জলে_ভাসা_পদ্ম পর্ব: ০১

পদ্মর স্বামী যখন তাকে জিজ্ঞেস করেছিল,
‘আমার দ্বিতীয় বিবাহ নিয়ে তোমার কী মতামত পদ্ম?’
তখন পদ্ম এক বাক্যে উত্তর দিয়েছিল,
‘করে নিন বিয়ে।’

সেদিন প্রিয় স্বামী অপলক দৃষ্টিতে কীয়ৎক্ষণ তাকিয়ে ছিল স্ত্রীর মুখপানে। তার দু’চোখে বিস্ময় ছিল না। ছিল না অবিশ্বাসের ছাপ। নিষ্প্রাণ‍ মুখ নিয়ে চেয়ে ছিল সে। অতঃপর চলে গিয়েছিল। যাওয়ার আগে কিছুটি বলেনি। ওই দিনের পর আর স্বামীর সাথে কথা হয়নি পদ্মর। ওটাই ছিল শেষ কথা। আজ প্রায় কয়েক দিন হলো। দেখা হয়, দৃষ্টি বিনিময় হয়, হৃদয়ে দহন হয়, কিন্তু মুখে কথা ফোঁটে না। পদ্ম ভাবে, মানুষটা কেনই বা এখন কথা বলবে তার সাথে? কিছুদিন পর মানুষটা নতুন বিয়ে করতে চলেছে। সে তো এখন মানুষটার কাছে একটি অবহেলার জিনিস বৈ আর কিছুই নয়। তার সাথে কথা বলার মন কি এখন আছে মানুষটার? কথাটা মনে উঠতেই পদ্মর হৃদয় ভার হয়, নেত্র হতে জল ঝরে।

পদ্ম আর তাহেরের বিয়ের সাত বছর পূর্ণ হয়ে, আট বছর চলছে এখন। যখন বিয়ে হয় তখন পদ্মর বয়স মাত্র চৌদ্দ বছর। পদ্মর জন্মের সময় পদ্মর মা মারা যায়। পদ্মর বাবা এ নিয়ে মেয়েকে অলক্ষ্মী মনে করেন। রাগান্বিত হন সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া মেয়ের উপর। রাগ করে বাড়ি ছাড়েন। এরপর আর কোনো হদিশ পাওয়া যায় না তার। পদ্ম বড়ো হয়েছে দাদা-দাদির কাছে। অবহেলা, অযত্নে বেড়ে ওঠা তার। কে জানতো আফজাল হাওলাদারের দৃষ্টি এসে এই অবহেলা, অযত্নে বেড়ে ওঠা কিশোরীটির উপরই পড়বে? কী দেখে যে তিনি ছেলের বউ করার জন্য পদ্মকে পছন্দ করেছিলেন, সেটা পদ্মসহ সকলের কাছেই বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল। হয়তো পদ্ম লাবণ্যময়ী রূপের অধিকারী হওয়াতেই পছন্দ করেছিলেন। তিনি পদ্মকে ছেলের বউ করে নেওয়ার জন্য প্রস্তাব পাঠালেন পদ্মর দাদা-দাদির কাছে। দাদা-দাদির কাছে পদ্ম ছিল একটা বোঝা স্বরূপ। এ বোঝাকে বিতাড়িত করতে পারলেই তারা মুক্ত এবং চিন্তা স্বাধীন। আর যখন প্রস্তাবটা এলো বড়ো ঘর থেকে তখন তো এটা ফিরিয়ে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। আফজাল হাওলাদারের কাছ থেকে প্রস্তাবটা পেয়ে তারা খুশিতে গদগদ হলেন। আফজাল হাওলাদারদের পারিবারিক অবস্থা অনেক ভালো। বিষয় সম্পত্তি আছে বিপুল পরিমাণ। এমন ঘর থেকে বিয়ের প্রস্তাব পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। যখন তারা নিজ থেকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে তখন এ প্রস্তাব হাতছাড়া করা মোটেই ঠিক কাজ হবে না।
পদ্মর এত কম বয়সে বিয়ে করার মন ছিল না। কিন্তু তার মতের উপর যে কোনো গুরুত্ব নেই সেটা সে ভালো করে জানে। বিয়েতে অমত করলেও কোনো লাভ নেই। তাই মনে মনে বিয়ে না করতে চাইলেও মুখে সে ‘না’ শব্দটি উচ্চারণ করেনি। এছাড়া নিজেও ভেবে দেখেছে, দাদা-দাদির কাছে তার জীবন কষ্টের। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে গেলে জীবন কিছুটা সুখের হলেও হতে পারে।
বিয়ের আগে স্বামীর মুখশ্রী দেখার সুযোগ হয়নি পদ্মর। দেখা হওয়ার সময় ছিল। চাইলে মানুষটা দেখা করতে পারতো তার সাথে। কিন্তু করেনি। স্বামীর মুখ দেখেছিল একেবারে বাসর ঘরে। দুপুরের এক ছটা আলসে রোদের নির্জন দ্বি-প্রহরে পদ্মর মানসপটে হঠাৎ দূর অতীতের সুপ্ত মুখর স্মৃতিটা হুড়মুড় করে উঠলো। তার স্পষ্ট মনে আছে ওই রাতটা। স্মৃতির পাতায় গাঢ় লেপন ফেলে আছে ওই রাত। সে লাল বেনারসি পরে বসেছিল। কাঁচা ফুলের গন্ধে ভাসছিল পুরো কক্ষ। পদ্মর বুক ছিল দুরুদুরু। শ্বশুর বাড়িতে পা রাখার পর থেকেই বক্ষে তার এমন সমর শুরু হয়েছিল যা বলার মতো নয়। পুরো অচেনা এক পরিবেশে এসেছে সে। ভয়, আড়ষ্টতায় অন্তর গাঁট হয়েছিল। একটু পরই সে স্বামী নামক ব্যক্তিটার সাক্ষাৎ পেতে চলেছে। যে ব্যক্তিটাকে সে এক সেকেন্ডের জন্যও এর আগে আঁখিপাত করেনি। পদ্মর হৃদয় ছটফট করছিল। এমন মুহূর্ত তার জীবনে আর কখনও আসেনি। কক্ষের দরজা খোলা ছিল, হঠাৎ খোলা দরজা দিয়ে একজন সুঠাম দেহের মানুষের আগমন ঘটলো। পদ্মর দম বন্ধ হয়ে এলো ওই মুহূর্তে। ঘোমটার আড়ালে তার মুখটা দেখলে নিশ্চয়ই মানুষটা হেসে ফেলতো তখন। কয়েক মুহূর্ত পদ্মর অন্য কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ ছিল না। সে ব্যস্ত ছিল নিজেকে মানাতে। তার ভিতরটা ক্রমশ জড়ো-সড়ো হয়ে আসছিল। সাহস নামের যে জিনিসটা আছে সেটা চুপসানো বেলুনের মতো নেতিয়ে পড়েছিল একেবারে।

তাহের খাটের পাশে থাকা একটা টুল টেনে বসলো। চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল বধূবেশী মেয়েটার দিকে। ঘোমটার কারণে মেয়েটার ভয়ে থমথম মুখটা দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু সে বেশ উপলব্ধি করতে পারছে মেয়েটার ভাবগতিক। মনে মনে হাসি পেল তার। কত ছোট একটা মেয়ে বধূ বেশে বসে আছে তার ঘরে। এগারো বছরের ছোট তার। তাহেরের হাসি ঠোঁটে উপচে পড়তে চাইলে সে কোনো রকম চেপে নিলো সেই হাসি। আরও কিছুক্ষণ নীরবতার পর বধূবেশী কিশোরী মেয়েটির উদ্দেশ্যে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম!”

পুরুষালি কণ্ঠের বিশুদ্ধ সালামের ধ্বনি শুনে পদ্মর গলা শুকিয়ে এলো। হৃদকাঁপন বেড়ে গেল আরও কয়েক গুণ। মুখ মন্ডল ঘামতে লাগলো। চাইছে সালামের উত্তরটা দিতে, কিন্তু গলার কাছে কঠিনভাবে কিছু একটা বিঁধে আছে। যেটা গলা থেকে স্বর বের হতে দিচ্ছে না। শত চেষ্টা করেও পদ্ম ব্যর্থ হলো সালামের উত্তর দিতে। গলা দিয়ে সামান্য একটু আওয়াজও বের হলো না তার।

তাহের বললো,
“কেউ সালাম দিলে সালামের উত্তর দিতে হয়, জানো না সেটা?”

তাহেরের কথায় পদ্মর ভিতরটা আরও চুপসে গেল। কাচুমাচু হয়ে গেল ভয়ে। এবারও সে নির্বাক রইল। তাহের প্রশ্নের উত্তর পেল না। পদ্মর এমন অভিপ্রায় দেখে তার কেবলই হাসি পেতে লাগলো। কিন্তু সে হাসলো না। প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,
“আমি তাহের হাওলাদার। তোমার স্বামী। চেনো আমাকে?”

পদ্ম একটু থমকালো। তাহেরের প্রশ্নটা ভালো করে উপলব্ধি করার চেষ্টা করলো। এটা আবার কেমন কথা, কেমন প্রশ্ন? কথাটায় বড়ো ধরণের একটি গরমিল উপলব্ধি হলো তার।

“কী ব্যাপার? এত চুপচাপ কেন তুমি? কোনো কথা বলছো না কেন?”

পদ্মর থেকে এবারও কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। তাহের ক্ষুদ্র একটা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বললো,
“ঠিক আছে, কথা না বলো, ঘোমটা সরাও। দেখি তোমায়। দেখতে ঠিক কেমন তুমি?”
পদ্ম তাহেরকে এর আগে না দেখলেও তাহের ঠিকই দেখেছে পদ্মকে। কিন্তু এখন এমনভাবে বললো যেন সে ওকে দেখেনি এর আগে।

তাহেরের এই কথায় পদ্ম লজ্জা পেল। সলজ্জ মুখখানিতে ছড়িয়ে পড়লো লজ্জার লাল প্রভা।
তাহের পদ্মর এমন মৌন আচরণে একটু অধৈর্য অনুভব করলো। টুল ছেড়ে খাটের উপর এসে বসলো সে। পদ্মর মুখের উপর পড়ে থাকা ঘোমটার পর্দাটা নিজেই সরিয়ে দিলো। পদ্মর নত মুখটা তখন আরও নত হয়ে এলো। তাহের ওই লাবণ্যময়ী মুখখানিতে চেয়ে থেকে বললো,
“মাশাআল্লাহ! তুমি দেখতে তো খুব সুন্দর, কিন্তু তোমার আচরণ এত কেন অসুন্দর? গুরুজন একাই শুধু কথা বলে যাচ্ছে, অথচ তুমি তার কথাতে হু, হা পর্যন্ত করছো না! তুমি তো খুব বেয়াদব আছো!”

পদ্মর মুখ কয়লা বর্ণ ধারণ করলো। মুখ শুকিয়ে একটুখানি! তাহের ওই মুখ দেখে হেসে ফেললো। প্রশ্ন করলো,
“নাম কী তোমার?”

পদ্ম জবাব দিলো না। তবে মানুষটাকে কেমন যেন মনে হচ্ছে তার। নিজের বউয়ের নাম কি সে জানে না? অবশ্যই জানে। তাহলে কেন আবার নাম জানতে চেয়ে প্রশ্ন? মানুষটা যেন একটু বেশিই ফটফটে!

“কী হলো? বলবে না নাম? আসার পর থেকেই দেখছি তুমি চুপচাপ। কাহিনী কী? তুমি কি কথা বলতে পারো না? তুমি কি বোবা?”

পদ্ম যেরকম ছিল ঠাঁয় সেরকম বসে রইল। তাহের ওর নীরবতা দেখে বললো,
“যাক শেষ পর্যন্ত একটা বোবা মেয়েকে বিয়ে করলাম আমি। তো বোবা মেয়ে, বলো দেখি, স্বামী পছন্দ হয়েছে তোমার?”

এই কথা শুনে পদ্মর লজ্জায় মরে যাই যাই অবস্থা হলো। সে বেশ বুঝতে পারলো এই লোকটার মুখে কোনো লাগাম নেই। ঠোঁটের কোণে লজ্জা টানা একটা হাস্যভাব ফুঁটে উঠলো পদ্মর। তাহের তা লক্ষ্য করে বললো,
“বোবা মেয়ে দেখছি লজ্জাও পেতে জানে।”
বলে মৃদু হাসলো।

কিছুক্ষণ নীরবতা গেল। পদ্ম মুখ নত করেই বসে রইল। তাহের অন্যমনস্ক হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎই বললো,
“তোমার নাম পদ্ম, তাই না?”
প্রশ্নটা করতে করতে পদ্মর দিকে তাকালো।

পদ্ম হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো।

“কে রেখেছে এই নাম? উত্তর দেবে এইবার। নইলে থাঠিয়ে এক চড় মারবো।”

তাহেরের কথার ধারালো তেজে পদ্ম কেঁপে উঠলো। নত মাথাটা অগত্যা সোজা হলো। কাঁপা কাঁপা স্বরে উত্তর দিলো,
“দা-দি।”

“হুম…” ঈষৎ মাথা দোলাতে দোলাতে উচ্চারণ করলো তাহের। “আমাদের বাড়ির পিছনে একটা পদ্মপুকুর আছে। যাবে সেখানে?”

পদ্ম তাকিয়ে রইল। তার মৌনতা দেখে বোঝা গেল সে যাবে। ওই রাতে তাহের পদ্মকে পদ্মপুকুর ঘাটে নিয়ে এসেছিল। সময়টা ছিল শরৎকাল। অনেক পদ্ম ফুঁটে ছিল পুকুর জলে। আকাশে চাঁদ, পরিবেশ ছিল জোৎস্না মাখা। চাঁদের আলো থলথল করছিল পুকুরের জলে। তাহের বললো,
“তুমি আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট পদ্ম।”

“ও…” পদ্ম ছোট করে উচ্চারণ করলো।

“আমি তোমার থেকে কত বছরের বড়ো জানো?”

পদ্ম স্বামীর মুখের দিকে তাকালো। চাঁদের আলোয় স্বামীর শ্যাম বর্ণের মুখটা সহসা আপন মনে হলো তার। মুখ দেখে যেন অনুমান করছে বয়সের পার্থক্যটা। বললো,
“পনেরো বছরের?”

তাহের হেসে বললো,
“উহু, এগারো বছরের।”

পদ্মর মস্তক নত হয়ে এলো আবার। সঠিক উত্তরটা দিতে পারলো না বলে মন খারাপ হলো। তাহেরের কণ্ঠ শুনতে পেল,
“পদ্ম নামের মেয়ের কাছে পদ্মফুল না থাকলে কেমন লাগে? বড্ড বেমামান লাগছে দেখতে।”

বলে সে সিঁড়ি ভেঙে নেমে গেল। জলের নিচে চলে যাওয়া সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে একটা পদ্মফুল তুললো। কষ্ট হয়েছে ফুলটার নাগাল পেতে। তিনটা ফুলই ঘাটের কাছে ছিল। বাকি সব ফুল দূরে দূরে। ফুলটা নিয়ে তাহের ফেরত এলো পদ্মর কাছে। ঠোঁটে প্রাঞ্জল হাসির রেখাপাত ঘটিয়ে ফুলটা পদ্মর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“পদ্ম বিবির জন্য পদ্মফুল উপহার। গ্রহণ করো বিবিজান!”

পদ্মর দুই গাল বেয়ে উষ্ণ জলের ধারা গড়িয়ে পড়লো। স্মৃতিরা হালকা হয়ে মিলিয়ে গেল বাতাসে। পদ্ম চোখের জল মুছে নিলো। এই মুহূর্তে সে সেখানটাতেই বসে আছে। পদ্মপুকুর ঘাটে। পুকুর জলে ফুঁটে আছে লাল পদ্মরা। এটাও শরৎকাল। এক শরতে বিয়ে হয়েছিল তাদের। আরেক শরতে আবারও বিয়ে করতে চলেছে তার স্বামী!

পদ্ম পুরোনো দিনের জীবন সম্পর্কে ভাবতে লাগলো। বিয়ের পর জীবন তো সুন্দরই ছিল, সুখের ছিল। শ্বশুর আব্বা পছন্দ করে বাড়ির বউ করে এনেছিল তাকে। আদর-যত্নে রেখেছিলেন। যদি কখনো প্রশ্ন ওঠে, পদ্মর দেখা সবচেয়ে আদর্শ মানুষটা কে? তাহলে পদ্ম চোখ বন্ধ করে উত্তর দেবে, তার শ্বশুর আব্বা, আফজাল হাওলাদার। শাশুড়ির কাছ থেকে ভালোবাসা পায়নি পদ্ম। শাশুড়ি চেয়েছিলেন খানদানি পরিবারে ছেলের বিয়ে দিতে। কিন্তু পারেননি। আফজাল হাওলাদার পদ্মকে ছেলের বউ করার জন্য পছন্দ করলেন। ফিরোজা খাতুন ভেবেছিলেন ছেলে এই বিয়েতে মত দেবে না। কিন্তু সেখানেও তার ভাবনার জোর খাটলো না। তাহের প্রথমে মেয়ে ছোট বলে বিয়েতে অমত করলেও পরে আবার মত দেয়। বিয়েটা হয়ে যায়। কিছু করার থাকে না ফিরোজা খাতুনের। শাশুড়ির ভালোবাসা না পেলেও এখানে খারাপ জীবন কাটছিল না পদ্মর। শাশুড়ির বাধ্য হয়ে হলেও পদ্মর সাথে ভালো আচরণ করতে হতো। তার মাঝে ধীরে ধীরে বোধহয় একটু একটু মায়াও জন্ম নিচ্ছিল পদ্মর জন্য। কিন্তু একটা ঝড় সেই মায়ার খুঁটি নাড়িয়ে দিলো।
পদ্মর জীবনে তখন থেকেই একটু একটু করে বিষাদ ঢুকে পড়ছিল, যখন তার শ্বশুর মারা গেল! শ্বশুর মারা গিয়েছে আজ প্রায় এক বছর হলো। শ্বশুর মারা যাওয়ার পর যেন শাশুড়ি একটু রুক্ষ হয়ে উঠলো পদ্মর প্রতি। খিটখিটে আচরণ করতো। আর খিটখিটে আচরণ একেবারে নির্দয় হয়ে উঠলো যখন প্রকাশ পেল পদ্ম মা হতে পারবে না কোনোদিন! এটা প্রকাশ হওয়ার পর কত লোকের কত কথা শুনতে হলো পদ্মকে। কত অশ্রু যে বিসর্জন দিয়েছে সেটা শুধু সে জানে। তাহের জানে না? সেও অনেক কিছুই জানে।
তাহের অবশ্য মা হতে পারবে না এ বিষয় নিয়ে কখনও কিছু বলেনি তাকে। একটা মাস থমথমে পরিবেশের মধ্য দিয়েই কেটে গিয়েছিল। ঝামেলা যত শুরু হলো ওই এক মাস পর। তাহেরের মা, ভাই-ভাবি, চাচার পরিবার সবাই মিলে তাহেরকে বুঝ দিতে লাগলো পদ্মকে তালাক দিয়ে নতুন একটা বিয়ে করার জন্য। তাহের এটা শুনে রেগে গেল। ঝগড়া-ঝাটি, কথা কাটাকাটি চললো অনেক দিন অবধি। তাহের কিছুতেই পদ্মকে ডিভোর্স দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করবে না।
কিন্তু হঠাৎ কী যেন হলো তাহেরের! যত সময় যাচ্ছিল পদ্ম বুঝতে পারছিল তাহেরের মত পরিবর্তন হচ্ছে ক্রমশ। হয়তো তাহের বুঝতে পেরেছে একটা সন্তান জীবনের অতি প্রয়োজনীয় সম্পদ। এজন্যই হয়তো সে দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য মনস্থির করেছে। পদ্ম এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছিল যখন তাহের তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আমার দ্বিতীয় বিবাহ নিয়ে তোমার কী মতামত পদ্ম?’
মানুষটার যদি দ্বিতীয় বিয়ে করার মন না থাকতো তাহলে কি জীবনে এমন একটা প্রশ্ন করতো স্ত্রীর কাছে? পদ্ম ধরে নিয়েছিল তাহের তাকে ডিভোর্স দিয়ে নতুন বিয়ে করবে। কিন্তু তাহের তার ধারণায় কিঞ্চিৎ পরিবর্তন এনেছে। তাহের বিয়েতে মত দিয়েছে ঠিকই কিন্তু তাকে ডিভোর্স দেয়নি। তাহেরের পরিবার এ বিষয়েও ক্ষেপে যায়। এ মেয়েকে ঘরে রাখার কী আছে? নতুন বিয়ে তো করছেই।
তাহের সকলকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, পদ্মকে সে কিছুতেই ডিভোর্স দেবে না। এ নিয়ে আর একটা কথা হলে সে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। পরিবারের লোকেরা এরপর আর কিছু বলার সাহস পায়নি। ছেলে যে দ্বিতীয় বিয়েতে মত দিয়েছে এটাই অনেক।

পদ্ম বসে বসে অনেক কিছুই ভাবছিল, ভাবনা স্থিতিশীল হলো কারো আগমনে। সে না দেখেও বুঝলো এটা তাহের। অন্তঃকরণ কান্নার সুর ধরেছিল যেন, পদ্ম থামিয়ে দিলো সেই করুণ ধ্বনি। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো দ্রুত। পিছন ফিরতেই স্বামীকে দেখলো। এক মুহূর্তের জন্য দৃষ্টি বিনিময় হলো। পদ্ম আর দাঁড়ালো না। চলে যেতে নিলেই তাহের তার হাত ধরে আটকালো। থামতে হলো পদ্মর। পিছনে তাকালো স্বামীর দিকে। স্বামীর মৌন অবস্থা বোঝার চেষ্টা করলো। মানুষটা কি কিছু বলতে চাইছে তাকে?
না, কিছু বললো না মানুষটা। মানুষটার দু চোখে কিছু বলার উদ্বেগ, কিন্তু মুখ নির্বাক। পদ্ম সময় নষ্ট করলো না। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গেল।

(চলবে)
________________

#জলে_ভাসা_পদ্ম
#পর্ব: ০১লেখা: ইফরাত মিলি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here