#জাস্ট_ফ্রেন্ডস
#৬ষ্ঠ_পর্ব
~মিহি
রুদ্ধর রাগ কমেনি এখনো। অবশ্য এটাকে রাগ বলা চলে না, বড়জোর অভিমান বলা যায়। কেননা এর আগেও বহুবার প্রেমা তাকে খোঁটা দিয়েছে, তাতে কখনো রুদ্ধর মনে কোনো প্রভাব পড়েনি কিন্তু এবার সবকিছু ভিন্ন। অনুভূতি আর অনুভূতির প্রকাশ সবকিছুই এক ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপিত হচ্ছে। কিছুটা দূরে একটা দোকান দেখতে পেল রুদ্ধ। এতটা রাস্তা পেরিয়ে এসে এখানে দোকান? এরপর বোধহয় কোথাও দোকান পাওয়া যাবে না। এখান থেকে কিছু কিনে খাওয়া-দাওয়াটা সেরে ফেলতে পারলে বাঁচা যায়। এই ভেবে গাড়ি থামালো রুদ্ধ।
-“কীরে রুদ্ধ, গাড়ি থামালি যে?”
-“ঐ যে দেখ রেহান, দোকান। চল কিছু নাস্তা কিনে আনি।”
-“শুভ্র তো খাবার এনেছে।”
-“সেসব ওখানের জন্য জমিয়ে রাখ। সব তো শুকনো খাবার। এখান থেকে আপাতত কিছু খেয়ে যাই।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে।”
-“সবাই না হয় একটু বের হয়ে বাইরের বাতাস খেয়ে আসি। অনেকক্ষণ তো গাড়িতে বসে থাকা হলো।”
-“ঠিক বলেছিস।”
রুদ্ধর কথা শুনে সবাই এক এক করে গাড়ি থেকে নামলো। রুদ্ধ প্রেমার থেকে একটু দূরে দূরেই থাকছে। এটা যে সে ইচ্ছে করে করছে এমন না, প্রেমার প্রতি তার অভিমানটা অনেক আগে থেকে ছিল। এই ছোট্ট ঘটনা সেই ছোট্ট বহ্নি শিখাটাকে আগুনের জ্বলন্ত গোলায় পরিণত করেছে। রাগের বশে সে প্রেমাকে উল্টোপাল্টা কিছু বলে ফেলতে পারে এই ভয়েই সে প্রেমার থেকে দূরে দূরে থাকছে। প্রেমা অবশ্য বিষয়টা এখনো আন্দাজ করতে পারেনি। পারলে হয়তো এতক্ষণে বকবক করে রুদ্ধর মাথা খেয়ে ফেলতো।
_______________________
-“ওবায়দুর ভাই, কই যাও?”
-“পরিস্থিতিটা হাতে আনার ব্যবস্থা করতে।”
রাজন আর দাঁড়ালো না। গাড়ির ব্রেক ফেইল করতে হবে তাকে। যাতে সবাই সামনের মোড়েই ধাক্কাটা খায়। অনেকটা ঝুঁকি আছে এতে। তবে একবার গুরুর বলা মেয়েটাকে হাতে পেলে বাকিগুলোকে মরার জন্য ফেলে দিলেও অসুবিধে নেই। শুনশান রাস্তা, মেরে ফেলে গেলেও দেখার কেউ নেই। আচমকা রাজনের মাথায় অদ্ভুত একটা শয়তানি ইচ্ছেশক্তি চেপে বসে। মাথার পাগলামি পোকাটা কি আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো? নাহ! এটা হতে পারে না। যে পাগলামির জন্য তাকে শৈশব নষ্ট করে জেলে যেতে হয়েছিল, সেই পাগলামিটা আবার করে নিজের জীবনটাকে নষ্ট করতে চায় না সে।
রুদ্ধ এসে গাড়িতে বসার পরপরই প্রেমা পাশের সিটটা দখল করল। প্রেমা বেশ কিছুক্ষণ ধরেই লক্ষ করেছে রুদ্ধ তাকে এড়িয়ে চলছে। ঠিক কী কারণে এড়িয়ে চলছে তা এখনো বুঝে উঠতে পারেনি।
-“এই রুদ্ধ, তুই কি রেগে আছিস আমার উপর? এত রুড কবে থেকে হলি তুই? আমার রুদ্ধ তো কখনোই এমন ছিল না।”
-“তোর রুদ্ধ? রুদ্ধ তোর কবে হলো?”
-“ওমা তোর মনে নেই? কত সাধনা করে তোকে পটিয়ে বন্ধুত্ব করেছিলাম। সেই থেকেই তো তুই আমার।”
-“তাই বুঝি?”
-“হ্যাঁ তাই। এখন একটু হাস। এরকম রাগী রাগী মুখে একদম রামছাগল লাগতেছে তোরে।”
রুদ্ধ হেসে ফেলে। তার লজ্জা লাগছে, কোনো কারণ ছাড়াই। মূলত ‘আমার রুদ্ধ’ শব্দটা তার মন কেড়েছে। সামান্য দুটো শব্দ অথচ রুদ্ধর শরীর বেয়ে বিদ্যুতের ঝংকার বয়ে চলেছে শুধু ঐ দুটো শব্দের কারণে।
গাড়ি চলছে আপন গতিতে। রুদ্ধ মনোযোগ দিয়ে প্রেমার বকবক শুনছে। গুগল ম্যাপে দেখলো সামনে রাস্তা দুদিকে গেছে আর সামনের দিকে বিশাল খাদ। রুদ্ধ গাড়ি ব্রেক করার চেষ্টা করে। কিন্তু ব্রেক কিছুতেই কাজ করছে না। রুদ্ধর মনে হচ্ছে যেন তার নিঃশ্বাসটাই বুঝি বন্ধ হয়ে এলো। সামনেই খাদ, মনে হচ্ছে স্টিয়ারিংটাও যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
-“গাড়ি থেকে লাফ দে।”
-“কেন? তুই একা যাবি?”
-“ফাজলামি করার সময় না এটা। সামনেই খাদ, গুগল ম্যাপে দেখাচ্ছে। সম্ভবত আর পাঁচ-ছ’ মিনিটেই সামনে খাদ পড়তে পারে। যত দ্রুত সম্ভব লাফ দে তোরা।”
-“আর তুই?”
-“তোরা লাফ দিলে আমিও নেমে পড়বো কোনোভাবে।”
-“এত স্পিডে চলছে! কীভাবে লাফ দিব?”
ঠিক এমন সময় রুদ্ধর চোখ পড়লো গাড়ির গ্লাসে। পিছন থেকে একটা গাড়ি আসছে। গাড়িটি পাশ ঘেঁষে চলতে শুরু করলো। গাড়ির ভেতর থেকে শ্যামলামতন লোকটা বলে উঠল,”এনি প্রবলেম ভাই?” রুদ্ধ মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
-“ভাই, আমাদের গাড়ির ব্রেক কাজ করছে না। সামনেই খাদ।”
-“আচ্ছা। আমি আমার গাড়ি আপনাদের গাড়ির পাশে নিচ্ছি। আপনারা জানালা দিয়ে বের হয়ে পার হয়ে আসুন।”
-“আচ্ছা। প্রেমা, তুই আগে যা।”
প্রেমা দ্বিধায় ভুগছিল কিন্তু রুদ্ধর রক্তলাল চোখের দিকে তাকিয়ে আর দ্বিধায় পড়ার সময় পেল না। সময় বেশি নেই। প্রেমার পর তনয়াকে পাঠালো রুদ্ধ। এরপর রেহান যেতে যাচ্ছিল এমন সময় পাশের গাড়িটি থেমে যায়। রুদ্ধ ঝাপসা চোখে শুধু দেখল পেছনে পড়ে থাকা গাড়ি থেকে একটা লোককে বের হয়ে নষ্ট গাড়িটাতে লাথি মারতে। রুদ্ধ চোখ বন্ধ করে ফেলল। পেছন থেকে প্রেমার চিৎকারটা শোনার পরপরই চোখ ঝাপসা হয়ে এলো…
___________________________________________________________________________________________________
‘পা…পা…পানিইই…’ পিপাসায় ছটফট করতে করতে ঝাপসা চোখে এলোমেলো পা ফেলছে রুদ্ধ। কপাল ফেটে রক্তে মাখামাখি অবস্থা। চারিদিকে জঙ্গল। ঠিক কীভাবে এখানে এসেছে সে তা জানা নেই। জ্ঞান ফেরার পর হাতের সাথে একটা কাগজ বাঁধা পায়। কাগজে লেখা,
‘Let’s begin this game in this mysterious forest..Either try to find me or your live…Both options will make you reach to me…’
রুদ্ধর লেখাটা পড়তে অনেকটা সময় লেগেছে কেননা চোখের একপাশ থেকে এখনো রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। রুদ্ধর এখন সেই শ্যামলা লোকটার উপর সন্দেহ হচ্ছে। নিজের বোকামির জন্য প্রেমা আর তনয়ার জীবনটা না বিপদে ফেলে দেয় রুদ্ধ! এই চিন্তা তাকে ক্রমশ খেয়ে চলেছে। শুভ্র কিংবা রেহান কাউকেই খুঁজে পাচ্ছে না সে। চারদিকে জঙ্গল। এটাই কি থবে চিকন কালার বন? এক্সিডেন্ট তো অনেকটা দূরে হয়েছিল তাহলে এখানে কি করে এলো সে? রুদ্ধ চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করে শেষ মুহূর্তে কী হয়েছিল। কোনোভাবে স্টিয়ারিংটা বামে ঘুরিয়েছিল রুদ্ধ। ফলে গাড়িটা খাদে না পড়ে গাছের সাথে ধাক্কা লাগে কিন্তু সেই ধাক্কাও খুব একটা হালকা ছিল না। স্টিয়ারিংয়ে মাথা লাগে রুদ্ধর আর শুভ্র, রেহান দুজন দুদিকে ছিটকে পড়ে। রুদ্ধর কিছুই ভালোভাবে খেয়াল নেই। কোথায় আছে সে! তাও জানে না। আর এই চিরকুটটাই বা কে দিল তাকে? তাহলে কি এমনটা হয়েছে যে রুদ্ধর এক্সিডেন্ট হওয়ার পর লোকটা তাকে নিজের গাড়িতে তুলে এখানে এনে ফেলে দিয়েছে? তাহলে শুভ্র আর রেহানেরও তো আশেপাশেই থাকার কথা। ওরা কোথায়? রুদ্ধ বারকয়েক চিৎকার করে উঠে শুভ্র আর রেহানের নাম ধরে। নাহ! শুভ্র আর রেহানের পাত্তা নেই। ওদেরকেও ধরে নিয়ে যায়নি তো লোকটা?
রাজনের মাথা ধরেছে। শয়তানি পোকাটা এতবছর পর মাথায় চড়ার ফল। রাজন দরিদ্র পরিবার সন্তান, দশ বছর বয়সেই বাবা-মাকে হারায়। অতঃপর এতিমখানাই হয় তার একমাত্র স্থান। এতিমখানার জীবনটা তার মনকে ভালো রাখতে পারেনি। সেখান থেকে পালিয়ে এক নারী পাচার দলের সাথে যোগ দেয়। তার দায়িত্ব ছিল মেয়েগুলোর উপর নজর রাখা। নজর রাখার ব্যাপ্তিটা অনেক সময় অনেকটা দীর্ঘও হত। দেখা যেত এক-দু’মাস মেয়েগুলোর উপর তাকে নজর রাখতে হচ্ছে। এই সময়টাতে নিজের আনন্দের জন্য সে মাঝে মাঝেই বিকৃত মস্তিষ্কের কিছু খেলা উদ্ভাবন করত। মেয়েগুলোর মধ্যে যেকোনো একজনকে টার্গেট করত, তাকে ছেড়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে জঙ্গলের মাঝ বরাবর রেখে আসা হত। মেয়েটাকে সুযোগ দিত পালানোর কিন্তু মেয়েটা মূল রাস্তায় আসলেই তাকে ঢলে পড়তে হত মৃত্যুর মুখে। এই পাচার কাজ হত চিকন কালার বনে। বনের বাইরে থাকত দুজন রক্ষী। মেয়েগুলো পালিয়ে বের হলেই শ্যুট! কোনো কথা নেই। এতগুলো মেয়ের মাঝে দু’একজন মরলেও তাদের কিছু যায়-আসত না। বরং এক দলের একজনকে মারলে তাদেরই লাভ, অন্যরা ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকে। কী সুন্দর জীবন ছিল ঐটা! সব শেষ হয়ে গেল, সব! কোনো এক মহাপুরুষ বলেছেন,”পৃথিবীতে যাবতীয় অনিষ্টের পেছনে নারীর হাত থাকবেই।” আজ কথাটা পুনরায় রাজনের মাথায় ঘুরছে। আসলেই নারীর জন্যই তার জীবনটা এরকম বদলেছে। পরিবর্তনটা ইতিবাচক না নেতিবাচক আজও বুঝে উঠতে পারেনি সে। তবে ঘটনাগুলো এখনো চোখের সামনে ভাসে।
চলবে…
[বাসা শিফটিংয়ের প্যারায় পড়ে এত লেইট হলো, তার জন্য অত্যন্ত দুঃখিত। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]