জান্নাহ্ “পর্বঃ৩৩

0
3147

#জান্নাহ্
#পর্বঃ৩৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

গত এক সপ্তাহে স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মতো চলছে জান্নাহ্ আর সারহানের সংসার।জরুরি প্রয়োজন ছাড়া একে অপরের সাথে কথা বলে না।সেদিনের কথা বোধগম্য হয়নি জান্নাহ্ এর।শ্রীজা বলেছে সারহান সেদিন কোনো একটা কাজে যাবে।কিন্তু সেদিন ছিলো তাদের বিবাহ বার্ষিকী।তার উপর সকালেই ইহতিশাম জানিয়ে দিয়েছে সে বাসায় আসবে।তাহলে সেক্ষেত্রে সারহানের কোথাও যাওয়ার প্ল্যান কী করে হতে পারে!
টলটল করে উঠে জান্নাহ্ এর চোখ।জান্নাহ্ এর ভাবনার অবসান হয় সারহানের দারাজ গলায়।

“রজনীগন্ধা।”

সপ্রতিভ হতেই জান্নাহ্ খেয়াল করে তার হাত স্টোভের উপরে।খেমটি মেরে সারহান পুনরায় বললো—

“অার একটু হলেই তো হাতটা পুড়িয়ে ফেলতেন।”

জান্নাহ্ অধর কোণে তাচ্ছিল্য হাসে।নিজের উপর মায়াহীনভাবে বললো—

“যার পুরো জীবনটাই পুড়ে গেছে তার হাত পুড়লেই বা কী!

সারহানের দীপ্ত চেহারা ক্ষনকালেই নিষ্প্রভ হয়ে যায়।ম্লান চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে জান্নাহ্ এর দিকে।কিন্তু জান্নাহ্ দেখলো না।তার এই অবহেলায় কেউ একজন নিজেকে হারিয়ে ফেলছে।

ডিভানে বসে আছে সারহান।বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে পা দুটো পিরামিডের মতো করে তার মাঝে বই নিয়ে বসে আছে জান্নাহ্।একটু পরপর তার মেসেজ টোন বেজে উঠেছে।আর তা দেখেই একেক বার একেক রকম মুখভঙ্গি করছে জান্নাহ্।কখনো কপট রাখ,কখনো অভিমান আবার কখনো বা খলখলে হাসি।সারহানের মুখের সামনে রাখা ল্যাপটপের ফাঁকে আড়চোখে তাকায় জান্নাহ্ এর দিকে।আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না কিন্তু আমার শত্রুর সাথে ঠিকই হাসছে।ইচ্ছে করছে মোবাইলটা নিয়ে এখন ভেঙে ফেলে।সারহানের ভাবনায় গুঁতো লাগে জান্নাহ্ হাসির আওয়াজে।আর সহ্য হলো না।ত্রস্ত পায়ে উঠে জান্নাহ্ এর হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে নেয়।হতচকিত জান্নাহ্ বিছানা থেকে উঠ সরু চোখে তাকায়।চোখা চোখা কন্ঠে বললো—

“কী সমস্যা?

সারহান রাশভারি গলায় বললো—

“জিনিসপত্র গুঁছিয়ে নিন।কাল সকালেই আপনাকে বাড়িতে দিয়ে আসবো।”

জান্নাহ্ নিষ্কম্প চোখে তাকিয়ে কোনোরকম উল্লেখ যোগ্য প্রতিক্রিয়া ছাড়াই হেয়ালি গলায় বললো—

“কেন!আমি থাকলেই আপনার সমস্যা?

সারহান দৃঢ় চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন।নিজের ড্রয়ার থেকে ঢাকা টু ইন্ডিয়ার টিকেটটা এনে জান্নাহ্ এর হাতে দেয়।থমথমে গলায় বললো—

“দেখুন।কাল সন্ধ্যায় আমার ফ্লাইট।আপনাকে বাড়ি রেখে এসে আমাকে যেতে হবে।”

জান্নাহ্ চুপ মেরে টিকেটের দিকে সুক্ষ্ম চাহনি দেয়।সারহান তার ট্রাউজারের পকেটে দুই হাত পুরে শক্ত হয়ে দাঁড়ায়।ক্ষীন গলায় বললো–

“স্বামীদের সন্দেহ করা স্ত্রীদের জন্মগত অধিকার।আপনিও তার ব্যতিক্রম নন।”

জান্নাহ্ তার অশ্রুসজল চোখ দুটি দিয়ে সারহানকে দেখলো।ভেতর দিকে একটা শ্বাস টেনে বললো–

“বিশ্বাস হলো মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় নিঁখুত,ধারালো আর নিরব হাতিয়ার।যার আঘাতে কোনো মানুষকে নৈঃশব্দে নির্বাক করা যায়।”

সারহান বিগলিত হাসলো।কন্ঠে গভীরতা এনে বললো–

“অনেক কথা বলতে শিখেছেন!

জান্নাহ্ দমদমে গলায় বললো–

“অবুঝ নই আমি।”

ঝলমলে হাসে সারহান।তার এই হাসিই সূঁচের মতো বিঁধে জান্নাহ্ এর শরীরে।সরস গলায় সারহান বললো–

“আমার কাছে তো অবুঝই।”

হেলেদুলে রুম থেকে বেরিয়ে আসে সারহান।হিমালয়ের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জান্নাহ্।তার হাতে সারহানের ফ্লাইটের টিকেট।জল জমা চোখে অস্পষ্ট দেখছে জান্নাহ্।চকিতে শ্বাসরুদ্ধ করে জান্নাহ্ দৌঁড়ে আসে ড্রয়িং রুমে।আঁতকে উঠে জান্নাহ্।ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ডেকে উঠে—

“সারহান!

সেদিন শপিংমলে গিয়ে একটা কাঁচের জার এনেছিলো জান্নাহ্।তার মধ্যে মাল্টিকালারের পাথরকে পানিতে চুবিয়ে রেখেছিলো।সেটাই ভেঙে তছনছ করেছে সারহান।সাথে নিজের হাত কেটে ফেলেছে।জান্নাহ্ শশব্যস্ত হয়ে এসে উদ্বেলিত গলায় বললো—

“এইসব কী শুরু করেছেন আপনি!পাগল হয়েছেন?

সারহানের মধ্যে কোনো ভাবান্তর হলো না।অবিচলিত হয়ে বসে থাকলো সে। মৃদুহাস্য অধর।জান্নাহ্ অধৈর্য হয়ে এক পেঁজা তুলো এনে স্যাভলনের সাহায্যে সারহানের হাত পরিষ্কার করতে থাকে।সারহান তার কাতর চোখে অনিমেষ চেয়ে রইলো জান্নাহ্ এর ওই মোহনীয় চেহারায়।কাত হয়ে পরম আবেশে আলতো হাতে সেই রক্ত মুছে দিচ্ছে জান্নাহ্।কপালের ঘামে তার ফিরফিরে চুলগুলো লেপ্টে আছে কানের দিকটায়।চোখের স্মিত প্লাবণ নাকের ডগা দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে।স্যাভলনসহ তুলো লাগাতেই ঝাঁঝিয়ে উঠে হাত।সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না সারহান।ডান হাতের তর্জনী দিয়ে জান্নাহ্ এর ঘামে সিক্ত চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দেয়।এখন ঠিকভাবে দেখা যাচ্ছে তার রজনীগন্ধাকে।

সারহান তার পিঠ ঠেকায় কাউচে।রহস্য হাসে সে।যে মেয়েটা রক্ত দেখলে অজ্ঞান হয়ে যায় সে আজ দিব্যি সুস্থ!বাঁকা হাসলো সারহান।তার রজনীগন্ধা বড্ড বোকা।এখনো ভালো করে অভিনয় করা শিখেনি।একজন সফল অভিনেত্রী যেকোন পরিস্থিতিতেও নিজের ক্যারেক্টার ধরে রাখে।কিন্তু তার রজনীগন্ধা এতোদিন বেস্ট এক্টরের খেতাবটা পেলেও আজ আর পারলো না।

হাতটা ভালো করে পরিষ্কার করে তার মধ্যে তুলো দিয়ে আপাতত বেঁধে দেয় জান্নাহ্।অসহ্যকর চুলগুলো দুইপাশে নিজের হাত দিয়ে গুঁজে ভেজা অক্ষিপল্লব মেলে তাকায় জান্নাহ্।চোখ দুটো ঢোল হয়ে আছে।নাকের ঢগা লাল রঙ ধারণ করেছে।ফর্সা মুখটা ফ্যাকাশে।সারহান নির্বিকার চাহনিতে দেখছে তার রজনীগন্ধাকে।ধীরগতিতে জান্নাহ্ এর গলার দিকটায় মুখ নামিয়ে আনতেই আর্দ্র গলায় জান্নাহ্ বললো–

“প্লিজ সারহান।”

সারহান স্মিত হাসে।জান্নাহ্ এর অসাঢ় শরীরটাকে সরব হাতে কাউচে শুইয়ে দেয়।তার উপর পুরো ঝুঁকে কানের কাছে হিসহিসিয়ে সারহান বললো—

“এখনো রাগ কমেনি আমার উপর? আজ রাতে যদি আমি মরে যাই সবচেয়ে বেশি আপসোস আপনি করবেন রজনীগন্ধা।”

মাথাটা একপাশে ফিরিয়ে ঝমঝমিয়ে কাঁধে জান্নাহ্।সারহান তার শুষ্ক ঠোঁটের স্পর্শ একে দেয় জান্নাহ্ এর গলার দিকটায়।গভীর আশ্লেষে নিজের প্রশ্বস্ত বক্ষপিঞ্জিরায় আচ্ছন্ন করে জান্নাহ্ এর ছোট্ট মাখনের মতো শরীরটাকে।
,
,
,
কিছু জামা কাপড় রেখে বাকি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো গুঁছিতে নেয় জান্নাহ্।সকাল সাতটা।তার গোঁছগাছ শেষ।কোমরে হাত দিয়ে গভীরভাবে ভাবছে আর কিছু নেওয়া বাকি আছে কিনা।পেছন থেকে তাকে আলগোছে আঁকড়ে ধরে সারহান।জান্নাহ্ এর ভেজা চুলে ঘ্রাণেন্দ্রিয় গুঁজে বড় বড় কয়েকটা শ্বাস টেনে নেয়।সারহানের এই স্পর্শ রোবটের মতো আস্বাদন করলো জান্নাহ্।কোমরে জড়ানো সারহানের হাতদুটো ছাঁড়িয়ে তার দিকে ফিরে তাকায়।সারহানের চোখ দুটো অদ্ভুত তৃপ্তিতে হাসছে।জান্নাহ্ একটা শুষ্ক ঢোক গিলে ঠোঁটের সাথে ঠোঁট চেপে ধরে স্বাভাবিক গলায় বললো—

“আপনি আমাকে মামার বাসায় দিয়ে আসুন।”

সারহান বিগলিত হেসে ফিচেল গলায় বললো—

“কেন!মামা ভাগ্নি মিলে কী আমাকে মারার প্ল্যান করবেন নাকি!

ফকফক করে হেসে উঠে সারহান।তার এই অযাচিত হাসিতে রুদ্ধবাক জান্নাহ্।লোকটা মাঝে মাঝে কী অদ্ভুত কথা বলে!
জান্নাহ্ আনম্র গলায় বললো—

“তিলকে কল করেছিলাম।বললো পরীক্ষা শুরু হতে আরও এক সপ্তাহ বাকি।তাই কয়েকদিন মামার কাছে থাকবো।মামির শরীরটাও ভালো নেই।”

সারহান ভাবলেশহীনভাবে বললো—

“ওকে।এজ ইউর উইশ।”

সারহানের দিকে পূর্ণ নজরে তাকিয়ে সন্দিগ্ধ গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে জান্নাহ্–

“আপনি কী একা যাবেন?নাকি শায়িখ ভাইয়াও যাবে?

সারহান সোজা কন্ঠে বললো—

“একা।”

“কবে ফিরবেন?

“যতদিন কাজ শেষ করতে সময় লাগে।”

জান্নাহ্ মিইয়ে যাওয়া চোখে তাকায়।সারহান উজ্জ্বল হেসে জান্নাহ্কে নিজের বক্ষস্থলে চেপে ধরে।হুসহুসে বললো—

“এইবার যদি ফিরে আসি তাহলে আপনার হয়েই ফিরবো।”

জান্নাহ্ সন্দিহান গলায় বললো—

এইসব কী বলছেন!

সারহান আরেকটু চাপা গলায় বললো–

“আমার জীবনের সত্য যা হয়তো আপনিও জানেন।যান তাড়াতাড়ি করুন দেরি হচ্ছে আমাদের।”
,
,
,
ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকা দোহারের একটা ছোট্ট পাড়ায় থাকে জান্নাহ্ এর মামা মামি।প্রায় এক ঘন্টার রাস্তা অতিক্রম করে তারা পৌঁছায় সেখানে।জান্নাহ্কে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে নিজেও বের হয় সারহান।কিন্তু ভেতর দিকে যাওয়ার কোনো তাড়া না দেখিয়ে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে বুকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকে।সূর্যের তীর্যক রশ্মি একদম খিঁচে যাচ্ছে সারহানের চোখে।সূর্য উদয়ের বিপরীত পার্শ্বে বাড়ির মুখ হওয়ায় এখান থেকে তার আলো সরাসরি দেখা যায়।পেছন ফিরে সারহানকে দাঁড়াতে দেখে ফিরে আসে জান্নাহ্।সারহানের মুখটা মুহূর্তেই লাল হয়ে উঠেছে কারণ তার এই আলো সরাসরি হজম করা ক্ষমতা নেই।চলাচলের রাস্তা থেকে একটু উঁচুতে বাড়ি।জান্নাহ্ সারহানের সামনে এসে দাঁড়ায়।তার ছায়ায় সারহানের মুখের উপর থেকে তপ্ত রোদ আড়াল হয়।কিঞ্চিৎ মুদিত চোখে জান্নাহ্কে দেখে সারহান।জান্নাহ্ প্রশ্নবিদ্ধ গলায় বললো–

“এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন!ভেতরে চলুন।”

সারহান মাথা নাড়ায়। কোমল গলায় বললো–

“নাহ।আজ আর ভেতরে যাবো না।দেরি হচ্ছে আমার।মামা মামিকে আমার সালাম জানাবেন।”

সারহান গাড়ি ছেড়ে জান্নাহ্ এর সামনে এসে দাঁড়ায়।জান্নাহ্ তার থেকে একটু উঁচুতে হওয়ায় জান্নাহ্ এর বুকের কাছে সারহানের শিয়র।ওয়ালেট থেকে কিছু টাকা বের করে জান্নাহ্ এর হাতে দেয়।জান্নাহ্ সরব গলায় বললো—

“লাগবে না।আমি অলরেডি ফি দিয়ে দিয়েছি।”

“ফি এর জন্য নয়।আপনার দরকারে লাগবে।না লাগলে কাউকে দিয়ে দিবেন।”

জান্নাহ্ এর হাতে ছোট্ট চুমু খায় সারহান।মোহবিষ্ট গলায় বললো—

“ভালো থাকবেন।নিজের খেয়াল রাখবেন।আসি।”

সারহান গাড়িতে গিয়ে বসে।এক্সিলেটরে পুশ করার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তার ওই তৃষ্ণার্ত দুই চোখ আবদ্ধ থাকে তার রজনীগন্ধায়।
যতক্ষন পর্যন্ত সারহানের ধূলো উড়ানো গাড়ি দৃশ্যমান ছিলো ততক্ষন পর্যন্ত জান্নাহ্ পর্বতের মতো সূর্যের সেই গা ঝলসানো রোদে দাঁড়িয়ে রইলো।

চলবে,,,

(সবাইকে রমজানের অসংখ্য শুভেচ্ছা।রমজানুল কারীম।
ভালো থাকবেন,সুস্থ্য থাকবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here