আমার গল্পে তুমি পর্ব-১৮

0
1929

#আমার_গল্পে_তুমি
//১৮//
#সাদিয়া

.
সাদিয়ারা ক্যাম্প থেকে ফিরেছে আজ সাত দিন। এই সাতদিন সাদিয়া আর আরনাফের মধ্যে কোনো প্রকার কথা-বার্তা হয়নি। ক্লাসে যতটুকু দেখা হয়েছে ততটুকুই। বলতে গেলে সাদিয়া এক প্রকার এড়িয়ে চলছে আরনাফকে। এতে আরনাফের খুব একটা মাথা ব্যাথা আছে বলে মনে হলো না। সে নিজের মতো করে আছে।
আজকে আরনাফ ক্লাসে আসেনি। সাদিয়াও তেমন মাথা ঘামায়নি। তবে মনটা কেমন যেন কু-ডাকছে।

ফাইনাল ইয়ারে একাডেমি ক্লাস হয়না বললেই চলে। পুরো সময় ওয়ার্ড আর ওটিতেই কাটাতে হয়। ওয়ার্ড শেষ করে হাসপাতালের ক্যাফেটরিয়াতে এসে বসলো আদিবা আর সাদিয়া। দুজনের হাতে দুটো ওয়ান টাইম কফির কাপ। সাদিয়া কফিতে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে আর মুখ বাঁকাচ্ছে। সাদিয়া কফি খুব একটা পছন্দ করে না। কিন্তু আদিবার পাল্লায় পড়ে তার কফি পান করতে হয়। কফিতে চুমুক দিতে দিতে তারা লক্ষ্য করছে কয়েকজন ইন্টার্ন ডাক্তাররা ছোটাছুটি করছে। বিষয়টা জানতে আদিবা তাদের জুনিয়র এক ছেলে ধ্রুবকে ডাক দেয়।

—কি হয়েছে বল তো ধ্রুব? সব ইন্টার্ন ভাইয়া-আপুরা এমন দৌড়াদৌড়ি কেন করছে?

—একি তোমরা জানো না কি হয়েছে?

সাদিয়া ডানে-বামে মাথা ঘুরালো। অর্থাৎ তারা জানে না।

—আরে আমাদের আরনাফ স্যারের তো এক্সিডেন্ট হয়েছে।

আরনাফের এক্সিডেন্ট হয়েছে শুনে সাদিয়ার বুকটা ধক করে উঠলো। সেই সাথে হাতের ওয়ান টাইম কফির কাপটাও নিচে পড়ে গেলো। আচমকাই সাদিয়ার নিজেকে ভরশূন্য মনে হতে লাগলো। সাদিয়া পড়ে যাওয়ার আগেই আদিবা তাকে আগলে নেয়। আদির মৃত্যুর পর থেকে সাদিয়া এক্সিডেন্ট শব্দটা খুব একটা সহ্য করতে পারে না। হাত পা তার অবস হয়ে যায়।
আদিবা সাদিয়াকে ধরে ধরে হলে নিয়ে যায়। সাদিয়া ঘনঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। তার দম যেন আটকে আসছে। আদিবা সাদিয়াকে শান্ত করতে ব্যস্ত। কিছু সময় পর সাদিয়া কিছুটা শান্ত হলো। আদিবাকে বললো ধ্রুবকে ফোন করে আরনাফের খবর জেনে নিতে। আদিবা তাই করলো। ফোন লাগালো ধ্রুবকে।
—হ্যাঁ আদিবা আপু বলো?

—আরনাফ স্যারের কি অবস্থা রে?

—এখন ভালোই আছে। জ্ঞানও ফিরে এসেছে। শুধু কপালের একপাশে কেটে গেছে আর ডান হাতটা একটু ফ্যাক্চার হয়েছে। চিন্তার কোনো কারণ নেই।

—আচ্ছা রাখছি।

আদিবা ফোন রাখতেই সাদিয়া আদিবাকে আরনাফের কথা জিজ্ঞেস করতেই আদিবা ধ্রুবর বলা কথাগুলো বললো। সাদিয়ার অস্থিরতা কমলো না। সাদিয়ার এমন অস্থিরতা দেখে আদিবা খুশি হলো। আলতো হেসে সাদিয়ার উদ্দেশ্য বললো,
—যাবি স্যারকে দেখতে?
সাদিয়া এক কথায় রাজি হয়ে গেলো। কোনে রকম জামাটা পাল্টে সাদিয়া আর আদিবা ছুটলো হাসপাতালের ৩০৮ নম্বর কেবিনের উদ্দেশ্য। ছুটছে মূলত সাদিয়া। আদিবাতো শুধু সাদিয়ার কান্ড দেখছে আর মিটিমিটি হাসছে আর ভাবছে, অবশেষে তার বান্ধবীর জীবনের দুঃখ ফুরিয়ে সুখ আসতে চলেছে!

.
৩০৮ নম্বর কেবিনের সামনে এসে পা জোড়া থেকে যায় সাদিয়ার। নয়ন জোড়ায় ভর করে তপ্ত অশ্রু!
—আম্মু আর কতো কাঁদবে? এক ঘন্টা যাবত শুধু কেঁদেই চলেছো কিছু বলছো না। আর আব্বু তুমি এমন থম মেরে বসে আছো কেন? কিছুতো বলো। আর আপু তুই! তুই এমন কেন করছিস? আম্মুকে একটু বুঝা না। এতো কাঁদলে তো শরীর খারাপ করবে। আম্মু অনেক হয়েছে আর না। আর চোখের জল ফেলা যাবে না। আরে আমি তো মরে যাইনি।
কথাটা বলার সাথে সাথে থাপ্পড় পড়ে আরনাফের গালে। আরনাফ হালে হাত দিয়ে আকিব আহমেদের দিকে তাকায়। আকিব আহমেদের মুখ থমথমে। আরনাফের গালে চড়টা দিয়ে তিনি নিজের আগের স্থানে ফিরে গেলেন। আরনাফ এবার এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা আশার দিকে নজর দিলো। আশার মুখটা মলিন হয়ে আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে যে অনেক কেঁদেছে। আরনাফ শীতল কণ্ঠে ডাক দিলো,
—আপু!
আরনাফের ডাক শুনে আরশি এবং আশা দুজনেই এক সাথে “হুম” বলে উঠলো। এবার আরনাফ একবার আরশি আরেকবার আশার দিকে তাকাচ্ছে। অতঃপর সে দুই বোনকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—আমি একদম ঠিক আছি। এতো কান্নাকাটি করার কিছু নেই। তোমরা এমন করলে কেমন করে হবে বলো তো?
আরনাফের কথায় আরশি মুখ ফিরিয়ে নিলো আর আশা মুখ ভার করলো।
এবার মিসেস আয়শা চোখের জল মুছে আরনাফ কে বললো,
—আদিব..
এতো বছর পর নিজের মায়ের মুখে এই নাম শুনে আরনাফের কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো এক ফোটা তপ্ত অশ্রু! (ইয়েস ইয়েস ইয়েস জনগণ’স আরনাফ-ই হচ্ছে আমাদের আদিব😁)
আরনাফ কিছু না বলে মিসেস আয়শাকে জরিয়ে ধরলো। মিসেস আয়শাও পরম যত্নে ছেলেকে আগলে নিলেন। কতোগুলো বছর পর নিজের ছেলেকে ফিরে পেয়েছেন। তবে তিনি এর পেছনের ঘাপলাটা বুঝতে পারছেন না।
কিছুক্ষণ মায়ের বুকে থেকে মাথা উঠায় আরনাফ উরফে আদিব।
—আচ্ছা আদিব আমাদের তো মানিয়ে নিলি তুই আর শিশির মিলে কিন্তু সাদিয়া! ওকে কি করে মানাবি বাবা? ও যদি এটা জানতে পারে তাহলে যতটা না খুশি হবে তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাবে। মেয়েটা যে এতো বছরে অনেক কিছু সহ্য করেছে রে বাবা।
এবার আকিব আহমেদ মুখ খুললেন,
—কোনো আক্কেল জ্ঞান আছে নাকি তোমার ছেলের? জিজ্ঞেস করো তো এতোগুলা দিন কেন ও আমাদের এভাবে কষ্ট দিলো? কেন জীবিত থাকতেও আমাদের সামনে এলো না? কেন আড়াল করলো নিজেকে আমাদের সবার থেকে? আরে আমাদের কথা না ভাবতেই পারতিস তুই তাই বলে ছোট্ট মেয়েটার কথা একবারও ভাবলি না? এক বারও ভাবলি না এসবের পরে মেয়েটার কি হবে? মেয়েটা যে ভেঙে গুড়িয়ে যাবে তাও ভাবলি না একবার।

এবার তার কথায় মিসেস আয়শাও সায় দেয়,
—কেন করলি এমন তুই বাবা? কেন সত্যিটা আমাদের থেকে লুকলি? আজকে শিশির না বললে তো জানতেই পারতাম না আমরা। এখন তুই সাদিয়ার সামনে কিভাবে যাবি বাবা?

আরনাফ কিছু বলতে যাবে তার আগেই তার চোখ পড়লো দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা রমণীর উপর। তার মায়াবী দুটো চোখে তপ্ত অশ্রু এসে হানা দিয়েছে। আরনাফ অস্পষ্ট সুরে বলে উঠে,
—সাদিয়া…
আরনাফের কথা সকলে দরজার দিকে তাকায়। সাদিয়া কোনো কথা না বলে উল্টো দিকে দৌড় দেয়। এক পলক কেবিনের বেডে শুয়ে থাকা আরনাফকে দেখে আদিবাও সাদিয়ার পিছন পিছন চলে যায়।

মেডিকেল কলেজের সামনে থাকা ছোট দিঘির পাড়ে বসে অনবরত চোখ মুছে চলেছে সাদিয়া। আজকে সে যে ধাক্কাটা পেলো সেটা তার জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কা। এটা তার কল্পনাতীত!
আদিবা এসে সাদিয়ার কাঁধে হাত রাখলো। সাদিয়া আদিবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আর আদিবা সাদিয়ার পিঠে হাত বুলচ্ছে।
—আর কতোকি সহ্য করতে হবে আমাকে বলতো আদিবা? কোন পাপের এমন শাস্তি আলহ্ তায়ালা আমায় দিচ্ছে বলতো? কি এমন পাপ করেছিলাম যে কপালে কষ্ট ছাড়া আর কিছুই নেই? কেন করলেন উনি আমার সাথে এমন? কেন করলেন বলতো?
আদিবা কিছু বললো না। চুপ রইলো। সেই সময় ওখানে আদিবের বাবা আকিব আহমেদ আসলেন। তিনি শীতল কণ্ঠে ডাকলেন,
—সাদিয়া?

তার ডাকে সাদিয়া মাথা তুলে তাকালো। আকিব আহমেদকে দেখে যেন সাদিয়ার কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেলো। আকিব আহমেদ আস্তে করে সাদিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
—এতো কাঁদছো কেন মা? আমাদের আদিব বেঁচে আছে এটা জেনে তুমি খুশি হও নি? নাকি এতোদিন নিজের পরিচয় লুকানোর জন্য ওর উপর অভিমান করে আছো? দেখ মা তুমি ওর উপর অভিমান করে থাকতেই পারো। তোমার হক আছে ওর উপর অভিমান করা। আমরাও তো আদিবের উপর অভিমান করে আছি। কিন্তু আমাদের তো আগে এটা জানতে হবে কেন আদিব এতোগুলো বছর নিজেকে সবার থেকে আড়ালে রেখেছে? কেন আমাদের সামনে আসেনি? বলো তো মা এগুলো জানা উচিত না আমাদের।

আদিবের বাবার কথায় সাদিয়া হ্যাঁ সূচক মাথা দুলালো। আকিব আহমেদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তবে তার চিন্তা এক চুলও কমলো না। তিনি বুঝতে পারছেন না তার ছেলে এমন কেন করলো? কি এমন কারণ থাকতে পারে যার দরুন আদিব এমন একটা স্টেপ নিলো? আজকে সকালে শিশির না বললে তো তারা জানতেই পারতো না তাদের একমাত্র ছেলে বেঁচে আছে!
আজ সকালে…
আহমেদ পরিবারের সবাই নাস্তার টেবিলে বসে নাস্তা করছে আর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করছে। তখনই ফোন আসে শিশিরের। শিশির তাদের অতি দ্রুত হাসপালে যেতে বলে। শিশিরের ফোন পেয়ে আদিবের মা,বাবা এবং আরশি হাসপাতালের উদ্দেশ্য রওনা দেয়। হাসপাতালে যেতেই শিশির তাদেরকে টেনে ৩০৮ নম্বর কেবিনে নিয়ে যায়। অতঃপর যা বলে তাতে তারা স্তব্দ হয়ে যায়। আরনাফ তাদের ছেলে আদিব! তাদের ছেলে বেঁচে আছে! আদিবের মা তো কেঁদে কেটে অস্থির। এর মধ্যে আশা আর মেহেদীও ওখানে উপস্থিত হয়। প্রায় এক ঘন্টা পর আদিবের জ্ঞান আসে। জ্ঞান ফেরার পর সামনে নিজের মাকে দেখে আদিব চমকায়। অবাক চোখে শিশিরের দিকে তাকায়। শিশির চোখের ইশারায় বলে যে সে সবাইকে সত্যিটা বলে দিয়েছে।

#চলবে….ইনশাআল্লাহ
(এখন অনেকের হয়তো প্রশ্ন আদিব বাঁচালো কিভাবে? আর কেনই বা নিজের পরিচয় আড়াল করলো? উম উত্তর কালকের পার্টে।
হ্যাপি রিডিং❤️)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here