আমার গল্পে তুমি পর্ব-২০ শেষ পর্ব

0
3910

#আমার_গল্পে_তুমি
//২০ এবং শেষাংশ//
#সাদিয়া

আদিবদের বাড়ি থেকে সাদিয়া সোজা নিজের বাড়িতে চলে আসে। রুমে গিয়ে দরজা আটকাতে গেলে আদিব বাঁধা দেয়। যেহেতু আদিবের এক হাত ভাঙা তাই সাদিয়া কোনো শক্তি প্রয়োগ করেনি। শুধু এক পলক আদিবের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়।
তোয়ালে নিয়ে সে গটগট করে ওয়াশরুমে চলে যায়। আদিব সাদিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রায় আধঘন্টা পর সাদিয়া ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। তখন আদিব ঘুরে ঘুরে সাদিয়ার রুমটা দেখেছিলো। সাদিয়ার রুমে তার কয়েকটা ছবি আছে যা বেশ পুরনো।
সাদিয়াকে ওয়াশরুম থেকে বের হতে দেখে আদিব সাদিয়ার সামনে গিয়ে এক হাতে কান ধরে ছোট করে সরি বলে। সাদিয়া মুখ ফিরিয়ে নেয়। সে বারান্দায় চলে যায়। আদিবও গুটিগুটি পায়ে সাদিয়ার পিছন পিছন বারান্দায় যায়।
—শ্যামবতীদের অভিমানী রূপে আরো মোহনীয় লাগে। তাই ভাবছি আমার শ্যামবতীর অভিমান ভাঙাবো না। তুমি কি বলো?

সাদিয়া নিরুত্তর। আদিব হতাশ হয়। নিজের বাম হাতটা রেলিংয়ে থাকা সাদিয়ার ডান হাতের উপর রাখে।
—এতো অভিমান কেন কাজললতা? এতো দিন দূরে ছিলাম বলে? এতোদিন তোমাকে প্রণয় বিরহে পুড়িয়েছিলাম বলে?
সাদিয়া এবারও চুপ রইলো।
আদিব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
—প্রণয় বিরহে তো তুমি একা পুড়নি পুড়েছি আমিও। কষ্ট তো তুমি একটা পাওনি, পেয়েছি আমিও। হয়তো তোমার থেকে বেশি বা কম! তুমি কি ভেবেছিলে আমার গল্পে তুমি থাকবে না? তাহলে তুমি ভুল। আমার গল্পে তুমি ছিলে আছো এবং আজীবন থাকবে। তোমায় যে আমি বড্ড বেশি ভালোবাসি গো। বড্ড বেশি ভালোবাসি।
কথাগুলো বলে আদিব এক মূহুর্তও দেরি না করে প্রস্থান করলো। সাদিয়া আদিবের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দুফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিলো। আচ্ছা এই দুফোঁটা অশ্রু কি কষ্টের অশ্রু? নাকি প্রাপ্তির অশ্রু? নিজের ভালোবাসাক প্রাপ্তির কৃতজ্ঞতা স্বরুপ অশ্রু?
সাদিয়া জানে না তা। আর সে জানতেও চায় না। সাদিয়া ভাবছে, এতোকিছুর পরেও তার ভালোবাসার মানুষটা তার আছে যে তাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। একটা মেয়ের কাছে এরচেয়ে বেশি আর কি চাওয়ার থাকতে পারে।
সাদিয়া ঠিক করলো সে আদিবকে ক্ষমা করে দেবে তবে এতো সহজে না। আগে আদিবকে শাস্তি পেতে হবে! এতোদিন নিজেকে আড়াল করার শাস্তি! সাদিয়াকে কাঁদানো শাস্তি! একটা প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে সাদিয়া রুমে চলে যায়।
.
দেখতে দেখতে বিশ দিন চলে গেছে। আদিবের হাতও ঠিক হয়ে গেছে।
সকাল সকাল সাদিয়া হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে যায়। কারণ সে জানে আজকে আদিব তাকে নিতে আসবে। আর সে আদিবকে সেই সুযোগটা দিতে চায় না।
সাদিয়াদের বাড়িতে এসে সাদিয়াকে না পেয়ে চটে যায় আদিব। চোয়াল শক্ত করে স্টেয়ারিংয়ে একটা ঘুষি দিয়ে সেও বেরিয়ে যায় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
হাসপাতালের সবাই জানে ডা.আরনাফ আর সাদিয়া স্বামী-স্ত্রী। তবে তারা এটা জানে না ডা.আরনাফ এতোদিন সকলের থেকে নিজের পরিচয় আড়াল করেছিলো। হাসপাতালে আসতে না আসতেই সাদিয়াকে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে যার ফলে সে আদিবের উপর ক্ষেপে আছে।
ওয়ার্ড শেষে করিডোর দিয়ে হাঁটছে সাদিয়া। এমন সময় কেউ তার হাত টান দিয়ে একটা রুমে নিয়ে যায়। স্পর্শটা সাদিয়া চেনে। এটা অচেনা আগন্তুকের স্পর্শ। সাদিয়া ভয়ে ছোটাছুটি করতে থাকে।
—এতো ছোটাছুটি কেন করো বলো তো? আমি না চাইলে তুমি ছুটতে পারবে বলে মনে হয় তোমার? কেন নিজের এনার্জি নষ্ট করতে উঠে পড়ে লেগেছো।
পারফিউমের গন্ধটা সাদিয়ার বেশ পরিচিত মনে হলো। আর কণ্ঠস্বর শুনে সাদিয়ার চক্ষু চড়কগাছ। সে চোখ বড় বড় করে তাকায় সামনের মানুষটার দিকে। এতোক্ষণে সামনের মানুষটা তার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছে।

—আপনি? এতোদিন এইসব আপনি করেছেন?

—কোনসব বলো তো?

সাদিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—আপনি জানেন না কোনসব? আপনি লুকিয়ে লুকিয়ে আমার রুমে আসতেন। যখন তখন আমাকে মিনি কিডন্যাপ করতেন। এইসব আপনার কার্য ধারা তাই না?

—ও হ্যাঁ মনে পড়েছে। হুম আমি। কেন তুমি কি ভেবেছিলে ওই ইডিয়েট ডা.সিফাত আসবে।

আদিবের কথায় ভ্রু কুঁচকায় সাদিয়া। সে বুঝতে পারছে না এখানে ডা.সিফাত কোথা থেকে টপকালো।
—কি খাবে বলো।

—আমি কিছু খাবো না।

—ঠিক আছে বিরিয়ানি আনতে বলছি।

—বললাম তো খাবো না।

—কি আজব! আমি কি তুমি খাওয়ার জন্য আনতে বলবো নাকি? আমি তো আমার জন্য আনাতাম। তুমি যে খাবে না বললে ওটা আমি শুনছি হুহ।
সাদিয়া কিছু না বলে কটমট দৃষ্টিতে তাকালো আদিবের দিকে আর আদিব দাঁত কেলিয়ে হাসলো।
নিজের কেবিনে থাকা সোফায় বসে গোগ্রাসে বিরিয়ানি গিলছে আদিব। তার ভাবখানা এমন এই মূহুর্তে বিরিয়ানি খাওয়া ছাড়া তার কাছে আর কোনো কাজ নেই। সাদিয়া তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আর ভাবছে, কেমন মানুষ উনি? একবার কি বললাম খাবো না আর সাধলো না? এমন কিপ্টে জামাই জুটলো কপালে অবশেষে?
সাদিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো।
—শুনো মিস থুড়ি মিসেস প্যাকাটি!

সাদিয়া অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাতেই,
—আ..আব মানে মিসেস ডাক্তার সাহেবা ওই প্যাকেটে তোর জন্য বিরিয়ানি আছে। খেতে মন চাইলে খেয়ে নিয়ো।

যেহেতু সাদিয়া সকাল থেকে কিছু খায়নি তাই আর সে কোনো ত্যাড়ামি না করে বিরিয়ানির প্যাকেটটা নিয়ে চলে গেলো।

সাদিয়া আদিবের কেবিনের বাইরে মায়াকে দেখতে পেলো। মায়ার সাথে কুশলাদি বিনিময় করে সে চলে গেলো নিজের কাজে। মায়া সাদিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখের কোণ তপ্ত অশ্রুতে ভেজা। আশা এসে মায়ার কাঁধে হাত রাখলো।
—মায়া তোকে আমি কয়েকটা কথা বলতে চাই।

—আমি জানি তুমি কি বলবে ভাবি।

মায়ার কথায় অবাক হয় আশা।
—আমি যেন আদিব আর সাদিয়ার সম্পর্কের মধ্যে না ঢুকি এটাই বলতে এসেছিলে তো তুমি। তাই না?
আশা মাথা নিচু করলো।
—তুমি চিন্তা করো না ভাবি আমি ওদের মাঝখানে তৃতীয় পক্ষ হয়ে কখনোই আসবো না। আমি ওইসব মানুষের মতো না যে নিজে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য অন্য কারো ভালোবাসা কেড়ে নেবো। আর তার চেয়ে বড় কথা গুলো আরনাফ আমাকে নয় সাদিয়াকে ভালোবাসা।
একটু দম নেয় মায়া।
—যাই বলো ভাবি বাচ্চা মেয়েটার ভালোবাসার জোর আছে বলতে হবে। নাহলে এতো গুলো বছর কিভাবে সবার এতো এতো অপমান সহ্য করতে পারলো বলো তো। আমি সবসময় দোয়া করবো ওরা যেনো ভালো থাকে, সুখে থাকে। ওদের সুখে যেন কারো নজর না লাগে।
আশা মায়ার মাথায় আলতো করে হাত বুলালো। মায়া একটা বিরস হাসি দিয়ে প্রস্থান করলো।
.
হাসপাতালের ক্যাফেটরিয়ায় মুখোমুখি বসে আসে আদিব আর ডা.সিফাত। আদিবের মুখশ্রীতে বিরক্তিবোধ স্পষ্ট আর ডা.সিফাতের মুখে অসহায়ত্ব!
—ডা.সিফাত তুমি কি আমায় কিছু বলবে?

ডা.সিফাত অনেকটা সাহস জুগিয়ে বললে,
—আ’ম সরি ডা.আরনাফ।

আদিব ভ্রু কুঁচকে বলে,
—সরি? সরি কেন?

—না জানার ভান কেন করছো? আমি জানি এটা তুমিও জানো তোমার এক্সিডেন্ট আমি করিয়েছি। আ’ম সো সরি ডা.আরনাফ।

—ইট’স ওকে ডা.সিফাত। আসলে মায়াবতী বউ থাকলে স্বামীদের এতটুকু আতটু ইনজোর্ড হতে হয়। ডোন্ট বি সেড। আর ইউ ডিজার্ভ আ বিগ থ্যাঙ্কস!

—কেন কেন?

—কারণ তোমার জন্যই তো এতো তাড়াতাড়ি আমি নিজের পরিবারের কাছে ফিরতে পারলাম। আর এই এক্সিডেন্টের জন্য সবাই আমাকে ক্ষমাও করে দিয়েছে।

—আর সাদিয়া? ও ক্ষমা করেছে?

আদিব বিরস মুখে জবাব দিলো,
—না গো! সে এখনো অভিমান করে বসে আছে। এতোদিন তো কম চেষ্টা করিনি বলো।

— ডোন্ট বি আপসেট। মন খারাপ করো না। মানুষ তার উপরই বেশি অভিমান করে যাকে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।

আদিব একটা বিনিময়ে একটা চমৎকার হাসি উপহার দিলো। আদিব কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। কয়েক কদম গিয়ে পিছন ঘুরে ডা.সিফাতকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—সিফাত তোমার জন্য একটা ভালো সমন্ধ আছে। আমার বোনের ননদ আশা। তোমার সাথে খুব মানাবে।
এতটুকু বলেই বা চোখে একটা টিপ্পনী কাটে আদিব। আদিবের এহেন কর্মে হাঁসে আদিব।

রাত নয়টায় বাড়ি পৌঁছায় সাদিয়া। আরো আগেই চলে আসতো কিন্তু আদিবের জন্য দেরি হলো। সাদিয়া ভেবেছিলো বাড়ির সবাই চিন্তা করবে কিন্তু ওদের মুখ আর ব্যবহার দেখে তা মনে হচ্ছে না সাদিয়ার। সাদিয়া মাথা না ঘামিয়ে রুমে গিয়ে ফ্রেশ হলো। ওয়াশরুম থেকে বের হতেই সামনে ধারাকে দেখতে পেলো সে। সরা তার দিকে দাঁত কেলিয়ে তাকিয়ে আছে।
—কি? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?

—তা ননদীনি কোথা থেকে ফিরলে এই রাতে?

—হাসপাতাল থেকে।

—মিথ্যা কেন বলছিস বল তো? আদিব ভাইয়া আমাদের ফোন করে বলেছে আজ তুই তার সাথে কিছুটা সময় থাকবি তাই তোর ফিরতে দেরি হবে।

—জানিস যখন কোথায় ছিলাম তাহলে প্রশ্ন কেন করছিস?

সারা সাদিয়ার কথায় পাত্তা না দিয়ে বললো,
—তা কেমন কাটালি কোয়ালিটি টাইম?

—খুব ভালো।

—আচ্ছা সাদি তুই আদিব ভাইকে ক্ষমা করেছিস তো?

—ক্ষমা তো তাকে আমি সেই কবেই করে দিয়েছি রে সারু। তার সামনে যে আমার অভিমানের পাহাড় কর্পূরের তৈরি!
বারান্দার দরজার দিকে তাকিয়ে সারা তাড়াহুড়ো করে বললো,
—আচ্ছা সাদি আমি যাই তুই থাক।

—আরে কোথায় যাচ্ছিস?

—যাচ্ছে যেতে দাও না। কেন ভাবিকে আমাদের মাঝে কাবাবে এলাচ বানাতে চাইছো?

চমকে পাশ ফিরে থাকাতেই আদিবকে দেখতে পায় সাদিয়া। আদিব খুব আয়েশ করে সাদিয়ার খাটে বসে।
—আপনি? আপনি এখানে কেন এলেন আবার?

—আমার বউয়ের কাছে আমি এসেছি তোমার এতো সমস্যা হচ্ছে কেন হে কন্যা।

—আপনি এখন যান প্লিজ। বাবা বা ভাইয়া দেখলে কি ভাববে বলুন তো?

—এমন ভাব করছো তোমার বাপ-ভাইয়ের বউ নেই। তারা বউয়ের সাথে একা সময় কাটায় না।

—উফ প্লিজ যান।

আদিব এবার টানটান হয়ে শুয়ে গেলো।
—একি আপনি শুলেন কেন?

—ঘুমাবো তাই।
বলেই সাদিয়ার গাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসলো।
—চুলগুলো একটু টেনে দাও তো। ভীষণ ব্যাথা করছে। আর প্লিজ নো অ্যারগু আ’ম সো টায়ার্ড।
সাদিয়া কোনো কথা না বলে চুল টানতে লাগলো।
—আমাদের গল্পটা হয়তো আর পাঁচটা সাধারণ ভালোবাসার গল্পের না তাই বলে যে আমাদের গল্পে ভালোবাসার অভাব তাও কিন্তু নয়। এই যে এতো বছর আমি আমার গল্পে তোমায় যেভাবে আগলে রেখেছি তুমিও তোমার গল্পে আমায় আগলে রেখেছো। আমার গল্পে তুমি আর তোমার গল্পে আমি মিলে আমাদের গল্প! এক অন্তহীন ভালোবাসার গল্প!
সাদিয়া মন দিয়ে আদিবের বলা প্রতয়েকটা শব্দ প্রতিটি বাক্য শুনলো। আদিব ততক্ষণে ঘুমিয়ে গেছে। সাদিয়া ঘুমন্ত আদিবের কপালে ঠোট ছুয়ালো। সে কোনোদিন ভাবেনি তার জীবনও এমন একটা দিন আসবে। আদিব তার জীবনে আবার ফিরে আসবে। সে ভীষণ খুশি আজ ভীষণ খুশি। সাদিয়া মনে মনে আল্লাহ্ তায়ালার নিকট অজস্র শুকরিয়া জ্ঞাপন করলো।

ভালোবাসার প্রত্যেকটা অনুভুতিই মনোমুগ্ধকর। ভালোবাসা আল্লাহ্ তায়ালা এক বিশেষ নিয়ামত স্বরুপ। সবাই ভালোবাসতে পারে না। আর সবাই ভালোবাসা আগলে রাখতে পারে না। আদিব-সাদিয়ার ভালোবাসা চিরকাল বেঁচে থাক। তাদের ভালোবাসার গল্প অক্ষয় থাক।
~~সমাপ্ত~~

(আস্সালামু আলাইকুম। শেষটা হয়তোবা সবার ভালো লাগে নাই। আর অনেকেই হয়তো এতো তাড়াতাড়ি শেষ আশা করেন নাই। আমিও এতো তাড়াতাড়ি গল্পের ইতি টানতে চাই নাই। কিন্তু আমার কিছু করার নাই ব্যক্তিগত কারণে ইতি টানা লাগলো।
যারা প্রথম থেকে পাশে ছিলেন তাদের অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসা।
গল্পে মার্ক করা কোনো ভিলেন নাই😒। আই হেইট ভিলেন🙂।
আর আর আর ওভারঅল গল্পটা কেমন লাগলো অবশ্যই জানাবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here