জান্নাহ্ “পর্বঃ৩২

0
3065

#জান্নাহ্
#পর্বঃ৩২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

খাবারের ঘ্রাণে উতলা হয়ে উঠছে ইহতিশাম।ঝকমকে হেসে বললো–

“আই সয়ের,আমার যদি একটা জাদুর ছড়ি থাকতো তোমাকে পৃথিবীর বেস্ট শেফের খেতাবটা দিয়ে দিতাম।”

ঝুমঝুম করে ইহতিশামের কথায় হেসে উঠে জান্নাহ্।মুখে এক লোকমা দিয়েই আগ্রহী গলায় ইহতিশাম বললো—

“এতো ভালো রান্না কোথায় শিখলে তুমি?

জান্নাহ্ স্বাভাবিক গলায় বললো—

“আমার বাবার কাছ থেকে।”

ইহতিশাম ভ্রু নাচিয়ে বিস্মিত গলায় বললো–

“তাই নাকি!আঙ্কেল কী মাস্টার শেফ ছিলো নাকি!

জান্নাহ্ নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকায়।মৃদু গলায় বললো–

“উঁহু।”

“তাহলে?

জান্নাহ্ স্বশব্দে বললো—

“মাম্মা,রান্না করতে পারতো না।তাই বাবাই করতো।সাথে আমাকেও শেখাতো।”

ইহতিশাম ভ্রু কুঁচকে ক্ষীন চোখে তাকায়।মাম্মা ডাকটা বড় অদ্ভুত শুনালো তার কাছে।সে নিরুত্তাপ গলায় বললো—

“তোমার বাবা কী করতেন?

নিজের কথায় হোচল খায় জান্নাহ্।বেশ কিছুক্ষন চুপ থেকে কথা বলতে গিয়েও বলতে পারলো না।সারহান কোনোরকম ভনিতা ছাড়ায় দৃঢ় কন্ঠে ঘোষনা করলো—

“জান্নাহ্ এর বাবা কী করে তা তোর না জানলেও চলবে।খেতে আসছিস,খেয়ে বিদায় হ।”

মুক্ত চোখে তার দিকে তাকায় জান্নাহ্।ফেরার পর থেকে একটা কথাও বলেনি একে অপরের সাথে।ইহতিশাম তার স্থির চোখ দুটো দিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার আভাস আন্দাজ করতে চাইছে।কিন্তু পারছে না।তার মাঝে গো গ্রাসে গিলে যাচ্ছে শায়িখ।নিজের অসুস্থ মায়ের হাতের রান্না কবে খেয়েছে বেমালুম ভুলে গিয়েছে সে।তাই এ সুযোগ হাতছাড়া করা করতে তার মস্তিষ্ক তীব্র প্রতিবাদ করেছে।
সারহান খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে জান্নাহ্কে দেখছে।সে খাচ্ছে তো ঠিকই কিন্তু তা তার গলা থেকে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে।জান্নাহ্ দেখলো না।ইচ্ছে করছে না তার।সে চায় না তার সামনে হঠাৎ উদিত সত্য তার পরিশুদ্ধতা পাক।তার মানুষটা তারই থাক।আর কী করার আছে তার!আর কতো সইবে সে!

সারহানের নজর সরলো না।অপ্রস্তুত হয় জান্নাহ্।বিরসমুখটা কোনোরকম আড়াল করলো সে।সারহান বিক্ষিপ্তচিত্ত তাকিয়ে আছে এখনো।এতো কিসের রাগ!কে বলেছে এই মেয়েকে আসতে তার জীবনে!ভালোবাসার পুষ্পভরা ডালা নিয়ে।সে তো অনেক আগেই মৃতভূমিতে পরিণত হয়েছে।সেই ভূমিতে ভালোবাসার ফুল ফুটাতে কে বলেছিলো এই মেয়েকে!প্রথবারই সে নিজেকে থমকে নিয়েছে।তাহলে দ্বিতীয়বার কেন আসলো এই মেয়ে!আমি তো চাইনি।সে নিজে এসে করা নেড়েছে আমার দ্বারে।তাহলে এখন!
সুযোগ দিয়েছি আমি।কেন যাইনি সে!কিন্তু আজ আর আমি দিবোনা।কোথাও যেতে দিবোনা।শেষ শ্বাস পর্যন্ত আমার কাছেই থাকতে হবে।হয় মারবো না হয় মরবো।

ঝট করে চেয়ার থেকে উঠে পড়ে সারহান।তার দিকে তিনজোড়া চোখ গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।ইহতিশাম কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন করে–

“উঠলি যে?

সারহান সহজ গলায় রোষ নিয়ে বললো–

“খেতে ইচ্ছে করছে না।তুই খেয়ে বিদায় হ।আর শায়িখ তুমি খেয়ে আমার রুমে আসো।”

সারহান যেতেই ইহতিশামের বিষন্ন দুই চোখ আবদ্ধ হয় জান্নাহ্ এর দিকে।ম্লান গলায় বললো—

“কিছু হয়েছে?

ইহতিশামের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে শায়িখ বললো—

“তেমন কিছু নয়।আসলে নতুন একটা কেস নিয়ে স্যার একটু চিন্তিত।”

ইহতিশাম ভ্রু ক্রুটি করে।সংক্ষেপিত তার দৃষ্টি কিছু একটা বুঝতে পেরেও কিছু বললো না।জান্নাহ্ বিভ্রান্ত চোখ তাকায়।তার চাহনিতে অপ্রস্তুত হয় শায়িখ।অপরাধি মুখটা নিচু করে খাওয়ায় অভিনিবেশ করে।
বাটিতে থাকা চিংড়ির মালাইকারি মুখে দিতেই ইহতিশাম সরস গলায় বললো–

“এতে লবণ কম।”

জান্নাহ্ চোখ পিট পিট করে যেইনা লবণ দেখার জন্য বাটিতে হাত দিতে যাবে উদ্বেলিত গলায় বলে উঠে শায়িখ–

“ম্যাম,আপনার চিংড়িতে অ্যালার্জি।”

রুদ্ধশ্বাসে একে অপরকে দেখছে তারা।ইহতিশাম মুখ ফুলিয়ে দাঁতের কোনায় জীভ গুঁজে ধরে।চোখের কোণ ক্ষীন করে অনেকটা প্রশ্নসূচক অভিপ্রায়ে হেয়ালি গলায় বললো–

“আর ইউ সিরিয়াস?

বৃহৎ ঢোক গিলে শায়িখ।তার দীপ্ত মুখটা হঠাৎ নিষ্প্রভ হয়ে যায়।মিনমিনে গলায় ভাঙা ভাঙা করে বললো–

“আসসসলে স্যাএএর বলেছিলো।”

ইহতিশাম প্রশ্রয়ের হাসি হাসলো।মসৃণ কপালটায় ঠিক মাঝ বরাবর কয়েকটা লম্বালম্বি রেখা ফেলে বললো–

“তোমার ব্রেইন তো খুবই শার্প।জিনিয়াস।স্যারের সাথে সাথে স্যারের ওয়াইফের প্রতিও তোমার দারুণ আনুগত্য।”

লজ্জা পেলো শায়িখ।তার নিষ্কম্প চোখ অবনত করে মিষ্টি হাসলো।জান্নাহ্ চোখে হেসে বললো–

“সরি তিশাম ভাইয়া।আসলে লবণ চেক করা হয়নি।সারহান বললো আপনার নাকি চিংড়ি মাছ পছন্দ।”

ইহতিশাম ভারি গলায় বললো–

“সারহানেরও।হোস্টেলে থাকতে কতো কাড়াকাড়ি করে খেয়েছি।”

বিরস হাসে জান্নাহ্।ক্ষীন গলায় বললো–

“সারহান এখন আর চিংড়ি মাছ খায় না।”

ইহতিশাম অধর ছড়িয়ে মুক্ত শ্বাস ফেলে।আবেগী গলায় বললো–

“সারহান সত্যিই তোমায় ভালোবাসে।”

জান্নাহ্ কিছু চিন্তা করার আগেই তার চোখের সামনে শ্রুতির আঁকা সেই ছবি ভেসে উঠে।চকিতে ইহতিশাম বলে উঠে—

“তোমার কোনো বোন টোন আছে নাকি?

জান্নাহ্ তার পাতলা ঠোঁটের কোণ একটু ফাঁক করে হাসলো।ঝলমলে গলায় বললো–

“কেন?

ইহতিশাম ভারি মজা নিয়ে বললো—

“ভাবছি বিয়ে করে নিবো।সারহান খেতে পছন্দ করে না।আমি কিন্তু খেতে ভীষন পছন্দ করি।তাই ভাবছি তোমার বোন থাকলে তাকেই বিয়ে করে নিবো।রান্না করাবো আর খাবো।”

কলকলিয়ে হেসে উঠে উপস্থিত তিন নরনারী।নিজের ঝর্ণার প্রবাহমান হাসিকে দমিয়ে অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে জান্নাহ্ বললো–

“আছে তো।কিন্তু আপু এখন বাইরে।আপু ফিরলেই আমি আপনার কথা বলবো।”

ফুরফুরে হাসলো ইহতিশাম।বাম হাত দিয়ে বুক পকেট থেকে নিজের কার্ড বের করে দিয়ে অতি মাত্রায় আনন্দিত গলায় বললো–

“কৃতজ্ঞ কিউটি।এই নিন আমার কার্ড।আপনার আপুর সাথে দেখা হলেই তাকে এইটা দিয়ে আমাকে বউ খোঁজার এই ভয়াল যুদ্ধ থেকে রক্ষা করবেন।”

ইহতিশাম আরেকটু চেপে নেয় গলা।জান্নাহ্ এর একটু কাছে এসে হুসহুসে বললো–

“আমি কিন্তু ছেলে হিসেবে খারাপ না।আপনার বোনকে বলবেন।”

খলখলিয়ে হেসে উঠে জান্নাহ্।তার সেই মুক্তো ঝরা হাসিতে বিমুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে ইহতিশাম।সে চায় এভাবেই যেনো হাসি খুশিতে ভরা থাকে তার কিউটির জীবন।
,
,
,
নিমগ্নচিত্তে বসে আছে সারহান।পাশেই মুখ ভার করে বিভ্রান্ত চাহনিতে শায়িখ আবদ্ধ করে রেখেছে সারহানকে।নিরুত্তাপ গলায় বললো–

“স্যার।”

সারহান কিছু একটা ভাবছে।তাই শায়িখের কথা তার কর্ণকুহর হলো না।সে ঠাঁই সেভাবেই উদাস হয়ে বসে রইলো।জান্নাহ্ এর ক্রন্দনরত চেহারা কিছুতেই ভুলতে পারছে না সারহান।তার ওই চোখ ই তার জীবন।আজ তার জন্য সেই চোখেই জল।

শায়িখ কোমল গলায় ফের ডেকে উঠে–

“স্যার।”

শুনলো না সারহান।শায়িখ এইবার গলার স্বর উঁচু করে বললো–

“স্যার!

সারহান সপ্রতিভ হয়েই দিকভ্রান্তের মতো শব্দের উৎস খুঁজতে লাগলো।শায়িখ যে তার পাশেই বসা বেমালুম ভুলে গেছে সারহান।বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে সন্দিহান গলায় সারহান বললো–

“কিছু বলবে?

শায়িখ ফাইলটা হাতে দেয় সারহানের।প্রভু ভক্ত ভৃত্যের মতো বললো—

“মন্ত্রী সাহেব সব ব্যবস্থা করেছেন।আগামী শুক্রবারই আপনার ফ্লাইট।সব ব্যবস্থা করেছেন তিনি।এই খানে সব ঠিকানা আছে।আর একটা টোকেনও আছে।এইটা দেখালেই তারা আপনাকে চিনে নিবে।”

সারহান বিরসমুখে বললো—

“থ্যাংকস।”

শায়িখ গাঢ় গলায় বললো—

“আপনি আজও বললেন না কাকে খুঁজছেন আপনি!আজ এতো বছরেও কী তিনি আদৌ বেঁচে আছেন?

সারহানের ঠোঁট উল্টে কান্না পায়।নাকের পাল্লা মৃদু তালে ফুলতে থাকে।নিজের ঠোঁটকে কামড়ে ধরে বললো—

“আই উইশ মৃত্যুর আগে হলেও যেনো সে একবার আমাকে দেখতে পারে।”

গম্ভীর শ্বাস ফেলে শায়িখ।সারহানকে আজকাল বেশ বিধ্বস্ত দেখায়।কিছু একটা ভেতর থেকে কুঁড়ে খাচ্ছে তাকে।যেখানে আগে সময় পেলেই নারীসঙ্গী খুঁজে বেড়াতো সে, আজকাল সময় পেলেই শহরের বিভিন্ন পূনর্বাসন কেন্দ্র,ব্রোথেলে ঘুরে বেড়ায়।বিভিন্ন সময় হাসপাতালের মর্গেও যায়।কোথাও কোনো দূর্ঘটনা ঘটলে।অবশ্য এইসব তাকে শ্রীজা বলেছে।কারণ সারহান কে কল করে না পেয়ে এনজিওতে গিয়ে জানতে পারে আজকাল সে এখানেও তেমন আসে না।শ্রীজার সাথেও সম্পর্ক ভালো নেই।হয়তো শ্রীজার সময়ও শেষ হয়ে এসেছে তার জীবনে।একটা শীতল দীর্ঘশ্বাস ফেলে শায়িখ।

মৃদু ছন্দে শায়িখ বললো—

“একটা কথা বলবো স্যার?

সারহান অস্পষ্ট কন্ঠে বললো–

“বলো।”

“আমার মনে হয় ইহতিশাম স্যারের হাতে কিছু একটা লেগেছে।”

সারহান উঠে দাঁড়ায়।ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো–

“আই ডোন্ট কেয়ার।”

শায়িখ অতি নির্ভয়ে ক্ষীন গলায় বললো–

“আপনার কী মনে হয় স্যার যারা আপনার প্রিয় মানুষগুলোকে খুন করেছে তারা আপনার শত্রু না শুভাকাঙ্ক্ষী?

দুর্বোধ্য হাসলো সারহান।ক্ষেপা সুরে শক্ত কন্ঠে বললো—

“ওরা কেউই আমার প্রিয় মানুষ নয়।”

“সরি স্যার।”

সারহান স্বগতোক্তি করে বললো—

“আমার জীবনে যারা এসেছে তারা সবাই নিজেদের স্বার্থে এসেছে।আমার রজনীগন্ধাও আমাকে নিজের স্বার্থে বেছে নিয়েছে।কিন্তু এতো মানুষের ধোঁকার মাঝে আমি শুধু একজনকেই ভালোবেসেছি।”

সারহানের অশ্রুসিক্ত অক্ষিযুগল নিবদ্ধ হয় প্রায় বিয়াল্লিশ ইঞ্চির জান্নাহ্ এর সেই পোট্রেটে।যাতে জান্নাহ্ সে চোখ দুটো চেয়ে আছে সারহানের দিকে।

সারহানের মৌনতায় শায়িখ আবার বললো–

“আপনি গেলে ভাবীজানের কী হবে?

সারহান সহজ হয়।জান্নাহ্ থেকে চোখ ফিরিয়ে ঝরা হেসে বললো–

“সামনেই তার পরীক্ষা।বাড়িতে রেখে আসবো তাকে।ইন্ডিয়া থেকে ফিরলে আবার নিয়ে আসবো।”

নিজের উত্তর পেয়ে আশ্বস্ত হয় শায়িখ।সারহান ঝরঝরে গলায় বলে উঠে–

“জিঙ্গেস করলে না যারা ওদের খুন করেছে তারা আমার কী!
শুভাকাঙ্ক্ষী।সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী।”

রহস্য হাসে সারহান।তার সেই ভয়ংকর নৈঃশব্দের হাসিতে ক্ষনে ক্ষনে কেঁপে উঠে শায়িখ।

চলবে,,,

(গ্রুপে পোস্ট+কমেন্টস💖💖💖)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here