#জান্নাহ্
#পর্বঃ২৫
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
প্রায় দুই ঘন্টা ধরে ক্যাফেটেরিয়াতে বসে আছে ইহতিশাম।পুরো ক্যাফে নিথর,নিস্তব্ধ।দু’দুটো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় আজকের জন্য ক্যাফে বন্ধ করে দেয় ম্যানেজার।ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে বাকিরা।জসিমের অবস্থা ভয়ংকর।পুরো শরীর ফুলে গিয়ে একটা আলুর বস্তা তৈরি হয়েছিলো।দ্রুত তাকে হসপিটালে নেওয়া হয়।ভাগ্য ভালো সুপ্রসন্ন বলে এ যাত্রায় বেঁচে যায় জসিম।কিন্তু সম্পূর্ণ প্যারালাইজড সে।জসিমের শরীরে বিষাক্ত সাপের বিষ ইনজেক্ট করা হয়।যাতে করে তার হৃদযন্ত্র স্পন্দন কমিয়ে দিতে থাকে।
ক্যাফেতে বসে ঈগল চোখ দুটি আবদ্ধ করে রেখেছে ইহতিশাম সামনে রাখা মনিটরে।ক্যাফের সিসি টিভির ফুটেজ প্লে করা।ক্যাফের সামনেই প্রশ্বস্ত মহাসড়ক।এমন একটা জায়গায় হঠাৎ করে ঝামেলা করা কোনো সাধারণ মানুষের কাজ নয়।কেউ তো আর সাথে করে পয়জন নিয়ে ঘুরে না।
ইহতিশাশ চোখ তুলে ক্যাফের পশ্চিম দিকে তাকায়।একদম কোনার দিকটায় ক্যামেরা লাগানো।এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় পুরো ক্যাফে।ইহতিশাশ হেলান দিয়ে আছে চেয়ারে।চিবুকের নিচটায় হাত ঠেকিয়ে গম্ভীর দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে।সারহান!সারহানকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।কিন্তু তার সাথের মেয়ের চেহারা নয়।ইহতিশাম আরেকটু খুঁটিয়ে দেখলো।তার সিক্স সেনস বলছে এইটা জান্নাহ্।ক্যামেরা যেখানে লাগানো জান্নাহ্ এর পিঠ টা ঠিক সেদিকে।তাই তার চেহারা বোঝার উপায় নেই।কিন্তু যেহেতু ইহতিশাম জান্নাহ্কে আগে দেখেছে তার চিনতে বেশি বেগ পেতে হলো না।
গোলযোগের মাঝেই জসিম আসছে।ইহতিশামে তীক্ষ্ম দৃষ্টি জসিমের অঙ্গভঙ্গিতে।ভীতসন্ত্রস্ত জসিমের শরীরের পরিবর্তিত মুখভঙ্গি ধরতে পারে ইহতিশাম।জান্নাহ্কে দেখে ভয়ে আড়ষ্ট সে।কিন্তু কেন?টনটন করে উঠে ইহতিশামের মস্তিষ্ক।ফুটেজটা পজ করে উঠে দাঁড়ায়।চতুর্থবারের মতো ক্যাফেতে চক্কর লাগায় ইহতিশাম।ক্যাফের বিশাল থাই বন্ধ।তাই বাইরের কোলাহল ভেতরে আসছে না।ইহতিশাম ছাড়া কেউ নেইও।ইহতিশাম সারহানের টেবিলের কাছে আসে।খাবারগুলো এখনো তেমন করে পড়ে আছে।মুচকি হাসে ইহতিশাম।এইটুকু মেয়ে কতো খাবার অর্ডার করেছে।জান্নাহ্ মেয়েটার চেহারাটা বড্ড মায়াবী।বেশ লাগে ইহতিশামের কাছে।ষোড়শী হলেও নবযৌবনা।জান্নাহ্কে দেখলে ইহতিশামের তার প্রিয়তমার কথা মনে পড়ে।মেয়েটাকে অনেকদিন হলো দেখা হয় না।আর এই ঝামেলাটাও শেষ হচ্ছে না।যত দ্রুত এই কেস সলভ হবে তত দ্রুত ইহতিশাম তার প্রিয়তমার কাছে ফিরে যাবে।
আবার এসে বসে ইহতিশাম চেয়ারে।উন্মুখ হয়ে এই নিয়ে দশবার দেখছে পনেরো মিনিটের এই ফুটেজ।ইহতিশাম খেয়াল করে সেই হুডি ওয়ালা লোক জান্নাহ্দের আগেই এসেছে।কিছু একটা ভেবে অন্যদিনের ফুটেজগুলোও দেখে।আচম্বিত হয় ইহতিশাম।এই লোক আরও এসেছে এখানে।কিন্তু কখনই তার চেহারা ক্যামেরাতে আসেনি।চকচক করে উঠে ইহতিশামের দুই চোখ।তাহলে কেউ না কেউ তো তার চেহারা দেখেছে।জসিমের দ্বারা আর কিছু বলা সম্ভব নয়।কারণ আপাতত সে কথা বলতে পারবে না কয়েক বছর।
কিন্তু ইহতিশামের মস্তিষ্ক জুড়ে টগবগ করছে এক বিদঘুটে প্রশ্ন।জান্নাহ্ কোনোভাবে জড়িত এই খুনের সাথে!
নাহ সারহান?সামিরা আর তিথির সাথে কিছু একটা ছিলো সারহানের তা সে সেদিন সারহানের গ্রামে গিয়েই বুঝতে পেরেছে।শুধু সামিরার কেস দেওয়া হলেও সিমিলার বলে তিতির কেসটাও নিজ দায়িত্বে হাতে নিয়েছে ইহতিশাম।
সামিরা আর তিথির নাম্বারে যে অচেনা নাম্বালগুলো থেকে কল আসতো তার বেশিরভাগ সারহানের বাড়ির কাছ থেকে।সামিরা সারহান যেই পত্রিকার জার্নালিস্ট তার চেয়ারম্যানের মেয়ে।ইহতিশামের মস্তিষ্ক নাড়া দিয়ে উঠে।সারহান কী এখনো সেই নেশায় আসক্ত!তা কী করে হয়!যদি তাই হয় তাহলে সারহান কিছুতেই বিয়ে করতো না।আর জান্নাহ্ এর মতো মিষ্টি একটা মেয়েকে বিয়ে করার পর অন্য কোন মেয়ে!
ইহতিশাম নিজের ভাবনাকে চড় লাগায়।কী ভাবছে এইসব সে!
কিন্তু যদি তাই হয় তাহলে কী এই খুন সারহান করছে!জান্নাহ থেকে কোনো কিছু লুকানোর জন্য!তাহলে জসিম জান্নাহ্কে দেখে ভয় পেলো কেন?এমন নয়তো সারহানের বিষয়ে জান্নাহ্কে কিছু বলতে চেয়েছে।কারন যে বা যারা খুন করেছে তারা সাধারণ খুনি হয়।এতো সহজভাবে সবটা সামলানো সবার পক্ষে সম্ভব না।যেখানে সারহান তুখোড় বুদ্ধি নিয়ে চলে।কিন্তু যদি সারহান এইসব করে থাকে তাহলে অন্য কাউকে ইনভলব সে কখনই করবে না।এই ধরনের রিস্ক নেওয়ার মতো ছেলে সে নয়।
বিশ্রি শব্দ বেরিয়ে আসে ইহতিশামের মুখ থেকে।কিছু বুঝতে পারছে না সে।কিছু করার আগে সারহানের সাথে কথা বলা জরুরি।একবার ভুল করে নিষিদ্ধ গলিতে ছুঁড়ে ফেলেছে সে সারহানকে দ্বিতীয়বার নয়।আর এখন সারহান একা নয়।তার সাথে আরো একজন জড়িয়ে আছে।কেনো যেনো মেয়েটাকে আপন মনে হয় ইহতিশামে।কোথাও সে দেখেছে জান্নাহ্কে।সত্যিইকে এই সে যাকে সে দেখেছিলো?
যদি তাই হয় তাহলে জান্নাহ্ এর কোনো ক্ষতি সে হতে দিবে না।
,
,
,
গুমোট অন্ধকারে এক চিলতে কৃত্রিম আলো হয়ে জ্বলছে নীল রঙের ডিম লাইট।ছোট্ট ছোট্ট দম ফেলছে জান্নাহ্।আকাশে জটলা মেঘ ডাকছে।ঝড় শুরু হবে বলে।জান্নাহ্ এর শরীরটা বড্ড ক্লান্ত।শুয়ে আছে সে বিছানায়।তার পাশেই বসে আছে সারহান।শীতল গলায় বললো—
“খেতে যখন পারবেন না অর্ডার কেন করলেন?আমাকে থালা ধরানোর ফন্দি!
জান্নাহ্ ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।সারহান অসহিষ্ণু গলায় আবেগ মিশ্রন করে বললো–
“হঠাৎ এমন হলো কেন?
জান্নাহ্ ক্ষীন গলায় বললো—
“জানি না।”
ফোঁস করে দম ফেলে সারহান।মোলায়েম গলায় বললো—
“এখন কেমন লাগছে?
“ভালো।”
চকিতে ফিচেল হাসে সারহান।জান্নাহ্ এর নাকের সাথে নাক ঘষে রসালো গলায় বললো–
“বমিটিং হলো কেন আপনার?এই আপনি প্রেগন্যান্ট না তো?অবশ্য তা হওয়ার কথা না।”
ঠোঁট গুঁজ করে জান্নাহ্।মৃদু ছন্দে হেসে উঠে সারহান।বেশ মজা পেলো নিজের কথায় সে।স্বাভাবিক গলায় বললো–
“ঘুমান।আজ আর রাতে কিছু খেতে হবে না আপনাকে।আমাকে পথে বসানোর পরিকল্পনা চলছে আপনার।দু’দুবার হসপিটালে দৌঁড়াতে হয়েছে আজ।”
সারহান উঠে দাঁড়ায়।তার হাত আকড়ে ধরে জান্নাহ্।অত্যন্ত কোমল গলায় বললো—
“আজ এখানেই শুয়ে পড়ুন।”
চোখে হাসে সারহান।শক্ত গলায় বললো—
“নারী দেহের উষ্ণতায় তো বরফও গলতে শুরু করে আর পুরুষজাতি তো হিংস্র হায়েনা।আপনার এখন রেস্টের প্রয়োজন রজনীগন্ধা।”
নিঃশব্দে তার হাত ছেড়ে দেয় জান্নাহ্।সারহান শুনবে না তার কথা।ড্রয়িং রুমে এসে পরিচিত সেই কাউচেই ধপ করে শুয়ে পড়ে সারহান।সারাদিনের ক্লান্ত দেহ কাউচের উষ্ণ স্পর্শ পেতেই আরো ভার হয়ে আসে।চোখ বুজে নেয় সারহান।তার সেই মুদিত চোখে ভেসে উঠে সেই কিশোরী দুই চোখ।সে হাসছে।শুধু হাসছে।মৃদু গলায় বলে উঠে সারহান–
“আমার বোকা রজনীগন্ধা।”
চলবে,,,