জাস্ট ফ্রেন্ডস পর্ব-৭

0
1667

#জাস্ট_ফ্রেন্ডস
#৭ম_পর্ব
~মিহি

শুভ্র আর রেহানকে এক হ্যান্ডকাফে আটকানো হয়েছে। দুজনেরই আঘাতপ্রাপ্ত হাত ব্যতীত অপর হাতে হ্যান্ডকাফ। চাইলেই ঘাতক তাদেরকে বন্দি করতে পারত কিন্তু সে সেটা চাচ্ছে না। আশেপাশে তাকিয়ে রুদ্ধকে খোঁজার চেষ্টা করছে দুজনেই। সমস্যা হচ্ছে দুজনকে একদিকেই যেতে হচ্ছে। সামান্য দুরত্ব রেখেও হাঁটা যাচ্ছে না। রেহানের টলমল অবস্থা। ছেলেটা এমনিতেই একটু দুর্বল, তার উপর আঘাত লেগেছে। রেহানের জন্য একটু পর পর শুভ্রকে বসতে হচ্ছে। রেহান ঠিকমতো উঠতেই পারছে না। সবকিছু অন্ধকার দেখছে সে। শুভ্র চারপাশে খুঁজছে। জঙ্গলটা ঠিক কতটা গভীর তা সে জানেনা তবে গুগল থেকে জানা তথ্যের ভিত্তিতে এটা একটা রহস্যময় জঙ্গল। এখান থেকে বের হওয়াটা যে সহজ হবে না তা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে শুভ্র। আপাতত রুদ্ধকে খুঁজে পেলে অনেকটা উপকার হবে। ছেলেটা আদৌ সুস্থ আছে তো?

শুভ্র একটু এগোতেই বেশ কিছু পায়ের ছাপ দেখতে পেল। এসব কোনভাবে রুদ্ধর নয় তো? কিংবা সেই লোকটার যে তাদেরকে এখানে এনেছে আর প্রেমা আর তনয়াকে বন্দি করে রেখেছে? রেহান নড়তে পারছে না। এভাবে ওকে সাথে নিয়ে এগোনো সম্ভব না। আশেপাশে ভারি কোনো পাথর খোঁজে সে। খুব বড় না, মাঝারি সাইজের একটা পাথর খুঁজে পায়। রেহান তো পাথর দেখামাত্র ভ্রু কুঁচকায়ে ফেলে।

-“তুই কি এই পাথর দিয়ে আমার হাত থেঁতলে দিয়ে আমাকে ফেলে পালাতে চাচ্ছিস?”

-“ছাগল রে! পা চলে না তোর আর মুখ থামে না। ইচ্ছে করতেছে পাথর দিয়ে তোর মুখ থেতলে দেই। চুপ করে বসে থাক। হাত রাখ মাটিতে।”

-“না, আমি রাখবো না।”

-“ভাই, প্লিজ! এই বিপদের সময় ঢঙ করিস না। আল্লাহর দোহাই লাগে।”

রেহান হাত রাখলো মাটিতে। শুভ্র বেশ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে হ্যান্ডকাফটাতে জোরেসোরে একটা আঘাত করল। রেহানের চিৎকারে এক মুহূর্তের জন্য ঘাবড়ে গিয়েছিল সে। পরমুহূর্তেই আলহামদুলিল্লাহ পড়লো। রেহানের হাত ঠিক আছে, হ্যান্ডকাফটাও খুলেছে। রেহানকে একটা গাছের পাশে বসিয়ে পায়ের ছাপ অনুসরণ করতে লাগল শুভ্র। আট নম্বর জুতোর ছাপ, এটা রুদ্ধরই। মনে মনে কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হলো সে। একবার রুদ্ধকে পেয়ে গেলে সবাই মিলে প্রেমা আর তনয়াকে খুঁজে বের করাটা ব্যপার নাহ।

রুদ্ধর প্রচণ্ড মাথা ঘুরছে। কিছুতেই চারফাশ স্পষ্ট দেখতে পারছে না সে। অবশ্য চাইলেই একটু বসতে পারে কিন্তু এই মুহূর্তে প্রত্যেকটা সেকেন্ড তার জন্য দামি। হাতের ঘড়িটাও নেই, সূর্যের আলো জঙ্গলের গাছগুলো আড়াল করে ফেলেছে। সন্ধ্যে নামলে চারপাশটা বিদঘুটে অন্ধকার হয়ে যাবে। তখন আর নিজের ছায়ারও সন্ধান পাওয়া যাবে না। রুদ্ধর কেন যেন মনে হচ্ছে সে বারবার ঘুরে ফিরে একই জায়গায় এসে দাঁড়াচ্ছে। অবশ্য এটা তার ভুল ধারণা কেননা জঙ্গলের প্রতিটা মোড় একই রকম। রুদ্ধ ঠিক করলো তার যাওয়ার চিহ্ন রাখবে। যদিও হে তখনো আশেপাশে কোনো চিহ্ন রাখার মতো বস্তু খুঁজে পায়নি। ঝাপসা চোখে বারবার প্রেমার ছবি কল্পনা করছে সে। আফসোস হচ্ছে, কেন সে আগেই প্রেমাকে সব বললো না? দুই বছর আগে যে ভুলটা হে করেছিল, সেই একই ভুলটা আবারো কী করে করতে পারল সে! আগেরবার প্রেমা হারিয়েছিল নিজের ইচ্ছেতে, ফিরেছেও কিন্তু এবার যদি আর না ফিরে? রুদ্ধ যদি আর কখনো প্রেমাকে ফিরে না পায়? বুকের ভেতরে একরাশ শুন্যতা জমাট বাঁধে রুদ্ধর। হিংস্র পশুর চিৎকারের শব্দ শুনতে পাচ্ছে রুদ্ধ। একবার মনে হচ্ছে চিৎকারটা সত্যি, একবার মনে হচ্ছে হ্যালুসিনেশন। আশেপাশের সবকিছুই হ্যালুসিনেশন মনে হচ্ছে তার। কপাল থেকে রক্ত পড়া এখনো বন্ধ হয়নি। ঘাস দিয়ে কিছুক্ষণ আটকে ছিল কিন্তু এখন আবারো রক্ত স্বগতিতে প্রবাহিত হচ্ছে। রুদ্ধর যত চিন্তা তার বন্ধুদের নিয়ে। তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল এখানে আসতে রাজি হওয়া।

রাজন গুরুর পাঠানো লোক দুটোকে বেঁধে রেখেছে। রীতিমতো লোকগুলো স্বীকারও করে ফেলেছে ‘গুরু’ আসলে কোনো সাধক নয়। সে একজন ছোটখাটো স*ন্ত্রাসী। লোকের থেকে টাকা নিয়ে কিডন্যাপ করা, খু*ন করা এসব তার পেশার অন্তর্ভুক্ত। রাজনের একমুহূর্তের জন্য নিজেকে চরম বোকা একজন মানুষ মনে হয়। মেয়ের শোকে সে একদম বদ্ধ উন্মাদ হয়ে উঠেছে। এখন তার তীক্ষ্ম মস্তিষ্কটা সচল হচ্ছে যে মস্তিষ্কে জং ধরিয়ে পালিয়েছে রুখমিনী। অবশ্য মেয়েটাকে সে বড় বেশিই ভালোবেসেছিল। নারী পাচার দলের সাথে দীর্ঘদিন থাকার পর রাজনের মনে হলো তার নিজের একটা দল থাকবে। ঐ দল থেকে অব্যাহতি দিয়ে নিজের দল গঠনের চেষ্টা করল সে কিন্তু কেউই তার দলে আসতে রাজি নয়। বাধ্য হয়ে একাই কাজ করতে শুরু করলো। মাসখানেক যাওয়ার পর তার বেশ নামডাক শুরু হলো চারদিকে। বেশ কয়েকজন তার দলে যোগ দিল। আগের নারী পাচার দলটা খেই হারিয়ে ফেলল। সবকিছু ভালোই চলছিল। একদিক রুখমিনী নামের এক মেয়েকে আনা হলো পাচারের জন্য। ভয়াবহ সুন্দরী না হলেও সে মেয়ের চোখে নির্ঘাত কোনো ভয়ঙ্করী মায়া কিংবা বশীকরণ ক্ষমতা ছিল। তার বলেই রাজনকে বশ করে বিয়ে করে ফেলল সে। রাজনের জীবনে ভালো পরিবর্তন আনার শত চেষ্টা তার। অবশেষে সে রাজনকে শর্ত দিয়ে বসলো রাজন যেন পুলিশের কাছে ধরা দিয়ে নিজের শাস্তি মেনে নেয়। রাজন তখন রুখমিনীর প্রেমে মাতোয়ারা। সে তাই করলো। দলটা রসাতলে গেল। রাজনের স্বেচ্ছায় ধরা দেওয়ার কারণে শাস্তি কমিয়ে চার বছরে আনা হলো। রাজনের জেলে সময় কাটত অপেক্ষার প্রহর গুণতে গুণতে। অথচ তার ঘরে যে ষড়যন্ত্র হচ্ছিল, তার বিন্দুমাত্র খবর সে রাখেনি। রাজন যে দলে কাজ করত, সে দলের লিডার রুখমিনীকে পাঠিয়েছিল। রাজন টোপটা ভালোই গিলেছিল। রাজনের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলে সবাই আবার আগের দলে ফেরে। আগের দলটা আবারো সিংহাসনে বসে। রুখমিনী যে রাজনকে ভালোবাসত তাও সত্যি নয়। রাজন চার বছর পর জেল থেকে বের হয়ে জানতে পারে তার চার বছরের একটা মেয়ে আছে। কথাটা মিথ্যে! মেয়েটা রাজনের নয়, রুখমিনীর প্রেমিকের। যার সাথে সে পালিয়েছে নিজের মেয়ের তোয়াক্কা না করে। রাজন জেল থেকে বের হয়ে খুব সাধারণ চাকরিতে ঢোকে যেন মেয়ের জীবন নষ্ট না হয় কিন্তু অতীতের কুকর্মের ফল তাকে পেতেই হয়েছে। শত শত মেয়ের জীবন নষ্ট করার ফল সে পেয়েছে নিজের মেয়েটাকে হারিয়ে।

প্রেমা আর তনয়ার হাত এক দড়ি দিয়ে বাঁধা। দুটো চেয়ারকে এক জায়গায় করে একসাথে হাত বাঁধা হয়েছে। প্রেমার এখনো জ্ঞান ফেরেনি। ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে দুজনকেই। তনয়া ধীরে ধীরে চোখ খোলে। ঝাপসা চোখে দেখতে পায় একটা ঘর। চারপাশে মাটি, অনেকটা সুড়ঙ্গের মতো। তনয়ার সামনেই দুটো লোক মেঝেতে পড়ে আছে। এই দুটো লোক গাড়িতে ছিল সেই লোকটার সাথে। লোক দুটোর অবস্থা দেখেই আঁতকে উঠলো তনয়া।

মানুষ ভুল করে, রাজনও করেছে। ভুলের মাশুলটাও দিয়েছে সে কিন্তু এখন তো আর কিছু হারানোর বাকি নেই। সমস্ত মায়া ইতিমধ্যেই ত্যাগ করে ফেলেছে। তাহলে কেন পুরনো খেলাটায় ফিরতে পারবে না সে? প্রেমা আর তনয়া দুজনের মধ্যে যেকোনো একজনকে নিয়ে খেলতে হবে। কাকে বাইরে পাঠাবে বুঝে উঠতে পারছে না সে। একটা কাগজে দুজনের নাম লিখে সে। অতঃপর কাগজ দুটো মেঝেতে ফেলে। সেখান থেকে যেকোনো একটা কাগজ তুলে হাতে নেয়। কাগজের ভাঁজ খুলতেই জ্বলজ্বল করে ওঠে একটা নাম। রাজনের মুখের হাসি বহমান থাকে। সে যেই নামটা চেয়েছিল সেটাই উঠেছে। প্রত্যাশা আর ভাগ্য মিলে গেলে যে অনুভূতি হয়, তার মতো সুখের বোধহয় কিছু হয় না আর সেই সুখকর মুহূর্তটাই উপভোগ করছে রাজন।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here