#জান্নাহ্
#পর্বঃ৭৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
বর্ষার নতুন আমেজ শুরু হয়েছে।থৈ থৈ জলে ভরেছে চারপাশ।প্রভাকরের প্রখর তীব্র তাপদাহে ঝলসে যাওয়া পত্রপল্লব সেজে উঠেছে নতুন প্রাণে।বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় যেনো প্রাণের আহ্বান।প্রকৃতি তার রূপ সঞ্জীবনী ফিরে পেয়েছে নতুন আঙ্গিকে।
বর্ষার প্রথম পশলার বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু সারহান।বৃষ্টির আর্দ্রতা তার দেহপিঞ্জরের তপ্ততাকে হার মানাতে পারে নি।অরুণলোচনে তাকিয়ে আছে ইহতিশামের চক্ষু বরাবর।পাশে দাঁড়ানো ইহতিশামের মা,বাবা নির্বাক।ভীতসন্ত্রস্ত ইহতিশামের ছোট ভাই।সারহানের ক্রোধিত কন্ঠে দাপিয়ে উঠে বদ্ধ ঘর।বললো—
“কেন করছিস এইসব?কেন কেড়ে নিলি আমার মেয়েকে?
ইহতিশাম নিরুত্তর।সে অনিমেষ চেয়ে রইলো সারহানের ভেজা মুখটার দিকে।বৃষ্টির ফোঁটা জল চুইয়ে পড়ছে সারহানের এলোথেলো চুল দিয়ে সেই সাথে তার চোখের নোনতা জল।ইহতিশাম মৃদু গলায় বলে উঠে–
“বিশ্বাস কর আমি কিছুই জানি না।আমি ভাবতে পারি নি মেহনাজ এমন একটা কাজ করে বসবে।”
“কি জানতি তুই?কিছু না।কেন কেড়ে নিচ্ছিস আমার শান্তি।অামার মেয়েকে কেন কেড়ে নিলি?কোথায় খুঁজবো আমি ওকে?
ক্রন্দনরত সারহানের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইহতিশামের বাবা,মা।ইহতিশাম সরব গলায় বললো—
“আই এম সরি ইয়ার।আমি সত্যি বলছি আই ডোন্ট নো।গত কয়েক মাস ধরে মেহনাজের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিলো না।ও বাড়ি ছেড়ে যেতেই ভেবেছি আমাকে ছেড়ে চলে গেছে রাগ করে ওর বাবার কাছে।কিন্তু ও যে এমন একটা কাজ করবে আমি ভাবনাতেও আনি নি।”
ধপ করে কাউচের উপর বসে সারহান।দুই হাতে মাথার চুল টেনে ধরে অসহায় গলায় বললো—
“তোরা সবাই আমার পেছনে কেন লাগলি বলতো?এই পৃথিবীতে কী কারো ভালোবাসার যোগ্য নই আমি?যাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবেসেছি সে মানুষটাও আমাকে ধোঁকা দিলো।কাকে বিশ্বাস করবো আমি বলতো?কাকে?
ইহতিশাম নিঃশব্দে সারহানের পাশে বসে।বাঁধাহীন সুরে বললো–
“জান্নাহ্ এর চেয়ে বেশি তোকে কেউ ভালোবাসেনি সারহান।মেয়েটা এই বয়সেও তোর জন্য কম কিছু করে নি।একবার ওর দিকটা ভাব।কতোটা কষ্ট চেপে রেখে নিজের সদ্য জন্ম নেওয়া সন্তানকে আরেকজনের হাতে তুলে দিয়েছে!
“এখন আমি কী করবো বলতো?মেহনাজ কেন এমন করলো?
ইহতিশাম নরম গলায় বললো–
“আমি ওকে কখনো ক্ষমা করবো না।জান্নাহ্ এর মেন্টাল কন্ডিশন ঠিক নেই।প্রেগন্যান্সিতেও মেয়েটা কম কষ্ট ভোগ করে নি।ডিপ্রেসড ও।মেহনাজ কী থেকে কী বলেছে।কে জানে!
সারহান কাতর গলায় বললো–
“এখন আমি কী করবো বলতো?আর কতো শাস্তি দিবি তোরা আমাকে। আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দে ইহতিশাম।আমি ওকে এখান থেকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবো।আর কখনো আসবো না তোদের মাঝে।কথা দিলাম তোকে আমি।”
ইহতিশাম আশ্বস্ত গলায় বললো—
“ভরসা রাখ আমার উপর।আমি তোর মেয়েকে খুঁজে বের করবো।”
তাচ্ছিল্য গলায় সারহান বললো—
“কার উপর ভরসা রাখবো আমি!যখন যাকে ভরসা করেছি সেই সুযোগ নিয়েছে আমার।আমার এই নোংরা জীবনের জন্য কী শুধু আমিই দায়ী?
আমার পরীকে ফিরিয়ে দে আমায়।আমি সারাজীবন তোর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো।”
ইহতিশাম নির্বিকার গলায় বললো–
“শান্ত হ সারহান।আমি কথা দিচ্ছি তোকে।তোর মেয়েকে আমি ফিরিয়ে আনবো।জান্নাহ্ নিশ্চয়ই জানে মেহনাজ কোথায় আছে?
সারহান বিতৃষ্ণা গলায় প্রত্যুক্তি করে–
“জানি না।জানি না আমি।আমি শুধু আমার মেয়েকে ফেরত চাই।চলে যাবো তোদের দৃষ্টি সীমার বাইরে।এখান থেকে অনেক দূরে।কখনো ফিরবো না আর।শুধু আমার রক্তকে ফিরিয়ে দে আমায়।আমি যদি ওকে না দেখে মরে যাই আমার আত্নাও যে শান্তি পাবে না ইহতিশাম।”
,
,
,
গাঢ় অন্ধকার ক্রমশ প্রগাঢ় হতে লাগলো।অন্ধকার রাত্রিতে এক বাবা তার সন্তানকে পাওয়ার আশায় ঘুরে বেড়ায় শহর রাস্তার অলিতে গলিতে।তার সঙ্গী হয় রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুর।
শ্রান্ত-পরিশ্রান্ত সারহান মধ্য রাতে ফেরে ঘরে।নিমিঝিমি তার চোখ,ঢুলুঢুলু তার দেহ।গায়ে বিশ্রি মদের গন্ধ।নিজের কষ্ট ভুলতে নাকি মানুষ পানশালায় যায়।তাই আজ সারহানও তাই করলো।যে সারহান পাব,বার আর নৈশ হোটেলে কোনায় কোনায় জীবনের অর্ধেকটা সময় কাটিয়েও কখনো এইসব জিনিস ছুঁয়েও দেখেনি আজ সেই নিষিদ্ধ জিনিসই তার রাতের সঙ্গী।
বেডরুমে অগোছালো হয়ে গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন জান্নাহ্।ধীর পায়ে তার পাশে বসে সারহান।জান্নাহ্ এর মুখটা দেখে মনে হলো হাজার বছর পর সে তার রজনীগন্ধাকে দেখছে।নেশার্ত সারহান তার আঙুল ছোঁয়াতে থাকে জান্নাহ্ এর শুষ্ক ঠোঁটে।নড়ে উঠে জান্নাহ্।এতোটা কাছে সারহানকে দেখে ভড়কে উঠে সে।ভীত চোখ দুটো প্রশ্বস্ত করতেই তার অধর জুড়ে আর্দ্রতা মাখিয়ে দেয় সারহান।নেশার্ত সারহান বেসামাল।তার ছোঁয়ায় ক্রমশ সক্রিয় হয়ে উঠে জান্নাহ্ এর থিতিয়ে থাকা অনুভূতি।জান্নাহ্ এর অধর ছেড়ে তার গলার দিকটায় আর্দ্র অধরের স্পর্শ আঁকে সারহান।জড়িয়ে ধরে সারহানকে জান্নাহ্।
আচমকায় নেশায় বিভোর সারহান ধাক্কা মারে জান্নাহ্কে।হতচকিত জান্নাহ্ আঁতকে স্তব্ধ হয়ে যায়।সারহান নেশার্ত গলায় ক্ষীণ আওয়াজে বললো—
“চলে যান এখান থেকে,চলে যান।কাউকে চাই না আমার।কাউকে না।সারহান আর কোনোদিন কাউকে ভালোবাসবে না।কোনোদিনও না।যেখানে ইচ্ছে চলে যান আপনি।মুক্তি চেয়েছেন আপনি তাই না?দিলাম আপনাকে মুক্তি।আজ থেকে আপনি মুক্ত।আমার ভালোবাসা থেকে মুক্ত।আমার বুকের শ্বাস থেকে মুক্ত।আমার হৃদয়ের স্পন্দন থেকে মুক্ত।আমার দুঃখিত চোখের নহর থেকে মুক্ত।আমার অস্তিত্ব থেকে মুক্ত আপনি।সারহানের জীবন থেকে মুক্ত আপনি।তার রজনীগন্ধা থেকে মুক্ত আপনি।চলে যান এখান থেকে,চলে যান।”
হৃদয়ের রুদ্ধদ্বার ভেঙে কেঁদে উঠে জান্নাহ্।তার প্রাণের এই অবস্থার জন্য সেই দায়ী।শরীর কাঁপিয়ে কেঁদে উঠে জান্নাহ্।বেডরুম থেকে বেরিয়ে লিভিং রুমে আসে জান্নাহ্।উন্মাদের মতো কাঁদতে থাকে।নিজের প্রাণকে দায় মুক্ত করতে তার প্রাণপাখিকেই কেড়ে নিলো তার থেকে।হাঁপিয়ে উঠে জান্নাহ্।মাথাটা কাউচে এলিয়ে দিতেই চোখ বুজে আসে তার।
এ ঘুম না তার শেষ ঘুম হয়!
চলবে,,,
(বিঃদ্রঃ
পর্ব কেন ছোট নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন?আপনার রেসপন্স করলেই আগামী তিন চারদিনেই জান্নাহ্ শেষ হবে।
ধন্যবাদ।)¡