জান্নাহ্ “পর্বঃ৩১

0
3829

#জান্নাহ্
#পর্বঃ৩১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

জান্নাহ্ এর কোমল মুখে আলতো হাত দিয়ে তাকে ছুঁয়ে দেখছে শ্রুতি।এতোটা সন্তর্পনে যেনো কোনো মাখনে হাত লাগাচ্ছে যাতে একটু উষ্ণতার আঁচ লাগতেই গলে যাবে।ভোলা ভোলা দৃষ্টিতে জান্নাহ্কে দেখছে শ্রুতি।জান্নাহ্ এর ঠোঁট,চোখ,মুখ একটু একটু করে ছুঁইছে সে।শ্রুতির কাছে মনে হচ্ছে সে কোনো জীবন্ত পুতুলকে দেখছে।বাড়ন্ত বয়সের সাথে সাথে জান্নাহ্ এর রূপ খেলে উঠছে।

জান্নাহ্ মিষ্টি গলায় বললো–

“কেমন আছো শ্রুতি?

শ্রুতি কথা বললো না।দাঁতের সাথে দাঁত লাগিয়ে ঠোঁটের পাল্লা দুটো ফাঁক করে মিষ্টি করে হাসলো।যেমন করে আচমকা খুশিতে দুই তিন বছরের বাচ্চারা হাসে।এক মুহূর্তের জন্য জান্নাহ্ এর তিতির কথা মনে পড়লো।শ্রুতি চোখ ছোট ছোট করে হাসছে।কোনো কথা বলছে না।আজ কমলা রঙের একটা ফ্রক পড়েছে শ্রুতি।বয়সের তফাৎ না হলেও জান্নাহ্ আর শ্রুতির মধ্যে বিস্তর ফারাক।অবশ্য হওয়ারই কথা।যে মানুষকে আমরা সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করি সেই মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষত বিক্ষত করে।শ্রুতির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।গ্রামের এক ছেলেকে ভালোবেসেছে সে।তার হাত ধরে কিশোরী শ্রুতি ভালোবাসার টানে পালিয়ে এসেছে।ভেবেছিলো ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে ছোট্ট সংসার হবে।হয়েছিলো কিন্তু তা হিংস্র দানবদের নিয়ে।যারা তাকে খুবলে খেয়েছে।শ্রুতি স্বাভাবিক হলেও মেন্টাল ট্রমা এখন তাকে একটা বাচ্চা বানিয়ে দিয়েছে।

দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে শ্রুতি।গোল গোল চোখ করে জান্নাহ্কে দেখে।ভালো লাগে তার।জাদুর কাঠির মতো আঙুল দিয়ে আলগোছে ছুঁয়ে দেয় জান্নাহ্কে।আপ্লুত হয় সে।জান্নাহ্ এর ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়াতে থাকে।জান্নাহ্ অধর প্রসারিত করে হেসে হেসে বললো—

“এইটা পছন্দ তোমার?

শ্রুতি মাথা উপর নিচ করে সম্মতি দেয়।জান্নাহ্ তার পার্স থেকে দুটো লিপস্টিক নিয়ে শ্রুতির হাতে দেয়।সারহান বলেছিলো শ্রুতির পছন্দ অনেকটা তিতির মতো।খুশিতে ঝুমঝুমিয়ে হাসে শ্রুতি।যেনো সে অনেক আকাঙ্ক্ষীত বস্তু পেয়েছে।জান্নাহ্ ধীর গলায় আবার বললো–

“আর কী চাই তোমার?

শ্রুতি তার গলা থেকে চিবুকটা একটু আলগা করে চোখ দুটোকে বড় বড় করে ইশারা করে।জান্নাহ্ বোঝে না।তাই সে নিজের চোখে হাত দিয়ে দেখায়।শ্রুতি না করে।জান্নাহ্ তার কানের কাছে হাত নিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করতেই ফিক করে হেসে ফেলে শ্রুতি।জান্নাহ্ নির্মল হাসে।কান থেকে হোয়াইট পার্লের দুলটা খুলে শ্রুতির কানে পড়িয়ে দেয়।দুই কানে হাত দিয়ে উচ্ছল হাসে সে।জান্নাহ্ও হাসে।

শ্রুতির পায়ের কাছেই অনেকগুলো আর্ট পেপার আর রঙ।পেন্সিল রঙের পাশাপাশি পেস্টাল রঙও আছে।শ্রুতি ভালো ছবি আঁকতে পারে।এনজিও তে হাঁটার সময় যখন যা দেখে তার মধ্যে কিছু ভালো লাগলেই তা আঁকে।জান্নাহ্ সেই ছবিগুলো দেখতে থাকে।কিন্তু একটা ছবিতে তার চোখ আটকে যায়।কেউ একজন কাউকে জড়িয়ে ধরে আছে।জান্নাহ্ এর চোখের পাল্লা প্রশ্বস্ত হতে থাকে।আর জমতে থাকে প্লাবন।কারণ ছবিটা আর কারো নয় সারহানের।সারহান যাকে জড়িয়ে ধরে আছে তার পিঠের উপর যেই হাত তাতে ব্রেসলেট পড়া।আর ব্রেসলেট টা সারহানের।যেখানে ব্রেসলেটের সাথে একটা লেটার এস এর মাঝে জেড।আগে যা সারহান জেইদি নামে থাকলেও এখন তা সারহান জান্নাহ্ নামে আখ্যায়িত।কিন্তু মেয়েটা জান্নাহ্ নয়।কারণ জান্নাহ্ কখনো টপস আর ল্যাগিন্স পড়ে না।এই ড্রেস পড়ে শ্রীজা।ছলছল চোখ নিয়ে উঠে যায় জান্নাহ্।তার প্রাণআত্না যেনো বের হয়ে যেতে চাইছে।দরজার কাছে যেতেই শ্রুতি শীতল গলায় বললো—

“তুমি কী কষ্ট পেয়েছো?এই ছবিটা তোমার ভালো লাগেনি?তাহলে ফেলে দেই?

জান্নাহ্ অবিশ্বাস্য আচরণ করলো।ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো–

“নাহ।ছবিটা তোমার সারহান ভাইয়াকে দেখাবে।”
,
,
,
বিছানায় বসে নিজের মোবাইলে জান্নাহ্ এর ছবি দেখছে সারহান।কাল রাতেই উঠিয়েছে এই ছবিগুলো।গাঢ় লাল গাউনে যেনো রক্তজবা লাগছে জান্নাহ্কে।কাল অনেকদিন পর জান্নাহ্ আর সারহান এক মিষ্টি সময় কাটিয়েছে।জান্নাহ্ এর দেহের সুবাসে অদ্ভুত মাদকতা যা সারহানের পৌরষসত্তাকে ক্ষনকালেই উন্মাদ করে তোলে।
সারহানের দিকেই তীক্ষ্ম নজরে চেয়ে আছে শ্রীজা।থমথমে গলায় বললো–

“তুমি শুনতে পারছো আমি কী বলছি?

সারহান মোবাইলটা পকেটে রেখে রসালো গলায় বললো–

“রজনীগন্ধাকে দেখছিলাম।শুনতে পাই নি।এইবার বলো।”

তেতে উঠে শ্রীজা।গমগমে গলায় বললো–

“বিয়ে করো আমাকে।”

এক মুখ হাসে সারহান।হেয়ালি গলায় বললো–

“মাথার নিউরণ কী ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে নাকি তোমার!

শ্রীজা চেতে গিয়ে বললো–

“সারহান!

সারহান বিগলিত গলায় বললো—

“হঠাৎ বিয়ে করার ইচ্ছে জাগলো কেন তোমার!তোমার তো এইসবে বিশ্বাস নেই।”

“তুমি আমাকে এভয়েড করছো।গত দেড় মাস ধরে তুমি আমাকে সময় দিচ্ছো না।যখন থেকে জান্নাহ্ এখানে এসেছে তোমার কাছে আমার কোনো চাহিদাই নেই।”

সারহান নরম গলায় বললো–

“স্বাভাবিক।ব্যস্ত আমি এখন।”

“আমারো সেই অধিকার চাই যা জান্নাহ্ এর।”

সারহান অধর কোণে হেসে বললো—

“অধিকার!কিসের অধিকার!আমাদের সম্পর্কটা
কমিটমেন্ট।তোমার আমাকে প্রয়োজন আমার তোমাকে।দ্যাটস ইট।”

শ্রীজা তপ্ত গলায় বলে উঠে—

“তাহলে বিয়ে কেন করলে?তুমি তো কখনো বিয়ে করতে চাওনি।জান্নাহ্কে দেখার পর কী হলো তোমার?

সারহান শক্ত কন্ঠে প্রত্যুক্তি করে—

“তার জবাব আমি তোমাকে দেবো না।”

বিছানায় আলগোছে শুয়ে পড়ে সারহান।মাথার নিচে দুই হাত দিয়ে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।শ্রীজা দমদমিয়ে বললো–

“কী এমন পেলে তুমি ওর মধ্যে!

সারহান বাঁকা হাসলো।স্বশব্দে বললো–

“তোমার মতো বিয়ের আগে রাত কাটায় নি আমার সাথে।সে আমার রজনীগন্ধা।”

সারহান চোখটাকে তেরছা করে শোয়া অবস্থায় শ্রীজার দিকে তাকিয়ে ক্ষেপা গলায় বললো—

“আজকের পর আর কোনোদিন জান্নাহ্ এর সাথে নিজের তুলনা করবে না।তাহলে আমাকে হারাবে সারজীবনের মতো।”

ধম করে উঠে শ্রীজার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সারহান।তার পশ্চাতে শ্রীজা ভাঙচুর শুরু করে।

করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে জান্নাহ্।তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিড়ালপায়ে এগিয়ে আসছে সারহান।খয়েরি পাড়ের সাদা শাড়ি পড়েছে জান্নাহ্।মাথায় হাত খোপা করে তাতে আর্টিফিসিয়াল বেলি ফুলের গাজরা গুঁজেছে।চোখের পানি বাঁধা মানছেই না।গরগর করে গড়িয়ে পড়ছে।হাতের উল্টো পাশ দিয়ে যতবারই মুছে ততবারই গড়িয়ে পড়ে তা।চোখে দেওয়া মোটা কাজলের আঁচড়টাও লেপ্টে যায়।পাশে এসে দাঁড়ায় সারহান।ডেকে উঠে–

“রজনীগন্ধা।”

পাশ ফেরার আগে নিজের চোখটা ভালো করে মুছে নেয় জান্নাহ্।সারহান বিগলিত হাসে।সরস গলায় বললো—

“আপনাকে দেখে মনে হয় না আপনি ষোড়শী।”

বিনা সময় ব্যয়ে আর্দ্র গলায় বলে উঠে জান্নাহ্–

“মানুষের উপরটা দেখে কখনো ভেতরটা বোঝা যায় না।ভেতরটা কতটা নিকৃষ্ট আর কুচকুচে কালো।”

ভ্রু বাকায় সারহান।হতভম্ব গলায় বললো–

“কী হয়েছে আপনার?

“কিছু না।বাসায় যাবো আমি।”

সারহানকে রেখেই হাঁটা ধরে জান্নাহ্।সারহানের কোনো ডাকই তার কর্ণকুহর হলো না।
গাড়িতে কোনো কথা বললো না জান্নাহ্।রাগ হচ্ছে তার।চোখগুলোও বড় বেহায়া।কাঁদতে চায় না তাও নোনতা জল ছেড়েই চলছে।স্টেয়ারিং হাত থাকলেও সারহানের বিক্ষিপ্ত নজর জান্নাহ্ এর দিকে।ব্যস্ত গলায় বললো–

“কী হয়েছে বলবেন তো!

সারহানের কন্ঠে আর থামাতে পারলো না নিজেকে।ঝমঝমিয়ে কাঁদলো জান্নাহ্।হতচকিত সারহান ব্রেক কষে।দারাজ গলায় বললো–

“কী হয়েছে বলবেন প্লিজ!সে কখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছেন।”

জান্নাহ্ তীক্ষ্ম গলায় বলে উঠে—

“ধমকাচ্ছেন কেন!একদম ধমকাবেন না আমাকে।”

সারহান ফোঁস করে এক শ্বাস ফেললো।অনুযোগের সুরে বললো—

“সরি।প্লিজ বলুন কী হয়েছে?

“আপনার মোবাইল দিন।”

সারহান বিস্মিত নয়নে তাকায়।জান্নাহ্ ফের জোর গলায় বললো–

“কী হলো দিন।”

সারহান তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে।এতে যদি তার রজধীগন্ধা খুশি হয় তাহলে তাই হোক।সারহানের মোবাইল নিতেই দেখে তা লক করা।শক্ত গলায় জান্নাহ বললো–

“পাসওয়ার্ড?

সারহান নির্বিকার গলায় বললো–

“আপনি।”

জান্নাহ্ রজনীগন্ধা লিখতেই স্ক্রিন আনলক হয়।কল লগস থেকে খুঁজে শ্রীজার নাম্বারে গিয়ে মেসেজ করে।কিছুক্ষন পর শ্রীজা রিপ্লাই করতেই তা সারহানকে দেখায়।জান্নাহ্ লিখেছিলো,”আজ তোমার সময় হবে?
শ্রীজা রিপ্লাই করে,”তোমার জন্য আমি সবসময় ই ফ্রি।”
আগুন জ্বলে উঠে সারহানের মাথায়।সে কিছু না বলেই গাড়ি ঘোরায়।এনজিওর গেটেই দাঁড়ানো শ্রীজা।সারহানকে দেখে খুশি হলেও তার পাশে জান্নাহ্ক দেখে চটে যায়।তার কাছে গিয়েই মোবাইলটা দেখিয়ে গর্জে গিয়ে সারহান বললো—

“এইসব কী?

শ্রীজা কিছুক্ষন চুপ থেকে মিনমিনে গলায় বললো—

“তুমি না বললে সেদিন পুরাণ ঢাকায় একটা ড্রাগস গ্যাং ঢুকেছে।তাই আমি ভাবলাম আজ হয়তো যাবে।”

সারহান জান্নাহ্ এর দিকে চেয়ে সরব গলায় বললো–

“আর কিছু শুনতে চান আপনি?

জান্নাহ্ চেয়ে থাকলো।সারহান থমথমে গলায় বললো-

“যদি ইচ্ছে হয় তাহলে আসুন নাহলে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকুন।”

গাড়িতে গিয়ে বসে সারহান।কয়েক কদম গিয়ে পেছন ফিরে জান্নাহ্।তার ঘোলা চোখে শ্রীজার গম্ভীর মুখটা দেখছে।কিছু বলতে চায় শ্রীজা।কিন্তু কী?

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here