জান্নাহ্ “পর্বঃ২৪

0
3837

#জান্নাহ্
#পর্বঃ২৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

গুমোট অন্ধকার সরিয়ে প্রস্ফুটিত হচ্ছে স্বচ্ছ দিনের আলো।ঠান্ডা ঠান্ড হাওয়া বইছে।দুই একটা পাখি উড়ে যাচ্ছে শুভ্র নীলাভ আকাশে।সূর্যের শিশু রোদের আলোয় অবগাহনে ব্যস্ত জান্নাহ্।মিষ্টি হলুদ রোদে জান্নাহ্ এর ফর্সা রঙ চিকচিক করছে।ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয় জান্নাহ্।এখান থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়।হঠাৎ করে এক পাশে থাকা লম্বা লম্বা পাতা ওয়ালা নারকেল গাছ থেকে কাকের কর্কশ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।চকিত হয় জান্নাহ্।কিন্তু তাতেই মনটা ঝিমিয়ে উঠে তার।

আজ এক সপ্তাহ হয়েছে ঢাকা এসেছে জান্নাহ্।গভীর ঘুমে রাতটা কোনোমতে কাটলেও দিনটা থাকে বিষাদে ভরা।সারহান সারাদিন বাইরে থাকে।সেই রাতে ফেরে। বাসায় ফিরেই খাওয়া দাওয়া করে নিজের অফিসিয়াল রুমে গিয়ে বসে।কিছুক্ষন সেখানে কাজ করে ড্রয়িং রুমে গিয়ে কাউচেই শুয়ে পড়ে।এখান আসার পর বেড রুমে জান্নাহ্ একাই ঘুমাই।এর কোনো কারণ না জান্নাহ জানতে চেয়েছে না সারহান বলেছে।

ঠোঁট গুঁজ করে জান্নাহ্।একদম ভালো লাগছে না।একা থাকা বিষন কষ্ট।যা জান্নাহ্ বিয়ের আগেই উপলব্ধি করেছে।এই পরিবারের কোনো মানুষের প্রতি তার ক্ষোভ নেই।বরং এক সমুদ্র ভালোবাসা।প্রতিটা মানুষ তাকে ভালোবাসে।জমির তাকে নাম ধরে ডাকে যেমনটা একজন বাবা তার মেয়েকে সম্মোধন করে।শুভ্রা বড় বোনের মতো।জাবিন ভাই তো বলা যাবে না তবুও সে অন্যরকম।সেরাজের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কখনো জান্নাহ্ কথা বলে না।সে কখনো খারাপ কিছু আঁচ করতে পারে নি।মাঝে মাঝে অপ্রস্তুত মুহূর্তের সামনা সামনি হতে হয় যা জান্নাহ্ এর কাছে দূর্ঘটনা মনে হয়।আর হলো ছোট্ট তিতি।একটা পুতুল তার কাছে।ওই মেয়েটা না থাকলে তার ওই বাড়িতে থাকাটাই দায় হয়ে যেতো।আসার দিন জান্নাহ্ এর ওড়না ধরে সে কী কান্না!ঢাকা আসার পরও তিতির কথা ভেবে ঘুমাতে পারে নি জান্নাহ্।কয়েকবার কল করার পরও অভিমানে কথা বলতে চায়নি তিতি।জান্নাহ্ বোঝে না,এই মেয়েটা এতো কেন ভালোবাসে তাকে!
কাঁদতে কাঁদতে বললো,”পরীমা তুমি ভালো না।তুমিও উড়ে গেলে।মামুনি বলতো পরীরা নাকি উড়ে চলে যায়।আর ভালো মানুষদের নিয়ে যায়।আমিও তো ভালো।তোমার মিত্তি তিতি।আমাকে নিয়ে গেলে না কেন?
জান্নাহ্ সহ্য করতে পারে নি।একদম পারে নি।বিলাপ করে কেঁদেছিলো সেদিন।যেমনটা সে তার চোখের সামনে তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষের লাশ দেখে কেঁদেছিলো।কেন হয় জীবনটা এমন!প্রিয় মানুষগুলো কেন ছেড়ে চলে যায়!

জান্নাহ্ এর চোখ থেকে অবাধ্য শ্রাবণের বর্ষণ শুরু হয়।ব্যস্ত হয়ে তা মুছে নেয়।সে তার অতীতকে ভুলতে চায়।বর্তমানকে নিয়ে বাঁচতে চায়।অন্তরার উপর কোনো রাগ নেই জান্নাহ্ এর।তাকে সে মায়ের আসনে বসিয়েছে।নিজের মায়ের চেয়েও একসময় বেশি খেয়াল রেখেছে অন্তরা তার।কিন্তু অন্তরার এই বিরূপ ব্যবহারের জন্য কোথাও না কোথাও সারহান দায়ী।

ঝলমলে আলোয় ভরে গেছে চারপাশ।সূর্যের প্রখরতা বাড়তে লাগলো।উষ্ণ হতে লাগলো পরিবেশ।ঘড়ির কাটাও নিজ গতিতে এগিয়ে চলছে।জান্নাহ্ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।তাকে নাস্তা বানাতে হবে।একটু পরই সারহান উঠে যাবে।জান্নাহ্ তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসে।এই জন্যই হয়তো সারহান তাকে আনতে চায় নি কখনো নিজের কাছে।সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর শ্রান্ত,পরিশ্রান্ত দেহ নিয়ে ফিরে তেমন একটা কথা বলারও সময় পায় না সারহান।নিজের প্রয়োজনীয় কাজ শেষে ঘুমে ঢলে পড়ে সে।
ব্যলকনি থেকে ঘরে আসে জান্নাহ্।রুম থেকে বের হতেই দেখে কাউচে উপুর হয়ে শুয়ে আছে সারহান।উষ্ণতার বলয় ঘিরে ধরে তাকে।নীল রঙের পাতলা টিশার্টটা ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে।পিচ কালারের ঠোঁটদুটো ঠেস দিয়ে আছে কাউচে।কপাল আর ভ্রু উষ্ণ নোনতা জলে সিক্ত।ঠোঁটের নিচে চিবুকের উপরিভাগের খাদের জায়গাটুকুও স্যাঁতসেঁতে।একদম বাচ্চাদের মতো লাগছে যেনো খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে জান্নাহ্।সারহান গরম সহ্য করতে পারে না।তবুও যখন থেকে জান্নাহ্ এসেছে তাকে এসি রুমে দিয়ে এই উষ্ণ ফ্যানের বাতাসেই চোখ বুজে সে।এই লোকটাকে জান্নাহ্ কখনো বুঝতে পারে না।

রান্না ঘরের ঝাঁঝালো গ্যাসে চোখ-মুখ কুঞ্চি করে সারহান।গলায় খুসখুসে কাশি শুরু হয়।বিরক্তকরা চোয়ালের ঘাম মুছেই গরগরে গলায় বলে উঠে—

“রজনীগন্ধা,এটাচ ফ্যানটা ছাড়ুন।”

নিমিঝিমি চোখ নিয়ে উঠে বসে সারহান।ঘাড়ের পেছনের দিকটা ভীষন ব্যাথা করছে। সারহানের জোরালো আওয়াজে চঞ্চল পায়ে রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে জান্নাহ্।অনুযোগের সুরে বললো–

“সরি,সরি।আমার খেয়াল ছিলো না।”

সারহান ভারি গলায় আবেগ ঢেলে বললো—

“দিলেন তো আমার ঘুমটা ভাঙিয়ে।এদিকে আসুন।”

জান্নাহ্ সারহানের পাশে এসে বসে।তার কোলেই ক্লান্ত দেহটা এলিয়ে দেয় সারহান।নিজের ওড়না দিয়ে সারহানের ভেজা মুখটা মুছে দেয় জান্নাহ্।জান্নাহ্ এর ভেজা চুল দেখে সন্দিগ্ধ গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে সারহান—

“এতো সকালে গোসল করলেন যে?

“গরম লাগছিলো।”

ফিচেল হেসে ক্ষীন গলায় সারহান বললো—

“এসি রুমে থেকেও এতো গরম!আপনার উষ্ণতায় না আমি গলে যাই।
তা কী রান্না করছিলেন?

জান্নাহ্ সহজ গলায় বললো–

“তেমন কিছু না।কাল রাতের যে বাড়তি ভাত ছিলো তা পিঁয়াজ,মরিচ কুচি করে ডিম দিয়ে ভেজেছি।আর ডিমের সাথে দুধ,চিনি গুলিয়ে পাউরুটি ভেজেছি।”

সারহান নরম গলায় বললো—

“সকাল,সকাল তেল খাইয়ে আমাকে মারার পদ্ধতি।”

“ঘরে তো আর কিছু নেই।”

“ফ্রীজে ফ্রুট ছিলো।”

“আপনি বসুন আমি কেটে দিচ্ছি।”

সারহান মৃদু গলায় বললো—

“লাগবে না।আপনাকে এইসব রান্না কে শিখিয়েছে।”

জান্নাহ্ খুশি খুশি গলায় বললো–

“আমার বাবা।”

সারহান ফট করে হেসে ফিচেল গলায় বললো–

“শশুর মশাই কী বাবুর্চি ছিলো নাকি?

জান্নাহ্ ঠোঁট বাঁকিয়ে তীর্যক গলায় বললো–

“নাহ।রাজমিস্ত্রি ছিলো।”

সারহান রসালো গলায় বললো—

“তাই তো বলি আমার মিষ্টি বউটা এতো পার্ফেক্ট কেন!

জান্নাহ্ ভ্রু কুঞ্চি করে বললো—

“হঠাৎ বাবার কথা জিঙ্গেস করছেন কেন?

আচমকা সারহান জান্নাহ্ এর দুই পাশে হাত রেখে তার মুখের কাছে গিয়ে সরল চোখে তাকিয়ে রহস্য গলায় বললো–

“আমি কিন্তু আপনাকে ঠিকই চিনতে পেরেছি রজনীগন্ধা।আর সুযোগও দিয়েছি।আপনি তা কাজে লাগান নি।এইবার কিন্তু আমি আপনাকে ছাড়ছি না।”

সারহানের তপ্ত নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে জান্নাহ্ এর অধরে।হতবুদ্ধি জান্নাহ্ ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।সারহান গভীর গলায় বললো—

“যান,তৈরি হয়ে নিন।আপনাকে আজ বাইরে নিয়ে যাবো।”

“আপনার অফিস?

“আজ অফ।”

“কোথায় নিয়ে যাবেন?

“গেলেই দেখতে পাবেন।”
,
,
,
একটা ক্যাফেটেরিয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সারহানের গাড়ি।স্তব্ধ হয়ে বসে আছে জান্নাহ্।একরাশ অনুতপ্ততা তার মনে।সারহান দীর্ঘশ্বাস ফেললো।অনুরক্তির সুরে বললো–

“আপনার একটুও ভরসা নেই আমার উপর?

জান্নাহ্ ক্ষীন শ্বাস ফেললো।কিন্তু কথা বললো না।সারহান বিতৃষ্ণা গলায় বললো–

“আমি ব্যর্থ স্বামী।আমার স্ত্রীর পার্সোনাল ইস্যুও আমাকে অন্যের কাছ থেকে জানতে হয়।”

নড়ে উঠে জান্নাহ্।আহত গলায় বললো—

“সারহান আমি…।”

সারহান শক্ত গলায় বলে উঠে–

“আমাকে বিশ্বাস করা যায় না রজনীগন্ধা?

জান্নাহ্ চুপ করে রইলো।পিরিওড চলাকালীন মুহুর্তওগুলো অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে পার করে জান্নাহ্।কিন্তু সারহানকে কখনো বলা হয়নি।শুভ্রা সারহানকে জানিয়েছে।একটু আগেই গায়নোকলোজিস্ট এর কাছ থেকে ফিরেছে তারা।

“নিন,কী খাবেন অর্ডার করুন।”

মেনু কার্ড দেখে জান্নাহ্ বলতে থাকে—

“বার্গার,শর্মা,চাউমিন,লাচ্ছি,ক্যাপিচেনো আর….।”

ব্যস্ত হয়ে বলে উঠে সারহান–

“এতো কিছু খাবেন কী করে?

জান্নাহ্ ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো–

“চেখে দেখবো।”

সারহান হাস্যোজ্জ্বল গলায় বললো—

“আমাকে ফকির বানানোর ধান্দা।”

“খোঁটা দিচ্ছেন কেন?

বিগলিত হাসে সারহান।জান্নাহ্ চোরা হাসে।ফরমাল ড্রেসে আরো বেশি সুদর্শন লাগে সারহানকে।তার তীক্ষ্ম চোখ জোড়াই সবচেয়ে ভয়ংকর।জান্নাহ্ এর ভয় হয়।একবার তাকিয়ে সে জীবনেয সবচেয়ে বড় ভুল করেছে দ্বিতীয়বার আর কোনো ভুল সে করতে চায় না।সারহানের পিচ কালারের ঠোঁট দুটো আনমনেই নড়ছে।হঠাৎ বলে উঠে–

“রজনীগন্ধা!

জান্নাহ্ অস্ফুট আওয়াজে বলে–

“হু।”

সারহান কোমল গলায় বললো–

“আপনি বসুন আমি আপনার মেডিসিন গুলো নিয়ে আসি।পাশেই মেডিসিন শপ।আমার পরিচিত।”

“আচ্ছা।”

ওয়েটার খাবার দিয়ে যায়।জান্নাহ্ বার্গারে কামড় বসাতে গেলেই দেখে দূরে দাঁড়ানো লাল ক্যাপ আর লাল টিশার্ট পড়া একটা ছেলে তার দিকে সুতীক্ষ্ম চোখ দিয়ে তাকিয়ে আছে।তাতে জান্নাহ্ এর কোনো ভাবাবেশ হলো না।সে খাওয়ায় ব্যস্ত।কপাল ঘামতে শুরু করে জসিমের।তার কেন যেনো মনে হলো এই মেয়েটাকে সে কোথাও দেখেছে।কোথায়?কিছু একটা মনে পড়তেই ঝনঝনিয়ে উঠে জসিমের শরীর।চোয়াল শক্ত হয়ে আসে তার।ভালো করে জান্নাহ্কে দেখার চেষ্টা করছে সে।এর মধ্যেই সারহান এসে বসে।তাতে করে জান্নাহ্ এর ছোট্ট মায়াবী মুখটা আড়ালে চলে যায়।জসিম কম্পিত পায়ে উদাস দৃষ্টিতে সামনে এগুতে থাকে।ইহতিশামের কার্ডটা ধীরেসুস্থে বের করে বুক পকেট থেকে।
জান্নাহ্ সবেই শর্মাতে কামড় বসিয়েছে।কিন্তু আধ সেদ্ধ মাংসের গন্ধ নাকে আসতেই গা গুলিয়ে উঠে তার।গরগর করে বমি করে সব ভাসিয়ে দেয়।ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়ে সারহান।জান্নাহ্ এর এই অবস্থায় সেখানে আগত আরো কিছু কাস্টমার এগিয়ে আসে।জটলায় প্রায় কাছাকাছি চলে আসে জসিম।ওপাশ থেকে ইহতিশাম কল রিসিভ করতেই পাশ দিয়ে যাওয়া হুডি পড়া একটা লোকের সাথে ধাক্কা খায় জসিম।তাকে সরি বলে হ্যালো বলতেই যেই হাতের সাথে লোকটার ধাক্কা লেগেছিলো সেই হাতের কনুইয়ের ভাঁজে চুলকানি শুরু হয়।জসিম চোখ-মুখ বিকৃত করে জোরালো হাতে তা চুলকাতে থাকে।মুহুর্তেই তা লাল হয়ে শক্ত চাকার মতো হয়।নিঃশ্বাস ভারী হতে থাকে জসিমের।নিচে লুটিয়ে পড়ে সে।মৃগী রোগীর মতো তড়পাতে থাকে।ততক্ষনে সারহান জান্নাহ্কে নিয়ে ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেরিয়ে আসে।সেখানের অন্যান্য ইমপ্লয়িরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে জসিম কে নিয়ে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here