জান্নাহ্ “পর্বঃ৩৯

0
3212

#জান্নাহ্
#পর্বঃ৩৯
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

হসপিটালের করিডোরে উৎসুক জনতার ভীড়।একটু আগেই একটা লাশ বের করা হয়েছে ওটি থেকে।তার সার্জারি চলছিলো।কিন্তু ডক্টররা কিছু করার আগেই পেশেন্ট এর অবস্থা এতোটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো যে তাদের পক্ষে আর কিছুই করা সম্ভব হয়নি।কিন্তু পেশেন্টের পরিবার তা মানতে চায় না।তাদের ধারণা ডক্টররা ইচ্ছে করে এইসব করেছে।কারণ যখন গুরুতর আহত অবস্থায় মেয়েটাকে হসপিটালে আনা হয় তখন নাকি হসপিটাল কর্তৃপক্ষ পুলিশ কেস বলে গড়িমসি করতে থাকে আর এতেই মেয়েটির মৃত্যু ঘটে।কিছু কিছু জনতারা এতোটাই উত্তেজিত যে হসপিটালের করিডোরের ওয়েটিং চেয়ার,নার্সদের হাতা থাকা সার্জারি ট্রে সব ভেঙেচুরে একাকার করে ফেলছে।কিছুতেই যখন থামানো যাচ্ছে না তখন বাধ্য হয়ে পুলিশকে কল করা হয়।পুলিশ আসতেই ধীরে ধীরে সিচুয়েশন কন্ট্রোলে আসে।

আর এ সবকিছুই নির্ভয়চিত্তে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলো মেহনাজ।এইসব তার কাছে নতুন নয়।দিল্লীর একটা নামি হসপিটালের সিনিয়র নার্স সে।তার আন্ডারে প্রায় অর্ধ শতাধিক জুনিয়র রয়েছে।সে একজন ট্রেইনারও।শীতল নিঃশ্বাস ফেলে ক্যাবিনে ঢুকে মেহনাজ।
হুসনা বেডে শুইয়ে আছে।একটা চেয়ার টেনে তার কাছে বসে মেহনাজ।হুসনার হাতটা ধরে পরম আদুরে গলায় প্রশ্ন করে—

“চিন্তুা হচ্ছে?

হুসনা চোখের পাল্লা ফেললো দুইবার।মেহনাজ মিষ্টি হেসে আশ্বস্ত গলায় বললো—

“ডোন্ট ওয়ারি মা।সব ঠিক হয়ে যাবে।অপারেশনের পর তুমি আবার হাঁটতে পারবে।ডক্টর যে টেস্ট গুলো করিয়েছে তার সবগুলোর রেজাল্ট পজিটিভ।”

হুসনা মলিন হাসলো।তার চোখে উজ্জ্বলতা।ত্রস্ত পায়ে ক্যাবিনে ঢুকলো শরীফ।মৃদু গলায় বললো—

“ডক্টর বললো সব ঠিক আছে।আমরা ইচ্ছে করলেই তোর মাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারি।”

ম্লান হাসলো মেহনাজ।চোখে থাকা মাইনাস পাওয়ারের চশমাটা ঠিক করে নির্মল গলায় বললো–

“ওয়েল।আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।তুমি মাকে নিয়ে যাও।”

শরীফ ভ্রু কুঞ্চি করে জিঙ্গাসু গলায় বললেন–

“তুই যাবি না বাড়িতে?

মেহনাজ খসখসে গলায় বললো–

“নাহ।আমার ছুটি শেষ হয়ে এসেছে।আমাকে দিল্লী ফিরে যেতে হবে।”

“তাই বলে..।”

শরীফকে কথা শেষ করতে দিলো না মেহনাজ।কাঠখোট্টা গলায় বললো—

“আমাকে তোমার কী প্রয়োজন বাবা?তোমার জান্নাহ্ আছে তো।”

মেহনাজ দাঁড়ালো না।চাপা কান্না উগরে আসার আগেই ক্যাবিন থেকে বেরিয় এলো।শরীফও মেয়ের পিছু পিছু বেরিয়ে এলো।মেহনাজের কাঁধে হাত রাখতেই তেঁতে উঠে সে।রুক্ষ গলায় বললো—

“প্লিজ,বাবা।এমন কিছু বলবে না যা আমি রাখতে পারবো না।”

শরীফ অনুনয় করে বললো—

“একবার অন্তত চল।জান্নাহ্ তোর সাথে দেখা করতে চায়।মেয়েটা কতো আগ্রহ নিয়ে বসে আছে।”

তাচ্ছিল্য হাসে মেহনাজ।বাবার দিকে পূর্ণ নজর ক্ষেপন করে বললো—

“হাসালে বাবা।একটা কথা বলবে বাবা,আমার একটা ভুলে আমার গায়ে হাত তুলেছিলে তুমি।আর জান্নাহ্!এতো বড় একটা নাটক করলো তুমি ওকে বাঁধা দেওয়ার বদলে উল্টো ওর নাটকে পার্টিসিপেট করলে!

শরীফ তেজী গলায় বললো–

“মেহনাজ!

মেহনাজ নাক ফুলিয়ে দমদমে গলায় বললো—

“জান্নাহ্কে তো অস্কার দেওয়া উচিত।কোটিপতির মেয়ে হয়েও একটা অনাথ,দরিদ্র মেয়ের অভিনয় করে যাচ্ছে।সমাজে চিরাচরিত নিয়ম অনুসারে বাবা মায়ের মৃত্যুর পর মামা,মামির চক্ষুশূল ভাগ্নিকে টাকার বিনিময়ে ঘর থেকে বিদায় করতে পারলে শান্তি।এমনটাই সাজিয়েছিলে না পুরো নাটকটা?

গর্জে উঠে শরীফ।তার এহেন আচরণে হসপিটালের নার্স চোখ ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলো।এমন চাহনিতে বিব্রত হয় শরীফ।নিজেকে শান্ত করে শান্ত সুরে কঠোর গলায় বললেন—

“জান্নাহ্ সারহানকে ভালোবাসে।আর ওরা সত্যি জানলে কী সারহানের সাথে জান্নাহ্ এর বিয়ে দিতো!শুধু শুধু জল ঘোলা হতো।তাই এমনটা করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না।”

উপহাসমিশ্রিত হাসে মেহনাজ।নিষ্কম্প গলায় জিঙ্গাসুসূচক হয়ে বললো—

“ভালোবাসায় নাটক করার কী প্রয়োজন!ওই ছেলেকে ভালোবাসার কোনো স্পেশাল কারন?রাফাত!রাফাতের দোষ কোথায়?

শরীফ প্রতিবাদের সুরে বললো–

“তোকে এইসব নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।ওকে ওর মতো থাকতে দে।মেয়েটা এমনিতেও অনেক কিছু সহ্য করেছে।”

অধর কোণে বিপন্ন হাসে মেহনাজ।গম্ভীর গলায় বললো—

“এতো মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে জান্নাহ্ ঠিকই তার ভালোবাসা পেলো।আর আমি!বিশ্বাস করে বারবার ধোঁকা খেয়েছি।আমার সাথেই এমন কেন হলো বলোতো!

মেহনাজের চোখে উবরে আসে শ্রাবণের অবিশ্রান্ত বর্ষণ।ঝাপসা চোখে করিডোর থেকে সে দেখতে পায় স্ট্রেচারে করে একটা রোগীকে হসপিটালে ভেতরের দিকে নিয়ে আসা হচ্ছে।নিজের ভাগ্যের উপর বেদনাগ্রস্ত হাসি আসে মেহনাজের।প্রথমবার কাউকে ভালোবেসে বিশ্বাস করে যখন হৃদয়টা ভেঙে গুড়িয়ে দিলো সেই ভাঙা মন নিয়ে দ্বিতীয়বার যখন কাউকে উজার করে ভালোবাসলো সেও তাকে ধোঁকা দিলো।সেই ধোঁকাটাও এতোই গভীরভাবে তাকে বিক্ষিপ্ত করলো এই মনে সে আর কোনোদিন কাউকে জায়গা দিতে পারবে।যে ক্ষতের অস্তিত্ব সে তার শরীরে বহন করে তা কোনো দিন মুছার নয়।
,
,
,
অন্তরার খুশি যেনো আজ সাত অসমান ফুঁড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।যখন থেকে জানতে পেরেছে জান্নাহ্ কনসিভ করেছে কী থেকে কী করবে ভেবে পায় না সে।পুরো এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করেছে গত একদিনে।জান্নাহ্কে না পারে মাথায় তুলে রাখতে।
জমিরের বুকটা প্রফুল্লতায় ভরে উঠে।সে দাদুভাই হতে চলেছে।পুরো ঘরের খুশির আমেজ তিতি বুঝতে না পারলেও ঘরময় নেচে বেড়াচ্ছে সে।জাবিনের মুখে হাসি।আফটার অল তার ভাই বা বোন আসতে চলেছে।যদিও ব্যপারটার একটু অকওয়ার্ড।তবুও জাবিন বেশ খোশমেজাজে আছে।জান্নাহ্ এর জন্য একগাদা আচার কিনে এনেছে।জান্নাহ্ জিঙ্গেস করতেই বললো,সে নাকি মুভিতে এমনটা দেখেছে।প্রেগন্যান্সিতে টক খেতে ভালো লাগে।তাই।তার এই বাচ্চাসুলভ আচরণে হেসে কুটুকুটি হয় জান্নাহ্।তার অবশ্য একটু লজ্জাও করছে।কী একটা সাংঘাতিক ব্যাপার!ষোড়শী জান্নাহ্ মা হতে চলেছে।ইশ!আর কয়েকদিন পর তারও একটা পিচ্চি বাবু হবে!ভাবতেই গা নেচে উঠে জান্নাহ্ এর।তার আর তার প্রাণের অংশ আসতে চলেছে।এখন আর তার শাশুড়ি তাকে কথা শুনাতে পারবে না।বাড়ির সবার মনে খুশির মোলায়েম,স্নিগ্ধ ভালোবাসার হাওয়া বইলেও কেউ একজন একদমই খুশি হয়নি এই খবরে।তার এতো বছরের সব পরিকল্পনা এক নিমিশেই ধূলিসাৎ করে দিবে জান্নাহ্ আর সারহানের অনাগত সন্তান।তা সে কিছুতেই হতে দিবে না।

জান্নাহ্ এর প্রাণবন্ত হাসিতে যেনো স্বর্গ নেমেছে আজ এই বিরাণ বাড়িতে।কিন্তু জান্নাহ্ জানে না তার এই খুশি ভয়ংকর ঝড় তুলবে তার প্রাণের জীবনে।সেই ঝড়ে চিরতরে শেকড় হতে উপরে যাওয়া গাছের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে তার প্রাণের অস্তিত্ব।

হাসির ফোয়ারা বইছে জান্নাহ্ এর।গত এক ঘন্টা যাবৎ কথা বলছে সারহানের সাথে।সারহান আজ বেশ খুশি।কিন্তু কেন তা সে জানে না।কথার মাঝেই তিতি ওর আহ্লাদী গলায় ডেকে উঠে—

“পরীমা,পরীমা।”

সারহানের সাথে কথা শেষ করে মোবাইল রাখে জান্নাহ্।তিতিকে কোলে তুলে নিয়ে খুশি খুশি গলায় জিঙ্গেস করে—

“কী হয়েছে তিতি?

তিতি ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বললো—

“আঙ্কেল এসেছে।”

“কোন আঙ্কেল?

“তায়িখ।”

খিলখিলিয়ে উঠে জান্নাহ্।তিতির গালে শক্ত চুমু খেয়ে বললো—

“শায়িখ।বলো।শা,,য়িখ।”

“শাআআয়িখ।”

“আমার পাখিটা।চলো।”

শায়িখ ঘরে ঢুকে ফ্যানের নিচে বসেই কলারটা ছড়িয়ে দেয়।ঘামে ভিজে জামাটা ঝাপ্টে আছে তাকে।এক থালা মিষ্টি এনে রাখে তার সামনে শুভ্রা।অনেক বিস্ময় নিয়ে হতবাক হয়ে শায়িখ বললো—

“মিষ্টি কেন হঠাৎ!কোনো খুশির সংবাদ?

শুভ্রা ভ্রু ক্রুটি করে সন্দিহান গলায় বললো—

“সারহান তোমাকে কিছু বলে নি?

শায়িখ তার পুরু ঠোঁট জোড়া কুঁচকে রইলো।ভ্রু নাচিয়ে সাবলীল কন্ঠে বললো–

“বলেছে।কিন্তু মিষ্টি খাওয়ার মতো কিছু ঘটেছে বলে তো মনে হয় না।”

“আরে সারহা….।”

কথা শেষ করতে দিলো না জান্নাহ্।মাঝ পথেই শুভ্রাকে থামিয়ে দেয় তার মখমলে কন্ঠে।

“আপু।”

শুভ্রা পেছন ফিরে তাকায়।শায়িখকে সালাম জানায় জান্নাহ্। প্রত্যুত্তরে শায়িখও উষ্ণ হাসে।তার দিকে একটা চেক বই এগিয়ে দেয়।সারহান বলেছে শায়িখকে দেওয়ার জন্য।বিগলিত হাসে শায়িখ।টপাটপ দুটো মিষ্টি মুখে পুরে নিয়ে ভজভজ করে বললো–

“খুশির সংবাদটা কী ভাবিজান?

মিষ্টি হাসে জান্নাহ্।লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে বললো–

“ওটা আপনার স্যারের কাছ থেকে জেনে নিবেন।”

শায়িখ উঠে দাঁড়ায়।মৃদুহাস্য অধরে বললো–

“ঠিক আছে।স্যারের কাছ থেকেই না হয় শুনবো।অনেক দিন স্যারের মুখে গুড নিউজ শুনি না।শুধু আউলাঝাউলা খবরাখবর।”

শায়িখের এহেন কথায় ফিক করে হেসে ফেললো জান্নাহ্।মুহূর্তে শায়িখ গোমড়া মুখে বললো–

“স্যার না আসা পর্যন্ত অনেক ঝামেলা হচ্ছে।শ্রীজা ম্যামের খুনি এখনো ধরা পড়েনি।রোজ রোজ পুলিশ আসায় আতঙ্কিত সবাই।”

গোলগোল চোখে তার দিকে অভিনিবেশ করে জান্নাহ্।শুভ্রা ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো–

“এই এইসব কী কথা বলছো ওর সামনে!এই সময় এই ধরনের কথা শুনতে নেই।জানো না জান্নাহ্…।”

“আপু।”

আবারো তাকে থামিয়ে দেয় জান্নাহ্।শায়িখকে ইশারা করে চলে যেতে।শায়িখ যেতেই উৎসুক গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে শুভ্রা–

“এই কী হয়েছে বলতো তোর!বারবার আমাকে থামাচ্ছিস কেন?

জান্নাহ্ খসখসে ঠোঁট দুটো জীভ দিয়ে ভিজিয়ে অনুযোগের সুরে বললো—

“সারহানকে বলিনি আমি।”

শুভ্রা বাজ পড়ার মতো আঁতকে উঠে বললো–

“কি!সারহান জানে না!কী বলছিস এইসব?

জান্নাহ্ নম্র গলায় বললো–

“সারহান জানে না।সে ফিরলে তারপর বলবো।”

শুভ্রা জান্নাহ্ এর হাত ধরে ঝাঁকি মেরে ত্রস্ত কন্ঠে শুধালো–

“এই তুই কী বলছিস বলতো!তুই কনসিভ করেছিস সেইটা সারহান জানে না?

জান্নাহ্ ভোলা ভোলা দৃষ্টিতে তাকিয়ে মোলায়েম গলায় বললো–

“উঁহু।”

বজ্রকঠোর গলায় খেমটি মেরে উঠে শুভ্রা–

“কী করেছিস বলতো?

জান্নাহ্ কিছুক্ষন চুপ থেকে নির্বিকার গলায় বললো–

“আম্মা যা বলেছে তাই করেছি।আমি পিল খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম।”

শুভ্রা চোখের পাল্লা ছড়িয়ে অবিশ্বাস্য গলায় বললো–

“এমন কেন করলি তুই!সারহানকে না জানিয়ে এইসব করার কী দরকার ছিলো তোর!এখন আমি কিছু জানি না।তুই,তোর আম্মা আর সারহান বুঝবি।আমাকে কিছু বলতে পারবি না।”

জান্নাহ্ ভীত গলায় বলে উঠে-

“এমন করে বলো না প্লিজ।আম্মা বললো উনি সবকিছু সামলে নেবে।সারহানকে বোঝাবে।”

শুভ্রা গা ঝাড়া দিয়ে বললো–

“তাইলে বোঝা।আমাকে কেন বলছিস!

টলটল করে উঠে জান্নাহ্ এর দুই চোখ।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here