-“তোমার আসলেই লজ্জা নাই প্রেমা? তোমার লজ্জা করলো না নিজের প্রাক্তনের বিয়েতে এসে কব্জি ডুবিয়ে খেতে? ছেলেরা এত নির্লজ্জ হয় জানতাম কিন্তু তুমি এত বেহায়া? তাও পড়ে এসেছো এক পুরনো আমলের শাড়ি! লজ্জা লাগেনা তোমার?”
-“বাহ রে! এত শখ করে দাওয়াত দিলা আর আমি আসবো না ভাবলে কী করে? তোমাকে বিয়ে করে কার জীবনটা ধ্বংস হচ্ছে সেটা অন্তত দেখি।”
মুহূর্তের মধ্যে সবার তীক্ষ্ম নজর এসে পড়লো রুদ্ধ আর প্রেমার উপর। ইতিমধ্যে কানাকানিও শুরু হওয়ার পূর্ব প্রস্তুতি চলছে। সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়ে উঠতে চলেছে জায়গাটা। রুদ্ধ প্রেমাকে বেশ কড়া কিছু কথা শোনানোর জন্য প্রস্তুত হয় কিন্তু তার আগেই প্রেমা গ্লাসের অবশিষ্ট জুসটুকু রুদ্ধর মুখে ছুঁড়ে মারে। রুদ্ধর অপমানিত মুখটা রাগে লাল হয়ে উঠে। প্রেমার গালে সজোরে একটা থাপ্পড় মারে সে। এতক্ষণ সবাই চুপ করে থাকলেও এবার কানাকানি শুরু হয়। রুদ্ধ কটমট করে তাকিয়ে থাকে প্রেমার দিকে।
-“তুই কি যাবি এখান থেকে? রাস্তার মেয়ের মতো আচরণ করিস না। খেতে এসেছিস, খেয়ে চলে যা।”
-“খেয়ে ছেড়ে দেওয়ার অভ্যাস আমার নেই মি.রুদ্ধ মির্জা। তোমার বিয়ে আমি কিছুতেই হতে দিচ্ছি না। দরকার পড়লে আমি পুলিশ ডাকবো।”
-“হা হা হা! আমার হবু শ্বশুর এসব পুলিশদের তার প্যান্টের ব্যাকপকেটে রাখে আর তুমি আমায় পুলিশের ভয় দেখাও? লাইক সিরিয়াসলি? গেট আউট অফ হিয়ার।”
-“আমি কোথাও যাচ্ছি না। তুমি এই বিয়ে ভাঙবে নাকি আমি আরো সিন ক্রিয়েট করবো?”
রুদ্ধ কিছু বলতে যাবে তার আগেই রুদ্ধর হবু শ্বশুর আদনান রাহমান সেখানে এলেন। বেশ রাগী দৃষ্টিতে আশপাশ পর্যবেক্ষণ করলেন তিনি। অতঃপর বিনয়ের সহিত প্রেমাকে বসতে বললেন। প্রেমা বসলো।
-“এই মেয়ে, নাম কী তোমার?”
-“প..প্রে..প্রেমা।”
-“ভয় পেয়ো না। সত্যি বলো।”
-“আঙ্কেল! আপনি যার সাথে আপনার মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছেন, তার সাথে আমার প্রায় চার বছরের সম্পর্ক। এমনকি ও আমায় কথা দিয়েছিল আমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না অথচ এখন আমায় মিথ্যে বলে আপনার মেয়েকে বিয়ে করছে। কারণটা হলো আপনার টাকা।”
-“তোমার কাছে কোনো প্রমাণ আছে?”
-“আমাদের বেশ কিছু ছবি আছে একসাথে।”
-“আজকাল কত ছবিই তো মর্ফ করা যায়। কিভাবে বিশ্বাস করবো তোমায়?”
-“আপনি একজন ক্ষমতাশালী নেতা। যদিও আমার আপনার চোখের উপর সন্দেহ নেই কিন্তু তবুও একজন ভালো মানের যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে ডেকে চেক করে নিতে পারেন এটা মর্ফ নাকি আসল।”
আদনান রাহমান কিছুটা অপমানিতবোধ করলেন। ছবিগুলো হাতে নিয়ে বিস্ফোরিত চোখে রুদ্ধর দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। রুদ্ধ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আদনান রাহমান একবার তাকালেন বধূবেশে থাকা তার ছোট কন্যা অদৃতার দিকে। অদৃতার চোখ ছলছল করছে। আদনান রাহমানের কপালে ঘাম, চিন্তায় ভাঁজ পড়ছে কপালে। আজ বিয়ে না হলে বড়সড় কোনো বিপদ আসন্ন। কী যে করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। অদৃতার মা মারা যাওয়ার পর থেকে তিনিই সামলেছেন তার দুই মেয়েকে। সব দেখে-বিচার করে রুদ্ধকে যোগ্য পাত্র মনে হয়েছিল বলেই বিয়েটা ঠিক করেছিলেন কিন্তু রুদ্ধ যে এমন বের হবে তা তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পাননি। এই মুহূর্তে কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে তার। অদৃতা মারাত্মক সুন্দরী, একদম নিজের মায়ের মতো। যার কারণে আশেপাশের সকলের নজর সবসময় অদৃতার দিকে। বেশ কয়েক মাস ধরেই মেয়েটা অসুস্থ। ডাক্তার দেখিয়ে লাভ হয়নি। এক খ্যাতনামা পীর বলেছেন অদৃতাকে পাওয়ার জন্য কেউ একজন কালো যাদু করেছে যার দরুন অদৃতা বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তিনি আরোও বলেছেন আজকের তারিখের মধ্যে অদৃতার বিয়ে না হলে অদৃতার বড়সড় বিপদ হবে। সব পরিস্থিতি বিবেচনা করেই বিয়ের জন্য এত তাড়াহুড়ো করা।
রুদ্ধকে আদনান সাহেব চেনেন এক অনুষ্ঠানের বদৌলতে। ছেলেটাকে দেখেই তার মনে হয়েছিল ভদ্র, উচ্চ বংশোদ্ভূত ছেলে অথচ এত নিচ তার কর্মকাণ্ড! কী সুন্দর একটা মেয়ের কোলে শুয়ে ছবি অবধি তুলিয়ে অন্য একজনের জন্য কবুল বলতে বসেছে। যাই হয়ে যাক, এ ছেলের সাথে তিনি তার মেয়ের বিয়ে দিতে পারেন না। বুকে ক্ষীণ ক্ষীণ ব্যথা হচ্ছে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। এমন সময় আশার শেষ আলোটা উপলব্ধি করতে পারেন তিনি। বড় মেয়ে তন্নী দৌড়ে আসে।
-“বাবা, আমার দেবর আদিল বিয়ে করবে অদৃতাকে। তূমি দয়া করে এ ছেলের সাথে বিয়ে দিও না ওকে। আমি জানি তুমি কখনোই চাওনি পরিবারের দুই মেয়েকেই এক বাড়িতে পাঠাতে কিন্তু এই মুহূর্তে সেটাই কি ভালো হবে না?”
-“তুই ঠিক বলেছিস মা! আমি এই রুদ্ধর সাথে আমার কলিজার টুকরোর বিয়ে দিতে পারিনা। তুই আদিলকে ডাক। এখানেই বিয়ে হবে ওদের। রুদ্ধ, তুমি কি তোমার পরিবার নিয়ে সসম্মানে যাবে নাকি তোমারও নিজের হবু বউয়ের বিয়ে দেখার শখ আছে? তোমাকে যে আমি এমনি এমনি ছেড়ে দিচ্ছি তা কিন্তু ভেবো না। তোমার পরিণতি কী হবে তা আমি পরে ভেবে দেখবো।”
রুদ্ধ তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে আসে সেখান থেকে। এতটা অপমান সহ্য করা যায় না। রুদ্ধর পরিবারও বেশ রেগে আছে। সোজা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয় তারা। বিয়েটা মেয়ের বাড়িতে ঠিক করা হয়েছিল! নিজের বাড়িতে হলে হয়তো পাড়া প্রতিবেশী যারা বিয়েতে আসেননি, তাদের সামনেও নাক কাটা যেত।
বিয়ে বাড়িতে সকলের মুখ একটু আগেও গম্ভীর ছিল তবে এখন যেন সব স্বাভাবিক। সবার হাসিমুখের ভীড়ে একজনের ঠোঁটে দেখা যাচ্ছে শয়তানি হাসি। এত জাঁকজমকের মাঝে খুব সাধারণ সেই তীক্ষ্ম হাসিটা কারো নজরের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়ার কথা না, হচ্ছেও না।
খুব সুন্দরভাবে বিয়ে সম্পন্ন হয়। আদনান রাহমান খুশিতে কাঁদছেন। তার ছোট্ট পরীটা আজ অন্য কারো ঘরে চলে যাবে ভাবতেই বিষণ্ণতা তাকে ঘিরে ধরছে। মেয়ের মুখটা বারবার দেখছেন তিনি। সেই ছোট্ট মেয়েটা আজ কত্ত বড় হয়ে গেছে! সবার অলক্ষ্যে চোখের জল ফেলেন তিনি।
______________________________________________________________________________________
-“কীরে কোনটা খাবি? স্প্রাইট নাকি স্পিড?”
-“থাম! বিরিয়ানিটা তো শেষ করতে দে।”
-“তুই কী রে! বিয়ে বাড়িতে এত খেলি! এখানে এসে তিন প্লেট বিরিয়ানি খেলি, তাও তোর পেট ভরছে না? দেখতো তো ঝাঁটার কাঠি অথচ খাস হাতির মতো।”
-“নজর দিবিনা শালা। তোর বিয়ে ভাঙার জন্য কত্ত পরিশ্রম করলাম আর তুই আমারে সামান্য তিন প্লেট বিরিয়ানি খাওয়াতেও কিপ্টামি দেখাচ্ছিস? আন্টি, দেখো তোমার ছেলে কিপ্টা!”
হেসে উঠেন রুদ্ধর মা আফিয়া চৌধুরী। পাশেই রুদ্ধর বাবা রাদিফ চৌধুরী বিরিয়ানির স্বাদ নিতে ব্যস্ত। আফিয়ার খুশি মুখে আচমকা হালকা বিষণ্ণতার ছাপ পায় রুদ্ধ।
-“কী হলো মা? মন খারাপ তোমার?”
-“এত কিছু করার কোনো দরকার ছিল রুদ্ধ? আমরা সরাসরি বিয়েটা ভেঙে দিলেই হতো! এত লোক ডেকে, অনুষ্ঠান করে, অপমানিত হয়ে বিয়ে ভাঙার তো কোনো কারণ ছিল না।”
-“আচ্ছা মা, আমরা বিয়ে ভেঙে দিলে আদনান সাহেব যে অন্য কোনো ছেলের সাথে অদৃতার বিয়ে ঠিক করতেন না তা কি তুমি নিশ্চিত?”
-“এই আদনান রাহমানের মাথার সমস্যা আছে বুঝছিস! নিজের মেয়ের মনের কথাও বোঝেনি। আর মেয়েটাই বা কী! একবার নিজের বাবাকে বলে তো দেখবে নিজের পছন্দের কথা। তা না করে তোকে হাতে আনলো আর তুইও আমার সরল সোজা বাচ্চা! রাজি হয়ে গেলি ওদের দুজনের বিয়ের ব্যবস্থা করে দিতে।”
এই মুহূর্তে প্রেমা বেশ রেগে গেল। মেকি রাগ দেখিয়ে বলল, “বাহ রে! আর আমি যে তোমার সরল সোজা ছেলের জন্য লন্ডন থেকে ছূটে এলাম, সেটা বুঝি কিছুনা আন্টি?” রুদ্ধ জোরে হেসে ওঠে। প্রেমা আনমনে রুদ্ধর হাসিটা খেয়াল করে। বুকে একটা ক্ষীণ ব্যথা অনুভব করছে সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যথা কমানোর চেষ্টা করে। অতঃপর বিরিয়ানি খেতে খেতে কথা বলতে শুরু করে।
-“তা আন্টি, তোমার ছেলের যে মানহানি হলো, এখন ওকে কেউ বিয়ে করবে?”
-“কেউ না করলে তুই আছিস না!”
-“হ! আমার ঠ্যাকা! তোরে জিগাইছি আমি? আন্টিরে জিগাইছি। তুই চুপ থাকবি। শয়তান, বাঁদর একটা!”
রুদ্ধ হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়। আচমকা ফোনের ভাইব্রেশনে কিছুটা চমকে ফোন হাতে নিল সে। স্ক্রিণে জ্বলজ্বল করতে থাকা নম্বরটা দেখে নিমেষেই ঘাম ছুটে যায় তার। ঢোক গিলে ফোনটা রিসিভ করে সে।
চলবে…
#জাস্ট_ফ্রেন্ডস
#সূচনা_পর্ব
~মিহি
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। অনেকদিন পর কী ভেবে যেন গল্প লিখতে ইচ্ছা করলো😇। সবাই জানাবেন কেমন হলো🥺]