#জাস্ট_ফ্রেন্ডস
#শেষ_পর্ব
~মিহি
-“রুদ্ধ সাহেব! এসেছেন তবে। ভেবেছিলাম এই অপরাধীকে বোধহয় আর বিশ্বাস করবেন না।”
-“যা বলার তাড়াতাড়ি বলো।”
-“আফনান শাহরিয়ারের নাম শুনেছেন?”
-“আমার বান্ধবী প্রেমার বাবা তিনি।”
কথাটা শোনামাত্র ভ্রু কুঁচকালো রাজন। পরক্ষণেই আবারো বলতে শুরু করল,
-“খুব বেশি সময় আমাকে দেওয়া হয়নি। তাই খুব সংক্ষেপে বলি। আমি একটা দলের হয়ে কাজ করতাম। নারী পাচার দল আর কী! পরবর্তীতে সে দল থেকে বেরিয়ে নিজের একটা দল বানিয়ে ফেলি। ফলে আগের দলের খ্যাতি অনেকটাই কমে যায়। ঐ দলের লিডার নানান চক্রান্ত করে আমাকে জেলে পাঠায়। সেসব না বলি। জেল থেকে বের হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চেয়েছিলাম তখন আমার মেয়েকে খুন করা হয়। আমার পাপের ফল! একদিন সংবাদ পাই ‘গুরু’ নামের এক লোক আমার মেয়েকে ফেরাতে পারবে অশুভ শক্তি দ্বারা। বদ্ধ উন্মাদ আমি তখন। যে যা বলত, মেনে নিতাম। তোমার বান্ধবীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার আদেশ পেলাম। ওরা অবশ্য চেয়েছিল আমার হাত দিয়ে প্রেমাকে মেরে আমাকে একেবারে জেলে পাঠিয়ে দিতে, আবারো! সেটা হলো না।”
-“লিডারটাকে চেনেন আপনি? তাহলে পুলিশকে ওনার তথ্য দিন।”
-“লিডারের নাম আফনান শাহরিয়ার। একমাত্র আমিই তার আসল নাম জানতাম। সেজন্যই আমাকে সরাতে চেয়েছিল।”
-“প্রেমার বাবা? ওনি প্রেমাকে কিডন্যাপ করার অর্ডার কেন দিলেন?”
-“একটা ব্যক্তিগত কথা বলি। প্রেমার জীবন নিয়ে! প্রেমার আসল বাবা উনি নন। ওনি প্রেমার মায়ের দ্বিতীয় স্বামী, সম্পত্তির লোভে প্রেমার মাকে বিয়ে করেছিলেন।”
-“আপনি কি সত্যি বলছেন নাকি ম্যানুপিউলেট করার চেষ্টা করছেন?”
-“আপনার কাছে মিথ্যে বলে আদতে আমার কোনো লাভ আছে কি?”
-“প্রেমার বাবার উপর আপনি যে অভিযোগ তুলছেন, তার কোনো প্রমাণ আছে আপনার কাছে?”
-“যে মূর্তিটা তোমরা পেয়েছো, তার মধ্যে একটা চিপ আছে। ঐটা চেক করতে হবে, তাহলেই সব প্রমাণ পাবে।”
-“পুলিশকে না বলে এসব কথা আমাকে কেন বলছেন? সরাসরি পুলিশকে জানালেই পারতেন।”
-“পুলিশের কিছু সদস্যও ঐ লোকটার সাথে জড়িত। এতটা সময় ঐ লোকের গ্যাংয়ে থেকেছি, অনেক কিছুই জানি। আমি এখন অবধি কাউকে ভরসা করে উঠতে পারিনি তবে আমি জানি তুমি প্রেমাকে ভালোবাসো। ওকে বাঁচানোর জন্য তুমি সব করতে পারবে। এই ভরসাতেই তোমাকে সত্যিটা বলার ঝুঁকি নিলাম।”
-“আপনাকে কে বলল আমি প্রেমাকে ভালোবাসি?”
-“ভালোবাসা- সে কি মুখে বলার জিনিস? প্রিয়তমার বিপদে যার উদ্বিগ্ন চোখ পলক ফেলে না, নিজের জীবনের ধার ধারে না, তার অনুভূতি আমার কাছে ধরা দিবে না? শোনো, আমিও ভালোবেসেছিলাম কাউকে, হৃদয়ের প্রতিটা স্পন্দন দিয়ে। তীব্র ভালোবাসা ছিল তো, হারিয়েছি তাকে। তার প্রতারণার স্বাদটাও বিষাক্ত মনে হয় নি। বাদ দাও এসব। তুমি এখন কী করবে ভাবছো?”
-“আমারও একটা ঝুঁকি নিতে হবে। আমার জানাশোনা একজন প্রভাবশালী মানুষ আছেন তবে তিনি আমার সাহায্য করবেন কিনা জানিনা। চেষ্টা করে দেখতে হবে।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে। এখন যাও তুমি।”
-“আচ্ছা ওয়েট! পুলিশ যদি ঐ লোকটার সাথে মিলেই থাকে, তবে আপনার সাথে আমাকে দেখা করতে দিল কেন?”
-“তুমি কি ভেবেছো পুলিশ স্টেশন থেকে কল গেছে তোমার কাছে? নাহ! কলটা আমি করিয়েছিলাম, একজনকে টাকা দিয়ে। তুমি পুলিশ স্টেশনে এসে দেখা করার কথা বলেছো, তোমাকে ডাকা হয়েছে সেটা বলোনি। তাই তারা দেখা করতে দিয়েছে।”
-“আপনি কিভাবে বুঝলেন আমি ডাকার কথা বলবো না?”
-“রিস্ক নিয়েছিলাম একটু। আচ্ছা, তোমার মনে হয়না আমি খুব খারাপ মানুষ?”
-“কয়েক ঘণ্টা আগ অবধি মনে হতো, এখন মনে হচ্ছে না। আপনি খারাপের মুখোশ পড়া একজন ভদ্রলোক।”
-“ওহ আরেকটা কথা! প্রেমাও তোমায় ভালোবাসে। তোমার মুখ থেকে শোনার অপেক্ষায় আছে।”
রাজনের কথা শুনে রুদ্ধ আর কিছু বলে না, স্রেফ হাসে। রুদ্ধ বের হতেই একডন পুলিশ ব্যতিব্যস্ত গলায় প্রশ্ন করে,”লোকটা কী বললো তোমায়?” রুদ্ধ খানিকটা চিন্তিত হওয়ার ভান করে বলে,”লোকটা নাকি কিছুই জানেনা। এসব কেউ তাকে দিয়ে করায়নি। সে স্বেচ্ছায় করেছে।” রুদ্ধর কথা শেষ হওয়ামাত্র পুলিশের মুখ থেকে চিন্তার ছাপটা সরে যায় যা রুদ্ধর দৃষ্টি এড়ায় না।
________________________________________________________
বাড়িতে ফিরে রুদ্ধ কেবলই বসতে যাবে এমন সময় টুং করে একটা মেসেজের শব্দ এলো। মেসেজ ওপেন করতেই দেখে প্রেমার মেসেজ,
‘রুদ্ধ, আমি চলে যাচ্ছি। বাবা আর কোনোভাবেই আমাকে এখানে রাখতে চান না। একটা কথা…থাক দরকার নাই। তোরা ভালো থাকিস আর শোন! বিয়ে করে নে এবার। বুড়ো হচ্ছিস। নিজের খেয়াল রাখিস।’
প্রেমার মেসেজে রুদ্ধর পৃথিবী যেন থমকে গেল। প্রেমার বাবা যদি প্রেমাকে নিয়ে চলে যায়, তাহলে আর তাকে বাঁচানোর কোনো সুযোগ থাকবে না তার কাছে। এখন একটাই উপায় আছে। দ্রুত গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বের হয় রুদ্ধ।
মাত্রই একটু ঘুমিয়েছেন আদনান রাহমান। বাইরের চেঁচামেচিতে দৌড়ে উঠে এলেন। বিশাল বাড়িতে একা তিনি, বাইরে একজন গার্ড আছে কেবল। বাইরে আসতেই দেখলেন রুদ্ধ গেটে দাঁড়িয়ে। তাকে দেখামাত্র দৌড়ে এলো তার কাছে। রুদ্ধর উপর তার অবশ্য আর রাগ নেই। বিয়ের রাতেই অদৃতা তাকে কল করে সব বলেছিল। রুদ্ধর সাজানো নাটক, অদৃতা আর আদিলের লুকোচুরি প্রেম সবটাই। তিনি নিজের মেয়ের উপর বড্ড খুশি হয়েছিলেন। অন্তত তার মেয়ে দিনশেষে হলেও সত্যটা জানিয়ে সংসার শুরু করেছে। রুদ্ধর কাছে মাফ চাইতে চেয়েছিলেন তবে সুযোগ হয় নি। তবে আজ রুদ্ধর উপস্থিতিটা তাকে নিশ্চিন্ত করল।
তিনি কিছু বলার আগেই রুদ্ধ বলতে শুরু করলো,
-“আঙ্কেল! আগের কথা সব ভুলে যান। আমায় দয়া করে একটু সাহায্য করুন।”
-“তোমার উপর রাগ নেই আমার বরং আমি খুশি। অদৃতা সবটাই বলেছে আমায়। তুমি ভেতরে এসো।”
-“সে সময় নেই আঙ্কেল।”
-“আচ্ছা, কী হয়েছে সেটা বলো।”
রুদ্ধ শুরু থেকে শেষ সবটুকুই সংক্ষেপে বললো। রুদ্ধর কথা শুনে আদনান রাহমান কিছুক্ষণ ভেবে বললেন,” আচ্ছা বুঝেছি। আমার জানা একজন বিশ্বস্ত অফিসার আছে। আমি তার টিমসহ এয়ারপোর্টে যাচ্ছি। তুমি তাড়াতাড়ি গিয়ে প্রেমাকে আটকাও। এয়ারপোর্টে কোনো সমস্যা হলে আমায় কল দিও।”
আদনান রাহমানের কথা বলতে দেরি আছে, রুদ্ধর যেতে দেরি নেই। প্রেমাকে হারাতে চায় না সে, কিছুতেই না…
_______________________________________________
এয়ারপোর্টে একটা গণ্ডগোল স্পষ্ট দৃশ্যমান! বাধ্য হয়ে জার্নি টাইম দু’ঘণ্টা পেছানো হয়েছে। আফনান শাহরিয়ারকে ঘিরে পুলিশের দল। তিনি কিছুক্ষণ পর পর ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে রুদ্ধর দিকে তাকাচ্ছেন। অবশেষে তিনি স্বীকার করলেন তিনি প্রেমার সৎ বাবা এবং সবটাই তিনি ঈরেছেন সম্পত্তির জন্য। প্রেমা বাংলাদেশে মারা গেলে তার উপর কেউ সন্দেহ করত না তাই তিনি এই প্ল্যান করেন আর রাজনকে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্য ছিল তাকে রাস্তা থেকে সরানো। রাজন আফনান শাহরিয়ারের আসল রূপটা জানতো। যদিও ও কাউকে বলবে কিনা নিশ্চিত ছিলেন না তিনি তবুও এই ভয় নিয়ে বাঁচতে চান নি। সবটা শোনার পর পুলিশ তাকে অ্যারেস্ট করলো। আদনান রাহমান রুদ্ধর দিকে তাকিয়ে হাসলেন। রুদ্ধ কৃতজ্ঞতাসূচক ধন্যবাদ জানালো। প্রেমা মূর্তির ন্যায় বসে আছে এক কোণে। তার কাছে জীবনের এতগুলো বছর মিথ্যে হয়ে গেছে। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারছে না সে। রুদ্ধ ঠিক কিভাবে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছে না কিন্তু কথাগুলো আজ তাকে বলতেই হবে।
-“এই প্রেমা! শোন!”
-“হুহ, শুনছি।”
-“তুই কি আমার উপর রেগে আছিস?”
-“নাহ।”
-“ওহ আচ্ছা।”
রুদ্ধ চুপ হয়ে যায়। কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। তাই বারবার প্রেমার দিকে তাকাচ্ছে। “তুই কি কিছু বলবি?” প্রেমার প্রশ্নে হকচকিয়ে যায় সে। এদিকে প্রেমা ভেবে রেখেছে যদি রুদ্ধ আজও কিছু না বলে তাহলে প্রথমে জুতো খুলে ওকে পেটাবে তারপর ফ্লাইট ধরে চলে যাবে। রুদ্ধর গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না তবুও অনেক কষ্ট মিইয়ে যাওয়া গলায় হ্যাঁ বলল।
-“তো বল কী বলবি।”
-“আসলে হয়েছে কী…না মানে..আমি আ…আসলে…তো…তোকে…না মানে..আমি …”
-“এক থাপ্পড় দিয়ে সব দাঁত ফেলে দিতে ইচ্ছে করতেছে।(বিড়বিড় করে)”
-“তুই কিছু বললি?”
-“তুই কী বলবি সেটা শোনার অপেক্ষায় আছি।”
-“কিছু না।”
মুহূর্তের মধ্যে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল প্রেমার। উঠে বললো,”বেশ থাক! আমার ফ্লাইটের টাইম হয়ে গেছে। আমি যাবো।” প্রেমার কথায় রুদ্ধর হাত পা কাঁপতে শুরু করল। প্রেমা চলে যাবে? কেন? রুদ্ধর মাথায় আর কিছু আসলো না। চোখ বন্ধ করে বলে ফেলল,” প্রেমা আমি তোকে খুব ভালোবাসি।” রুদ্ধ ঠিক করে রেখেছে প্রেমা না বলে দিলে সে সোজা উল্টো দিকে ঘুরে চলে যাবে। প্রেমাকে নিজের মুখটাও দেখাবে না। “দেখ রুদ্ধ! উই আর জাস্ট ফ্রেন্ডস! এর বাইরে আমি কিছু ভাবি না..” প্রেমা আর কিছু বলার আগেই রুদ্ধ পেছনে ঘুরলো। চোখের পানিটা অন্তত প্রেমার সামনে পড়তে দেওয়া যাবে না। পেছনে ঘুরে চোখ খুলতেই টুপ করে চোখ বেয়ে জল গড়ালো। বাম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সে জল মুছতেই প্রেমা পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লো রুদ্ধর উপর। একরকম জাপটে ধরলো তাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় বোবা হয়ে গেছে রুদ্ধ। প্রেমা তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেই বলল,”এত বছর লাগলো বলতে? ছাগল একটা!” রুদ্ধ চোখ পিটপিট করছে। স্বপ্ন দেখছে না তো সে?! এই খাদকটা অবশেষে তার ঘরেই যাচ্ছে? সত্যিই? আচমকা প্রেমা রুদ্ধকে ছেড়ে দিয়ে প্রশ্ন করলো,”আচ্ছা, তুই কী করে জানলি বাবা আমায় মেরে ফেলতে চায়? তোকে কে বললো?” রুদ্ধ বোধহয় সুযোগ পেল। সাহস নিয়ে প্রেমার কানের কাছে গিয়ে বললো,”বাসর রাতে বলবো!” রুদ্ধর বলতে দেরি, প্রেমার ‘অসভ্য! নির্লজ্জ’ আখ্যা দিতে দিতে রুদ্ধর পিঠে কিল বসাতে দেরি নেই।
সমাপ্ত||
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আমি যখনি গল্প লেখা শুরু করি, আমার মাথায় পরীক্ষার টেনশন ভর করে। ফলস্বরূপ বিরাট পর্বের গল্পগুলো আমার লেখা হয়না। যাই হোক, যারা শেষ অবধি পাশে ছিলেন, অশেষ ধন্যবাদ।]