জান্নাহ্ “পর্বঃ১৭

0
4911

#জান্নাহ্
#পর্বঃ১৭
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

লাগাতার রিং বেজে যাচ্ছে জান্নাহ্ এর মোবাইলের।কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না।অসহনীয় গরম আরো অসহনীয় হয়ে উঠলো সারহানের জন্য।ঝিমঝিম করছে তার শরীর।রুমজুড়ে পায়চারী করছে সে।প্রশ্বস্ত দুই চোখের পাতায় যেনো অগ্নি ঝরছে।কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে উষ্ণ জলের প্রস্রবণ।রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে সারহানের।

অবাক দৃষ্টিতে সারহানকে দেখছে শ্রীজা।অস্থিরতা দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে সারহানকে।দাঁত মুখ খিঁচে বিড়বিড় করে যাচ্ছে।ওপাশে কল রিসিভ হতেই খিস্তি মেরে উঠে সারহান–

“কোথায় ছিলেন আপনি?কল কেন রিসিভ করছিলেন না?

ছোট্ট দম নেয় জান্নাহ্।নরম গলায় প্রত্যুক্তি করে বললো–

“সরি,তিতির শরীরটা ভালো নেই।সকাল হতেই গা গরম ছিলো।কিছুই খেতে চাইছিলো না।দুপুরে একটু জোর করে খাইয়েছিলাম।আর তারপরই গরগর কর সব উগরে দেয়।খুব কাঁদছিলো।কারো কাছেই যাচ্ছিলো না।ওকে ঘুম পাড়াতে গিয়েই দেরি হয়ে গিয়েছে।”

সারহান কপাল ভাঁজ করে উদ্বেলিত গলায় বললো–

“এখন কী অবস্থা?ডক্টরের কাছে নিয়েছে?

জান্নাহ্ নিরুদ্বেগ গলায় বললো-

“নাহ।এখন ঘুমোচ্ছে।আপু বললো ঘুম থেকে উঠলে যদি খারাপ কিছু দেখে তাহলেই ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবে।”

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সারহান।তার দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে শ্রীজা।অপ্রস্তুত হয়ে সারহান।ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের প্রাঙ্গনে আসে।তপ্ত সূর্য তার আগুন যেনো উগরে দিচ্ছে।কোমল গলায় প্রশ্ন করে সারহান—

“আপনি খেয়েছেন?

“জ্বী।”

আরো বেশ কিছু সময় কথা চলতে থাকে তাদের।নিজের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে হতাশ চোখে চেয়ে থাকে শ্রীজা।সারহান গরম সহ্য করতে পারে না।কিন্তু গনগনে মধ্য দুপুরের প্রভাকরের হিংস্র তাপে সারহানের কপাল বেয়ে ঝরছে ঘাম।এডাম’স অ্যাপেলের নিচটায় জমেছে মুক্তোর দানার মতো নোনতা জল।ফোল্ড করা লোমশ হাত দুটোর মধ্যে চিকচিক করছে সেই ঘাম।লালচে আভায় রাঙিয়ে যায় সারহানের ফর্সা মুখ।চোখের পাতায় টপকে পড়া উষ্ণ জল মুছে নেয় হাতের উল্টো পাশ দিয়ে।নাকে চোখে ব্যক্ত হয় অস্বস্তি।অধরের কোণ প্রসারিত করে এক চোখ ক্ষীন করে সূর্যের দিকে তাকায় সারহান।চোখ বুজে আসে তার।একটা ঠান্ডা বাতাস আসতেই বেখেয়ালিভাবে নিজের শার্টের কলারটা পেছন দিকে ছড়িয়ে দেয় সারহান।তবুও মুখে উচ্ছল হাসি।নিচের দিকে তাকাতেই দেখে ধূলো উড়ানো প্রাঙ্গনে তার ছায়ামূর্তি।সারহান সেদিকে দৃষ্টি ক্ষেপন করে জান্নাহ্ এর সাথে কথা বলায় ব্যস্ত।নিজের ছায়া দেখে স্মিত হাসে সারহান।পৃথিবীর সবাই সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেও এই ছায়া কখনো তার মালিককে ছেড়ে যায় না।

শ্রীজার ধমনীতে বহমান রক্তকণিকা সরব হয়ে উঠে মুহুর্তে।একটু পরই র্্যাশ দেখা দিবে সারহানের।এই উত্তপ্ত সূর্যের সরাসরি বেগুনি রশ্মি বেশিক্ষন হজম করতে পারে না সারহান।কিন্তু আজ দিব্যি সেখানেই দাঁড়িয়ে কথা বলে যাচ্ছে।ভীত হয় শ্রীজা।তাহলে কী সারহান সত্যি সত্যিই জান্নাহ্কে ভালোবাসে!

রুমে এসেই ওয়াশরুমে ঢুকে সারহান।পানির ঝাপটা মেরে শীতল করে নিজেকে।তার দিকেই নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্রীজা।আয়নায় সামনে দাঁড়াতেই দেখে গলার আর মুখের বিভিন্ন জায়গা লাল লাল হয়ে আছে।বিগলিত হাসে সারহান।রজনীগন্ধার জন্য এইটুকু কষ্ট তো সহ্য করাই যায়।শ্রীজা হেয়ালি গলায় অভিমান নিয়ে বললো–

“জান্নাহ্ এর প্রতি ঝুঁকে যাচ্ছো তুমি।”

বিক্ষিপ্ত হাসে সারহান।সরব গলায় বললো–

“এইটাতো হওয়ারই ছিলো।আমার রজনীগন্ধা সে।”

শ্রীজা দমদমে গলায় বললো–

“ভালোবাসো ওকে?

স্মিত হাসে সারহান।রহস্যচ্ছলে বললো—

“ভালো তো আমি তাকে বেসেছি যার চোখের ধারালো চাহনিতে আমি খুন হয়েছি।”

পরম আবেশে চক্ষু মুদন করে সারহান।তার মানসপটে ভেসে উঠে দুটো চোখ।হাস্যোজ্জ্বল চেহারার সেই চঞ্চলা কিশোরীর দুই চোখ।তার চোখে কিছু একটা ছিলো।নব যৌবনা সেই কিশোরী বারবার ফিরে দেখছে শ্রান্ত,ঘামার্ত, চিন্তিত সারহানের দিকে।তার পরনের বাদামী আর নীলের মিশেলের চেক শার্টের মাঝে থোকা থোকা রক্তের ছাপ।কিশোরীটি তার নরম কিশলয়ের মতো ওষ্ঠাধর কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে হাসছে।কোমরে ছড়ানো রেশম কালো চুল নড়ছে তার বারবার ফিরে চাওয়াতে।একটা হাঁটু ছাড়ানো ফ্রক পরা।মোজাবিহীন দুই ফর্সা পায়ে স্কেকার্স পরা।বেখেয়ালিভাবেই সারহান তাকায় সেই কিশোরীর দিকে।কিশোরী হাসছে।তার হাসিতে মুক্তো ঝরছে।সারহান সেই হাসিতে ঘায়েল হয়।ক্লান্ত চোখ আর পরিশ্রান্ত দেহে কিশোরীর দিকে তাকাতেই সারহানের হৃদকম্পন থেমে যায়।কিশোরীটি তার পাশে থাকা বলিষ্ঠ মানুষটির হাত চেপে ধরে এগিয়ে যাচ্ছে।আর সারহানকেই দেখে যাচ্ছে।চোখের আড়াল হওয়ার আগ পর্যন্ত সেই চোখেই হারিয়ে যায় সারহান।তার মৃত্যু দেখে সে ওই চোখে।এক ভয়ংকর,তৃপ্তিকর ঐশ্বরিক মৃত্যু।
,
,
,
ফাঁকা রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি হাঁটছে জান্নাহ্ আর রাফাত।জান্নাহ্ দ্বিধান্বিত হয়ে তাকায় রাফাতের দিকে।রাফাত সোজা দৃষ্টি রেখে আনমনে হেঁটে চলছে।নিরুদ্বেগ,নিরুত্তাপ।গরমে টিশার্ট গায়ের সাথে ল্যাপ্টে আছে।তবুও ভাবলেশহীনভাবে হেঁটে চলছে সে।কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ধীরপায়ে তার সাথেই এগিয়ে চলছে জান্নাহ্।আকাশ ভেসেছে ফিকে নীলাভ রঙে।দূরের আকাশে উড়ে চলছে নীড়ে ফেরা পাখি।কেউ কথা বলছে না।

রহস্য হাসলো রাফাত।দুলে দুলে চলছে সে।তার এই অবস্থা দেখে ভ্রু ক্রুটি করে জান্নাহ্।থম মেরে দাঁড়িয়ে যায় সে।কপট রাগ নিয়ে বললো–

“হাসছো কেন?

আওয়াজ করে হেসে উঠে রাফাত।দাঁত কিড়মিড় করে জান্নাহ্।জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বললো—

“হাসি বন্ধ করো মিয়া খলিফার চামচা।”

হাসি বন্ধ করে ড্যাবড্যাব করে তাকায় রাফাত।পদযুগল তার স্থির হয়েছে আগেই।কপট বিস্ময় নিয়ে বললো–

“ছিঃ!কী বললে তুমি?

জান্নাহ্ প্রাণখুলে হাসে।সেই হাসিতেই উৎফুল্ল হয় রাফাতের হৃদযন্ত্র।অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে জান্নাহ্ বললো–

“তুমি হাসি বন্ধ করলে না ক্যান!

“বড্ড পেকে গেছো তুমি।”

“তা তো অবশ্যই।”

রাফাত মিচকি হেসে ফিচেল গলায় বললো–

“হ্যাঁ।লাল টসটসে।”

জান্নাহ্ নাক ফুলিয়ে বললো–

“বেহুদা রাফাত।”

গা দুলিয়ে হেসে উঠে রাফাত।ছোটবেলা থেকেই একদম বন্ধুর মতো সম্পর্ক রাফাত আর জান্নাহ্ এর।জান্নাহ্ যতটা না নিজের দেহ সম্পর্কে অবগত তার চেয়ে বেশি রাফাত তা নিয়ে তটস্থ।শিশু থেকে কিশোর জীবনে পদার্পনের প্রথম ধাপ অতিক্রম করে জান্নাহ্ রাফাতের হাত ধরে।তার প্রথম মান্থলির সময়টাও রাফাত ছিলো জান্নাহ্ এর সাথে।তাকে বুঝিয়েছে তার শারীরিক পরিবর্তনের কারণ,তার প্রয়োজনীয়তা।তাই তাদের মধ্যে সম্পর্কটা অন্যান্য বন্ধুত্বের থেকেও গভীর।তাদের সম্পর্কের গভীরতা বোঝার আগেই নতুন সম্পর্ক তৈরি হয় যা সম্পর্কে রাফাত সপ্রতিভ থাকলেও জান্নাহ্ ছিলো অজান্তা।সেই সম্পর্কের মানে তখন বুঝতে পেরেছে জান্নাহ্ যখন তার জীবনে সারহান আসে।

বিরসমুখে রাফাত বললো–

“বড্ড বেখেয়ালি ছিলে ।কিন্তু এখন!
নিজেকে সামলে নিয়েছো।বড় হয়ে গেছো তুমি।ছোট্ট রেড চেরি আজ…।”

ফোঁস করে এক শ্বাস ফেললো রাফাত।তার রেড চেরি আজ অন্য কারো।ভাবতেই গা গুলিয়ে আসে তার।ভালোবাসা তো ছিলো না তাদের মধ্যে।তবুও ছিলো কিছু একটা।ছিলো একে অন্যের সাথে পথ চলার অঙ্গীকার,ছিলো পাশাপাশি থাকার চেষ্টা,ছিলো এক জনের সুখে অন্যজন হাসার আর এক জনের দুঃখে অন্যজন কাঁদার।আজ সব বদলে গেলো।বুকটা ভারি হয়ে আসে রাফাতের।চোখ ভরে আসে তার।নিজেকে দোষী মনে হয়।কেন গেলো সে তার রেড চেরি কে ছেড়ে?কেন গেলো সে?

দূরে দাঁড়ানো জাবিন কে দেখতে পায় জান্নাহ্।তাকে দেখেই এগিয়ে আসে জাবিন।হালকা গলায় বললো-

“তুমি এখানে?

জান্নাহ্ নির্মল গলায় রাফাতকে দেখিয়ে বললো–

“উনি আমাদের স্যার।”

সরস হাসে জাবিন।রাফাতকে সালাম দেয়।মোলায়েম গলায় তার প্রত্যুত্তর করে রাফাত।কিন্তু জান্নাহ্ এর দিকে তাকিয়ে রাগাম্বিত গলায় বললো—

“তোমাকে না রিক্সা করে আসতে বলেছি।সারহান টাকা দিয়ে যায়নি?

জাবিনের কথায় বিরক্ত হয় জান্নাহ্।তপ্ত গলায় বলে উঠে–

“জাবিন!

জাবিন অনুতপ্তের সুরে বললো–

“সরি।”

কিছু একটা আন্দাজ করতে পারলেও তা সম্পর্কে কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো না রাফাত।শীতল গলায় বললো–

“ওকে।আমি যাচ্ছি তাহলে।”

রাফাত যেতেই কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে জাবিন—

“ওই স্যার তোমার সাথে আসলো কেন?

জান্নাহ্ অতি স্বাভাবিক গলায় উত্তর দেয়–

“স্যার হ্যায়ার ম্যাথের টিচার।কিন্তু পেশায় কী জানো?ডক্টর।”

মিটমিটিয়ে হাসে জান্নাহ্।ভ্রু নাচিয়ে জাবিন বললো–

“হাসার কী?সাইন্স নিয়ে পড়লে যদি হ্যায়ার ম্যাথ না পড়ে তাহলে পড়ার দরকারটা কী!

“আই সী।তুমি এখানে কেন?কোচিং নাই?

জাবিন নির্বিঘ্ন গলায় বললো–

“যাইনি।পড়ালেখা করে কী হবে?শেষে তো ওই নানাভাইয়ার আড়তে বসতে হবে।সারহানের মতো তো আর দুনিয়া ঘুরে বেড়াতে পারবো না।”

দূর্বল হাতে এক চাটা মারে জাবিনের মাথায় জান্নাহ্।ভারি গলায় বললো–

“তুমি দিনদিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছো জাবিন।মামার নাম ধরে কেন বলো তুমি?

জাবিন ফিচেল হেসে রসালো গলায় বললো–

“তাহলে তুমিও আমাকে আপনি করে বলো।আমি তো বয়সে তোমার থেকে বড় ই।”

“ইশশ!এসেছেন বুড়ো খোকা।ভাগো।”

খলখল করে হেসে ফেলে জাবিন।কথাবার্তায় প্রায় বাড়ির কাছে চলে আসে তারা।জাবিন জান্নাহ্কে একাই যেতে বলে।কারণ অন্তরা তাদের একসাথে দেখলে আবার ক্ষেপে যাবে।

বাড়ির ভেতরে পা রাখতেই দৌঁড়ে আসে তিতি।উচ্ছলিত সে।জান্নাহ্ মাথা থেকে নেকাবটা খুলতেই ঝরা হাসে তিতি।জান্নাহ্ এর ঠোঁটে টুপ করে চুমু খায় সে।অতি উৎসাহের সাথে বললো–

“পরীমা,এসো এসো।”

জান্নাহ্কে হাত ধরে ভেতরের দিকে নিয়ে আসে তিতি।তাকে দেখেই মুখ বাঁকায় অন্তরা।তার কঠিন চেহারা দেখে জান্নাহ্ এর উজ্জ্বল চেহারা মুহূর্তেই ম্লান হয়ে যায়।একটা চিকন সুরে চোখ তুলে তাকায় জান্নাহ্।

“কেমন আছো জান্নাহ্?

ভ্রু জোড়া চড়িয়ে উচ্ছ্বসিত গলায় জান্নাহ্ বললো–

“তুমি!
তুমি কখন এলে?

মেয়েটি মিষ্টি হেসে বললো–

“এইতো একটু আগেই।”

জান্নাহ্ জড়িয়ে ধরে শক্ত করে মেয়েটিকে।প্রফুল্ল কন্ঠে বললো–

“অনেক ভালো হয়েছে তুমি এসেছো।এইবার খুব মজা হবে।”

“হুম।”

নিধি,সেরাজের ছোট বোন।অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা শেষ হওয়ায় হোস্টেল থেকে ফিরে এসেছে।এখন এখানেই থাকবে।সবাই খুশি হলেও জমির বেশি খুশি হতে পারলেন না।সারহানের সাথে নিধির বিয়ে দিতে চেয়েছিলো অন্তরা।কিন্তু সারহান রাজি হয়নি।অবশ্য এতে করে তাদের সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন আসে নি।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here