারের এই প্রতিদান দিলেন আপনি? ”

নায়েল ছোট্ট শ্বাস ফেলল। বিনয়ী গলায় বলল—

“আপনি আমার সামনে আর কোনো পথ রাখেননি।”

“তাই বলে ভাইয়াকে টাকার লোভ দেখাবেন?”

কৃত্রিম বাতির আলোকছটায় অর্হিতার উগ্রমূর্তি অক্ষিগোচর হলো নায়েলের। মেয়েটার রাগ যেন শিরায় শিরায় ধাবমান রক্তের সাথে মিশে আছে। নায়েল নরম গলায় বলল—

“আমি বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছি। আপনি রিজেক্ট করেছেন। তাই বাধ্য হয়েছি আমি।”

“কী ভাবেন আপনি নিজেকে?”

“কিছুই না।”

গায়ের ব্লেজারটা খুলে হাতে নিল নায়েল। দরজার পাশে টেবিল। তার সাথে লাগোয়া চেয়ারটা টেনে নির্বিঘ্নে বসল। শ্রান্ত গলায় বলল—

“বিয়ে করা কোনো অপরাধ নয়। তবে আই এম সরি।”

অর্হিতা উষ্ণ গলায় বলল—

” বিয়ে করা অপরাদ নয়। বউ মরা ছেলের কচি মেয়ে বিয়ে করা অপরাদ।”

অর্হিতা এহেন কথায় হাসি আটকাত বেগ পেতে হলো নায়েলে। এক ভ্রু উঁচু করে তার সেই হাসির কারণে টগবগ করে ওঠে অর্হিতা।

“আপনি কী বলতে চাইছেন বলুন তো? আপনার মেয়ের জন্য অন্য কোনো মা পেলেন না? আমাকেই আপনার বিয়ে করতে হলো।”

“ওকে তো আপনি বাঁচিয়েছেন। ও আপনাকেই ওর মা হিসেবে চায়।”

“কিন্তু আমি চাই না। আপনার মেয়েকে আমি চাইইইই না। বুঝতে পেরেছেন।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল নায়েল। ছোট্ট করে বলল—

“এছাড়া আপনার কাছে আর কোনো উপায় নেই। আপনাকে এই বাড়িতেই থাকতে হবে। আমার মেয়ের মা হয়েই থাকতে হবে।”

রাগে থরথর করছে অর্হিতার শরীর। লোকটা কতবড়ো অসভ্য!
চিৎকার করে উঠে অর্হিতা।

“আমি আপনার মেয়েকে বাঁচিয়েছি। সেই খুশিতে আপনি আমাকে মেরে ফেলতে চাইছেন?”

নায়েল ভ্রূকুঞ্চন করে অবাক গলায় বলল—

“আপনি ভুল ভাবছেন। আমি আপনাকে জোর করতে চাইনি। মেরে ফেলব কেন? বরঞ্চ বাঁচিয়েছি। আপনার ভাই বলল, আপনি বাইরের ক্রান্ট্রিতে গিয়ে হায়্যার স্টাডি করতে চান! আমি আপনার জন্য সব ব্যবস্থা করব। শুধু তার বিনিময়ে আমার মেয়েকে আপন করে নেবেন। দ্যাটস ইট।”

রাগে হতবিহ্বল অর্হিতা বিছানার পাশ টেবিল হতে টেবিল ল্যাম্পশেডটা নিয়ে ছুড়ে মারে নায়েলের দিকে। তা সোজা গিয়ে লাগে নায়েলের কপালে। কেটে যায় অনেকটা জায়গা। অর্হিতার রাগ কমলো না। মায়াও হলো না লোকটার জন্য। ভাবে কী নিজেকে। জোর করে বিয়ে করে একটা বাচ্চা ধরিয়ে দিলেই হলো! না। এমনিতেও ও বাড়িতে তার কোনো সম্মান নেই। এখানেও যদি তাই ই হয় তাহলে সে লড়বে। নিজের জন্য-ই লড়বে। অন্যের বাচ্চাকে সে কেন মাতৃস্নেহ দেবে?

কপালে হাত দিয়ে উজ্জ্বল চোখে চেয়ে আছে নায়েল। মেয়েটার এই ঝড়ো রাগের জন্য-ই এত কাঠখড় পুরিয়ে তাকে বিয়ে করেছে সে। তার প্রতি তিক্ততা এই সম্পর্কের মাঝে দেয়াল তুললেও তার মেয়েকে দেবে আশ্রয়। পিউলীর জীবন সংকটে এই মেয়ে-ই হবে তার হাতিয়ার। যে পিউলীকে রক্ষা করবে ওই অদৃশ্য শত্রুর হাত থেকে।

দশ মাস দশদিন একটা ভ্রুণকে যেমন মা তার জঠরে লালন করে পৃথিবীর ভয়াল আগ্রাসন থেকে রক্ষা করে, ঠিক তেমনভাবে অর্হিতাও তার পিউলীকে রক্ষা করবে সেই নামহীন ভয়ংকর প্রহেলিকা থেকে। যা এখনো বলয় হয়ে ঘিরে রেখেছে তার মেয়েকে। অর্হিতার এই রাগি, জেদি মনে তার মেয়ের জন্য জায়গা করে তুলতে হবে।

পাথরে ফুল ফোটা অসম্ভব। কিন্তু যদি ফোটে, তবে তা অবিশ্বাস্য ! অর্হিতা সেই পাথর, তার বুকে-ই ফুল হয়ে ফুটফে পিউলী। নায়েল সেই আশায় আশাবাদী।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here